অস্বস্তি শুরু হয়েছিল দিন পাঁচেক আগে। তখন কলকাতা শহর রাত জাগছে। বিশ্বকাপের খেলা শুরু হয় মাঝরাতে, শেষ হবে আড়াইটে। বাসুদেব রাত জাগতে পারে না। ফলে এগারোটার মধ্যেই টিভি বন্ধ করে শুয়ে পড়ে সে। সি আই টি রোডের দোতলায় দু-ঘরের ফ্ল্যাটের কোথাও এক ফোঁটা ধুলো নেই, সবকিছুর মধ্যে যত্নের ছাপ স্পষ্ট। সকালে মতির মা এসে যাবতীয় কাজ এবং রান্না সেরে যায়। তাই খেয়ে বাসন ধুয়ে অফিসে যায় বাসুদেব। সন্ধেবেলায় বাজার করে নিয়ে এসে ফ্রিজে ঢোকায়। রাত সাড়ে ন’টায় ফ্রিজ থেকে সকালের রান্না বের করে ঢুকিয়ে দেয় মাইক্রোতে। দশটার মধ্যে খাওয়া শেষ। তারপর কিছুক্ষণ টিভির সামনে বসা। তাতেই ঘুম এসে যায়। তিনশো পঁয়ষট্টি দিনে মোটামুটি এই রুটিনের পরিবর্তন হয় না।
সাতদিন আগে প্রবল চিঙ্কারে ঘুম ভেঙে গেল। চমকে উঠে বসল বাসুদেব। লোকগুলো। পাগলের মতো চেঁচাচ্ছে। বাসুদেব জানলায় এল। রাস্তার উলটোদিকে টিভি বসিয়ে এতক্ষণ। খেলা দেখছিল যারা তারা প্রিয় দলের সাফল্যে নৃত্য করছে। খুব বিরক্ত হল বাসুদেব। কোথায় জার্মানিতে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা হচ্ছে আর কলকাতার পাগলগুলো তাই দেখে নৃত্য করছে। ব্রাজিল দেশটা কোথায় তা জিজ্ঞাসা করলে নব্বইভাগ লোক ঠিকঠাক বলতে পারবে কিনা সন্দেহ।
ঘুম চলে গিয়েছিল। টিভি খুলে খুব বিরক্তিকর কোনও প্রোগ্রাম দেখলে যদি ঘুম আসে এই আশায় রিমোট টিপে চ্যানেল ঘোরাতে লাগল। খেলা ছিল তাই ওরা টিভি দেখছিল নইলে এই রাত্রে এত প্রোগ্রাম হচ্ছে, কারা দ্যাখে। হঠাৎ একটা হিন্দি সিরিয়ালে আটকে গেল সে। নির্জন পাহাড়ে একজন সাধক সাধনা করছেন। তাঁর সাধনা ভঙ্গ করতে ঝড়-বৃষ্টি, বিদ্যুৎ প্রবলভাবে শুরু হল। সাধক তবু অবিচল। হঠাৎ সব শান্ত হয়ে গেল। তখন আকাশবাণী হল, ‘হে সাধক, তোমার নিষ্ঠা দেখে আমি অত্যন্ত প্রীত। কিন্তু তা সত্বেও আমি তোমার অভিষ্ট বরদানে অক্ষম।’
সাধক হাতজোড় করল। আমার অপরাধ কী পরমাবতার?
‘নিজেকে যাচাই কর। এই জীবনে তুমি যদি একটি ক্ষুদ্র অন্যায় করে থাক তাহলে তার প্রায়শ্চিত্ত না করা পর্যন্ত তুমি সাধনায় সিদ্ধি পাবে না।’ আকাশবাণী হওয়া মাত্র সাধক ষাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন। সঙ্গে-সঙ্গে বিজ্ঞাপন শুরু হয়ে গেল।
বাসুদেব টিভি বন্ধ করে বিছানায় এল। হঠাৎ তার মনে হল এই পঞ্চাশ বছরের জীবনে সে নিজে কী-কী অন্যায় করেছে?আজ পর্যন্ত জ্ঞানত সে কোনও অন্যায় করেনি। একটিও মিথ্যে কথা বলেনি। এই মিথ্যা না বলার জন্য অনেকবার বিপদে পড়তে হয়েছে তাকে। ক্লাসের বন্ধুরা তো বটেই, মাস্টাররাও তাকে যুধিষ্ঠির বলে ডাকত। সেভেনে ওঠার পর সে বন্ধুসঙ্গ ত্যাগ করেছিল। সেই বয়স থেকে ওরা অশ্লীল কথা বলতে আরম্ভ করেছিল, সিগারেট খাওয়া ধরেছিল। মাধ্যমিক পাশ করেই বাবা তাকে কলকাতায় কলেজে ভরতি করেন। হোস্টেলে থাকতে হত। কিন্তু সেখানে সে কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব করেনি। প্রথম দিনেই সে বুঝে নিয়েছিল অবসর সময়ে ওদের একমাত্র কাজ মেয়েদের নিয়ে আলোচনা।
পরবর্তীকালে চাকরি জীবনেও সে কারও বন্ধু হতে পারল না। তার সহকর্মীরাও তাকে এড়িয়ে যায়। সে ঘুষ নেয় না। সন্ধের পরে বারে গিয়ে ওদের সঙ্গে মদ খায় না। বিবাহিত সহকর্মীরা। ট্যুরে যাচ্ছি বলে বাইরের মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি করতে দীঘায় যায়। এগুলো মেনে নিতে পারে বাসুদেব। হোস্টেলের জীবন থেকে একা থাকতে অভ্যস্ত হওয়ায় আজকের একাকিত্ব তার। কাছে আদৌ বড় হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এই জীবনে সে কি কোনও অন্যায় করেনি? অনেক চেষ্টা করেও মনে পড়ল না তার। তাই বাকি রাত জেগেই কাটিয়ে দিল বাসুদেব।
তারপর আর রাত নয়, দিনের বেলায় কাজ না থাকলে ওই ভাবনাটা তাকে ছোবল মারে। পরিচিত মুখগুলোকে সে মনে করতে চেষ্টা করে। বাবাকে সে একটি বারের জন্যেও অশ্রদ্ধা করেনি। বেশি বয়সে তাঁর সঙ্গে সহমত না হলেও তাঁকে অবজ্ঞা করেনি। মা মারা গিয়েছেন বছর দশেক হল, বাবার মৃত্যুর দু-বছর পরে। মায়ের জীবদ্দশায় প্রত্যেক সপ্তাহে সে সিউড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করে এসেছে।
এই অবধি ভাবতেই একটা অস্বস্তি মনে এল। মায়ের শেষ ইচ্ছেটা সে পূর্ণ করতে পারেনি। এটা কি অন্যায়? মা নিশ্চয়ই দু:খ পেয়েছিলেন কিন্তু। তখন তার বয়স প্রায় চল্লিশ। ওই বয়সে তো বটেই দীর্ঘকাল ধরে নিজের মনকে তৈরি করে ফেলেছিল বাসুদেব। তাই মাকে অনেক বুঝিয়েছিল সে। শেষ পর্যন্ত মা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
এখন একটু-একটু করে বাসুদেবের মনে হচ্ছিল সে অন্যায় করেছে। সন্তান হয়ে মাকে কষ্ট দেওয়া অবশ্যই অন্যায় কাজ। তখন সরাসরি মাকে না বলে অশ্বত্থামা হত ইতি গজ বললেও কি লাভ হত? মা সান্ত্বনা পেত হয়তো কিন্তু এই ঘুরিয়ে মিথ্যে বলার জন্যে যুধিষ্ঠিরও তো নিস্কৃতি পাননি।
সিউড়িতে তাদের তিনটি বাড়ির পরে থাকতেন কমলামাসিরা। ওঁর স্বামী সিউড়ি কোর্টের উকিল ছিলেন। কমলামাসি আর মা ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। রোজ বিকেলে দুজনে একসঙ্গে লাইব্রেরিতে। যেতেন বই আনতে। যেহেতু বাসুদেব কারও সঙ্গে মিশত না, তাই কমলামাসিদের বাড়িতে তার যাতায়াত ছিল না। কিন্তু কমলামাসির মেয়ে অদিতি তাদের বাড়িতে আসত। মায়ের সঙ্গে গল্প। করত। অদিতি রীতিমতো সুন্দরী। তাকে নিয়েও বাসুদেবের সহপাঠীরা রসালাপ করত যেটা খুব খারাপ লাগত বাসুদেবের। বন্ধুদের সে যেমন এড়িয়ে যেত তেমনি অদিতির মুখোমুখি হতে। চাইত না। অদিতিরও যে তার সঙ্গে কথা বলার কোনও ইচ্ছে আছে তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
বাসুদেব যখন বি . এ . পাশ করে কলকাতায় পড়তে আসবে তখন মা কথাটা বললেন। কমলামাসি আর তাঁর বাসনা বাসুদেব চাকরি পেলে অদিতির সঙ্গে বিয়ে দেবেন। লজ্জা পেয়েছিল। বাসুদেব। প্রতিবাদ করেনি কারণ মায়ের ইচ্ছে তার কাছে আদেশ। যেদিন তার কলকাতায় পড়তে যাওয়ার কথা সেদিন অদিতি চলে এল তার ঘরে। তখন মা গিয়েছেন কমলামাসির সঙ্গে লাইব্রেরিতে। ঘরে ঢুকে অদিতি বেশ রাগত গলায় বলল, ‘শোনো, তুমি যদি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হও তাহলে আমি গলায় দড়ি দেব।’
হকচকিয়ে গিয়েছিল বাসুদেব, ‘মানে?
‘তোমাকে আমার মা পছন্দ করেছে বলে উল্লসিত হওয়ার কোনও কারণ নেই।’
‘আমি তো উল্লসিত হইনি।’
‘ও। তাহলে ভালো কথা। যা বললাম তা মনে থাকবে?’
‘কিন্তু–।’
‘কোনও কিন্তু নয়। আমি আর একজনকে পছন্দ করেছি।’
‘ও।’
‘মা তাকে জানে। তার কুষ্ঠি বিচার করিয়ে জেনেছে সে নাকি বিয়ের দশ বছরের মধ্যে মারা যাবে। যত্ত বাজে কথা। সঙ্গে-সঙ্গে তাকে নাকচ করে আমাকে এ-বাড়ির বউ করে পাঠাতে চাইছে।’
‘আমায় কী করতে হবে।’
‘এড়িয়ে যাবে। বিয়ের কথা উঠলেই সময় নেবে। দু-বছর কাটাতে পারলেই ও চাকরি পেয়ে যাবে। মা রাজি না হলে আমরা সই করে বিয়ে করব। যদি মাতৃভক্ত রামচন্দ্র হও তাহলে আমার মরামুখ দেখবে। কানে ঢুকছে?
‘হ্যাঁ।’ মাথা নেড়েছিল বাসুদেব।
সঙ্গে-সঙ্গে হাতের পার্স খুলে পাঁচটাদশ টাকার নোট অদিতি টেবিলের ওপর রেখে বলল, ‘এই নাও।’
‘একী! টাকা দিচ্ছ কেন?’
‘শুধু কথায় তো চিঁড়ে ভেজে না। টাকা নিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করলে নরকেও জায়গা হবে না। টাকা দিলে তবে চুক্তির দাম হয়। চলি।’
কথাগুলো গিলে ফেলতে অসুবিধে হয়নি কিন্তু টাকাগুলো নিয়ে খুব বিব্রত হয়েছিল বাসুদেব। ফিরিয়ে দিতে গেলে যে অদিতি নেবে না তাতে তার সন্দেহ ছিল না। একটা খামে টাকাগুলোকে ভরে রেখে দিয়েছিল আলমারিতে।
যখন পাশ-টাশ করে চাকরি পেয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেল তখন তিনি খুশি হয়ে কমলামাসিকে বিয়ের প্রস্তাব নতুন করে দিলেন। তারপর ঝড় শুরু হল। শেষপর্যন্ত কমলামাসি এসে মায়ের কাছে খুব কাঁদলেন। মেয়ে নাকি ইতিমধ্যে তার পছন্দের ছেলের সঙ্গে রেজিস্ট্রি বিয়ে করে বসে আছে গোপনে। মা চুপ করে থাকলেন।
বাসুদেবের যখন ঊনত্রিশ বছর বয়স তখন থেকে মা তার বিয়ের উদ্যোগ নিতে চাইলেন। কিন্তু প্রতিবারই বাসুদেব তাঁকে নিরস্ত্র করেছে। বলেছে সে সংসারি হতে চায় না। মা-বাবা যতদিন পৃথিবীতে আছেন ততদিন সে তাঁদের সঙ্গে থাকতে চায়, তারপর যা হওয়ার তা হবে। বাবা কারণ জিজ্ঞাসা করতে সে খুব বিনীত হয়ে বলেছিল, ‘তোমরা ছাড়া অন্য কোনও মানুষের সঙ্গে আমি মানিয়ে নিতে পারি না। যে কারণে আমার সঙ্গে কারও বন্ধুত্ব হয়নি।’ অচেনা একজন মহিলাকে বিয়ে করলে দূরত্ব থেকেই যাবে। মা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘তোর পছন্দের কেউ যদি থাকে তো বল।’
বাসুদেব হেসেছিল, ‘আমার কী পছন্দ তা আমি আজও বুঝতে পারলাম না মা।’
আমৃত্যু মা মাঝে-মাঝে এই নিয়ে আফশোস করে গেছেন।
কিন্তু এটা যদি অন্যায় হয় তাহলে তার প্রায়শ্চিত্ত কীভাবে করা সম্ভব?
মা নেই। মায়ের সঙ্গে যদি সে অন্যায় করে থাকে তাহলে সেটা সংশোধনের কোনও রাস্তা নেই। তা ছাড়া, তিনি যদি থাকতেনও তাহলে সে কীভাবে সংশোধন করত? পঞ্চাশ বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসে লোক হাসিয়ে? হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল! আলমারি খুলে লকারের এক কোণ। থেকে খামটা বের করল। প্রায় তিরিশ বছর আগে খামটাকে যেভাবে রেখেছিল তা অবিকল। রয়েছে। খামের ভেতর পাঁচটা দশ টাকার নোট। এই নোটগুলো আজকাল সচরাচর দেখা যায় না। মাকে জানায়নি সে এই টাকাগুলোর কথা। অদিতি দাম দিতে চেয়েছিল। দাম না ঘুষ? আজ মনে হল এটাও তার জীবনের একটা বড় অন্যায়। এর প্রায়শ্চিত্ত হতে পারে নোটগুলো যে দিয়েছিল তাকে ফিরিয়ে দিয়ে।
তিরিশ বছর বড় কম সময় নয়। বিয়ের পরে অদিতি এখন কোথায় তা বাসুদেবের জানা নেই। প্রায় পঞ্চাশে পৌঁছে যাওয়া অদিতি নিশ্চয়ই অন্য পাঁচজন প্রৌঢ়াদের মতো সংসার নিয়ে ব্যস্ত। এখন তাকে বিরক্ত করা কি ঠিক হবে? বাসুদেব ঠিক করল অদিতির ঠিকানা জোগাড় করে খামের ওপর ডাকটিকিট সেঁটে টাকাগুলো পাঠিয়ে দেবে। কে পাঠাল তা অন্য কেউ না বুঝলেও অদিতি নিশ্চয়ই একটু ভাবলে ঠিক বুঝতে পারবে।
সিউড়িতে এখন ছোটকাকা কাকিমা থাকেন। তাঁদের ছেলেমেয়েরা চাকরি এবং বিয়ের সুত্রে বাইরে। বহু বছর পরে বাসুদেব সিউড়িতে পৌঁছে গেল। তাকে পেয়ে কাকা-কাকিমা বিহুল। ছেলেদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ করলেন। কাকিমা বললেন, ‘তুই বিয়ে করিসনি বলে তোর মাকে শেষ সময় নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছিলি। বউমারা তো ছেলেদের এখানে আসতেই দেয় না।’ বিকেলে বাড়ি থেকে বেড়াতে বের হল বাসুদেব। তাদের পাড়াটা প্রায় একইরকমের রয়েছে। স্কুল ছাড়ার সময়টা যেন এখানে স্থির হয়ে আছে। হাঁটতে-হাঁটতে কমলামাসির বাড়ির সামনে পৌঁছে গেল সে। আবছা মনে পড়ছে, অদিতির একটা ভাই ছিল। সেই নিশ্চয়ই এখন সংসারের কর্তা।
বারান্দার ওপাশে মূল দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। পাশের খিড়কি দরজায় শব্দ করল সে। দ্বিতীয়বারে গলা কানে এল ‘কে? কে এসেছে?
গলাটা, এতবছর বাদেও কমলামাসির বলে মনে হল। সে জবাব দিল, ‘আমি।’
কয়েক সেকেন্ড পরে দরজা খুলল একটি ষোল-সতেরো বছরের মেয়ে। তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কাকে চাই? বাসুদেব হাসল, ‘কমলামাসি।’
‘আপনি।’
‘আমার নাম বাসুদেব। তুমি কে?’
‘আমি ওঁর নাতনি।’
‘কে রে পয়া?’ ওপাশ থেকে কমলামাসির গলা ভেসে এল।
পয়া দ্রুত ভেতরে চলে গেল। ইতস্তত করছিল বাসুদেব কিন্তু তার মধ্যেই কমলামাসি নেমে এসেছেন। খুব রোগা হয়ে গেছে শরীর, চুল প্রায় সাদা। বাসুদেব এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করতেই বৃদ্ধা কেঁদে উঠলেন সশব্দে।
মিনিট পাঁচেক বাদে যখন কমলামাসি শান্ত হলেন তখন আক্ষেপ শুরু হল। বাসুদেবের মা চলে গেছেন অথচ তিনি পড়ে আছেন, ইত্যাদি। বাসুদেব এইসময় জানল অদিতি বিধবা হওয়ার পরে মায়ের কাছে চলে এসেছে চার বছরের মেয়েকে নিয়ে। সেই মেয়ে এবার উচ্চমাধ্যমিক দেবে।। প্রচণ্ড আর্থিক কষ্টে দিন কাটছে। ওপাশের দুটো ঘর থেকে মাসে মাত্র দু-হাজার টাকা ভাড়া। পাওয়া যায়। এ ছাড়া অদিতি চারটে ছাত্রীকে পড়িয়ে মাসে দু-হাজার পায়। এই চার হাজার টাকার তিনহাজার সংসার চালাতে হচ্ছে। নাতনির জন্যে একটা প্রাইভেট টিচার রাখার ক্ষমতা তাদের নেই। তারপর কমলামাসি কান্না মেশানো গলায় অনুশোচনা শুরু করলেন, ‘তোর মায়ের ইচ্ছে ছিল, আমিও কত আশা করেছিলাম, কিন্তু মেয়ে নিজের পায়ে জেনেশুনে কুড়ুল মারলে আর কে আটকাবে! হ্যাঁ-রে, তোর বউকে এনেছিস?’
মাথা নাড়ল বাসুদেব, ‘না।’
‘আনলি না কেন? দেখতাম।
‘থাকলে তো আনব।’
‘সেকি? তুই বিয়ে করিসনি? কেন?
হাসল বাসুদেব। তারপরে দূরে দাঁড়ানো পয়াকে ডাকল, ‘তোমার নাকটা বেশ সুন্দর। পয়া নামের কোনও মেয়েকে আমি আগে দেখিনি।’
কমলামাসি বললেন, ‘ওর ভালো নাম পয়মন্তী। আমিই রেখেছিলাম। কিন্তু ওর কপাল দ্যাখ!’ শ্বাস ফেলল কমলামাসি।’
‘তোমার পড়াশুনা কেমন হচ্ছে?’
পয়মন্তী তাকাল, তারপর চোখ সরাল।
বাসুদেব বলল, ‘কমলামাসি, ওর পড়াশুনার জন্যে যা লাগবে তার জন্যে আপনারা চিন্তা করবেন না। আপনি ভালো টিচার দেখুন।’
‘কিন্তু–।’
‘কোনও কিন্তু নয়। আপনার বান্ধবীর যা টাকা ছিল তা ব্যাংকে পড়ে আছে। আমি স্পর্শ করিনি। মায়ের আত্মা খুব খুশি হবে যদি সেই টাকায় ওর পড়াশুনার ব্যবস্থা হয়। আপনার নাতনি তো মায়েরও নাতনি।’
বাসুদেবের হাত ধরলেন কমলামাসি, ‘দীর্ঘজীবী হও বাবা। উঃ, বুক থেকে পাথর নামল।‘
বাসুদেব পয়মন্তীর দিকে তাকাল, ‘কি, খুশি তো?’
পয়মন্তী মাথা নাড়ল।
বাসুদেব বুঝে নিয়েছিল অদিতি বাড়িতে নেই। তবু জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার মা কোথায়?
টিউশনিতে গিয়েছে। পয়মন্তী জবাব দিল।
‘তুই তোদের বাড়িতে উঠেছিস?’ কমলামাসি জিজ্ঞাসা করল।
‘হ্যাঁ।’
‘ওর মা এলে বলব দেখা করে আসতে।’
ফেরার আগে আর একবার কমলামাসির সঙ্গে দেখা করবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাসুদেব যখন ঘরের বাইরের দিকে পা বাড়াল তখন পয়মন্তী তাকে এগিয়ে দিতে এল। মেয়েটা দেখতে সুন্দর, লম্বা। হঠাৎ বাসুদেবের মনে হল, আঠারো বছরের অদিতি প্রায় এইরকমই দেখতে ছিল।
‘তুমি কলেজে কী নিয়ে পড়বে?’ খিড়কি দরজায় পৌঁছে জিজ্ঞাসা করল সে।
‘আমি, আমি কলেজে পড়ব না।’
‘কেন? আর তো কোনও অসুবিধে নেই।’
‘আমার পড়তে ভালো লাগে না।’ পয়মন্তী নিচের দিকে তাকাল।
‘কেন?’
‘ইচ্ছে করে না।’
‘তাহলে কী করবে?
হঠাৎ মুখ তুলল সে, ‘আপনাকে একটা অনুরোধ করব?’
‘বলো।’
‘দিদাকে রাজি করাবেন? ওরা এস সি বলে দিদা-মা রাজি হচ্ছে না।’
‘ওরা কারা?’ থেমে গেল বাসুদেব।
জবাব দিল না পয়মন্তী। মুখ তুলল না।
‘কারও সঙ্গে তোমার সম্পর্ক হয়েছে?
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল মেয়েটি।
‘সে কী করে?’
‘এল আই সি-তে চাকরিতে ঢুকেছে।’
‘যদি তোমার দিদা-মা রাজি না হন?
‘আঠারো বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তদ্দিনে পরীক্ষাও হয়ে যাবে।’
স্তম্ভিত হয়ে গেল বাসুদেব। অবিকল অদিতির কথা।
‘তোমার মাকে তো দেখছ। দেখেও বুঝতে পারছ না?’
‘মা ভুল করেছিল। বাবার কুষ্ঠিতে আয়ু নেই জেনেও বিয়ে করেছিল। ওর কুষ্ঠিতে আছে আশি বছর পর্যন্ত বাঁচবে।’ বলে পয়মন্তী ফিরে গেল ভেতরে।
ঠিক তখনই অদিতিকে দেখতে পেল সে। জীবনে আর একটা ধাক্কার জন্যে কি তৈরি হচ্ছে এই বিগতযৌবনা মহিলা?
‘তুমি?’ অদিতি হাসল।
‘তোমার সঙ্গে কথা আছে, খুব জরুরি।’
‘কী কথা?’ অদিতি উদাস চোখে তাকাল।
কী কথা বলবে বাসুদেব? এত বছর পরে যে কথা বললে ভুল সংশোধন করা যায় সেকথা বলার কি সময় আছে? ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে গেলে কেনা টিকিট ফিরিয়ে দিলে তো পুরো দাম ফেরত পাওয়া যায় না। তবু যেটুকু পাওয়া যায় তাই নিয়েই তো সন্তুষ্ট থাকে মানুষ।
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন