সমরেশ-মজুমদারের-গল্প-গুচ্ছ-সমরেশের-সেরা-১০১-গল্প.

শিরোনাম: তিন পবিত্র আত্মা এবং চোরাপথে অপ্সরা

গল্পকার: Author Avatar সমরেশ মজুমদার

সরকারি হাসপাতাল হলেও ঘরে এককুচি নোংরা পড়ে নেই। বিছানাও ধবধবে। চিকিৎসকরাও ফাঁকি দেওয়া কাকে বলে জানেন না। নার্সরা নিবেদিতপ্রাণ সেবায়। এই রকম এক হাসপাতালের বড় কেবিনে তিনটি বিছানায় শুয়ে আছেন যে তিন জন মানুষ তাঁদের আজই আই সি ইউ থেকে বের করে আনা হয়েছে। তিনজনেরই স্যালাইন এবং অক্সিজেন চলছে। এঁদের বয়স পঁচাশি থেকে ছিয়াশির মধ্যে। কাকতালীয় ভাবে এঁদের একটি মিল আছে। প্রত্যেকের নামের আদ্যক্ষর হল ‘ম’। মতিন, মনোরঞ্জন এবং ম্যাকডোনাল্ড। চিকিৎসকরা খুবই চেষ্টা করছেন এঁদের সুস্থ করে তুলতে, কিন্তু তাঁরা জেনে গেছেন প্রকৃতির বিরুদ্ধে যে-কোনও লড়াই-এ মানুষ হার স্বীকার করতে বাধ্য। তবু আজ সকালে পরীক্ষার পর একটু আশার আলো দেখা পাওয়ায় তিন জনেরই অক্সিজেন মাস্ক খুলে দেওয়া হল। তিন জনেই হেসে বললেন, ‘ধন্যবাদ ডাক্তার’।

একটু বেলা হলে বালিশে হেলান দিয়ে মতিন বললেন, ‘ভাইরা, আমি মতিন। আল্লার অনুগত সেবক মাত্র। সারাজীবন কোরান মেনে চলেছি, আমার সতর্ক দৃষ্টি ছিল যেন কোনও মানুষকে আঘাত না দিই। এমনকী পশুদের ওপর অত্যাচার করতাম না। ডাক্তার যতই চেষ্টা করুন, আমার অন্তিম দিন এসে গিয়েছে। আজ আমি মানুষ হিসেবে শেষ নিশ্বাস ফেলব, আপনারা আমার জন্য প্রার্থনা করবেন।’

মতিন চুপ করলে ম্যাকডোনাল্ড বললেন, ‘আপনার সঙ্গ পেয়ে আমার খুব ভালো লাগছে। আমিও সারাজীবন বাইবেলের নির্দেশ মান্য করেছি। প্রতিবেশি তো বটেই, অচেনা মানুষকেও সাধ্যমত সাহায্য করেছি। হ্যাঁ, আমি এই জীবনে কোনও পাপ করিনি। বন্ধু, আমিও অনুভব করছি, আজই আমার শেষ দিন।’

মনোরঞ্জন একটু কেশে নিয়ে বললেন, ‘অদ্ভুত কাণ্ড! খুব ভোরে কেউ যেন আমায় বলল, আজই তোর শেষ দিন। তৈরি হয়ে থাক। আমিও তৈরি। এই পৃথিবীতে অনেক দিন বাঁচলাম। না, আপনাদের মতো কোরান বা বাইবেল আমাদের নেই। বেদ, উপনিষদ, গীতা সংস্কৃত ভাষায় লেখা হয়েছিল। বাংলাতেও পাওয়া যায়। কিন্তু ওগুলো পড়ে মনে হয়েছে, এ আমার জন্য নয়। শেষপর্যন্ত ঠিক করেছিলাম–ভালো কাজ কাকে বলে জানি না, কিন্তু কখনওই খারাপ কাজ করব না। আজ অবধি তাই মেনে চলেছি। রোজ রাত্রে ঘুমোবার সময় নিজেকে প্রশ্ন করেছি কোনও খারাপ কাজ করিনি তো?যদি মনে হত কোনও কাজে একটু ধন্দ আছে, তাহলে পরের দিনই ছুটে যেতাম সেই মানুষটার কাছে যাকে জড়িয়ে কাজটা করেছি। আন্তরিক ক্ষমা চেয়ে নিতাম। আর, এসব করেছি বলেই আজ, জীবনের শেষ দিনে আপনাদের সঙ্গ পেলাম। ভগবান!’

শেষ শব্দটি স্বগোতক্তির মতো উচ্চারিত হল। মতিন বললেন, ‘আমি আল্লাকে স্মরণ করি সবসময়। তিনি নিরাকার। এই ব্রহ্মাণ্ড তাঁরই সৃষ্টি। আপনার ভগবানের কোন সঠিক রূপ আপনি এই মুহূর্তে কল্পনা করবেন?’

মনোরঞ্জন বললেন, ‘ভগবানেরও কোনও রূপ নেই, তিনিও নিরাকার, আমরাও বলি এই জগৎ তাঁরই সৃষ্টি। তাঁর রূপ কল্পনা করা অসম্ভব।’

ম্যাকডোনাল্ড বললেন, ‘বাঃ, আমার গড-এরও কোনও অবয়ব নেই। তিনিও নিরাকার, এই জল স্থল-আকাশ তাঁরই সৃষ্টি। তিনি বলেছিলেন, ‘আলো জ্বলুক, তাই আলো জ্বলে উঠেছিল। কিন্তু বন্ধুগণ, গড কীরকম দেখতে তা কল্পনাই করতে পারি না। আমি বিশ্বাস করি, এই দেহ ত্যাগ করার পর তিনি নিশ্চয়ই আমাকে হেভেন-এ নিয়ে যাবেন। জানি না সেখানে তাঁকে দেখতে পাব কি না। তবে নিশ্চয়ই যিশু আর মাদারকে দেখতে পাব। আমি এখনই রোমাঞ্চিত বোধ করছি।’

মতিন বললেন, ‘আল্লা নিশ্চয়ই আমাকে বেহেশতে যাওয়ার অনুমতি দেবেন। সেখানে অনন্ত শান্তি স্থির হয়ে আছে। সমস্ত ধর্মপ্রাণ, যাঁরা পৃথিবীর মানুষের উপকার করে গিয়েছেন তাঁরা। কোরান পাঠ করছেন, নামাজ পড়ছেন, আল্লার দয়ায় শান্তিতে বিরাজ করছেন। আমি তাঁদের পেছনে যদি একটু জায়গা পাই তাহলে ধন্য হয়ে যাব।’

মনোরঞ্জন চুপচাপ শুনছিলেন। এবার শ্বাস ফেললেন। ম্যাকডোনাল্ড তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার অভিপ্রায় জানতে পারি কি?’

‘আপনারা পবিত্র মানুষ। সারাজীবন কত ভালো কাজ করে এসেছেন। আমি ভালো কাজ করেছি। কি না জানি না, কিন্তু কোনও খারাপ কাজ করিনি। শুধু এইটুকু সম্বল নিয়ে কেউ স্বর্গে যেতে পারে কি না তাও জানি না। ভগবান যা চাইবেন তাই হবে। স্বর্গে গিয়ে কী করব তা কল্পনা করতে তাই চাই না’, মনোরঞ্জন মাথা নাড়লেন।

ম্যাকডোনাল্ড বললেন, ‘আপনি কারও খারাপ করেননি এরচেয়ে ভালো কাজ আর কী হতে পারে। আপনার ভগবান নিশ্চয়ই আপনাকে স্বর্গে যাওয়ার অনুমতি দেবেন। আচ্ছা, আপনার স্বর্গের চেহারা কীরকম?

মনোরঞ্জন বললেন, ‘সাধু-সন্ন্যাসীদের মুখে শুনেছি, বই-এ পড়েছি স্বর্গ মানে অপার শান্তির জায়গা। সেখানে কোনও জাগতিক দু:খ কষ্ট নেই। সেখানকার ফুলের নাম পারিজাত। একশো আট জন দেব-দেবী সেখানে অবস্থান করেন। স্বর্গের রাজা ইন্দ্রের রাজসভায় অপরূপা অপ্সরীরা নৃত্যগীত করেন। এই স্বর্গ দখল করার জন্য অসুররা চেষ্টা করেছে, কিন্তু সক্ষম হয়নি।

মতিন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বন্ধু, আপনি বললেন না, স্বর্গে ধর্মালোচনা হয় কি না। সেখানে আপনাদের ভগবান থাকেন কি না।’

‘এই ব্যাপারটা আমি ঠিক জানি না। পুরাণ বা অন্য বইতে যা পড়েছি তাতে দেখেছি দেবতারা ধর্ম নিয়ে তেমন মাথা ঘামাননি। আমার অনুমান তাঁরা সংস্কৃত কথা বলেন, আমি আবার সংস্কৃত

জানি না। যদি সেখানে যাই তাহলে ভাষার সমস্যা হবে। তবে নিশ্চয়ই ইনটারপ্রেটার পাব। থাকতে-থাকতে শিখেও নিতে পারব ভাষাটা। সংস্কৃতকে দেবভাষা বলে এই কারণে। ওখানে গেলে দেবতাদের দেখা পাবই। কিন্তু ভগবান তো জগৎ সৃষ্টি করেছেন। নরক-মর্ত-স্বর্গ নিয়ে। জগৎ। তা ছাড়া মহাকাশে অনেক গ্রহ-নক্ষত্র আছে। সবই তাঁকে দেখতে হয়। শুধু স্বর্গে থাকলে তাঁর পক্ষে সামাল দেওয়া সম্ভব নয়।’

ম্যাকডোনাল্ড বললেন, ‘একই সমস্যা আমাদের গড-এর। তিনিও হেভেন-এ থাকতে পারেন না। যিশু, সেন্টরা, ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টানরা তাঁর মহান সান্নিধ্য পেয়ে প্রতি মুহূর্তে আনন্দিত। আপনাদের স্বর্গে দেবতারা বিবাহিত বলে দেবীরা আছেন, কিন্তু অপ্সরা কেন? তাঁরা তো কোর্ট ড্যান্সার।’

মনোরঞ্জন বললেন, ‘ওঁরা আছেন যাতে দেবতারা বিনোদিত হন। তাঁদের আনন্দ দেওয়ার জন্যই ওঁরা নৃত্যগীত করেন।’

‘কিন্তু কোনও কারণে ওঁরা যদি সমস্যা তৈরি করেন?

‘না। এ ব্যাপারে ওঁরা খুব সতর্ক। তবে মন দুর্বল হলে ওঁরা লুকিয়ে-চুরিয়ে পৃথিবীতে যে আসেননি তা নয়। এসে কেউ-কেউ মা হয়েছেন, কিন্তু সন্তানকে জন্ম দিয়েই ফিরে গেছেন স্বর্গে। তবে ধরাও পড়েছেন কেউ-কেউ। তখন শাস্তি হয়েছে। মর্তে থাকতে হয়েছে হাজার বছর। কিন্তু যেহেতু ওঁদের বয়স বাড়ে না, রূপ একই থাকে, তাই মর্তের স্বামী মারা যাওয়ার পর ছেলের বয়সিরা যুবক হয়েই তাঁদের প্রেম নিবেদন করত। অনেক কান্নাকাটির পর তাঁরা শাপমুক্ত। হয়েছেন। অবশ্য এসব বহু কাল আগের ঘটনা। ইদানীং পৃথিবীতে সুন্দরী মেয়েদের সংখ্যা এত বেড়ে গেছে যে ওঁরা হালে পানি পাবেন না জেনে আর স্বর্গ ছেড়ে আসেন না।’

মতিন বললেন, ‘যাই বলুন, এই অপ্সরাদের ব্যাপারটা আমার ভালো লাগছে না।’

ম্যাকডোনাল্ড বললেন, ‘হেভেনেও ওঁরা নেই। শুধু মাদারই হলেন একমাত্র মহিলা।’

মনোরঞ্জন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বেহেশতের মহিলারা কি সবসময় ধর্ম পাঠ করেন?

মতিন হাসলেন, ‘আপনি কোনও খারাপ কাজ করেননি ঠিকই, তবে ভালো কাজ যে করেননি তা বুঝতে পারছি। আপনার প্রতিবেশীর ধর্ম সম্পর্কে তাই উদাসীন। বেহেশতে নারী বলতে আছেন হুরিরা। তাঁরা সেবিকা। সেবাই তাঁদের কাজ!’

‘সর্বনাশ!’ মনোরঞ্জনের মুখ থেকে বেরিয়ে এল শব্দটা।

‘তার মানে?’ মতিন তাকালেন।

‘ওখানে আনন্দিত হওয়ার কোনও উপাদান নেই বলে মনে হচ্ছে?’

‘বন্ধু, আনন্দিত হওয়া বলতে আপনি কী বোঝেন জানি না। আল্লার আশীর্বাদে যে আনন্দ, তা। আর কিছুতেই পাওয়া সম্ভব নয়। তাই সর্বনাশ নয়, সর্বময় বলুন। এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্যে যে সব সমস্যার মুখোমুখি আমাদের হতে হয়, তা থেকে মুক্ত হয়ে যাব বেহেশতে গেলে। তখন আরও নিবিড় করে নিজেকে আল্লার কাছে সমর্পণ করতে পারব। সেটাই তো প্রকৃত আনন্দ।’ মতিন চোখ বন্ধ করলেন।

ম্যাকডোনাল্ড বললেন, ‘ঠিক কথা। আপনাদের ওই অপ্সরাদের নৃতগীত ব্যাপারটা আমার ভালো লাগছে না। শুনেছি যেখানেই ওসব হয় সেখানেই গোলমাল ঘটে যায়। এইজন্য কোনও-কোনও। হাইকোর্ট বারড্যান্সারদের নাচ বাতিল করে দিয়েছেন। অবশ্য এ আপনাদের ব্যাপার।’

মনোরঞ্জন চুপ করে গেলেন। তিনি কোনও খারাপ কাজ করবেন না তাই কোনও খারাপ কথাও বলতে পারেন না।

সেদিন বিকেল পাঁচটা তিন মিনিটে ম্যাকডোনাল্ডের শরীর সাদা কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হল। মতিন বা মনোরঞ্জন দৃশ্যটি দেখতে পেলেন না, কারণ তখন তাঁরা সংজ্ঞাহীন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তাঁদের শরীরের অবস্থা এক হয়ে গেল। চিকিৎসকরা বললেন, তিনজন মানুষ প্রায় একই। সময়ে একই ঘরে মারা গেলেন, এটা কাকতালীয় হলেও এই হাসপাতালের রেকর্ড হয়ে রইল।

তিনজনের আত্মা আগুপিছু পৃথিবী ছেড়ে ঊর্ধ্বলোকে উঠে যেতে লাগল। যেতে-যেতে তাঁরা অনেক স্তর দেখতে পেলেন। বিভিন্ন সেই স্তরে অনেক আত্মা কাতর হয়ে রয়েছেন প্রতীক্ষায়। তাঁদের আবার পৃথিবীতে গিয়ে জন্মাতে হবে। কবে কখন কোনও মায়ের গর্ভে জন্মাবেন তা

জানেন না। কিন্তু এই তিন আত্মাকে কেউ থামাল না। সব স্তর অতিক্রম করে যখন তাঁরা স্থির হলেন তখন মতিন বললেন, ‘বন্ধুরা, এবার আমাকে যেতে হবে।’

ম্যাকডোনাল্ড জিজ্ঞাসা করলেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি বেহেশতে যাচ্ছেন?

‘সেখানে যাওয়ার যোগ্যতা আছে কি না সেটা জানা যাবে একটা পরীক্ষার পর। একটা সরু পুলের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে হবে। যদি আমি অযোগ্য হই তাহলে পুলের নিচে পড়ে যাব, জায়গা হবে দোজখে। আচ্ছা, আদাব।’

মতিনের আত্মা সেই পুলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। আল্লাকে স্মরণ করে তিনি ধীরে-ধীরে পুল পার হয়ে আসতে-আসতে আজানের মধুর ধ্বনি শুনতে পেলেন।

ম্যাকডোনাল্ডকে হেভেন-এ প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হল। বলা হল, এখন থেকে তুমি শুধু। একটি সমর্পিত প্রাণ যার স্ত্রী বা পুরুষ পরিচয় নেই। পৃথিবীর সেন্ট অ্যাগনেশ বা জোয়ান অব আর্ক এখানে রসাস্বাদন করেন ওই সমর্পিত প্রাণ হিসেবেই। ম্যাকডোনাল্ড বিড়বিড় করলেন, তাহলে আমি যে জানতাম হেভেন-এ মাদার ছাড়া কোনও মহিলা নেই, সেটা ভুল? উত্তরে। জানলেন, অনেক মহিলা সেন্ট তাঁদের অর্জিত পুণ্যের জন্য হেভেন-এ এসেছেন। অনেক ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টবিশ্বাসিনী হেভেন-এ এসেছেন যোগ্যতা দেখিয়ে। কিন্তু আসার পর কেউ পৃথিবীর পরিচয়ে নারী বা পুরুষ নন, তাঁরা সবাই এক। ম্যাকডোনাল্ডের ধন্দ তবু যাচ্ছিল না। তবে যে পড়েছি। হেভেন-এ সাধুরাই থাকেন। সাধ্বীদের কথা কোথাও লেখা হয়নি। উত্তরে বুঝলেন, প্রেসিডেন্ট, প্রাইম মিনিস্টার-এর মতো সাধু শব্দটি লিঙ্গমুক্ত পবিত্র আত্মার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত। ম্যাকডোনাল্ড নত মস্তকে হেভেন-এ প্রবেশ করলেন।

স্বর্গের দরজায় পৌঁছলে মনোরঞ্জনকে চিত্রগুপ্তের সামনে নিয়ে যাওয়া হল। নাম-ধাম জানার পর। চিত্রগুপ্তের সহকারি কম্পিউটারের বোতাম টিপলেন। আগত আত্মা পৃথিবীতে কী-কী ভালো কাজ

করেছেন তার তালিকা দিতে পারল না কম্পিউটার। উলটে জানিয়ে দিল, কোনও ভালো কাজ করেনি। এরকম আত্মাকে সোজা নরকে চালান দেওয়াই নিয়ম। কিন্তু কোন নরকে পাঠানো হবে জানতে খারাপ কাজের তালিকা জানতে চাইলেন চিত্রগুপ্ত। আশ্চর্য হয়ে জানালেন, মর্তে থাকার সময় এই আত্মা একটিও খারাপ কাজ করেনি।

মনোরঞ্জনকে নিয়ে গভীর সমস্যায় পড়লেন তিনি। যে খারাপ কাজ করেনি তাকে তোনরকে পাঠানো যায় না। আবার পুণ্য অর্জন না করে এলে স্বর্গে ঢুকতে দেন কী করে। এই আত্মা যখন সব স্তর পেরিয়ে এসেছে তখন তা আবার জন্মানোর জন্য পৃথিবীতে পাঠানো যায় না।

এইসময় কম্পিউটার ঘোষণা করল, স্বর্গে আপাতত কোনও নবাগতের জায়গা নেই। স্বর্গ তৈরি হওয়ার পর তার আয়তন বাড়েনি। ফলে স্বর্গে এখন প্রচণ্ড স্থানাভাব দেখা দিয়েছে। চিত্রগুপ্ত স্বস্তি। পেলেন। বললেন, ‘তোমাকে কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে। যখন কোনও প্রাচীন পুণ্যাত্মা মহাকাশে বিলীন হয়ে স্বর্গে নতুন জায়গা তৈরি করে দেবেন তখনই তুমি স্বর্গে প্রবেশ করতে পারবে।’

‘তাহলে আমি এখন কোথায় যাব?’ হকচকিয়ে গেলেন মনোরঞ্জনের আত্মা।

‘স্বর্গের চারপাশে ঘুরে বেড়াও।’

‘কিছু মনে করবেন না, এরকম কি প্রায়ই হয়?’

‘হয়। তবে খুব কম। আশঙ্কা হচ্ছে, এবার ঘন-ঘন হবে।‘

‘একটা কথা, আপনি সংস্কৃত না বলে বাংলা বলছেন কেন?

‘হিন্দুরা যতগুলো ভাষায় কথা বলে তার সবগুলোই আমি বলতে পারি। কিন্তু ভেতরে ঢুকলেই সংস্কৃত ছাড়া অন্য ভাষা বলা নিষেধ।‘

মনোরঞ্জন বিষণ্ণ হলেন। এত দূরে এসেও তাঁকে অপেক্ষা করতে হবে। একবার বেড়াতে গিয়ে শুনেছিলেন যে ঘর তাঁর নামে বুক করা আছে সেখানে আগের অতিথি এখনও আছেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই চেক আউট করবেন। মনোরঞ্জনকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল। অবশ্য তারজন্য একটুও রাগ করেননি।

আজও করতেন না। দেখলেন আকাশছোঁয়া প্রাচীর দিয়ে ঘেরা আছে স্বর্গরাজ্য। ভেতরে কী হচ্ছে দেখতে পাচ্ছেন না। স্বর্গাশ্রিত আত্মারা এই প্রাচীরের বাইরে কখনওই আসেন না। হঠাৎ তাঁর কানে সুমধুর সঙ্গীত ভেসে এল। ভক্তিগীতি। কে গাইছেন? রম্ভা না মেনকা? নিশ্চয়ই মেনকা। অল্প বয়সে বিশ্বামিত্র নামে একটি ফিল্ম দেখেছিলেন তিনি। সেখানে মেনকার গলায়। এই গানটি ছিল। গান শেষ হলে নূপুরের আওয়াজ কানে এল। এই প্রাচীরের কাছাকাছি বোধহয় ইন্দ্রের সভা।

মনোরঞ্জন হাঁটছিলেন কিন্তু তাঁর আত্মা ভেসে যাচ্ছিল। স্বর্গের প্রাচীর শেষ হওয়ার পর তিনি আর একটি প্রাচীর দেখতে পেলেন। সেই প্রাচীরের ভেতর থেকে ভয়ঙ্কর আর্তনাদ ভেসে আসছে। অর্থাৎ ওটি নরক। স্বর্গের এত কাছাকাছি নরকের অবস্থান জানা ছিল না মনোরঞ্জনের। ওদিকে যাওয়াই ভালো ভেবে ফিরে আসছিলেন তিনি, হঠাৎ চোখে পড়ল, নরকের প্রাচীরের নিচটা নড়ছে। কৌতূহলী হয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই দেখতে পেলেন প্রাচীরের নিচে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে

বেরিয়ে এল চারটি কালো আত্ম। বেরিয়েই তারা ছুটে গেল স্বর্গের প্রাচীরের দিকে। একজন বলল, ‘এইখানে খোঁড়, গতবার এখানেই সুড়ঙ্গ খুঁড়েছিলাম।’

মনোরঞ্জন এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনারা কারা?

লোকগুলো একটু ঘাবড়ে গেল, ‘তুমি কে হে?’

‘আমি নবাগত। স্বর্গে যাব। স্থানাভাব বলে অপেক্ষা করছি।’

একজন আর একজনকে বলল, ‘নতুন এসেছে, ঠিক চুকলি কাটবে। এখনই তড়পে দে, নইলে বিপদ হবে।’

সঙ্গে-সঙ্গে একজন এগিয়ে এল, ‘যা দেখছ, তা কাউকে বললে মুণ্ডু ছিঁড়ে আমাদের ওখানে নিয়ে যাব। বুঝলে?’

‘ঠিক আছে। কিন্তু কী করছ তোমরা?’

‘আজ আমাদের ওখানে এ্যানুয়াল ফাংশন। এখানে সুড়ঙ্গ কাটব। ওই সুড়ঙ্গ দিয়ে বেরিয়ে এসে আমাদের সুড়ঙ্গ দিয়ে নরকে ঢুকে সেই ফাংশন মাতাবে অপ্সরারা। বোম্বাই নাচ, ব্যান্ডের গান। সব করবে ওরা। শেষে মুক্তবস্ত্র হবে। তারপর রাত শেষ হওয়ার আগেই যেমন এসেছিল তেমন। সুড়ঙ্গে-সুড়ঙ্গে ফিরে যাবে স্বর্গে। তখন সুড়ঙ্গ এমন ভাবে বুজিয়ে দেব যে, ভগবান টের পাবে না। হ্যাঁ হ্যাঁ।’

কিন্তু অপ্সরা আসবেন কেন?’

‘ওইসব ভক্তিগীতি গেয়ে কারও মন ভরে? খ্যামটা চাই খ্যামটা। হট ব্যাপার।’

‘তা তোমরাও তো ওই সুড়ঙ্গ দিয়ে স্বর্গে ঢুকে যেতে পার।

‘পাগল। চরিত্র বলে কিছু থাকবে না ওখানে গেলে। ভদ্দরলোকে যায়। ছ্যা।’

তিনটে কালো আত্মা মহানন্দে স্বর্গে ঢোকার সুড়ঙ্গ খুঁড়ছে। মনোরঞ্জনের মনে হল, স্বর্গে বি এস এফ নেই। অবশ্য থাকলেই বা কী? রোজ তো লোকে সীমান্ত পেরোচ্ছে। কিন্তু অপ্সরাদের রুচি এত নেমে গেছে! না। ভুলেও ইন্দ্রসভায় যাবেন না মনোরঞ্জন।

এখন পর্যন্ত গল্পটি পড়া হয়েছে ৬০ বার
যদি গল্পটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
    মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন