অবজ্ঞা
১
‘মাটিতে থেকে উপরে কেন তাকান’ কথাটা বেশ অপমানজনক। তবুও সাবিনা পারভিনের এই কথায় রাশিদা বেগম প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। সাবিনা পারভিন সাবিহার মা। সাহিবার পুরো নাম সাবিহা জান্নাত। বেশ সুন্দরী, বুদ্ধিমতী ও স্বাধীনচেতা মেয়ে। রাশিদা বেগম মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেনের মা। সাবিনা-রাশিদারা প্রতিবেশী। প্রায় দশ বছর একই স্থানে বসবাস করছেন। পরস্পরের সম্পর্কটা রক্তের আত্মীয়র থেকেও বেশি। কিন্তু এবার সম্পর্কটা বেশ দূরে সরে যাবে বোধ হয়। মূলত রাশিদা আজ এসেছিলেন সাবিহার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। নিজের ছেলের সাথে সাবিহার বিয়ে। কিন্তু সাবিনা পারভিন এ প্রস্তাব অবজ্ঞার স্বরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। সাজ্জাদের তুলনায় সাবিহাদের অর্থ-সম্পাদ ও সামাজিক মর্যাদা বেশ উঁচু। সাজ্জাদের বাবা নেই। বাবা মারা যাওয়ার সময় সাজ্জাদের বয়স ৯ বছর ছিলো। বড় হয়েছে নানা বাড়িতে। পড়ালেখা শেষ করে ছোটো একটি চাকরি করছে। সাবিহার বাবা কৃষি কর্মকর্তা। মা কলেজ অধ্যাপিকা। দুই পরিবারের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। তাই বিয়ে হতেই পারে না।
রাশিদা বেগম এবার মৃদু হেসে উত্তর দিলেন, ‘মাটি থেকেই তো সকল মানুষ এসেছে, দেখুন আপা, সাবিহা খুব ভালো মেয়ে ।’ ‘আমার ছেলেও ভালো, আমি ধারনা করছি দুজন দুজনকে পছন্দ করে; আপনি একবার সাবিহার এবং ওর বাবার সাথে আলাপ করে দেখতে পারেন।’
কথা গুলো শুনে সাবিনা পারভিন আরো বিরক্ত হলেন। উঁচু আওয়াজে জবাব দিলেন, ‘আমার কথাই শেষ কথা, মেয়ে আমি শিগগিরই বিয়ে দেবো; তবে আপনার ছেলের সাথে নয়।’ সাবিহার মায়ের জোরালো ‘না’শুনে রাশিদা দ্বিতীয় কথা বাড়ালেন না। ভেতরে অপমান চেপে রেখে একটু হাসার চেষ্টা করলেন। যাওয়ার সময় মৃদু কন্ঠে বললেন, ‘আমি তো আর আপনাকে ‘হ্যাঁ’ বলাতে পারবো না, তবুও ভেবে দেখবেন।’
২
সাজ্জাদ হাবিহাকে পছন্দ করলেও সাবিহা করে না। অন্ততপক্ষে এমন অঙ্গভঙ্গি বা স্বল্প-বিস্তার কথা সাবিহা সাজ্জাদের সাথে কখনো বলেনি; যাতে বোঝা যায় সাজ্জাদকে সে পছন্দ করে। সাজ্জাদ শান্ত প্রকৃতির ছেলে। তবে বুদ্ধিমান ও ধার্মিক। নানা বাড়িতে বড় হয়েছে। বাবা নেই শৈশব থেকেই। তাই সব চাওয়া-পাওয়া তার পুরণ হতো না। না পাওয়ার কষ্ট সাজ্জাদকে ত্যাগী করে তুলেছে। জীবনের বড় বড় বিষয়ে সে পরাজিত। কিন্তু পরাজয়ের কষ্ট তাকে তাড়া করে না। সাবিহা বেশ স্বাধীনচেতা ও বুদ্ধিমতী মেয়ে। সেই সাথে ভীষণ সুন্দরী। পরিবার থেকে সে বেশকিছু শিক্ষা পেয়েছে। এর মধ্যে তুচ্ছ বিষয়ে আত্মসম্মানবোধে আঘাত অনুভব করা একটি। সাবিহা যখন জানতে পারলো রাশিদা বেগম সাজ্জাদের সাথে তার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলো। তখন বিষয়টি সাবিহার কাছে হাস্যকর মনে হলো। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বলতে লাগলো, ‘‘সাজ্জাদ ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ে?’ ‘তাকে আমি স্বামী হিসেবে কখনো কল্পনাও রিনি।’ সাবিনা পারভিন জানালেন, ‘তার মা বলে গেলো দুজন দুজনকে পছন্দ করে।’ সাবিহা একটু বিরক্তির স্বরে বলল, ‘তাদের বাসায় একটু বেশি আসা-যাওয়া করে ফেলেছি, এখন থেকে আর যাবো না।’ ‘এতটুকুতেও নিজের ছেলের বউ ভাবতে শুরু করেছে।’ বিষয়টি সাবিহাকে মোটেও ভাবালো না। সে সাজ্জাদকে কখনো স্বামী ভাবতে পারবে না। সাজ্জাদ মানুষ হিসেবে কেমন তা-ও সে বিচার করতে প্রস্তুত নয়। তার মনে শুধু একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছে; সাজ্জাদ আমার স্বামী হওয়ার অযোগ্য, চিরতরে অযোগ্য। কেন অযোগ্য এর জবাব সাবিহা জানে না। তবে এতটুকু তার জানা আছে পৃথিবী উল্টে গেলেও সাজ্জাদকে সে বিষয়ে করবে না।
৩
ছয় মাস পরে সাবিহার বিয়ে ঠিক হয়। ছেলে আয়কর মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। সাবিহার হবু শ্বশুর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সচিব। তাদের পরিবার সাবিহাদের তুলনায় উঁচু। এতটাই উঁচু যে সাবিহারা যদি বাস করে তিন তলায় তাহলে ওর শ্বশুরেরা তেইশ তলার বাসিন্দা। ভীষণ সুন্দরী হওয়াতেই সাবিহার শ্বশুর ওকে পছন্দ করেছে। সাবিনা পারভিন রীতিমতো মেয়ের বিয়ের দাওয়াত পৌঁছাতে লাগলেন সকলের নিকট। সাজ্জাদরাও বাদ পরেনি। দাওয়াত কার্ড দেয়ার সময় সাজ্জাদের মাকে শুনিয়ে আসলেন মেয়ের শ্বশুর বাড়ির আর্থিক অবস্থার কথা। সাজ্জাদের মা এসব শুনে সাবিহার জন্য দোয়া করলেন, ‘আল্লাহ মেয়েটাকে সুখী করুন, খুবই লক্ষী একটা মেয়ে।’ সাজ্জাদ সাবিহাকে পছন্দ করতো। ওর মা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিল তা-ও সাজ্জাদ জানে। সাবিহার বিয়ে ঠিক হয়েছে এতে সে মনক্ষুণ্ণ হলেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না।
দাওয়াতের কার্ড হাতে নিয়ে সাজ্জাদ বলল, ‘বাহ সাবিহার বিয়েটা এবার খাওয়া হবে, মেয়েদের একটু তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়।’
রাশিদা বেগম বললেন, ‘তুই একা গিয়ে খেয়ে আসবি দাওয়াত, আমার শরীর খারাপ, ভিড়ভাট্টার মধ্যে আস্বস্তি লাগে।’ সাজ্জাদ বুঝতে পেরেছে মা অভিমান করে আছেন। মনে মনে নিজেকে বলতে লাগলো, অভিমানের কী আছে? সব মানুষেরই ইচ্ছের স্বাধীনতা আছে। আমাদের যেভাবে বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার অধিকার আছে। তাদেরও প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা অধিকার আছে। মনে মনে এভাবে কথা বলতে দেখে রাশিদা বেগম জিগ্গেস করলেন, ‘কীরে কী ভাবছিস?’ সাজ্জাদ এলোমেলো কণ্ঠে উত্তর দিলো, ‘না মা কিছু না।’
৪.
বিয়ের পর সাবিহা বুঝতে পারলো সে হয়ত কিছু একটা হারিয়েছে। কী হারিয়ে সে? বিয়ের এক বছর আজ। প্রচণ্ড স্বাধীনচেতা মেয়ে সাবিহা। আত্মসম্মানবোধ শরীরের শিরা উপশিরায় মিশে আছে।কিন্তু নিজেদের থেকে উনিশ গুন উঁচু পরিবারের পুত্রবধূ। তাই শ্বশুর বাড়ি তার দু আনার দম নেই।
শাশুড়ি তাকে অবহেলা করে। কাজের মানুষদের সাথে তুলনা করে। সংসার জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ স্বামী। সেও তার নাগালের বাহিরে। তার রূপ-লাবণ্য কিছুই স্বামীকে আকর্ষণ করে না। কেন করে না? এর উত্তর সে জানে না। শ্বশুর তাকে ভালোবাসলেও রাজনৈতিক ব্যস্ততা ও শাশুড়ির রক্ত চক্ষুর ভয়ে সেই ভালোবাসা টুকুও প্রকাশ করতে পারে না। মরে যাওয়ার মতো অবস্থা। প্রতিদিন মুখ শুকিয়ে কাঁদে। মা বাবার সাথে এ কথা বললে তারা জবাব দেয় ‘মানিয়ে নে মা, এমনটা করেই সংসার করতে হয়; একটা ছেলে-মেয়ে কোলে আসলে সব ঠিক হয়ে যাবে।’‘ তোকে তো আর শারীরিক নির্যাতন করে না।’ শারীরিক নির্যাতন করে না ঠিক। কিন্তু সাবিহা নিজেকে মানসিক ভাবে ক্লান্ত মনে করে। অবহেলা, অবজ্ঞা শারীরিক নির্যাতনের থেকেও ভয়ঙ্কর। তার মনের অবস্থা কেউ বুঝবে না, আল্লাহ ছাড়া। নিজের সাথে নিজে প্রতিনিয়ত তর্ক-বিতর্ক করে সে। প্রশ্ন করে নিজেকে, ‘পৃথিবীর সব স্বামী কি এমন?’ ‘শশুর বাড়ি বুঝি এমনি হয়?’ আবার নিজেই উত্তর দেয়; ‘না, সব স্বামী এমন নয়।’ ‘সব শ্বশুর বাড়ি এমন হতেই পারে না।’ ‘যদি তাই হতো তাহলে সব মেয়ে সংসার ছেড়ে পালাতো।’ ‘কৈ তার মা তার চোখের সামনে সংসার করছে, তাকে বড় করেছে, মানুষ করেছে, কখনো পালিয়ে যায়নি তো।’সাবিহার বিয়ের তিন মাস পর সাজ্জাদ বিয়ে করে। সাবিহা মনে মনে ঠিক করে সে একবার সাজ্জাদের বউয়ের থেকে জানবে সাজ্জাদ কেমন আচরণ করে তার সাথে।
৫.
প্রায় চার মাস পর সাবিহা বাবার বাড়ি এসেছে। এসেই ছুটে গিয়েছে সাজ্জাদদের বাসায়। সাজ্জাদের বউয়ের সাথে এই প্রথম সাবিহার দেখা হয়। ‘বেশ মিষ্টি ভাবী আমাদের’ রাশিদা বেগমের দিকে তাকিয়ে সাবিহা বলে। ‘হ্যা খুবই লক্ষী, লজ্জাবতী মেয়ে সাথী।’ ‘আমিতো ওর বাবার কাছে কৃতজ্ঞ; এমন রাজ কন্যাকে আমার ভাঙা ঘরে থাকতে দিয়েছে বলে’ রাশিদা বেগম বলেন। সাজ্জাদের বউয়ের নাম সাথী। শিক্ষিতা মেয়ে। সাজ্জাদের মতোই শান্ত প্রকৃতির। সাবিহা স্বল্প কিছু দিনের মধ্যেই সাথীর সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলো। বাবার বাড়ি বেড়াতে এসেছে। কিন্তু সময় কাটে সাজ্জাদের ঘরে। সাথীর সাথে আলাপ করে নানান বিষয়ে। দুজনের সম্পর্ক এতোটাই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে দাম্পত্য জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়ে সম্পর্কেও তারা আলাপ করে।
কথার ফাঁকে একবার সাবিহা সাথীকে জিগ্গেস করলো, ‘আচ্ছা ভাবী সাজ্জাদ ভাই কেমন মানুষ?’
সাথী: ‘কেমন বলতে?’
সাবিহা: ‘মানে স্বামী হিসেবে কেমন?’
সাথী হেসে উত্তর দিল, ‘বেশ ভালো, আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ; আমাকে তিনি অনেক কিছু দান করেছেন, তার মধ্যে সাজ্জাদ একটি নিয়ামত।’
কথাটা শুনে সাবিহার চেহারা মলিন হয়ে গিয়েছে। পুনরায় জিগ্গেস করলো, ‘ভাই কি অবহেলা করে?’ সাথী প্রশ্নটি শুনে অবাক হলো। ‘অবহেলা? কেন করবে? অবহেলা, অবিশ্বাস শব্দ গুলো আমাদের অভিধানে নেই’ সাথী বলল।
কথাটা শোনামাত্র সাবিহা চট করে দাড়ি পরল।
বলল, ‘ভাবী কাল শ্বশুর বাড়ি চলে যাবো; এখন যাই, কাপড়-চোপড় গোছাতে হবে।’
সাথী: ‘আপনি তো বললেন বেশ কিছু দিন থাকবেন।’
সাবিহা: ‘জী, কিন্তু ছুটি শেষে!’
মূলত সাবিহা যে বিষয়ে জানার জন্য এসেছিল তা জানা হয়ে গিয়েছে। তাই বাবার বাড়ি থেকে তার কাজ নেই।
সাথী: ‘ছুটি?’
সাবিহা: ‘হ্যাঁ ছুটি, ছুটি নয় তো কী?’ ‘সংসার তো চাকরি,
তাই শ্বশুর বাড়ি থেকে বাবার বাড়ি আসা মানে কর্ম সংস্থান থেকে ছুটি নেয়া।’
সাথী কথা গুলো শুনে হাসতে লাগলো। বলল, ‘তা মন্দ বলেননি।’
এক বুক চাপা কষ্ট নিয়ে সাবিহা সাজ্জাদের ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো। পেছনে ফিরে তাকিয়ে মনে মনে বলতে গাললো, ‘আমার মা না হয়ে একটু অপমান করেছে; আমি না হয় অবজ্ঞা করেছি, তাই বলে এই ঘরের পুত্র বধূ হওয়ার যোগ্যতা আমার ছিলো না ’ ‘এই ছোট্ট ঘরে জান্নাতের যে সুখ নামে আমি কি এর যোগ্য ছিলাম না?
সমাপ্ত
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন