বেলা হল অনেক,

রোদ্দুর ঢলেছে পশ্চিমে

কলকাকলির পাখিরা ডানায় মেখেছে সিঁদুর।

মা, আমি এবার ফিরতে চাই মা।

ঝকঝকে মাঁজা কাঁসার গ্লাসে ঠাণ্ডা জল,

সঙ্গে একটু বাতাসা,

বৃষ্টি ধোয়া রাতে চালে ডালে খিচুড়ির মহাপ্রসাদ,

জ্বরে অসুখে কপালে ঠাণ্ডা হাতের বরাভয়,

আঘাতে বিপদে উদ্বিগ্ন চোখের জল।

মা, আমি আবার এইসব মহার্ঘ আবহে

ফিরে আসতে চাই মা।

মাটির উঠোনের এককোনে তুলসীর মঞ্চ,

তার নিচে শান্ত বেড়াল ছানা,

কাঠ চাঁপার ডালে লাল পিঁপড়ে, মৌমাছি।

কুয়োর অনেক নীচে বৃত্তাকার জলছবিতে

টুপটাপ পাতাঝরা ।

বাড়ির পিছনদিকের বাঁশঝাড়ে শৈশবের রাক্ষসী

পেত্নী ব্ৰহ্মদত্যি।

ঘুম ঘুম বেশি রাতে।

মা, আমি আবার ফিরে যেতে চাই

সেই সব সোনার খনিতে।

মা, আমি ফিরে যেতে চাই।

তোমার ছায়ায়, তোমার আশ্রয়ে

আবার আমি ফিরে যেতে চাই।

কলকাতায় এঁটো থালা

ফেলে দেওয়া মাটির ভাঁড়ের মতো

বড় বেশী উপেক্ষায়

ফুরোল জীবন, কাটলো সময়।

বাবুদের বাড়ি ইলিশ রান্না হলে ঘ্রাণে

অর্ধেকের বেশী চেটে পুটে খাওয়ার

স্বপ্নে বিভোর কাজের মেয়েটির মতো

অতৃপ্ত ফুরোল দুপুর,

অভুক্ত রাত।

গলা ফাটিয়ে এই শহরের বিনিদ্র পথে পথে

কতবার বলতে চেয়েছি

সব ঝুট হেয়, সব ঝুট হেয়।

বলতে পারিনি মা।

সাহসে কুলোয় নি।

মোহিনী মুখোশের সামনে নত হয়েছি,

সেলাম ঠুকেছি।

মা, এখানে আর থাকবো না মা।

আমি ফিরে যাবো।

মা, তুমি বলেছিলে-

খোকন চন্দন গাছ হবি, তবে বড় হতে পারবি।

কাটলে ছিড়লে, কোপালে শব্দ করবি না,

কাঁদবি না। তবে হবি বড়।

চন্দনের গন্ধ শুধু ছড়াবি বাতাসে

অকৃপণ অকাতর কাঠুরিয়া সময়কে

দিবি অমুল্য সুবাস।

মা, আমি পারিনি মা।

চন্দন গাছ হতে পারিনি মা।

কথ দিয়ে কথা না রাখা মোহিনী চোখ

কত খুবলে ছিঁড়ে নিয়ে গেছে

বুকের ভেতর থেকে রক্তমাখা গান,

অশ্রুময় কবিতা, ব্যথার নীল ছবি

বেচেছে চাঁদের হাটে।

খ্যাতি, অর্থ, সম্মানের নীলাজ মোচ্ছবে

আমি চন্দন গাছ হতে চেয়েছিলাম।

কিন্তু আমি হতে পারিনি।

ডালে ডালে পাতায় পাতায় তীব্র বিষ,

বড় জ্বালা।

কলকাতার বেশ্যারা, কলকাতার

বাউন্ডুলে ভিক্ষুকেরা,

কলকাতার বেপরোয়া মাতালেরা

চাদরের খুঁট থেকে বের করে দিতে

চেয়েছে কিছু স্নেহ কিছু মমতা।

আমি তাও নিতে পারিনি অঞ্জলি ভরে।

এ দু হাত সময়ের পদসেবায় ক্ষতবিক্ষত,

অনেক আলোর লোভে

অনেক আলোর জৌলুসে

ছুটে গেছি বার বার ।

মরিয়া পতঙ্গের মতো পুরে গেছে ডানা

আলোর মানুষেরা আলোই চেয়েছে

পাঁজর দিয়েছি খুলে।

সেই হাড়ের হাসিমুখে আগুন জ্বেলেছে।

সেই আঁচে ঝলসে ঠিক নিয়েছে

সাজিয়ে মহার্ঘ আহার।

খ্যাতি, অর্থ, প্রতিষ্ঠার মোগলাই খানা।

এবার আমি ফিরতে চাই মা।

দগ্ধ, ধ্বস্ত, শ্রান্ত আমি একটু ঘুমোতে চাই।

মা, তুমি কি এখনো আছো?

ঝিঁ ঝিঁ ডাক সন্ধ্যায় লন্ঠনের দীন আলো হাতে,

এখনো কি দরজায় ক্ষীণ চোখে পথ চেয়ে থাকো?

এখনো কি খোকনের জন্য দাও রেখে,

নিজেকে অভুক্ত রেখে ভাত ডাল রুটি?

এবার আমায় ডেকে নাও মা।

চন্দনগাছ হয়ে ওঠা আমার হল না জীবনে।

বিষাক্ত কাঁটা গাছ,

তুমি তো মা, তুমি নাও ডেকে।

আমি জানি সারা পৃথিবীর বুকে একমাত্র

চন্দনগাছ তুমি।

তোমার আশ্রয়ের সুগন্ধে ফেরাও আমাকে মা।

পরে পড়বো
১৭
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন