অরণ্য, তুমি

তসলিমা নাসরিন তসলিমা নাসরিন

১.
চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছো তুমি, অরণ্য,
আমি জগত দেখতে পাচ্ছি না।
অন্ধকার ছুঁড়ে ছুঁড়ে ইন্দ্রিয়গুলো বুজিয়ে দিয়েছো,
কাউকে শুনতে পাচ্ছি না, নিজের আর্তস্বরও নয়।
কেবল তোমাকে শুনছি,
তোমার মিথ্যে,
তোমার ছল-কৌশল,
তোমার ফণা, প্রতারণা।

তুমি আমাকে গ্রাস করছো,
গ্রহণ লেগেছে গায়ে, হৃদয়ে ঢুকে গেছে রক্তচোষা জোঁক,
রোমে রোমে নিশ্চিহ্ন হলাম।
আমার ভিতর বাহিরে এখন যে আছে সে আমি নই, অন্য কেউ।

ইচ্ছে ছিল তোমাকে গড়ে পিটে সভ্য করবো,
অথচ তোমার হাতেই দেখি বাগে আনার চাবুক,
লাগাম এমনই টেনেছো যেন তোমার ঠোঁটজোড়া ছাড়া
কিছুই থাকে না নাগালে,যেন খেলে তোমাকেই চুমু খাই।
দুটো তিনটে ক্যাভেরটা সেবনে এমনই পুরুষ হয়েছো
যেন তোমার উত্থান, এক তোমার উত্থানই মেটাতে পারে আমার রাক্ষুসে
ক্ষিধে।


ওভাবে দাঁড়িয়ে থেকো না অরণ্য,
আমি জগত দেখতে পাই না।
সবকিছু অক্ষত তোমার, সংসারের হিসেব, স্ত্রীপুত্র, সন্ধের মদ।
সবই তো বোঝো, সোনাগাছি রূপাগাছি, নন্দন চন্দন,
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িবাড়ি, অর্থকড়ি, যশখ্যাতি সব বুঝে সারা,
শুধু ভালোবাসা বোঝো না, সে কি আর বুঝেছিলে কোনওদিন!


ইচ্ছে ছিল প্রেমিক হও,
সব উজাড় করে উপুড় করে
ঢেলে দেখি আর যা কিছুই হয়েছো, কবি বা ব্যাবসায়ী, প্রেমিক হওনি।
ও মুরোদ সবার থাকে না। যা তুমি, তাই থাকো,
তোমাকে সভ্য হতে হবে না, মানুষ হতে হবে না, প্রেমিক হতেও না।
শুধু চোখের সামনে থেকে সরো,
পাশে বা পিছনে দাঁড়াও।
আমি যেন অন্তত আমি হই।


২.
আমাকে তুমি পাগল বানিয়ে ছাড়বে অরণ্য।
আরও বিরাট হয়ে বিকট হয়ে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছো,
চোখ আমার দিন দিন ঘোলা হচ্ছে, ঘোলা হতে হতে অন্ধ।
আমি কি কবন্ধ,
তোমাকে পাথর ছুঁড়ে কেন সরাচ্ছি না!
আমার জীবন-যাপনে কী জানি কী করে ঢুকে পড়ে এখন হল্লা করছো,
যেন আমার সংসার আসলে তোমার সংসার,
আমার ঘর−দার আসবাব তোমার,
বাসনকোসন, ব্যাংকের যাবতীয়, বাগানের ফুল, বইপষন সব তোমার,
সেলারের মদগুলো তোমার, রেশমি কাবাব তোমার, স্নানঘর তোমার,
আমার বিছানা বালিশ তোমার, শরীর তোমার।
এত দাপট দেখাচ্ছে! যেন তোমার আমি খাই পড়ি,
যেন তোমাকে না হলে আমি মরে যাবো,
হৃদপিণ্ড ঝুলে থাকবে, ফুসফুসে শ্যাওলা পড়বে।


দরজা সেঁটে দাঁড়িয়ে আছো,
কোনও আগন্তুককে আমন্ত্রণ জানাবে না,
বেমককা গুঁতো দেবে আমন্ত্রিতর পেটে,
কেবল তোমার অনুমোদিত অতিথিকে আসন দেবে তুমি।
চোখ দুটোয় রক্তজবা, সে জানো?
আমি পালাতে চাইলেই খপ করে ধরে ফেল
যেন আমার জীবন আসলে তোমার,
আমার হৃদয়ও তোমার তিন বা চার ইঞ্চি আধ-অকেজো শিশ্নের জোরে
তোমার।


তোমার বোতল থেকে দৈত্য বেরিয়ে এসেছে,
ছিপি চেপে বেশিদিন রাখতে পারোনি।
বোতল থেকে আসলে তুমিই বেরিয়েছো,
ন্যাংটো গায়ে নোংরা লাগা, শিশ্নে বীর্যের আঠা
কারও যোনি থেকে এই সবে উঠে এসে তড়িঘড়ি প্রেমিক সেজেছো।
আধিপত্য চাও, অরণ্য?
কাউকে সিঁদুর শাঁখা পরিয়ে বশে রাখো,
কাউকে প্রেম দিচ্ছে! দাবি করে বশে,
সারাদিন মনে মনে ধর্ষণ করো যেখানে যে নারীকেই দেখ।
তুমি পুরুষ বলে তোমার ছোঁকছোঁক মাফ!


পুরুষ বলে লাম্পট্য মাফ!
তোমাকে আর যা কিছুই দিতে পারি, আধিপত্য পারি না অরণ্য।
টন টন প্রেম নেবে নাও,
নিযে যা কিছুই করো,
গঙ্গায় ছোড়ো কী কোথাও পুঁতে রাখো সে তোমার খুশি।
যতবার ইচ্ছে করো শুতে,
শুতে পারো পুরোনো বীর্যের আঠা ধুয়ে বা না ধুয়ে
মিথ্যে তোমাকে বলতেই হয় তুমি ভালোবাসো,
মিথ্যে তোমাকে উচ্চারণ করতেই হয় তুমি এক আমাকেই।
এই দাপট এখনও তোমার নেই যে
ভালোবাসার কথা না বলে ঠোঁট ছোঁবে,
বুকের এত পাটা তোমার নেই যে
কেবল শরীরের জন্য বলবে শরীর স্পর্শ করছো।
জানি না জানো কী জানো না যে ভালোবাসতে যেমন পারি,
না বাসতেও ঠিক ততটুকু পারি আমি।
তোমার ওই আধ-অকেজো শিশ্নকে কেজো করার জন্য
এক ফোঁটা প্রেমের প্রয়োজন পড়ে না, অরণ্য।
শোনো, শুনে রাখো, ভালো তোমাকে না বেসেই আমি চুমু খাই,
শরীরের জন্যই স্পর্শ করি তোমার শরীর।


আমি তো আমিই ছিলাম এতকাল,
এখন ইচ্ছে করেই তোমার সঙ্গে তোমার মতো হই, অরণ্য।
বোঝো?

৩.
তোমার কি আর বোঝার মন আছে !
মন যদি কোনওকালে ছিল, তাকে ছড়িয়েছো ছষিনশদিকে,
এত টুকরো টুকরো করেছো যে মন আর মন নেই,
তুমিও এখন আর ঠিক ঠিক চিনতে পারো না কোনওটিকে।
ভাসিয়েছিলে তরুণীর তরে তরী, বাণিজ্য-বাঁধনে ছিলে।
হর্ষে কর্ষেছিলে, বর্ষেছিলে,
খুশি ছিলে,
আহলাদে আরামে ছিলে, ভেবেছিলে ছিলে।
এখন মন খুঁজতে গিয়ে দেখ
তোমার আস্ত শরীরের কোনও আনাচ কানাচে নেই,
টুকরোগুলো যষনতষন, খালে বিলে খাবি খাচ্ছে।
মনকে একষন করো একদিন, একাগ্র করো একদিন,
অরণ্য, সমৃদ্ধ হও,
দেখে দেখে তোমাকে মুগ্ধ যেন হই, মুগ্ধ হতে দাও।


যত বলি, যত যাই বলি যে ভালো না বেসে স্পর্শ করছি তোমাকে,
বিশ্বাসও করতে চাই প্রাণপণে যে শরীরের জন্যই শরীর,
আমাকে শরম দিয়ে, গোহারা হারিয়ে দিয়ে, অভিমানের পুরু প্রলেপ
ভেঙে
বেরিয়ে আসে আমার বীভৎস প্রেম।
এ আমার সঙ্গে আমার লড়াই, তোমার ভূমিকা অতি সামান্য অরণ্য।

মনকে একাগ্র করে সে মন যাকে ইচ্ছে তাকে দিও,
না দিতে চাও তো রেখে দিও।
ভিক্ষে চাইছি না, চাইনি কোনওদিন।
পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে যদি মানুষ না পাও দেবার,
তবেই এদিকে ফিরে চেও, না দিয়ে না পারো যদি, তবেই দিও।

৪.
কথা বলেছি ওই সুদর্শন যুবকের সাথে, তার সাথে,
তাতে তোমার কী অরণ্য?
তুমি কেন চিল্লিয়ে বাড়ি ফাটাচ্ছে!?
বাপ মা তুলে গাল দিচ্ছ, গালে শক্ত শক্ত চড় দিচ্ছা
ভালোবাসা দেখাচ্ছে!?
ছাই ভালোবাসো, মদে চুর হয়ে দুনিয়া উল্টে ফেলবে ভাব,
চুলের মুঠি ধরে আমাকে টানছো, ধাককা দিচ্ছ দেওয়ালে,
কব্জির জোর দেখাচ্ছে!, অথচ কব্জি উল্টে উল্টে কিন্তু
ঠিকই দেখে নিচ্ছ কটা বাজলো
সময় হলেই বাড়ি যাবে,
ওখানে তোমার নন্দিনী ভাত বেড়ে বসে আছে,
ওখানে নন্দিনী এলোমেলো শুয়ে,
আধো ঘুম তার ভাঙাবে আলতো ছুঁয়ে,
চোখের পাতায় চুমু খেয়ে চোখ খোলাবে, দেখাবে তোমাকে,
স্ত্রৈণ তোমাকে, নতমুখ নতজানু কর্তব্যপরায়ণ বিবেকি পুরুষকে।
ওখানে আমি নেই, আমার গল্প নেই, বিন্দুবিসর্গ নেই,
ওখানে হাসি মুখ, ওখানে ডিম দুধ, মাছ মাংস,
ওখানে সন্তান, বংশের দীপ, ওখানে ভবিষ্যৎ,
স্ফটিক-য়চ্ছ জলে খলসে মাছের সাঁতার।
ওখানে স্বজন বন্ধু, প্রতিবেশি,
ফুসফুসে শুদ্ধ হাওয়া,
ওখানে তুমি কত্তা,
আহ, নিটোল নিরাপত্তা।

চার দেওয়ালে আটকে রাখতে চাইছো,
অন্ধকারের আড়ালে,
মুঠোর মধ্যে পুরতে চাইছো সবটা,
আমার দখল চাইছো তুমি,
আমার ইচ্ছে অনিচ্ছে চাইছো,
গতরে অন্তরে স্ট্যাম্প মেরে মালিকানা চাইছো।
চোখ যেন অন্য কোনও যুবকের দিকে না ফেরে,
চোখ তুমি খুবলে আনতে চাইছো দশ নখে,
দাঁতে ছিঁড়তে চাইছো আমার স্তনবৃন্ত যেন কেউ ঠোঁট ছোঁয়াতে না পারে,
জ্বলন্ত শিক ঢুকিয়ে পুড়িয়ে দিতে চাইছো যৌনাঙ্গ,
হৃদয় মোহর করে দিতে চাইছো।
তুমি কি মানুষ অরণ্য?
যে কোনও পুরুষের মতোই পুরুষ তুমি।
দীন, হীন,
যে কোনও পুরুষের মতোই লোভী,
স্বার্থে অন্ধ। অনুদার, কুৎসিত।

নন্দিনীকে শেকল পরিয়েছো, আমাকেও পরাবে পণ করেছো ।
যারই সান্নিধ্যে যাও, যে-ই তোমাকে না-বুঝে না-দেখে ভালোবাসে
তাকেই খামচে কামড়ে পরাতে চাও শেকল।
সারা শরীরে তোমার ঝনঝন আওয়াজ, অরণ্য,
মানুষ পেঁচাতে পেঁচাতে নেশাগ্রস্ত এখন মানুষ পেঁচিয়ে বাঁচো।

দখলি-দারের লোল গড়াচ্ছে তলপেটে পেটে,
মুহূর্মুহু মালিক হবে মাংসের।
দূরারোগ্য দম্ভ-রোগে ভুগছো তিনকাল,
অন্যের স্বাধীনতাই এখন দাওয়াই বটে
তোমার-ঘোলা-জলে গুলে গুলে সারাদিন অপ্রকৃতস্থের মতো তাই খাও।
মেগালোম্যানিয়ার কিলবিলে কীট কুরে খাচ্ছে তোমাকে,
তোমাকে করুণা করি,
তোমার শতচারী শরীরে শতবার থুতু দিই।

কিছু কম ঘৃণা হলে একশ সুদর্শনের সঙ্গে রমণ করে দেখাতাম
স্বাধীনতা কাকে বলে।
বেশি ঘৃণা বলে তোমার তো নয়ই, তোমার জাতেরও স্পর্শ নেব না, না।
গেট লস্ট ইডিয়ট ছাড়া আপাতত আমার মুখে
প্রেমের অন্য কোনও বাক্য অবশিষ্ট নেই।

৫.
দুহাত পেতে ভিক্ষে চাইছো ক্ষমা,
তুমি কি জানো যোগের ঘরে শূন্য করেছো জমা !
বিয়োগের ঘরে কম করে বলি দুকোটি,
মনে আছে কেড়ে নিয়েছিলে সব, ছাড়ো নাই খড়কুটোটি!

তুমি বুঝি আর ছোটখাটো বদমাশ!
চুমু খেতে খেতে পরিয়েছো ফাঁস,
আমারই খেয়ে আমারই পরে আমারই সর্বনাশ।
ক্ষমার প্রশ্ন ওঠে না শুনেই অন্য আঁচলে ঝাঁপ,
দুধ কলা দিয়ে চিরকালই আমি পুষলাম কালসাপ।

৬.
তোমাকে এখন অনেক দূরের মানুষ মনে হয় অরণ্য,
সন্ধেটা কাটাতে তুমি আসো, মামুলি কিছু কথার পুনরাবৃত্তি করো,
চুমু না খেলে কী আবার ভেবে বসি বলে চুমুও দুতিনটে খাও।
সঙ্গমের জন্য গায়ের কাপড়চোপড় এমন করে খোলো
যেন সারাদিন রোদে ভিজে বাড়ি ফিরে পায়ের মোজা খুলছো,
খুলে আমার শরীর নিয়ে যা করো তা নিতান্তই দুপুরবেলার স্নানের
মতো,
স্নান সেরে টেবিলের বাড়া ভাতে হাত ডোবাবার মতো, খেয়ে ঢেঁকুর
তুলে বিছানায় ভাতঘুম দেওয়ার মতো, দিয়ে এলিয়ে কেলিয়ে বিকেলের
বেরিয়ে যাওয়ার মতো।
আমাকে কি বাড়ির বউ পেয়েছো অরণ্য?
আমি কি দীর্ঘ দু যুগ ধরে সংসার করা তোমার অভ্যেসের জিনিস!

ঘন কুয়াশার দিকে বুঝে না বুঝে দৌড়ে যাচ্ছে! তুমি
তোমার সন্ধেবেলার মুখকে প্রতিদিনই খুব নতুন নতুন লাগে,
তোমার মুখের মতো মুখ, অথচ ঠিক তোমার নয়।
তোমাকে স্পর্শ করি, অথচ ঠিক তোমাকে নয়।

ছটফট করা একটি মন বুকে না কোথায় বসে থাকতো,
তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে কোথায় কোন অরণ্যে নিয়ে গেছো, অরণ্য!
তুমি এখন অনেকটা এলেও যা না এলেও তা-এর মতো,
অনর্গল বকো বা অন্যমন বসে থাকো, একই।
শ্যাওলা ফেলে ফেলে চোখদুটো এমন করেছো যে আর পড়তে পারি
না।
তুমি কি চাইছো না পড়ি!
একটু একটু করে মরে যাবে ভেবেছো বলেই কি তুমি মরে যাচ্ছে! !
একটু একটু করে আমাকে মারবে বলেই কি তুমি মরছো, অরণ্য?

৭.
তুমি চলে যাও, পেছন পেছন আমিও যাই
যে আমিটি হাসি খেলি আনন্দ করি,
সাঁতরে সাঁতরে ওইপার যাই,
যে আমিটি হাত পা ছুঁড়ে সকালসন্ধে কাঁদি।
একটা পাথর-মতো কিছু পড়ে থাকে ঘরে,
কুণ্ডুলি পাকিয়ে অন্ধকার পড়ে থাকে,
সারা গায়ে যার স্যাঁতস্যাঁতে শ্বেতি।
একটা আমি পড়ে থাকি বোধবুদ্ধিহীন আমি,
একটা মেয়েমানুষ পড়ে থাকে
সাড়ে ছ হাজার বছর বয়স।

মুঠোর ভেতর আকাশ যে নিয়ে যাও
পেছন ফিরে কি দেখেছো কী থাকে?
তোমার না-থাকা জুড়ে কতটা শ্বাসকষ্ট,
ক জোড়া মৃত্যু থাকে!

রাতে রাতে তুমি কার কাছে যাও অরণ্য!
কে তোমাকে কী আমার চেয়ে বেশি দেয়?

এত টইটম্বুর তুমি, এত কানায় কানায় ভরে রাখি,
কোথাও কি নিজেকে দিতে যাও তাই!
ঢেলে দিয়ে খালি হাতে ফিরবে বলে একদিন, উদাসীন!
তোমার চলে যাওয়ার আস্তিন ধরে হেঁচকা
টেনেও কখনও এক সুতো নাড়াতে পারিনি,
তুমি নড়ো না কেন অরণ্য,
ছলকে পড়লে যদি তোমার এক ফোঁটা কিছু আবার পেয়ে যাই আমি!

আমাকে না দিতে চাও, না দাও,
যাকে দাও, ভালোবেসে দাও।
পারো তো ভালোবাসা শেখো অরণ্য,
স্বরেঅস্বরেআ শিখে নিয়ে দ্রুত যুক্তাক্ষর ধরো।
এইটুকু অন্তত আমার সান্ত্বনা হোক—
যাকে ভালোবাসি, সে কোনও ইট কাঠ নয়, সে মানুষ।
যাকে ভালোবাসি সে নিরেট কোনও স্বপ্ন নয়, সে রক্তমাংস।
ভালোবাসতে সেও কাউকে জানে, আমাকে না হোক।
সুনামি মাথায় করে কারও কাছে যেতে জানে,
কাউকে সে মুঠো খুলে আকাশ দিতে জানে।
সেও নিবিড় করে উষ্ণ হাত রাখে কারও হাতে,
সে হাত আমার নয়, না হোক।

অরণ্য, যাকে জীবন দিচ্ছে!, তাকে ভালোবেসেই দাও।
এভাবেই না হয় তুমি যোগ্য হয়ে ওঠো আমার প্রেমের।

৮.
একদিন আমারও ইচ্ছে করে যাই, অন্য অঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়াই,
একদিন আমিও আর পেছন না তাকাই।
দেখে নিও অরণ্য, তোমার ওই আদিখ্যেতার
আলিঙ্গণ থেকে হঠাৎই উঠে যাবো, শর্তে ঠাসা দুপুরগুলো দুহাতে ভেঙে
কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নেবো প্রণয়ের প্রতিটি প্রহর,
দুআনার বিনিময়ে তখন দুআনাই পাবে।

অন্যকে ফাঁকি দিয়ে একদিন আমার কাছে আসতে অরণ্য,
আমাকে ফাঁকি দিয়ে এখন অন্যের কাছে যাও,
তুমি কিন্তু তুমিই আছো। খেয়াঘাটে ডিঙিনৌকো ঠিকঠিক বাঁধা।
ফাঁকি দিতে জানলে আমি ফাঁকিই দিতাম,
জানি না বলেই দেখিয়ে দেখিয়ে অন্য কারওর হাত ধরে হেঁটে যাবো
যতদূর খুশি, দেখিয়ে দেখিয়ে সমুদ্রে স্নান করবো, দেখিয়ে দেখিয়ে
অনেক কিছু….
কিছু তো কোনওদিনই আমাকে দিলে না অরণ্য,
একটি দিনই না হয় দাও, যে দিনটি পিঠে আঙুল ছোঁয়ালেই
ঘুমের ঘোমটা তুলে খুলবো দুচোখ, শিশিরের মতো
ঝরতে থাকা সোনারং সকাল জুড়ে দেখবো অরণ্য নামে কেউ নেই
ও নামে কোনওদিন কেউ ছিল না কোথাও
বিছানা জুড়ে এলোমেলো শুয়ে আছে নতুন যুবক!

৯.
যুবকেরা শয্যাশঙ্গী হবে, হোক। হৈ হৈ করে মিলনে মিথুনে
বারো বছরের মতো দীর্ঘ এক একটি রাত্তির দেবে
দিক, ভালোবাসা নৈব নৈব চ।

ভালো আমি কাউকে আর বাসছি না অরণ্য।
বাসলেই আমার রাষিনদিন ছিটকে পড়বে মহাশূন্যে
বাসলেই আমি উন্মাদের মতো জপ করবো কেবল তার,
মস্তিষ্কের আর মেদমাংসের আর অস্থিমজ্জার নির্যাস নিংড়ে নিয়ে
নিজেকে নিঃশেষ করে
কেবলই তার পাষেন আমি গড়িয়ে পড়তে থাকবো।
বাসলেই বুকের ভেতর খাঁচা নাকি খোলা উঠোন
সব পুড়তে থাকবে, থাকবেই
যতক্ষণ না শেষবিন্দু রক্ত শুকিয়ে হৃদপিণ্ড অচল হয়।
যাকে ভালোবসি, তাকে, এমনই বদঅভ্যেস, আস্ত একটা জগত করে
ফেলি
জগত ক্রমশ বড় হতে হতে মাটি ফুঁড়ে উলঙ্গ উঠে আসে,
উদ্বাহু উল্লাসে হৈ রৈ করতে করতে
আমাকেই মুঠোয় নিয়ে শেষে চটকায়, পেষে।

ভালোবাসা মানেই আমার মরণ নিশ্চিত,
এ আর তোমার চেয়ে বেশি কে জানে অরণ্য!

১০.
দরজায় শব্দ হচ্ছে না, তবু সারাক্ষণই মনে হচ্ছে হচ্ছে,
আসোনি, তারপরও বিশ্বাস হতে চায় না যে সত্যিই তুমি আসোনি
অরণ্য।

১১.
লোকে করছে করুক, কত আর করবে কানাকানি
কেন ছাড়াছাড়ি, সে তুমি জানো আর আমি জানি।
দুজনে ছিলাম জড়িয়ে ছিলাম যে কদিনই ছিলাম,
ভ্রুক্ষেপ করিনি কিছু, কোনও দুর্নামও।
একটি সত্য মানো—
ভালো যা বাসার আমিই বেসেছি,
তুমি একটুও বাসোনি।
রইছো কোথাও রবি থেকে শনি,
চেনো ও-পাড়ার ডজন কয়েক যোনি।
ভালো আমিই বেসেছি অরণ্য, তুমি কোনওদিনই বাসোনি।

ভ্রমণ তো কিছু কম করছো না,
আমার সাথেই নেই বনিবনা।
ঘোরো অলিগলি, এ পথেই শুধু হয়না তোমার পা ফেলা,
যেদিকে চাও, এ তো সত্যিই, সেদিকেই নেবে কাফেললা।
মানচিষেন তো প্রত্যেকে আছে, আমাকেই তুমি রাখোনি,
অন্য কোথাও পেয়ে গেছ ধন, যক্ষের ধন, হিরে মানিকের খনি!

ভালো-বাসার জন্য তো তুমি আসোনি,
ভালো বাসোনি বাসোনি, বাসোনি!
মিটে গেল। মিটে কি আর কিছু অত সহজেই যায়,
বুকের বাঁপাশ যন্ত্রণা তার দাঁতে নখে ছিড়ে খায়।
এখন পর্যন্ত কবিতাটি পড়া হয়েছে ৪২১ বার
যদি কবিতাটা সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
    মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন