ছন্দ-হিল্লোল
ছন্দ-হিল্লোল
সুনির্মল বসু

গল্প - ছন্দ-হিল্লোল

সুনির্মল বসু | ছন্দের টুং টাং
বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৫ ছোটদের

উজিয়ে চলেছি বর্ষার ভরা গাঙ্ বেয়ে। ও পারে বন‍্তরাইয়ের নিবিড় গজারি-বন আর বুনো বোয়ানের ঝোপ্ ভালো দেখা যায় না; শুধু মহাকালের শাদা মন্দিরের চূড়োর চক‍্চকে

ত্রিশূল‍্টা ঝল্‌মলে আলোয় ঝক‍্মক্, করছে! এ পারের গ্রামের স্বপ্নটা সত্যি হয়ে চোখের সাম‍্নে ধরা দিল―গাছে গাছে মালতীলতার বেড়, বুঝি মধুমালতীর দেশ। চেয়ে দেখি অদূরে ভাঙ্গা ঘাটের শ্যাওলাপড়া পৈঠা বেয়ে “দুইটি মেয়ে নাইতে নেমেছে”— কিন্তু ভালো করে’ ঘুরে ফিরে তাকিয়ে দেখলাম্‌—কোথাও “নোটন নোটন পায়রাগুলি ঝোঁটন্‌ বাঁধেনি”।

নৌকার নীচে অথই জল অবিরাম গান গেয়ে চলেছে—“ছলাৎ ছল্—ছলাৎ ছল্।”

“ছলাৎ ছল্— ছলাৎ ছল্,
অধীর আজ নদীর জল্।
শোনায় গান্ জুড়ায় প্রাণ্,
পরাণ্ মোর সুচঞ্চল্!
বিজন তীর নিজন, থির—
কূজন-হীন্, কানন্ তল্;
ছলাৎ ছল্ ছলাৎ ছল্!”…
এগিয়ে চলেছি!……

গাঁয়ের পাশ ঘেঁসে একটা খাল্ এসে নদীতে পড়েছে! উঁচু ঢিবির আড়ে তার ক্ষীণ ধারা দেখা গেল। একটা প্রাচীন বট গাছ দাঁড়িয়ে কতকাল ধরে’ তার লেখা জোখা নেই। ঝুরির পর ঝুরি নেমেছে মাটির দিকে—তার তলে বসে এক বুড়ী— হয়ত আদ্যিকালের বদ্যি বুড়ী! পাড়ার কতগুলি দুষ্টু ছোট ছোট ছেলে মেয়ে তার নামে ছড়া কেটে বিরক্ত করছে!

“ও বুড়ি তোর কয়টি ছানা?” বুড়ী রেগেই কাঁই। হাতের লাঠি দিয়ে “হেঁই” বলে মুখ খিঁচিয়ে মাটিতে এক আছাড় মারে,—ছেলেমেয়েগুলি ভয়ে ছুটে পালায়! আবার বলে—

“ও বুড়ী তোর কয়টি ছানা?
ও কিরে তোর চোখ‍্টি কানা!!

বুড়ী পাশের গোবরের ঝাঁকাটি তুলে চলে যায়, ছেলেগুলি পিছন নেয়—“বুড়ী, বুড়ী, তোর কয়টি ছানা?”

একটা টিলায় বসে’ গাঁয়ের ছেলে চার ফেলেছে মাছের আশায়। পাশে একটি ছোট মেয়ে—বোধ হয় তার বোন্‌—আলুথালু চুলে একটা ধামা নিয়ে দাঁড়িয়ে দাদার মাছ ধরবার কসরৎ দেখ‍্ছে! নৌকার শব্দে মেয়েটি ডাগর চোখে ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে তাকালো!…

বেলা পড়ে আছে!—“ও মাঝি আর কতদূর?—”

মাঝি উত্তর দিলে,—“আর তিন্ বাঁক্ বাবু—হৈ আঠার বাঁকীর তীরে, সন্ধ্যার আগ্ নাগাদ্ পৌঁছাব।”…

“ক্যাঁচর কুর্ কুর্”—মাথার উপর দিয়ে একটা পাখী উড়ে গেল নাম জানি না, ধাম জানি না। দিগ্‌ দিগন্ত সেই শব্দে যেন মুখরিত হয়ে উঠছে। “ক্যাঁচর্ কুর্ কুর্—।”

“ক্যাঁচর্ কুর্ কুর্——
ক্যাঁচর্ কুর্ কুর্—।”
বাতাস্ ফুর্ ফুর্
উড়ায় মন্ মোর
অনেক দূর্ দূর্।
কোথায় যাই ভাই
কিছুই ঠিক নাই;
দূরের বন্ গাঁয়
পাতার ঝুর্ ঝুর্।
পাখীর গান শোন্—
ক্যাঁচর কুর্ কুর্!

সূর্য্যিমামা পশ্চিমে হেলে পড়েছেন। সমস্ত আকাশটা পাড়ি দিয়ে তাঁর মুখ‍্খানা পরিশ্রমে লাল্ টুক‍্টুক্! পুবে ঝাপ্‌সা ধোঁয়া ঘনিয়ে আস‍্ছে! কোন্ বাড়ী থেকে মা ছেলেকে আকুল হয়ে ডাকছেন—“তিতু ঘরে আয়রে!”
“তিতু ঘরে আয় রে—
ডাকে মাতা তায় রে,—
ডেকে গলা ভাঙ্গলো
কোথা তিতু হায় রে!
তিতু গেছে বাইরে
কোথা ভাবি তাই রে!
মা যে ডেকে হয়রাণ্,
ভেবে ভেবে ভয় পান্!
সাঁঝে ছায়া ছায় রে
তিতু ঘরে আয় রে!..
কিন্তু তিতুর আর সাড়া শব্দ নেই। কোথায় গেছে কাঁকড়া ধরতে, গাছে চড়‍্তে কি ছিপ্ বাইতে কে জানে! শূন্য ‘মাঠে মায়ের প্রতিধ্বনি ফিরে ফিরে আসতে লাগ‍্লো।

পাড়ার মেয়ে-বৌ ঘাটে আস‍্ছে জল নিতে। কাঁখে কলস, অলস গতি। কারুর বা পায়ের মল্ বাজ‍্ছে—“ঝিনিক্‌ ঝিক্‌ ঝিন্—”

সুনির্মল বসু Sunirmal Basu

ঝিনিক্ ঝি্ন ঝিন—,
ফুরায় ক্ষীন্ দিন্!

গাঁয়ের বৌ যায়
ঘাটের দিক্-টায়,—
বাজায় জোর্ জোর্
পায়ের মল্‌-বীন্।
ঝিনিক্ ঝিন্ ঝিন্!

ওদিক থেকে ঘাসে বোঝাই এক ছিপ্ নৌকা তর্ তর্ করে’ পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। অনেক দূর থেকেও মাঝির মাণিক‍্পীরের গান শুনতে পাচ্ছিলাম।

“ভব নদীর পারে যাবার লা—”

ফির‍্তি পথে রাখাল ছেলের মেঠো বাঁশী মন্ উদাস করে’ বেজে চলেছে। সঙ্গে গরু-ছাগলের পাল। অস্ত রবির লাল আলো তাদের গায়ে পিঠে পড়েছে। চমৎকার গোধূলী-সন্ধ্যা! ঐ কল‍্মীর ঘন ঝাড় ঘেঁসে পান‍্কৌড়ি ডুব দিল। খুব চালাক ওরা! কোথায় ডোবে কোথায় ওঠে বলা মুস্কিল্!

পান্ কৌড়ি
পান্ কৌড়ি,

দ্যাখ্ পট্‌লা
দ্যাখ্ গৌরী!
ওই ডুব‍্ল
খুব চুব‍্ল—
ফের উঠ‍্ল,
যায় দৌড়ি’!

পলাশ-তলার নীচে বুনো ঘেঁটুর গাছ। জল-পায়রা নাচ‍্ছে—থৈ তাতা থৈ!

থৈ তাতা থৈ—
নাচ্ দেখ ঐ
জল্ পারাবত
যায় উড়ে কৈ?
কৈ কোথা যায়——
আয় তোরা আয়
নাচ্ দেখে রই—
থৈ তাতা থৈ!

মাঝির লগিতে জল্‌-পট‍্পটি ঘাস আট্‌কাচ্ছে। জল খুব কম। প্রায় ডাঙ্গা ঘেঁসে চলেছি। এ পারে ঘুম‍্নগরের বাথান্—ওপারে বনে ঢাকা মাসী-পিসীর দেশ। শোনা যায় নিশুত্ রাতে বন‍্গাঁবাসী মাসী-পিসী উড়‍্কী ধানের মুড়‍্কী আর আমন-চিঁড়ের মোআ ছেলেদের বিলোতে বসেন! ছেলেরা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তাই খায় আর হাসে—যেমন হাসে বুড়ীমায়ের আদর পেয়ে ভরা পূর্ণিমার চাঁদ‍্টা!

এক ঝাঁক বাদুড় এক ডাল থেকে আর এক ডালে বসে। এখানে আদুরে ছেলেদের ভাগ্যে আর পেয়ারা খাওয়া ঘটে না. বোধহয়, কারণ ছোটবেলায় ঠান‍্দির মুখে শুনেছি, “আদুরের পেয়ারাটি বাদুড়ে খায়।”—তা কি আর মিথ্যা হবার জো আছে, বাপ্ রে!

জিওল গাছটার ফাঁকে দেখা যায় এঁকা বেঁকা ছোট রাস্তাটি ঘুরে ঘুরে দূরে চলে গেছে, গ্রাম পেরিয়ে, মাঠ পেরিয়ে, হাট ছাড়িয়ে অজান্তি পুরের দিকে। পথিক চল‍্তে গিয়ে খানিক বিশ্রাম করে’ নেয় গাছটার নীচে, পোঁট‍্লা খুলে চিঁড়ে গুড় খেয়ে চিৎপাৎ হয়ে শুয়ে পড়ে সবুজ মখ‍্মলের মত ঘাসের উপর। মনে পড়ে তার ঘরের কথা। গাঁয়ের ছেলেমেয়েকে দেখে মনে পড়ে যায় নিজের দুলালদের কথা। হন‍্হনিয়ে পথ হাঁটে ফের।

নেড়া বেল্‌গাছটায় ব্রহ্মদৈত্যির ভয়। মাঝি “রাম রাম” করে উঠ‍্ল। অনেক দূর দিয়ে ডুলি চলেছে। নতুন-বৌ চলেছে বোধ হয় শ্বশুর বাড়ী! বেহারাদের হুম্‌কী কাণে এসে বাজ‍্ছে!

দুলি’ দুলি’
চলে ডুলি।
আঁকা বাঁকা
বনে ঢাকা
ছোট পথে
কোন মতে
চলে ছুটে
চারি মুটে।
নাহি বুঝি
সোজা সুজি

বলে বুলি;
চলে ডুলি।

সুনির্মল বসু Sunirmal Basu

চলে মেয়ে,
আঁখি বেয়ে
ঝরে ধারা,
আহা সারা
কেঁদে বুঝি,
মাথা গুঁজি’।
বাড়ী ছেড়ে
চলেছে রে

স্বামী ঘরে,
আহা ঝরে
দুটি আঁখি
থাকি থাকি।
পড়ে মনে
গৃহ-কোণে
জননীকে
অনিমিখে,
মনে আসে
চোখে ভাসে।
ডুলি থেকে
বেঁকে বেঁকে
ডুরি দারী
রাঙা সাড়ী
পড়ে ঝুলি’,
চলে ডুলি।
ডোবে রবি

ঢাকে সবি
আঁধারেতে;
পাশে ক্ষেতে
ওঠে মেতে
মৃদু হাওয়া।
ঘাসে-ছাওয়া
উঁচু মাঠে,
নীচু বাটে,
নীচু আলে,
চলে তালে
“বাহী” গুলি,
চলে ডুলি।
ঝিঁ ঝিঁ ডাকে
শাখে শাখে,
পাখা ফিরে
নিজ নীড়ে
নভঃ বাহি,

গীতি গাহি’
‘কল’ তুলি।
চলে ডুলি।
ওঠে চাঁদা
লাগে ধাঁধা
আলো জাগে
ভালো লাগে,
ঝিলিমিলি
নিরিবিলি
বনে বনে,
কোণে কোণে,
নেশা লাগে,
অনুরাগে
সবি ভুলি—
চলে ডুলি।
চলে মেয়ে
স্বামী গেহে

কোথা যাবে
শুধু ভাবে,
জানে না সে
সুধু ভাসে
আঁখি জলে,
তবু চলে।
থাকি থাকি
মুদে আখি
পড়ে ঢুলি’;
চলে ডুলি।

ঐ আঁঠার-বাঁকীর মোড়। জোড়া মৌ-তলায় সাঁঝ্-পুজুনীর ঘণ্টা বেজে উঠেছে। তুলসী তলায় দুগ্‌গো পীদ্দিম্ দেওয়া সেরে বৌ-ঝি শাঁকে ফুঁ দিল।

আমার পথ শেষ।

পরে পড়বো
১৯
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন