আজ আবার দেখলাম ভদ্রলোককে।বয়েস জানি না কত হবে।মনে হয় আমার চেয়ে ছোটোই।স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে ডানদিকে মুখ ফিরিয়ে অভ্যস্ত ভঙ্গীতে একবার দেখলেন।আমিও দেখলাম।নরম সকাল,স্নিগ্ধ রোদ,অল্প ঠাণ্ডা হাওয়া আর একটি শ্যামল সবল পুরুষের ঘাড় ঘুরিয়ে দেখা।এসব আয়োজন খুব সামান্য।কিন্তু মন ভালো করার মহৌষধ তাতেই!

ভদ্রলোককে আমি চিনি না।চেনার প্রয়োজনও বোধ করি না।এসব পথের দেখায় ঈশ্বরতৃষ্ণা থাকে।তাই এ দেখা পূর্ণ না হওয়াই ভালো।ঈশ্বরের ভাবনাটাই যেমন সুন্দর।না দেখার এই যে আলো ছায়ায় কেবল খুঁজে ফেরা,এই যে কোনো দিন না পাবার অনুভব,এতেই তো রোমাঞ্চ!এই-ই তো আনন্দ!

মাঝে মাঝে স্কুল যাবার পথে দেখতাম মানুষটিকে।আজ সকালে হাঁটার সময় আবার দেখা।বর্ণ খুব গৌর,উজ্জ্বল নয়।কিন্তু ওই শ্যামশোভায় একটা খটখটে পৌরুষ আছে।তবু উগ্রতাও যেন কেমন আয়ত আদরে কোমল,সুন্দর হয়ে উঠেছে।আজ পর্যন্ত যে ক’দিন দেখেছি,বুঝেছি শার্ট পরেন আলতো রঙের।ফুলশার্ট।কিন্তু কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে রাখায় কেমন যেন আমাদের ছোটো বেলার সিনেমার নায়কদের মতো লাগে।আর চোখে খুব কালোরঙের সানগ্লাস।অমন কালো কাচের রোদচশমা খুব কারোকে তো পরতে দেখি না।সেও পুরোনো নায়কদের কথা মনে করায়।মনের আর দোষ কি?সব মিলিয়ে একটা দেখার মতো সামগ্রী পেলে সে কি না দেখে ছাড়ে?

খুব রূপবান নন তিনি।কিন্তু ওই ঈষৎ কালো রঙে,কালো চশমায়,আস্তিন পর্যন্ত গোটানো ভেজারঙের শার্টের হাতায়,মুখ ফিরিয়ে দেখায় কোথায় যেন একটা ছলছল ভাব আছে।চেনা দেবার বাসনা নেই।অথচ চেনা দেন।আমি দেখি।দেখি পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে।যেমন ভাবে মন্দারমণির উদার,ঢেউলগ্ন জলরাশি দেখি,যেমন করে তাজপুরের ভাঙা,মুখ থুবড়ে পড়া নৌকাগুলোকে দেখি,যেমন ভাবে মরে যাওয়া নৌকোর পাটাতনে শুয়ে সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারে ওই মাথার ওপর আকাশের তারাদের দেখি,ঠিক সেভাবেই আমি ভদ্রলোকটিকে দেখি।দু একদিন একটু বেশি দেখতে পাই।দু একদিন কম সময়।আমার বিপরীত গন্তব্যে তার যাওয়া।তাড়া আমারও।তাড়া নিশ্চয়ই তারও।তবু ক্ষণিক দেখার একটা মোহ আছে।ক্ষণিক দেখাকে দীর্ঘ না করার,অতৃপ্ত,তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার একটা বিষময় আনন্দ আছে।চেনা না দেবার একটা অভিঘাত আছে।দেখা হবে হবে ভাবনায় একটা পুজো আসছে আসছে অপেক্ষা আছে।একজন সম্পূর্ণ অপরিচিতকে দেখে রঙেরসে জাল বোনার একটা পীড়নপিপাসু ধকল আছে।

ছোটো বেলায় যখন সাঁতার শিখতাম,জলের ভয় দু চারদিনেই কেটে গিয়ে একটা দামালপনা জেগেছিল।শহরে বাল্যকাল কাটিয়ে আধা শহরে তিনটে পাশাপাশি পুকুর,মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া খেজুরগাছের সারি,নিচে পড়ে থাকা কালচে মেরুনরঙের খেজুর তুলে টপটপ মুখে দিয়ে থু থু করে বিচি ফেলে দেবার অঘোর আনন্দ আমার অনেকটা এমনই ছিল।চিরকাল আমি বন্ধুহীন।সঙ্গভীরু।আমার কেবল দেখায় সুখ।স্পর্শের উত্তেজনার পরেই আসে ক্লান্তি।কিন্তু দেখা অক্লান্ত।কারণ তাতে পাওয়া নেই।পাওয়া মানে রক্তমাংসের পাওয়া।না পাওয়ায় কিন্তু একটা বিজাতীয় সঙ্গোপন নেশা আছে।তিরতিরে বায়ুহিল্লোল আছে।সুমন্দ বাতাসের ফাজিল ষড়যন্ত্র আছে।সেই খেলাটাই মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় কবিতা।সারাজীবন কবিতায় পড়ে থেকে সৃষ্টিতে যা পেয়েছি,এসব অপরিচিত পুরুষের একপলক চেয়ে চলে যাওয়া আর আমার তারপরের রোমন্থনে আমি তার চতুর্গুণ পেয়েছি।

এই ভদ্রলোককে দেখাও আমার সেই ভেতরের বালিকার আনন্দ।ভেতরের নারীটির অস্ত্র শানানো।খিদেকাব্য আমার!লোলতৃষ্ণা আমার!

তবে আজ যেন একটু বেশিক্ষণ দেখলাম।পাশে কেউ বসেছিল।কোনো নারী।সুন্দরী।তার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই একবার এদিকে তাকালেন।দেখলাম।এমন আয়ত সুন্দর চেহারায় ছন্দোপতন করেছে কেবল ঠোঁটের কালোরঙ।এতদিন খেয়াল করি নি কেন?এমন দীঘল পুরুষের এমন কালো ঠোঁট?ও কি খুব সিগেরেট খায়?সিগেরেট খেলে বুঝি ঠোঁট কালো হয়?মনটা এখন বিষণ্ন হতে শুরু করেছে কেমন।যদিও দেখার পরমুহূর্তের তীব্র আনন্দও সত্যি।কিন্তু,ঠিক তেমনই সত্যি ওই কালো ঠোঁটের রসভঙ্গ।মন ছটফট করে উঠেছে সারাদিন।বাড়ি ফিরে আজ একচামচ,দু চামচ খাঁটি মধু খেলাম।ঠোঁটে মেখে নিলাম।মা বলতো,যাদের ঠোঁট কালো,তারা যদি নিয়মিত মধু ঘষে,তবে ঠোঁট নাকি গোলাপি হয় অচিরেই।সেই ভাবনায় মধুর শিশির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম।ছোট্ট একটা কৌটোয় খানিকটা মধু ঢেলে শোবার ঘরের জানলায় রাখলাম।হয়তো কোনোদিন ভদ্রলোকের সঙ্গে যেচে আলাপ করবো।কদিন যেতে না যেতেই বলবো,’এই নিন,মধু।এটা দিয়ে ঠোঁট ঘষবেন।আপনার এমন সুন্দর রূপ।সেটাকে পূর্ণ করতে হবে না?’

এখন অল্প বিরহের আলতো আবেশে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে মধুর এই ছোট্ট কৌটোটার দিকে চেয়ে বসে আছি।অপার তৃষ্ণায় ছেয়ে যাচ্ছে আমার ঘর।আমার ঘরের সরস্বতী মূর্তির মুখে চাপা হাসি।বইয়ের আলমারির থাকে থাকে বইয়েদের কৌতুক।ভদ্রলোকের প্রতি আমার কোনো আসক্তি আছে কি?কে জানে।তবে একটা নেশা আছে।ওঁর ঠোঁট একটু লালচে হোক।শরীরের সঙ্গে সমঞ্জস হোক।ওর প্রেমিকা বা স্ত্রী যেন ওর শরীর কেবল নয়,ওর রূপের বিষাদ আর আনন্দকে উপলব্ধি করে এমন শীতের রাতে।অন্ধকারের নিকষে ওর ঠোঁট মিশে না যাক।নিশীথরাতের ঘন কদম গাছের মতো হোক ওর শরীর।সামান্য অনাসক্তি বা নিছক শরীরেই যেন না ফুরিয়ে যায় ওর কাছের নারীটি।যতই শরীরকাব্য লিখি না কেন,কী করে ভুলি ‘মধু বাতা ঋতায়তে/মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ’?

আমার মধুর মায়ায়,আমার অচির মুক্তিতে,জালবদ্ধ হরিণীনেশায় আরো কিছুদিন থাকো,প্রিয়,যতদিন না তোমার ওই আশ্চর্য ডাহুককান্তির মতো অধরোষ্ঠের প্রতি সমান মাদকতা আমায় আচ্ছন্ন করে!

পরে পড়বো
৩৪
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন