বহুরূপীর গীতা

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

গোড়ালি-ডোবা কাদার মধ্যে হেঁটে যাচ্ছি গড়বন্দিপুরের দিকে
একটা অশথ গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছে বংশীধারী শ্ৰীকৃষ্ণ
আকাশে উড়ছে শকুন, পুকুর হওয়া মাঠে জাল ফেলছে
এক ঠেঙো-ধুতি জেলে
এক দঙ্গল বাঁদর-সাজা ছেলেমেয়ে তাড়া করছে একটা কুকুরকে…
মাথায় ময়ূরের পালক, মুখের রং নীল ধরনের, জরির পোশাক পরা
কৃষ্ণ একমনে বিড়ি খাচ্ছে
অনেকদিন বহুরূপী দেখিনি
একটানা বৃষ্টির মাসে বহুরূপীটির বোধহয় বাজার খারাপ
কেউ আর ও-সব আমোদে পয়সা দিতে চায় না
সঙ্গীদের থামতে বলে তার সামনে গিয়ে বললুম, কী গো ভাইটি,
তুমি কি গড়বন্দিপুরে থাকো,
সেখানকার খবর কী?
হাতে সুদর্শন চক্র নেই বটে, তবু তীব্র চোখে তাকিয়ে
নব দূর্বাদলশ্যাম শ্রীকৃষ্ণ যা বলতে লাগলেন, তা অবশ্যই এক
নতুন গীতা!

তোমরা বাবুরা সেখানে হঠাৎ উদয় হচ্ছো কেন গো?
ভোট আবার এসে গেল বুঝি?
হঠাৎ দাঙ্গা-টাঙ্গা লেগে গেল নাকি?
কাঁধের ঝোলায় জলের বোতল আছে, তাই না?
আমাদের গায়ের জল খেলে তোমাদের ওলাউঠো হয়,
আমাদের হয় না
সাপের বিষের ওষুধ এনেছ? কালকেই আজু শেখের এন্তেকাল
হয়ে গেল
মা মনসার বিষের ছোবলে!
বীজতলা রোয়ার সময় বৃষ্টি এল না
বৃষ্টি নেই, আকাশ শুকনো, মানুষের মুখও আমসি
এখন আবার শালা এত বৃষ্টি পড়ছে, পড়ছে তো পড়ছেই,
সব ভেসে গেল
এতে আর গরমিন্ট কী করবে, গরমিন্ট তো ভগমানের মতন
আকাশ সামলাতে পারবে না
কিন্তু ইস্কুলে একটাও ম্যাস্টার নেই, তা পাঠাতে পারো না?

আমার একজন সঙ্গী বলল, এ সব তুমি কী বলছ, বহুরূপীদা
সবই তো জানি, গ্রাম তো আর রাতারাতি বদলায় না
কিন্তু গ্রাম-পঞ্চায়েত কতটুকু কাজ করেছে, আর
আপনিই বা কী করেছেন?

এবার শ্রীকৃষ্ণ মৃদু হাসলেন
মুখের চেহারাটা বদলে গেল, গাঢ় কণ্ঠস্বরে বলতে লাগলেন
এই কলি যুগের মুক্তির উপায় বড় জটিল
একটা বিশাল গুহা, তার মধ্যে সবাই ঢুকে যাচ্ছে দলে দলে
স্বামী পোড়াচ্ছে স্ত্রীকে, স্ত্রী খেয়ে ফেলছে স্বামীকে
সন্তানরা বাবার পরিচয় না জানলেই ধর্মও জানবে না
বাচ্চারা হাতের আঙুলের বদলে পায়ের আঙুল চুষতে শিখবে
ছোট মেয়েরা অদৃশ্য হয়ে যাবে পূর্ণিমার রাতে
চোরদের ধরে এনে পদ্মবনের সামনে দাঁড় করালেই তারা কাঁদবে
কুকুরে চাটবে হিন্দু-মুসলমানের মারামারির রক্ত
তখন বিধবা লক্ষ্মী আর নীলোফার এ ওকে জড়িয়ে ধরবে
ধানের দুধ পোকায় খাবে না, আমি খাব
একটা নদী ঘরের দরজার কাছে এসে বলবে, ওগো,
আমায় রাত্তিরটা থাকতে দেবে?
একটা পুঁটি মাছ পৌঁছে যাবে সমুদ্রে
কুমিরেরা দর্জির দোকানে জামাকাপড়ের মাপ দেবে
আর আকাশ থেকে খসে পড়া একটা তারা নাচবে উদোম হয়ে
তোমরা অবশ্য কিছুই দেখতে পাবে না, সবই অদৃশ্য,
হা-হা-হা, সবই মায়া!
আমি মহাভারতের খটোমটো গীতা কখনো ভালো করে
বুঝতে পারিনি
স্বয়ং বেদব্যাসও কি বুঝতে পারতেন এই নতুন গীতা?
এখন পর্যন্ত কবিতাটি পড়া হয়েছে ৬৭ বার
যদি কবিতাটা সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
    মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন