সমরেশ-মজুমদারের-গল্প-গুচ্ছ-সমরেশের-সেরা-১০১-গল্প.

শিরোনাম: ম্লান-অম্লান

গল্পকার: Author Avatar সমরেশ মজুমদার

নিরাপদ বসুকে এই কাহিনির নায়ক বলা যাবে না। অথচ যা কিছু ঝামেলা ওকে নিয়েই। নিরাপদ অবশ্য ঝামেলা বলে স্বীকার করে না। সে যথেষ্ট ঝামেলা এড়ানো ভদ্রলোক। ওর স্ত্রী হৈমন্তী যদিও এই স্বভাবটার জন্যে ওকে ব্যক্তিত্বহীন মানুষ বলে মনে করে। নিরাপদ এসব শুনলে দু:খ পায়। কিন্তু ইদানীং স্ত্রী-র কথাবার্তা সে উপেক্ষা করতে শিখে গিয়েছে। নিরাপদ একজন সরকারি চাকুরে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া হিসেবে ফল ভালো করেছিল। চাকরিতে ফাঁকি দেয়নি। তাই পঞ্চাশ বছরেই যতটা ওপরতলায় ওঠা সম্ভব উঠেছে।

হৈমন্তী খুব গোছানো মেয়ে। স্বামীর যা আয় তাতেই সে সংসারটাকে সুন্দর করে সাজিয়েছে। চাহিদা তো অনেক থাকে কিন্তু সেটা পাওয়া যাচ্ছে না বলে দিনরাত অশান্তি করে না। চল্লিশের। এপাশে এসেও হৈমন্তী এখনও আকর্ষণীয়, যাকে বলে সুন্দরী, ঠিক তাই। আর এখানেই তার যা। কিছু কষ্ট। নিরাপদ পঞ্চাশেই কেমন বুড়ো-বুড়ো হয়ে গিয়েছে। অফিস আর বাড়ি ছাড়া কিছুতেই উৎসাহ নেই। সুন্দরী স্ত্রী যে তাকে তেমন আকর্ষণ করে তা আর আজকাল বোঝা যায় না। হৈমন্তী নিরাপদের মেয়ের নাম অদিতি। বয়স আঠারো-উনিশের মাঝামাঝি। লম্বা, দারুণ দেখতে, ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে। পাড়ার ছেলেদের জ্বালায় হৈমন্তীর রাত্রের ঘুম নেই। টেলিফোন বাজলেই অদিতিকে কেউ-না-কেউ ডাকবে। লেটার-বক্সে প্রেমপত্রের বন্যা বয়ে যায়। ভরসা এই মেয়েটা এসব পাত্তা দেয় না। হৈমন্তীর রাগ, নিরাপদ একটুও চিন্তিত নয় মেয়ের ব্যাপারে। কখন কোন। উটকো ছেলের সঙ্গে মজে গেলে সারাজীবন কপাল চাপড়াতে হবে। সারা সময় মেয়েকে সেকথা শোনায় হৈমন্তী।

এই নিরাপদকে অফিসের কাজে একবার দিল্লিতে যেতে হয়েছিল। দিল্লিতে হৈমন্তীর দিদি থাকেন। কোনও অসুবিধে হয়নি। ফেরার সময় কালকার টিকিট পাওয়া গেল না। সেকেন্ড ক্লাস স্লিপারে সে বেশি স্বচ্ছন্দ। ভায়রাভাই রাজধানীর চেয়ারকারের টিকিট ম্যানেজ করে দিল। বড়লোকি পরিবেশ একদম সহ্য হয় না নিরাপদর। এয়ার কন্ডিশন্ড মানে সেইরকম ব্যাপার বলে মনে হয়েছিল তার। কিন্তু সিটে বসে দেখল তার মতো পোশাক ও চেহারার অনেক যাত্রী যাচ্ছে। সে সাইড ব্যাগ থেকে আগাথা ক্রিস্টির একটা বই বের করে চোখ রাখল হেলানো চেয়ারে মাথা রেখে। আগাথা ক্রিস্টি ওর খুব প্রিয় লেখিকা। গাড়ি চলল। ভেতর থেকে গতি বোঝার উপায় নেই, ধুলো নেই। নিরাপদর ভালো লাগল। এই সময় বেয়ারা গোছের একটি লোক এসে সামনে দাঁড়িয়ে সেলাম করল। চমকে উঠে বসল নিরাপদ। তারপর লোকটিকে লক্ষ্য করে বুঝল সেলামটা তার পাশে বসা যাত্রীর জন্যে। বেয়ারা খুব বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করল, সাব, কফি চাহিয়ে?

কফি? হলে মন্দ হয় না।

ঠিক হ্যায় সাব। বেয়ারা চলে গেল।

নিরাপদ অবাক। কম্পার্টমেন্টের কাউকে এই প্রশ্ন করেনি বেয়ারা। এই লোকটি কী এমন তালেবর যে তাকেই খাতির করতে হবে! কিন্তু এই প্রশ্ন মনে এলেও মুখে কিছু বলল না নিরাপদ। সেটা তার স্বভাবে নেই। নিজেকেই বোঝাল, নিশ্চয়ই রেলের কোনও বড় কর্মচারী। সে আড়চোখে তাকাল। বছর পঁয়ত্রিশেক হবে। রোগা, ফরসা, চশমা পরা। এ ধরনের চেহারার বয়স চট করে অবশ্য আন্দাজ করা যায় না।

কফি এল। আরাম করে খেল লোকটা পাশে বসে। কম্পার্টমেন্টের অনেকেই এই খাওয়াটা দেখছে। সবার চোখেই বিস্ময়।

পাশাপাশি বসেও কথা হচ্ছিল না। আগ বাড়িয়ে কথা বলার স্বভাব নেই নিরাপদর। সে বই-এ দৃষ্টি রেখেছিল। বেয়ারাটা আবার এল কাপ প্লেট নিতে। জিজ্ঞাসা করল, সাব, আপনি কি আলাদা কোনও মেনু ডিনারে নেবেন?

লোকটি বলল, না, না। যা সবাইকে দিচ্ছ তাই আমাকে দিও।

নিরাপদ নিশ্চিত হল লোকটি রেলের অফিসার। তার অবশ্য রেলের অফিসারের সঙ্গে আলাপ রাখার প্রয়োজন নেই। কালেভদ্রে কলকাতা থেকে সে বের হয়।

ওটা কি আগাথা ক্রিস্টি?

চমকে উঠল নিরাপদ। দ্রুত মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

আমার খুব প্রিয় লেখক। কোনান ডয়েল, আগাথা ক্রিস্টি থেকে আমাদের ফেলুদা, হাতে পেলে পৃথিবী ভুলে যাই আমি।

নিরাপদ হাসল। অথবা বলা যেতে পারে, হাসবার চেষ্টা করল।

ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, দিল্লির লোক নন নিশ্চয়ই?

না, না, আমি কলকাতায় থাকি। কাজে এসেছিলাম। সরকারি কাজে।

প্রায়ই আসেন?

না। হঠাৎই আমাকে আসতে হল।

কোন ডিপার্টমেন্ট আপনার?

নিরাপদ সেটা জানাল। ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, যাক খুব দুশ্চিন্তা ছিল, আমার পাশে যদি কোনও উটকো লোক বসত তাহলে সারাটা পথ মুখ বন্ধ করে থাকতে হত। আপনার নামটা কিন্তু জানা হল না!

আমি নিরাপদ বসু। আপনি?

অম্লান মিত্র।

ভদ্রলোক কি করেন, রেলের অফিসার কিনা তা জানা গেল না। জিজ্ঞাসা করতেও সঙ্কোচ হচ্ছিল নিরাপদর। নিজের ওপর এই কারণেই তার ক্ষোভ হয়। হৈমন্তী রেগে যায় এই কারণে। ডিনার এল। ভদ্রলোক বেয়ারাকে বললেন খাবার দেওয়ার আধঘণ্টা বাদে আবার যেন কফি দিয়ে যায়। এবার দু-কাপ।

না, লোকটা খারাপ নয়। রাত্রে ঘুমাবার আগে অনেক কথা হল। সকালেও। নিরাপদর অফিস। এবং বাড়ির ফোন নম্বর নিলেন ভদ্রলোক। নিজের ফোন নম্বর দিলেন না। বললেন, টালিগঞ্জের নম্বর শুনছি পালটে যাবে। গিয়ে দেখব হয়তো এরই মধ্যে পালটে গিয়েছে। আপনাকে পরে। জানিয়ে দেব।

এই লোকটির কথা বাড়িতে ফিরে হৈমন্তীকে বলেনি নিরাপদ। বললেই হৈমন্তী জিজ্ঞাসা করত, একটা লোককে সব জানিয়ে দিলে অথচ সে কী করে কোথায় থাকে তা জানলে না? খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন। কিন্তু নিরাপদ বোঝাতে পারবে না যে তার মনে হয়েছিল লোকটি নিজের সম্পর্কে বেশি কথা বলতে চায় না। তাই জিজ্ঞাসা করতে তার ভদ্রতায় লেগেছিল। তা ছাড়া একজনের সঙ্গে ট্রেনে আলাপ হয়েছে এবং সেখানেই শেষ, তাই নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে ঝামেলা করে কী হবে। হৈমন্তীকে একথা বলা মানে ঝামেলা পাকানো। হৈমন্তীকে খুশি করার জন্যে ও রোজ সকালে। বাজারে যায়, গ্যাস বুক করে, তাগাদা দেয়, রেশনের দোকানে যায়, শুধু কেরোসিনের লাইন দেয় না। সেটা হৈমন্তীই নিষেধ করেছে। ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা বস্তির লোকেদের সঙ্গে স্বামীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে চায় না সে। কিন্তু ইলেকট্রিক বা টেলিফোনের বিলটা ওর পকেটে গুঁজে দেয়। ডাবল সিলিন্ডার থাকায় গ্যাস ফুরোবার আগেই দ্বিতীয় সিলিন্ডার পাওয়া যায়। হৈমন্তীর সমস্যা থাকে না। এবার দিল্লি থেকে এসে শুনল যে-কোনও মুহূর্তে আগের গ্যাস শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু। দোকানে বলা সত্বেও দ্বিতীয় সিলিন্ডার পাওয়া যাচ্ছে না। বলেছে সাপ্লাই নেই। পাড়ার দোকানে গ্যাস সাপ্লাই থাকলে নিরাপদ কী করতে পারে? হৈমন্তী অবশ্য কাজের মেয়েকে দিয়ে অনেকটা কেরোসিন তুলিয়ে রেখেছে।

একদিন অফিস থেকে ফিরে নিরাপদ দেখল লোডশেডিং। মেজাজ খারাপ হয় না আজকাল। এটাই স্বাভাবিক ঘটনা। প্রথম প্রথম ফোন করত অদিতির তাড়নায়। শুনত কেবল ফল্ট আজকাল করে না। মোমবাতি জ্বলে, গরমে পচতে হয়। আজ টেলিফোন বাজল। হৈমন্তী কথা বলে জানল অম্লান মিত্র নামে একজন তাকে ডাকছে।

নিরাপদ ফোন ধরল। অম্লানের গলা পাওয়া গেল, কি মশাই, চিনতে পারছেন? আমি অম্লান। রাজধানীতে আলাপ হয়েছিল। নিরাপদ শুকনো হাসল, হেঁ-হেঁ। কেমন আছেন।

ফার্স্ট ক্লাস। আপনাদের পাড়ায় এসেছিলাম। ভাবলাম যোগাযোগ করি। কি করছেন?

কিছু না।

তাহলে একবার আপনাদের ওখানে ঢু মেরে আসি। ঠিক কোথায় যেন বাড়িটা?

নিরাপদ মোটামুটি বুঝিয়ে দিল।

টেলিফোন রেখে সে কিন্তু কিন্তু হৈমন্তীকে বলল, অম্লানবাবুর সঙ্গে ট্রেনে আলাপ হয়েছিল। খুব বড় অফিসার।

কোথাকার?

রেলের বোধ-হয়।

বোধ-হয় মানে? উনি বলেননি?

নিরাপদ অস্বস্তিতে পড়ল, সেইরকম মনে হল।

আশ্চর্য! একটা লোকের সঙ্গে আলাপ হল, টেলিফোন নম্বর দিলে অথচ সে কোথায় কাজ করে জানলে না! কি করে সরকারি চাকরি করো? কী বললেন?

এ পাড়ায় এসেছিলেন। তাই ঘুরে যেতে পারেন।

এই অন্ধকারে? নিষেধ করলে না?

কেউ যদি আসতে চায় নিজে থেকে তা মানা করব কি করে?

আমি লোডশেডিং-এর মধ্যে চা-ফা খাওয়াতে পারব না।

মিনিট দশেক বাদে অম্লান এল। এসেই বলল, একি দাদা, অন্ধকারে বসে আছেন?

নিরাপদ বলল, কি করব, উপায় তো নেই।

উপায় নেই হয় নাকি? আপনার টেলিফোন কোথায়?

নিরাপদ অবাক হলেও টেলিফোন দেখিয়ে দিল। মোমবাতির আলোয় ডায়াল ঘোরাল অম্লান। নিরাপদ শুনল অম্লান বলছে, হ্যালো, চিফ ইঞ্জিনিয়ার আছেন? ও, অম্লান বলছি। আমি এখন তিনশো বাইশ সার্কুলার রোডে আছি। এখানকার ফেজটা অন করে দিতে বলুন। ধন্যবাদ। রিসিভার রেখে দিয়ে অম্লান বলল, এই গরমে কোনও ভদ্রলোক থাকতে পারে?

নিরাপদ অবাক। সে একেবারেই হতভম্ব হয়ে গেল যখন এর মিনিটখানেক বাদেই আলো এসে গেল। চারপাশে উল্লাস শোনা গেল। ভেতরের দরজায় দাঁড়িয়ে হৈমন্তী সমস্ত ব্যাপারটা শুনল। আলো জ্বলতে সেও অবাক। নিরাপদ না জিজ্ঞাসা করে পারল না, ইলেকট্রিক সাপ্লাইতে আপনার চেনাজানা আছে বুঝি?

ওই একটু-আধটু। অম্লান বসল। এই সময় অদিতি ছুটে এসে জানাল একমাত্র তাদের বাড়ি এবং রাস্তার এপাশের কয়েকটিতে আলো এসেছে। উলটোদিকটায় এখনও লোডশেডিং। অম্লান অদিতিকে দেখছিল। হেসে বলল, যাতে তোমাদের এই বাড়িতে কখনও লোডশেডিং না হয় সেই ব্যবস্থা করব?

আপনি পারবেন? অসম্ভব।

দেখি। রহস্যের হাসি হালে অম্লান।

নিরাপদ স্ত্রী ও কন্যার সঙ্গে অম্লানের আলাপ করিয়ে দিল। অম্লান খুবই ভদ্রভাবে কথা বলল। আদিতি টিভি খুলেছিল। ছবি এখনও কাঁপছে। দু-বছরের টিভি, মিস্ত্রি দেখিয়েও ঠিক হচ্ছেনা। অম্লান বলল, এই টিভি দেখবেন না দাদা, চোখ খারাপ হয়ে যাবে।

হৈমন্তী বলল, কিছুতেই ঠিক হচ্ছে না। গ্যারান্টি পিরিয়ড শেষ হয়ে যাওয়ার পর কয়েকবার মিস্ত্রি দেখালাম, যখন করে দিয়ে যায় তখন ঠিক থাকে তারপর যে-কে সেই। আর একটা যে কালার। টিভি কিনব তার তো উপায় নেই। যা দাম।

আহা কিনবেন কেন বউদি। দু-বছর তো বেশিদিন নয়। কোম্পানিকে লিখছেন না কেন? ঠিক আছে, টিভি কেনার রসিদটা আছে? অম্লান জিজ্ঞাসা করল।

রসিদ পাওয়া গেল। সে সেটা পকেটে রেখে বলল, এটা আমার ওপর ছেড়ে দিন। দেখি কী করা যায়।

অনেকক্ষণ গল্প করে চা খেয়ে চলে গেল সে। এর মধ্যে হৈমন্তী জানতে পেরেছে বিয়ে থা করার সুযোগ হয়নি এখনও ওর। টালিগঞ্জে বাড়ি। বাড়িতে মা আছে। সরকারি চাকরি করে। কিন্তু কোন ডিপার্টমেন্ট তা বের করতে পারেনি হৈমন্তী। অম্লান বলেছে, বউদি মাপ করবেন, এটা বলতে অসুবিধে আছে।

তাজ্জব ব্যাপার। সেদিনের পর আর লোডশেডিং হচ্ছে না এ বাড়িতে। প্রতিবেশীরা এতে অবাক। ঈর্ষান্বিত অনেকেই। হৈমন্তী বলল, সত্যি ভদ্রলোক খুব ইনফ্লুয়েন্সিয়াল।

হৈমন্তীর ভাই এসেছিল। ট্রেড ইউনিয়ন করে। বলল, সত্যি দিদি, এই কারণে তোমরা এত সহজে টুপি পরো।

হৈমন্তী চটে গেল, আজেবাজে কথা বলিস না।

ভাই বোঝাল, ধরো, আমার সঙ্গে খুব জানপয়চান আছে ইলেকট্রিসিটির ইঞ্জিনিয়ারের। এপাড়া এসে জানলাম তোমার বাড়িতে লোডশেডিং। সঙ্গে-সঙ্গে ফোনে তাকে অনুরোধটা করলাম। তারপর তোমার বাড়িতে এসে যেন প্রথম লোডশেডিং দেখছি এমন অভিনয় করে লোকটাকে দ্বিতীয়বার ফোন করলাম। ব্যাস, আলো এসে গেল। আর তুমি ভাবলে, ব্যাপস, লোকটার কি ক্ষমতা।

হৈমন্তী এতটা বোঝেনি। এবার বুঝে বলল, যাক বাবা, আমাদের তো আর লোডশেডিং হচ্ছে না, সেইটেই উপকার।

কিন্তু দিন-তিনেক বাদে টিভি কোম্পানি থেকে টেলিফোন এল। তাঁরা পুরোনো টিভি ফিরিয়ে নিয়ে নতুন সেট দিয়ে দিতে চান। আজ বিকেলে তাঁদের লোক সেটা পৌঁছে দেবে। হৈমন্তী হতভম্ব। গ্যারান্টি কার্ডে এক বছর সময়সীমা ছিল তবু এটা সম্ভব হল কি করে? সে সঙ্গে-সঙ্গে ফোন করল নিরাপদকে। নিরাপদ ছুটে এল বাড়িতে। কোম্পানির লোক বিকেলবেলায় এসে পুরোনো সেট। নিয়ে গেল নতুন সেট বসিয়ে। তারা জানাল ওপরতলার হুকুমে কাজটা করা হচ্ছে। নতুন সেট অনেক বেশি আধুনিক এবং দামের তফাত তিন হাজার টাকা।

হৈমন্তী বলল, না, ক্ষমতা আছে বটে অম্লানের। তবে গায়ে পড়ে এত উপকার করছে, এটা আমার ভালো লাগছে না।

নিরাপদ বলল, তুমি বড্ড সন্দেহবাতিক।

হয়তো। কিন্তু আমার মন সায় দিচ্ছে না।

তাহলেও আত্মীয়স্বজনরা ব্যাপারটা জানল। অনেকেই অম্লানের সঙ্গে আলাপ করতে চায়। হৈমন্তী ঠেকিয়ে রাখে। দিন-দশেক বাদে ছুটির দশ মিনিট আগে নিরাপদ দেখল তার সামনে অম্লান, এদিকে এসেছিলাম ভাবলাম দাদাকে নিশ্চয়ই অফিসে পেয়ে যাব। নিরাপদ টিভিটার জন্যে তাকে ধন্যবাদ দিল।

অম্লান বলল, এ কিছু নয়। আসলে আমরা অনেকেই নিয়ম জানি না। কোনও কোম্পানি চাইবে বিক্রির দুই বছরের মধ্যে তাদের জিনিস খারাপ এটা বাজারে চালু হোক। নিজেদের মান বাঁচাতে ওরা পালটে দেবে।

নিরাপদ অম্লানের সঙ্গে বের হল। সামনের গাড়িতে তাকে নিয়ে উঠল অম্লান। গাড়ির ওপর লাল আলো। ড্রাইভার নেই। অম্লানই চালান। ডালহৌসি এলাকায় অত স্পিডে গাড়ি চালাতে কাউকে দ্যাখেনি নিরাপদ। মাথার ওপর লাল আলো থাকায় মোড় পার হবার সময় সেপাইরা সেলাম ঠুকছে।

নিরাপদ বাকশক্তি রহিত। নিরাপদ কোনওমতে অনুরোধ করল আস্তে চালাতে। অম্লান হাসল, আস্তে চালাতে কোনও মজা নেই দাদা।

কিন্তু আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আর্তনাদ করল নিরাপদ।

গাড়ির গতি কমাল অম্লান। নিরাপদ জিজ্ঞাসা করল, তোমার গাড়িতে লাল আলো কেন হে? শুনেছি মন্ত্রীমশাই, জাজ ছাড়া লাল আলো কোনও সাধারণ নাগরিক জ্বালাতে পারে না।

অম্লান গম্ভীর হল, তাহলে আমাকে অসাধারণ নাগরিক মনে করুন।

বাড়িতে পৌঁছে দিল অম্লান। নিরাপদ তাকে নিমন্তন্ন করল চা খেয়ে যেতে। ওপরে এল ওরা। অদিতি দরজা খুলল। অম্লান তাকে জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছ? লোডশেডিং-এর কষ্টটা নেই তো?

অদিতি হাসল, না নেই। থ্যাঙ্কস। সে ভেতরে চলে গেল।

নিরাপদ দেখল ওর চলে যাওয়া মুগ্ধদৃষ্টিতে দেখছে অম্লান। সেই সময় হৈমন্তী ভেতর থেকে আসছিল। অম্লানের বিহ্বল দৃষ্টি দেখে সেও লজ্জা পেল। জিজ্ঞাসা করল, কি হল?

সম্বিৎ এল যেন, অম্লান বলল, কিছু না। কেমন আছেন?

ভালো। হৈমন্তী স্বামীর দিকে তাকাল, সর্বনাশটা হল।

কি ব্যাপার? নিরাপদ জিজ্ঞাসা করল।

গ্যাস ফুরিয়ে গিয়েছে। দোকানে গিয়েছিলাম। বলল, দিন-দশেক লাগবে।

হৈমন্তী চিন্তিত, আগামী পরশু মেয়ের জন্মদিন। সবাইকে আসতে বলেছি। কী হবে?

অম্লান জিজ্ঞাসা করল, আপনাদের ডাবল সিলিন্ডার নেই?

নিরাপদ জবাব দিল, ডাবল সিলিন্ডারেই এই দশা।

অম্লান মাথা নাড়ল, এটা কোনও প্রবলেমই নয়।

হৈমন্তী রেগে গেল, প্রবলেম নয় মানে? কেরাসিন পাওয়া যায় বাজারে?

যায়। দাম বেশি দিতে হয়। কিন্তু বউদি, চিন্তা করবেন না, আপনি গ্যাসই পাবেন। কাল সকালে আপনাকে টেলিফোনে জানিয়ে দেব।

অম্লানের কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করল নিরাপদর। যে ইলেকট্রিক এনে দিতে পারে, টিভি সেট পালটাতে পারে সে হয়তো গ্যাসও পারবে। একটু বাদে নিরাপদর শ্যালক অবিনাশ এল। তার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়া হল অম্লানের। অবিনাশ ট্রেড ইউনিয়ন করা মানুষ। সরাসরি জিজ্ঞাসা করল, আপনি কী চাকরি করেন মশাই।

অম্লান হাসল, আমি যে চাকরি করি সেটা সাধারণকে বলা যাবে না।

কেন?

নিষেধ আছে।

আপনার বাড়ির ঠিকানা?

টালিগঞ্জে থাকি, এটুকু জানলেই চলে না?

না, চলে না, আপনি কেমন লোক মশাই?হুট করে ট্রেনের আলাপ সম্বল করে ভদ্রলোকের বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়েছেন অথচ নিজের পরিচয় কাউকে জানাচ্ছেন না? এটা কোন ভদ্রতা?

নিরাপদ শালাকে সামলালো, আহা নিশ্চয়ই ওঁর অসুবিধা আছে।

অসুবিধে না ধান্দাবাজি। আপনাকে ফাঁসাবে এই লোকটা।

অম্লান হাসল, আপনি আমাকে অপমান করছেন। এখানে এখন আপনি আমাকে যা ইচ্ছে। করতে পারেন, গায়ের জোরে আমি পারব না। কিন্তু এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে আপনাকে কোনও কারণ না দেখিয়ে কয়েকমাস জেলের ভাত খাওয়াতে পারি। আচ্ছা বউদি, বলুন তো, আমি কি আপনার কোনও ক্ষতি করেছি?

তা নয়। আমতা-আমতা করল হৈমন্তী।

আপনার খুব ক্ষমতা, না? অবিনাশ তেজি গলায় বলল।

খুব না, সামান্য।

আমি একটা ফ্ল্যাট বুক করেছিলাম গড়িয়ায়। নাইনটি পারসেন্ট টাকা জমা দেওয়া হয়ে গিয়েছে কিন্তু প্রোমোটার এখন এক্সট্রা এক লাখ চাইছে। এটা সমস্ত রীতিনীতি ভদ্রতার বাইরে। প্রোমোটার এখন বেশি দাম পাচ্ছেন বাইরে থেকে। বলছেন হয় আমাকে এক্সট্রা টাকাটা দিতে হবে নয় উনি আমার জমা দেওয়া টাকা ফেরত দিয়ে দেবেন। কেস করে কোনও লাভ হবে না। কারণ সবাই জানে প্রোমোটার ফ্ল্যাট একেবারে সাদা টাকায় বিক্রি করে না। কিছু উপায় হতে পারে?

অম্লান নিরাপদর দিকে তাকাল, দাদা, আপনি কি চান কিছু হোক?

নিরাপদ নিজের মাথায় হাত বোলালে, হওয়া খুব শক্ত। এক, পাড়ার ছেলেরা যদি লোকটাকে চাপ দেয় তাহলে–।

অবিনাশ মাথা নাড়ল, সেটা আর সম্ভব নয়। লোকটা ওদের হাত করে ফেলেছে। অম্লান এবার হৈমন্তীকে জিজ্ঞাসা করল, বউদি আপনি কি চান?

হৈমন্তী একটু গদগদ গলায় বলল, দেখুন না, চেষ্টা করে।

অম্লান অবিনাশের কাছে ঠিকানা, প্রোমোটারের নাম-ধাম চাইল। তারপর আগামীকাল কিছু করা যাবে বলে চলে গেল। অদিতি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছিল, দেখল লাল আলো লাগানো গাড়িতে ওঠার আগে অম্লান ওপর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল।

পরদিন দুপুরে অফিসে অবিনাশের ফোন পেল নিরাপদ। সে খুব উত্তেজিত হয়ে বলল তাকে থানা থেকে ডেকে পাঠিয়েছে আজ বিকেল পাঁচটায় ফ্ল্যাট নিয়ে কথা বলার জন্যে। প্রোমোটার বোধহয় থানাকেও ম্যানেজ করেছে। জামাইবাবু যদি সঙ্গে আসেন তাহলে সে সাহস পায়। নিরাপদ স্ত্রী-র ভাই-এর দুর্দিনে সঙ্গী হল।

দারোগার সামনে বসেছিলেন প্রোমোটার এবং এক ভদ্রলোক। অবিনাশ নিজের পরিচয় দেওয়ামাত্র দারোগা তাকে বসতে বললেন। প্রাথমিক আলোচনার পর প্রোমোটার যখন জিনিসপত্রের বাজারদর বেড়ে যাওয়ার গল্প শোনাচ্ছেন তখন দারোগা স্পষ্ট বলে দিলেন, মাসখানেকের মধ্যে যদি আপনি অবিনাশবাবুর হাতে ফ্ল্যাটের চাবি না তুলে দেন তাহলে ভীষণ বিপদে পড়বেন। আপনাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।

প্রোমোটার ভদ্রলোক প্রতিবাদ করতে চাইলেন কিন্তু দারোগা কোনও কথা শুনতে চাইলেন না। এবার প্রোমোটার প্রস্তাব দিলেন একটু আলাদা করে তার সঙ্গে বসে কথা শুনতে। দারোগা। সেটাকেও নাকচ করলেন। এবার প্রোমোটারের সঙ্গী ভদ্রলোক কথা বললেন বেশগম্ভীর গলায়। দারোগা শুনলেন। হেসে বললেন, অজিতবাবু, পলিটিক্যাল প্রেশার দিয়ে কোনও লাভ হবে না। অর্ডারটা এসেছে এত ওপরতলা থেকে যেখানে আপনারাও পৌঁছতে পারবেন না। এর পরে। প্রোমোটার দারোগাকে লিখিতভাবে জানাল যে তিনি এক মাসের মধ্যে ফ্ল্যাটের চাবি অবিনাশকে দিয়ে দেবেন।

নিরাপদ তো বটেই অবিনাশেরও মাথা খারাপ হয়ে গেল। এ সবই অম্লানের জন্যে হয়েছে বুঝতে অসুবিধে হল না। লোডশেডিং দূর করা বা টিভি-সেট পালটানো খুব দারুণ ব্যাপার নয় কিন্তু ফ্ল্যাট পাইয়ে দেওয়া?

নিরাপদ বাড়িতে ফিরে শুনল হৈমন্তী বেরিয়ে গিয়েছে। অদিতি বলল, দুপুরে অম্লানকাকু ফোন করেছিল। ভবানীপুরের এক গ্যাস ডিলারের কাছে গিয়ে নিরাপদর নাম বললেই নাকি সিলিন্ডার পাওয়া যাবে। নিরাপদ হতভম্ব। সেই দোকানে তাদের নাম লিস্টে নেই।

বললেই দেওয়া যায় নাকি?কিন্তু হৈমন্তী ফিরে এল একটি কুলিগোছের লোকের সঙ্গে যার হাতে সিলিন্ডার। পুরোনোটা নিয়ে নতুনটা দিয়ে সে চলে যাওয়া মাত্র হৈমন্তী যেন সাতমুখে কথা বলে উঠল, তুমি জানো অম্লান কে?

কে? ফ্যাসফেসে গলায় জিজ্ঞাসা করল নিরাপদ।

ডেপুটি গভর্নর অফ ওয়েস্টবেঙ্গল। ভাবতে পারো?

যাঃ।

হ্যাঁ গো। আমি সেই ডিলারের কাছে গিয়েছিলাম। তোমার নাম শুনে উনি একটি চিরকূট বের করলেন। ওদের ওপরতলার এক সাহেব লিখেছেন যে, পশ্চিমবঙ্গের ডেপুটি গভর্নরের ইচ্ছা অনুযায়ী তোমাকে যেন একটা গ্যাসের সিলিন্ডার এখনই দিয়ে দেওয়া হয়। হৈমন্তী বসে পড়ল।

ডেপুটি গভর্নর? এরকম পোস্ট তো পশ্চিমবাংলায় আছে বলে শুনিনি।

আমি নিজের চোখে দেখে এলাম।

নিরাপদ বিড়বিড় করল, একবার অজয়বাবুর আমলে ডেপুটি চিফ মিনিস্টার পোস্ট তৈরি হয়েছিল, ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার পোস্ট মাঝে-মাঝে হয় কিন্তু ডেপুটি গভর্নর? সে উঠে টেলিফোন গাইড দেখে রাজভবনে ফোন করল। রাজভবন জানাল অম্লান মিত্র নামে কাউকে তারা চেনে না। নিরাপদ পরিচিতজনদের ফোন করল। সবাই হাসাহাসি করল ডেপুটি গভর্নর নামে কোনও পোস্ট আছে শুনে। অথচ হৈমন্তী জোর দিয়ে বলছে সে ওই শব্দদুটো কাগজে দেখেছে।

পরদিন সন্ধ্যাবেলায় জনাদশেক আত্মীয়স্বজন এল এ বাড়িতে আদিতির জন্মদিন উপলক্ষ্যে। হইচই হচ্ছে। অবিনাশের ছোটভাই বিকাশ থাকে বিরাটিতে। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে রাত করতে চাইল না। সে যখন আটটা নাগাদ বের হচ্ছে তখন অম্লান এল লাল আলো জ্বালানো গাড়ি চালিয়ে। এসে বলল, দাদা, অদিতির জন্মদিনে আমাকেই বাদ দিলেন? তবু অযাচিতের মতো এসে পড়লাম।

অবিনাশ তাকে দেখে খুব খুশি। হৈমন্তীও। সে বলল, আপনার ঠিকানা জানা ছিল না বলে নেমন্তন্ন করতে পারিনি। খুব খুশি হয়েছি এসেছেন বলে।তার সঙ্গে বিকাশেরও আলাপ করিয়ে দেওয়া হল। বিকাশ চলে যাচ্ছে শুনে ব্যস্ত হল অম্লান, সেকি, এখন তো সবে সন্ধে, এখনই চলে যাচ্ছেন কেন?

বিকাশ বলল, ফ্ল্যাটে তালাচাবি দিয়ে এসেছি। খুব চুরি হচ্ছে এখন ও-পাড়ায়। তাই বেশি রাত করতে চাই না।

এটা কোনও প্রবলেম নয়। ঠিকানাটা বলুন।

ঠিকানা শুনে টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিচুগলায় কিছু বলে এসে অম্লান হাসল, নিন, আড্ডা মারুন। দশটা নাগাদ উঠব।

কিন্তু–। বিকাশ আপত্তি করতে যাচ্ছিল।

অবিনাশ বলল, আর কিন্তু করিস না। অম্লানবাবু যখন বলছেন তখন মন ঠিক করে আড্ডা মার! কোনও ভয় নেই।

হঠাৎ অম্লান নিরাপদকে জিজ্ঞাসা করল, দাদা, আপনার জমি কেনা আছে?

জমি? না। ওসব আর হয়ে উঠল না।

হৈমন্তী বলে উঠল, একদম বিষয়ী মানুষ নয়। এই ভাড়ার ফ্ল্যাটেই সারাজীবন পচতে হবে।

অম্লান হাসল, তা কেন? আপনি সল্টলেকে পাঁচকাঠা জমি নিন। স্টেডিয়ামের ঠিক পেছনে। খুব ভালো জায়গা। নেবেন?

নিরাপদ কিছু বলার আগে অবিনাশ চেঁচিয়ে উঠল, সল্টলেকে? ওরেব্বাস। ওখানে এখন তিন লাখ করে কাঠা।

নিরাপদ বলল, আমাকে বিক্রি করলেও পাওয়া যাবে না। অম্লান হাসল, তিন লাখ তো ব্ল্যাক। বারো হাজার করে কাঠা পাবেন। নিয়ে নিন দাদা। ষাট হাজার দিয়ে জমিটা কিনে ফেলুন। ওটাই আইনসম্মত দাম। পরে বাড়ি করতে ইচ্ছে না হলে না হয় বিক্রি করে দেবেন।

অবিনাশ উল্লাসিত, নিয়ে নিন জামাইবাবু। বাড়ি না করলে চৌদ্দ লাখ চল্লিশ হাজার এখনই প্রফিট। এত লাভ ভাবা যায় না। জমি এখন সোনা।

অম্লান বলল, ভেবে দেখুন। যদি চান তাহলে একটা চেষ্টা হতে পারে।

নিরাপদ বলল, ভেবে দেখি।

হঠাৎ অম্লানের যেন মনে পড়ল এমন ভঙ্গিতে সে উঠে অদিতির সামনে এগিয়ে গেল। পকেট থেকে ছোট প্যাকেট বের করে ওর হাতে দিয়ে বলল, হ্যাপি বার্থ-ডে টু ইউ। অদিতি বলল, থ্যাঙ্কু।

বিকাশরা চলে গেল নটা নাগাদ। দেখে বোঝা যাচ্ছিল স্বস্তিতে নেই। নিরাপদই যেতে বলল তাকে। খাওয়া-দাওয়া হইচই করতে-করতে এদের দশটা বেজে গেল। এক ফাঁকে অম্লান নিরাপদকে বলল, দাদা আপনারা সবাই ভাবছেন আমি কে অথচ আমি সেটা জানাতে পারছি না। খুব খারাপ লাগে। এবার আমার সঙ্গে আপনাদের দেখা আর ঘনঘন হবে না।

সেকি, কেন? নিরাপদ অবাক।

আমাকে মাদ্রাজে বদলি করা হয়েছে। এখনও কিছু দেরি আছে যাওয়ার।

মন খারাপ হয়ে গেল নিরাপদর। লোকটার পরিচয় অস্পষ্ট হওয়া সত্বেও ওর ব্যবহার তার খুব ভালো লাগে। তা ছাড়া অযাচিত উপকারগুলোর কথা ধরলে! সে বলল, আমরা আপনার। কাছে শুধু উপকার নিয়ে গেলাম, বদলে কিছুই করলাম না।

ছি-ছি। আপনি একথা বলছেন কেন? আমি যা-যা করেছি ভালোবেসে করেছি। সবাইকে কি খুশি করা যায়? আমার মাকেই খুশি করতে পারলাম না।

কেন?

মা চান আমি বিয়ে করি, সংসারী হই।

এতে অসুবিধে কোথায়?

মেয়ে কোথায়? তেমন মেয়ে না পেলে বিয়ে করে কি লাভ?

কীরকম মেয়ে আপনার পছন্দ? সরল গলায় জানতে চাইল নিরাপদ।

এই সময় হৈমন্তী পাশে এসে দাঁড়াল। তার কানেও গেছে শেষ প্রশ্নটা। অম্লান হাসল, বউদি যদি রাগ না করেন তাহলে বলতে পারি।

হৈমন্তী হাসল, বাঃ রাগ করব কেন?

তাহলে বলি। ঠিক আপনার মতো মেয়ে পেলে বিয়ে করতে পারি।

হৈমন্তী লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করল। নিরাপদ হেসে উঠল। আর তখনই টেলিফোন বাজল। নিরাপদ এগিয়ে গেল সেটা ধরতে। হৈমন্তী বলল, আপনি খুব ফাজিল।

সত্যি কথা বলেছি বউদি।

আমার মতো মেয়ের কি অভাব বাংলাদেশে?

খুঁজে দিন। আপনাকেই দায়িত্ব দিলাম।

এই সময় অদিতি এসে দাঁড়াল পাশে, মা দ্যাখো!

হৈমন্তী দেখল। একটি দামি হাতঘড়ি। সে বলল, একি, এত দামি জিনিস কেন আনলেন?

অপরাধ হয়ে গেছে?

হৈমন্তী জবাব দিতে পারল না। হঠাৎ তার মনে সন্দেহটা এল। অম্লান কী অদিতির জন্যে এসব করছে? তার মতোই তো দেখতে অদিতি। প্রথমদিন যেভাবে তাকিয়েছিল মেয়ের দিকে, গাড়িতে ওঠার আগে হাত নাড়া, দামি ঘড়ি উপযাজক হয়ে এসে উপহার দেওয়া–এসব কি তারই ইঙ্গিত? অসম্ভব। এই দুজনের বয়সের পার্থক্য অন্তত আঠারো বছরের। ভাবল বয়সি লোকের হাতে মেয়েকে তুলে দিতে পারে না হৈমন্তী। আর অদিতি কিছুতেই রাজি হবে না জানত। ওর বন্ধুর দাদারাই পাত্তা পাচ্ছে না।

নিরাপদ ফিরে এল টেলিফোন রেখে, অনেক ধন্যবাদ।

কেন? হাসল অম্লান।

বিকাশ ফোন করেছিল। ও ট্যাক্সি থেকে নেমে দ্যাখে একটা পুলিশভ্যান দাঁড়িয়ে আছে ওদের ফ্ল্যাটের সামনে। ওর পরিচয় পেয়ে তারা জানায় যে অর্ডার পেয়ে এসেছিল ফ্ল্যাট পাহারা দিতে। কোনও বিপদ হয়নি। বিকাশ এসে যাওয়ায় ওরা চলে গেছে। বিকাশ আপনাকে ধন্যবাদ দিতে বলেছে।

অবিনাশ ছিল। সে বলল, অম্লানবাবু, আপনি কে মশাই? আরব্যরজনীর আলাদীনের প্রদীপের দৈত্যের গল্প শুনেছি, এ যে তার মতো ব্যাপার।

অম্লান হাসল, প্রদীপের দৈত্য কিনা জানি না তবে এসব করলে দেখেছি একসময় যাদের জন্য করেছি তাদের কাছে ভীতিকর দৈত্য হয়ে যাই। তারপর ঘুরে জিজ্ঞাসা করল, কী বউদি? আমার কথা কিছু ভাবলেন?

হৈমন্তী বাঁকা গলায় জিজ্ঞাসা করল, আপনি এত পারেন আর এটুকু পারেন না?

অম্লান হাসল, এখানে আমার সঙ্গে প্রদীপের দৈত্যের মিল আছে। পার্থিব জিনিস আমরা এনে দিতে পারি। কিন্তু দয়ামায়া ভালোবাসা পারি না। আপনি তা পারেন।

অসম্ভব। আপনার কথা আমি যেটুকু বুঝেছি তাতে কিছুতেই মত দিতে পারছি না।

জানতাম। অম্লান মাথা নাড়ল। তারপর নিরাপদকে বলল, চলি দাদা।

রাত্রে পাশাপাশি শুয়ে হৈমন্তী তার সন্দেহের কথাটা নিরাপদকে জানাল। নিরাপদ চমকে উঠল। অসম্ভব। অদিতি ওর হাঁটুর বয়সি। হৈমন্তী বলল, লোকটা এই মতলবে এসেছিল।

নিরাপদ অবশ্য একমত হল না। ট্রেনে অদিতির কথা ও জানত না। দু-দিন পরে লোডশেডিং হলে, গ্যাস ফুরিয়ে গেলে, জমি কেনার কথা মনে হলে হৈমন্তী নিরাপদর খুব কষ্ট হত। তাদের মনে হত অদিতিকে একবার জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল। এখন সেটা করে। কোনও লাভ নেই। অম্লান সম্ভবত মাদ্রাজে চলে গিয়েছে। হয়তো সেখানে কোনও দাদা-বউদি পেয়ে তাদের উপকার করছে। হৈমন্তী সেটা ভেবে ঈর্ষান্বিত হয়।

এখন পর্যন্ত গল্পটি পড়া হয়েছে ৪৭ বার
যদি গল্পটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
    মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন