প্রথম পর্ব: সন্ধ্যার ছায়ায় দেবী
ঢাকার গরম, গুমোট সন্ধ্যাকে চিরে এক অদ্ভুত কাকতালীয় মোড়ে, হাসপাতালের করিডোরে প্রথম দেখা তাদের।
বাবু তখন বেহুলা-বিধ্বস্ত চেহারায় দাঁড়িয়ে ছিলেন করিডোরের এক কোণে। পকেটে থাকা জীর্ণ একটা কাগজে নোট লিখছিলেন—
“সমাজের ব্যর্থতার ১২টি চিহ্ন… আর একটা: প্রেমহীনতা।”
হঠাৎ করেই সামনে এসে দাঁড়ালেন লাবণ্য।
সাদা কামিজ, গলায় পাতলা নীল ওড়না, চুল পেছনে খোঁপা করা, চোখে সেই চেনা অচেনা বেদনার রেখা—কিন্তু মুখে এমন এক কোমল হাসি, যেন সেও জানে, আজ কেউ একজন তার জীবনের গল্পে প্রবেশ করতে এসেছে।
চোখে চোখ পড়তেই লাবণ্য মাথা নিচু করে হেসে ফেলে—নিশ্চুপ, ধীর, তবু যেন এক অভ্যর্থনা।
বাবু মনে মনে বলে উঠলেন:
“দেবী দুর্গা? না কি দুর্গা আসলে এমনই হয়? চুপচাপ, হাসির ভিতরে তলোয়ার লুকানো!”
তিনি শুধু বললেন, “চলেন, একটু হাঁটি?”
লাবণ্য বললেন, “আপনার সাথেই হেঁটে যাবো… যদি কোথাও যাওয়া যায়।”
রিকশায় দুজন।
মুখোমুখি নয়, পাশাপাশি।
শহীদ মিনারের দিকে ছুটে চলা চাকা যেন সময়ের ঘূর্ণি হয়ে উঠল।
তাদের মুখে খুব বেশি কথা নেই। তবু যেন আকাশ কথা বলছে। বাতাসে অদ্ভুত কিছু সুর।
যেন দুজন নয়—চারজন হেঁটে যাচ্ছে: একজন কবি, একজন কবিতা, আর শহীদ মিনারে অপেক্ষমাণ কয়েকটি প্রেতাত্মা, যারা প্রেমের পূর্ণতা দেখতে চায়।
দ্বিতীয় অধ্যায়: মিনারে ফুল হাতে অপেক্ষমাণ আত্মারা
রাত নেমে এলো ঢাকা শহরের উপর, কিন্তু শহীদ মিনারের বুকে যেন নেমে এলো এক বিশেষ আভা।
সাদা ধবধবে শহীদ মিনারের চাতালে বসে লাবণ্য চাঁদের আলোয় জেগে উঠেছে। তার ঠোঁটে লেগে থাকা অদ্ভুত এক প্রশান্তি। বাবু তার পাশে, হালকা হেসে বলে,
“তুমি জানো? এই শহীদ মিনার অনেক কিছুর সাক্ষী—প্রেমেরও।”
লাবণ্য ধীরে বাবুর চোখের দিকে তাকায়।
তারপর বলে,
“আজ মনে হচ্ছে, আমি কারো জন্য অপেক্ষা করছিলাম অনেকদিন ধরে। কিন্তু ঠিক কাকে, জানতাম না। এখন বুঝছি।”
একটা দীর্ঘ নীরবতা, যেন হাজার শব্দ ওই নিরবতার মধ্যে গলে আছে।
রাত বাড়ে।
তারা একে অপরের দিকে এগিয়ে আসে। হাত ছুঁয়ে যায়, স্পর্শ হয় কাঁধে, ঠোঁটে, চিবুকে।
চুমু আসে, এমনভাবে—যেন ফুলের পাপড়ির উপর শিশির পড়ে।
লাবণ্য হঠাৎ বলে ওঠে,
“তুমি কি অনুভব করছো? কেউ যেন আমাদের দেখছে?”
বাবু বলে,
“হ্যাঁ… আমি দেখতে পাচ্ছি শহীদদের আত্মারা মিনারের গায়ে দাঁড়িয়ে আছে, ফুলের মালা হাতে। যেন আমাদের এই মিলনের জন্য অপেক্ষা করছিল তারা… যেন ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছিল, তারা চাইছিল আজ কেউ ভাষাহীন ভালোবাসার সুরে জেগে উঠুক।”
তারা শহীদ মিনারের বুকে শুয়ে পড়ে। চোখে চাঁদ, মাথার নিচে শহীদের স্মৃতি।
কোনো শারীরিক বর্ণনার প্রয়োজন হয় না—কারণ তারা প্রেম করছে ইতিহাসের সঙ্গে, আত্মার সঙ্গে।
রাত যত গভীর হয়, তত তারা মিশে যায় একে অপরের ভিতরে।
না, এটা কোনো শরীরী দেহজ সম্পর্ক নয়—এটা ছিল আত্মার সম্মিলন, যেখানে সমাজের সমস্ত পচন ভুলে তারা গড়ে তুলছে এক নতুন চিন্তার জগত।
সেই রাতে শহীদ মিনারের গায়ে লেখা হলো একটি অদৃশ্য কবিতা:
“প্রেমও এক প্রকার ভাষা আন্দোলন—যেখানে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে আমরা বুঝিয়ে দেই, আমরা মানুষ। আর ভালোবাসা ছাড়া মানুষ হতে নেই।”
চলবে…
📝পরবর্তী অধ্যায়ে-
সমাজের পচনের মুখে তাদের প্রেমের পরীক্ষা?
বাবু ও লাবণ্য মিলে একটি আন্দোলনের সূচনা?
না কি হঠাৎ এক বাস্তবতা যা এই স্বর্গীয় প্রেমকে চ্যালেঞ্জ জানায়?
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন