শিরোনাম: জমা জমি
গল্পকার: সমরেশ মজুমদার
চাষযোগ্য ভূমির বড়ই অভাব এই গ্রামে। সেই কবে পূর্বপুরুষরা পাহাড়ের গায়ে-গায়ে যে–মাটি নিজেদের জন্য চিহ্নিত করে গিয়েছিল তার বেশি একটা বাড়েনি। এক পুরুষ আগেও জঙ্গল কাটা। যেত, জমির শরীর বাড়ানো যেত সুবিধে পেলে। এখন সরকার সেটাও বন্ধ করেছেন। তা ছাড়া এই পাহাড়ের মাটিতে এত পাথর যে চাষ সহজ নয়। অনেক খাঁ-খাঁ প্রান্তরে দিনরাত হাওয়ারা খেলা করে। বিনি পয়সায় সেই জমি দিলেও কেউ মুখ ফেরাবে না। অতএব যেটুকু চাষযোগ্য জমি তার ওপরে মায়া প্রতিটি পরিবারের, সারা বছরের পেট ভরার যা অবলম্বন। কিন্তু তাই বা ভরে কই? দিন-দিন নতুন মানুষ আসছে সংসারে। তাদের পেটের জায়গা বাড়ছে। অথচ জমি বাড়ছে না এক ফোঁটাও।
এই গ্রামের মানুষেরা শহরে যায় না, যেতে চায় না। বড় শহর নয়, মোটামুটি গঞ্জ এলাকা বলতে মানেভঞ্জন, তাও আট ঘণ্টার হাঁটাপথ! সেখানে গেলে যে কাজকর্ম পাওয়া যায় না তা নয়। মাল বইবার লোক দরকার হয় ব্যবসায়ীদের। হাতে নগদ পয়সা আসে। কিন্তু তা নিয়েও ঝামেলা। আছে। আরও দশ-বিশটা গ্রামের মানুষ সেই একই ধান্দায় হাজির হয় সেখানে! এর ওপর আছে। খোদ মানেভঞ্জনের বেকাররা। ওরা তাদের ভালো চোখে দেখে না। ফলে দিন-দিন কাজ কমে যাচ্ছে দ্রুত। আরও দূরে যে শহর দার্জিলিং সেখানে নাকি খুব বড়-বড় মানুষ থাকে, এই গ্রামের। মানুষ অত দূরে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারে না। আশেপাশের জঙ্গলে আছে প্রচুর কাঠ। মেয়েরা তাই চুপিসাড়ে নিয়ে আসে ভোজালি চালিয়ে। এখন বুক ফুলিয়ে কাঠ কাটার দিন নেই। মাঝে মাঝেই ফরেস্ট গার্ডরা টহল মারে। তবু কাঠ আসে গ্রামে। শীতকালে যখন হু-হুঁ বাতাস করাত চালায় তখন ওই কাঠ প্রাণ বাঁচায়। দুটো মাস তো সাদা হয়ে যায় গ্রামটা বরফে। জমির মুখ। দেখা তো দূরের কথা, গাছের পাতাও চেনা মুশকিল হয়ে পড়ে। তখন যার উনুনে আগুন জ্বলে তার মতো ভাগ্যবান আর কে এই তল্লাটে! ওই জঙ্গলে এককালে জানোয়ারগুলোকে পাওয়া যেত। খিদে পেলে তির ছুঁড়ে তাদের কাঁধে তুলে আনা যেত অনায়াসে। এখন জঙ্গলটাও খাঁ-খাঁ করে। তার ওপর আছে ওই ফরেস্ট গার্ড। সব সময় শাসিয়ে যায়, খবরদার, বনের পশুর গায়ে কেউ হাত দেবে না। সব সরকারি মাল।
জঙ্গল সরকারি মাল, জঙ্গলের পশুও সরকারি মাল, তাহলে জঙ্গলের মানুষ কেন সরকারি মাল হিসেবে ঘোষিত হবে না? এই সরল সত্যটি কেন ওদের মাথায় ঢোকে না? তাহলে ওদের। দেখভাল করার দায়িত্ব পড়ত ফরেস্ট গার্ডদের ওপর। সারা বছর ওই চাষের জমি আর কতটুকু খাবার জোগান দিতে পারে?কম্বলটা সমস্ত শরীরে জড়িয়েও কাঁপুনি যাচ্ছিল না মানে লেপচার। বাতাসের দাঁত গজিয়েছে এর মধ্যেই। গাছের পাতাগুলো লাল থেকে হলুদ হয়ে যাচ্ছে। শেষ। ফসল কাটা হয়ে গেছে প্রত্যেকের। এখন জমি খাঁ-খাঁ করছে। কদিন বাদেই সাদা বরফে ঢাকা পড়ে যাবে চৌদিক। মানে তাদের জমিটাকে দেখছিল। এই জমি তাদের পরিবারের পনেরো। জনের পেট ভরায় কোনওরকমে।
আগামী বছরে পনেরো বছর পূর্ণ হয়ে মোলোয় পা দেবে মানে। বংশের ধারা অনুযায়ী চেহারা। হয়নি, বেশ ছিপছিপে এবং লম্বাটে, মুখের চামড়া মোমের মতো মোলায়েম। দাড়ি দূরের কথা, ফিনফিনে লোমও উঁকি মারেনি নাকের তলায়। চোখের পাতায় সুন্দর ভাঁজ আছে যা কিনা এই গ্রামের আর কারও নেই। মানে একবার পেছন ফিরে তাকাল। গ্রামের যে অংশটুকু দেখা যাচ্ছে সেখানেই তাদের বাড়ি। আর ওই বাড়িতেই আজ দুপুর থেকে চলছে ব্যাপারটা। জবরদস্ত আলোচনা। থুক শব্দ তুলে থুথু ফেলল সে। তারপর দূরের সান্দাকফু পাহাড়ের দিকে তাকাল। অন্তত দশবার গিয়েছে যে সান্দাকফু। কোনও মজা নেই, শুধু সাদা পাহাড়গুলোকে দেখতে পাওয়া ছাড়া। তা সেই দেখতে আসে কাঁহা-কাঁহা থেকে মানুষজন। হেঁটে সান্দাকফুতে পৌঁছে এমন ভাব করে যেন রাজ্য জয় করে এল। এই গ্রামের পাশ দিয়েই উঠতে হয় ওদের। ওসব। দৃশ্য দেখা বেশ মজার। এক হাত জিভ বেরিয়ে এসেছে চড়াই ভেঙে, ফোঁসফোঁস করে জিজ্ঞাসা করে, কিতনা দূর? তা এইরকম একটা দল তাকে নগদ বিশটা টাকা পাইয়ে দিয়েছিল তিন হপ্তা আগে। চারজনের দলের সঙ্গে কোনও কুলি ছিল না। কাঁধের ব্যাগটা এত ওজনদার হয়েছিল যে সেগুলোকে বয়ে নিয়ে গিয়েছিল মানে। এমন কিছুই না। লোকগুলো কতরকম খাবার খেয়েছিল পথে, ভাগ পেয়েছিল সে। জীবনে কখনও ওইরকম খাবার জিভে পড়েনি তার। তারপর থেকে। একটা নেশা হয়ে গেছে মানের। এই ঢালু জায়গাটায় এসে বসে থাকে সে। আবার যদি কোনও বাঙালিবাবুর জিভ বেরিয়ে আসে তাহলে পকেটে কাগজ আসবে। কাগজের বড্ড দাম এই গ্রামে।
মনে হল, ওপরে যাওয়ার শৌখিন বাবুদের আজ আর পাওয়া যাবে না। ঠান্ডা বাড়ছে হু-হুঁ করে। আলো কমছে। সে একবার পেছন ফিরে তাকাল। নিশ্চয়ই এতক্ষণে যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নেওয়া হয়ে গিয়েছে। সিদ্ধান্ত দুটো, হয় বড়াভাবি বেরিয়ে যাবে, নয় থাকবে। রিম্বিক থেকে বড়াভাবির বাপ আর ভাইও এসেছে। জোর ব্যাপার।
মানে চোখ বন্ধ করে বড়াভাই-এর মুখ মনে করতে চেষ্টা করল। দু-কুড়ি দশ বছর বয়স ছিল। লোকটার। সবসময় হাসত। পরিবারের কর্তা হিসেবে সব দায় নিজের কাঁধে নিত। দুঃখ পেলেও হাসিটা ছিল মুখে। মানের যখন তিন বছর বয়স তখন বাপ মারা যায়। মা গিয়েছিল জন্ম দিয়েই। বড়াভাই তার বাপ হয়ে গেল। বড়াভাই-এর বাচ্চা নেই, বড়াভাবি তার মা হল না কিন্তু। তার জন্যে ছিল মরা বাপের মা। তার কাছেই পরিবারের সব বাচ্চাদের থাকতে হত। সে বুড়িও চোখ বুজেছে বছর তিনেক। বড়ভাই ছিল মাটির মানুষ। লেপচাঁদের কথা খুব ভাবত সে। লেপচারা সংখ্যায় দিন-দিন কমে যাচ্ছে, বেশির ভাগই সাহেবদের ধর্ম নিয়ে নিয়েছে। বড়ভাই-এর এসব ব্যাপার একদম পছন্দ ছিল না। প্রায়ই তাদের কাছে ওই খারাপ লাগার কথা বলত। বলত, আমাদের পরিবারের যেন কোনও ভাঙন না দেখা দেয়। ওই জমি আমাদের পনেরো জনের রক্তের মতন। ওই জমি আমাদের মা, আমাদের একই সঙ্গে বেঁধে রাখবে।
কিন্তু বড়াভাবি একদম মান্য করত না বড়াভাইকে। সারাদিন ঝগড়াই লেগে থাকত। বুড়ি দাদি গজগজ করত, একটা বাচ্চা পেটে দিতে পারলেই নাকি ঝগড়া থেমে যাবে। কিন্তু মাথার ওপরে যে ভগবান আছে সে নিজের কাজকর্ম ভালো করে বোঝে না। তা ছাড়া বড়াভাবির গায়ে নানান দুর্নামের গন্ধ লাগতে শুরু করেছিল। এই গ্রামের নিয়ম হল কোনও বিবাহিতা মেয়ের সঙ্গে নটঘট করলে কড়া শাস্তি হবে। কিন্তু অভিযোগ তুলতে হবে সেই মেয়ের স্বামীকে। বড়ভাই সব জেনেও চুপ করে বসে থাকত। তারপর হঠাৎ এই সেদিন পেটে যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেল বড়াভাই-এর। আর দুদিনেই শরীর স্থির। সারা গ্রামের মানুষ বলেছিল, এরকম লোক আর জন্মাবে না।
কিন্তু তাতে কার কী লাভ হল?বড়াভাবি এবার চলে যাবে রিম্বিকে। যাওয়ার সময় পনেরো ভাগের দু-ভাগ জমি সঙ্গে নিয়ে যাবে। তার আর বড়াভাই-এর অংশ। ওই জমি চলে গেলে পেটে হাত পড়বে সবার। জমি যদি ছেড়ে দিতে না চায় তো পরিবারের বাকি লোক তা কিনে নিতে পারে বড়ভাবির কাছ থেকে। কিন্তু সে-টাকা কই?খামোকা নিজের জমির জন্যে টাকা দিতে ধার করবে কেন সবাই? কিন্তু আর একটা আইন আছে লেপচা পরিবারে, জমি বাঁচাবার জন্যে যে আইন করে দিয়েছিল পূর্বপুরুষেরা। সেই আইনে বড়াভাবিকে বেঁধে রাখা যায়। আর তাই নিয়ে আলোচনা সভা বসেছে বাড়ির উঠোনে। মেজোভাই এই সভার উদ্যোক্তা।
মানে আর একবার বাড়ির দিকে তাকাল। অন্ধকারের পাতলা চাদর ঝুলবে এখনই। সে খানিকটা চড়াই ভেঙে পরিত্যক্ত চালাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এই চালাটা ছিল একটা বুড়ির। তার না। ছিল জমিজমা না ছিল সন্তান। লোকের কাছে হাত পেতে বেঁচে থাকত। কিন্তু মানুষটা ছিল অদ্ভুত। প্রত্যেক বাচ্চা ছেলেকে বলত আমি মরলে আমার বাড়িটা তোর। ওই বাড়িতে হাওয়া ঢোকে,। বরফ আটকায় না, জল হলে ন্যাতা হয়ে যায়। কে থাকতে যাবে সেখানে! বুড়ি মরার পরও কেউ হাত দেয়নি, চালাটা অমনি আছে। মানের মতলব এল, এটাকে সারিয়ে নিয়ে থাকলে কেমন হয়! গাঁয়ের আর পাঁচজন যদি আপত্তি না করে তাহলে বেশ একা-একা থাকা যাবে! এই সময় কলরব শোনা গেল। চারটে মেয়ে কলবলিয়ে উঠে আসছে নিচের ঝোরা থেকে। তাদের প্রত্যেকের মাথায় ভরা কলসি। মানের খেলার সাথী ছিল একদিন। বড় হয়ে যাওয়ার পর ওরা এখন ছেলেদের সঙ্গে মেশে না। মানেকে দেখামাত্র ওদের হাসি বেড়ে গেল। কলসি নামিয়ে এ ওর। গায়ে ঢলে পড়ল। তারপর ওদের মধ্যে যে সবচেয়ে মুখরা সে হাত নেড়ে বলে উঠল, এ মানে, ছি-ছি, আজ তুই ওইরকম নোংরা জামা পরে আছিস, ছি-ছি!
মানে নিজের জামা দেখল, মোটেই নোংরা নয়। তা ছাড়া এর অনেকটাই তো কম্বলের তলায় ঢাকা আছে। সে বলল, যা ভাগ। নিজের কাম কর।
কাম? মেয়েগুলো আরও গলিত হল যেন। তারপর একজন গালে হাত রেখে বলল, পেট ভরে মিঠাই খাব কিন্তু। মানেভঞ্জন থেকে আনবি না সুখিয়াপোখরি?
মিঠাই?মিঠাই কেন খাওয়াতে যাব তোদের?
আই বাপ! আজ বাদে কাল তোর বিয়ে আর মিঠাই খাব না? সঙ্গে-সঙ্গে হাসির বাজনা বাজল যেন। তারপর ওরা কলসি তুলে নিল আবার মাথায়। এবং এতক্ষণ যে মেয়েটি একদম কথা বলছিল না, সঙ্গিনীদের হাসির সঙ্গে তাল রাখছিল মাত্র, সে বলে উঠল, ওই বুড়ি জমিকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাক।
এই কথায় কোনও হাসি বাজল না। ওদের শরীর দ্রুত গাঁয়ের দিকে ফিরে যাওয়া মাত্র বাতাসে হাঁক ভেসে এল, মানে, এ মা-নে, মানে দা-জু-উ-উ!
হাঁকটা দিচ্ছে ওর মেজো ভাইপো। মাত্র আট বছর বয়স, তার খুব ন্যাওটা। কিন্তু বুড়ি জমিকে জড়িয়ে শুয়ে থাকতে বলল কেন মেয়েটা? ওই জমি তাদের প্রাণ, অন্নদাতা তাদের রক্ত। ওই জমিকে ভালোবাসব না তো তোকে জড়াতে যাব আমি? মেয়েটির উদ্দেশে একটি গালাগাল। সজোরে উচ্চারণ করতেই তাকে আবিষ্কার করে ফেলল, ভাইপো, এ দাজু, সবাই তোমাকে খুঁজছে আর তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছ? চলল, চলো।
খুঁজছে কেন? মানে খিঁচিয়ে উঠল, আমাকে কী দরকার?বড়াভাবি বাপের বাড়িতে চলে যায়নি?
দ্রুত মাথা নাড়ল ভাইপো। না, যায়নি। তার মানে পরিবারের জমি পরিবারেই থাকছে। একটু ভালো লাগা শুরু হতে না হতেই আর একটাদম বন্ধ উত্তেজনা জন্ম নিল বুকে। মেজোভাই। গাঁয়ের মাতব্বরদের সঙ্গে অনেক কথা বলেছে। কিন্তু সঠিক উত্তরাধিকারীর সন্ধান পাওয়া সম্ভব হয়নি। আজকের সভায় স্থির ছিল যদি বড়াভাবির বাড়ি ছেড়ে যাওয়া বন্ধ করা যায় তাহলে সেই সন্ধানটি আজকেই মিটিয়ে ফেলা হবে। মানের সমস্ত রক্ত কম্বলের তলাতেও ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। উঠোনে আগুন জ্বলছে। জংলি কাঠের আগুন। পরিবারের এবং গাঁয়ের মাতব্বররা সেই আগুনের চারপাশে জড়ো, গোল হয়ে বসে ধূমপান করছে। চারপাশে ঘরের আড়াল থাকায় এখানে হাওয়া ঢোকে না, ঠান্ডাটা, কম। মেয়েরা কেউ এই আলোচনায় নেই। তারা বাচ্চাদের নিয়ে ঘরে-ঘরে। কান পেতেছে। মানে সভায় ঢুকে শরীর থেকে কম্বলটা খুলল। আগুনের তাতে চমৎকার গরম। ছড়াচ্ছে। মেজোভাই তাকে দেখে বলল, এই যে, মানে এসে গিয়েছে। আয় মানে, এখানে বস। এত আদর করে তাকে কখনও ডাকেনি মেজোভাই। মানে একবার সমবেত মাতব্বরদের দিকে তাকাল, তারপর আগুনের সামনে গিয়ে বসল।
মেজোভাই বলল, বড়া দাজু, আপনি কথা শুরু করুন।
বড়া দাজু হলেন এই গ্রামের সবচেয়ে প্রবীণ ব্যাক্তি। চার কুড়ির ওপর বয়স। মানে চোখ তুলে দেখল বড়াভাবির বাবা কিংবা ভাই এই আলোচনা সভায় নেই। ওরা কখন চলে গিয়েছে তা সে জানে না। বড়া দাজু বললেন, এ বড় খুশির কথা, খুশির কথা। ভগবান আমাদের পেট ভরানোর মতো জমি বেশি দেননি। যা দিয়েছেন তাই আমরা যত্ন করে রাখতে চাই। পাহাড়ের নিচের মানুষদের অনেক জমি, সেখানে ভগবান অনেক জল দেন, খুব ফসল ফলে। আমাদের মেহনত করতে হয় অনেক বেশি কিন্তু তাও পেট ভরে না। সেই জমি যদি ভাগ হয়ে যায়, কেউ তার অংশ নিয়ে চলে যায় তাহলে সাক্ষাৎ মৃত্যু। এসব কথা তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, মানে?
মানে মাথা নাড়ল, সে বুঝতে পারছে।
ভালো। তোমরা চার ভাই। তোমাদের বড়ভাই-এর মতো মাটির মানুষ আমি দেখিনি। ভালোমানুষদের ভগবান খুব দ্রুত টেনে নিয়ে যান তাঁর কাছে। তোমার মেজোভাই অত্যন্ত বিচক্ষণ। খুব ঠান্ডামাথার মানুষ। তোমার সেজোভাই-এর ওপর ভগবান করুণা করেননি। জন্ম থেকেই সে হাঁটতেও পারে না, কথা বলতে পারে না। বড় কষ্ট তার। আর ছোটভাই হিসেবে তোমার জন্যে আমরা গর্ব করি। কী সুন্দর স্বাস্থ্য দিয়েছেন ভগবান তোমাকে! সেজোভাই-এর সব খামতি তোমার মধ্যে তিনি পূরণ করে দিয়েছেন। এখন কথা হল, তোমার বড়ভাই মারা যাওয়ার পর তোমার বড়াভাবি কি করবেন! তার বয়স মাত্র দুই কুড়ি চার। এখনও তাকে যৌবন ছেড়ে যায়নি। কোনও সন্তান নেই। সে আবার বিবাহ করতে পারে। তার বাপ আজ এসেছিল ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। যাওয়ার সময় সে নিয়ে যাবে জমির ওপর তার দাবি, স্বামীর অংশ। বুঝতেই পারছ তোমাদের সংসারের ওপর কি আঘাত নেমে এসেছিল। তোমাদের এমন অর্থ নেই যে অংশটা বড়াভাবির কাছ থেকে কিনে নেবে। ওরা তো ছাড়বেই না। কিন্তু আমাদের আইনে, ধর্মে যে। বিধান আছে তা সবাই মানতে বাধ্য। বিধানটা হল যদি স্বামী মারা যায় তাহলে স্ত্রীকে বিবাহ। করবে তার সবচেয়ে বড় অবিবাহিত দেওর। সে যদি বিবাহিত হয় তাহলে তার পরের ভাই। যদি কোনও ভাই অবিবাহিত না থাকে তাহলে জেঠা বা কাকার ছেলেদের সঙ্গে ওই বিবাহ হতে পারে।
বড়াদাজু নিশ্বাস ফেলল, কিন্তু তোমার বড়াভাবি এসব বিধান শুনতে চাইছিল না। তোমার মেজোভাই বিবাহিত অতএব সেজোভাই-এর পবিত্র অধিকার ভোগ করার কথা। সে অবিবাহিত। কিন্তু তাকে প্রত্যাখান করেছে বড়াভাবি। আমাদের বিধানে অবশ্য এ ব্যাপারে সমর্থন করা আছে। এখন একমাত্র তুমিই অবিবাহিত এবং তোমাদের জমি এবং বড়াভাই-এর প্রতি সন্মান দেওয়ার সুযোগ পেয়েছ। এ ব্যাপারে তোমার কিছু বলার আছে?
মানে শূন্য চোখে আগুনের দিকে তাকাল। বড়াভাবিকে বিয়ে করতে হবে তাকে?আজ সকাল থেকে এই ভয়টা তাকে টোকা মেরে যাচ্ছিল। এখন আগুনের সামনে বসে তার শীত আরও বেড়ে গেল। বড়াভাবির মাথার চুলে পাক ধরেছে। খুব কাছে গেলে সেই দুই-একটা বেরিয়ে আসা সাদা চুলকে দেখা যায়। শরীর বেশ ভারী। বুক দুটো পাথরের মতো, সান্দাকফু পাহাড়কে কেটে বসিয়ে দেওয়া। সে যখন জন্মেছিল তখন বড়াভাবির বয়স এক কুড়ি সাত। মানের কোনওদিকে মন ছিল না। সে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিবাদ করতে চাইল। সে বিয়ে করবে একটা পনেরো-ষোলো বছরের মেয়েকে যার এই শীতেও নাকের ডগায় টলটলে ঘাম জমে। একটা বুড়ি মোষের সঙ্গে এরা কেন তাকে জুতে দিচ্ছে? ওই বুড়ি যদ্দিন মারা না যাবে তদ্দিন সে বিয়ে করতে পারবে না। যদি দু-কুড়ি বছর পর বুড়ি মারা যায় তাহলে সে নিজেও বুড়ো হয়ে যাবে। আর তখন কে তাকে বিয়ে করবে! মানের শরীরে কম্পন এল।
আর এই সময় বড়া দাজু বলল, মানে, তুমি রাজি?
সে কিছু বলার আগেই মেজোভাই উঠে দাঁড়াল, হ্যাঁ, ও রাজি। আমি মানেকে জানি। ওর মতো শান্ত ভালো ছেলের দাদা বলে আমি গর্বিত। ও কখনও আদেশ অমান্য করে না। তা ছাড়া এই জমিকে ও প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। এবারে ও সারা মরসুম আমার সঙ্গে চাষ করেছে। এর ওপরে আরও একটা কথা আছে, আমাদের বড়াদাদার বিধবা বলেছে যে এই পরিবারের কাউকে যদি বিয়ে করতে হয় তাহলে মানেকেই করবে, অন্য কাউকে নয়। মানে তার পছন্দের সন্মান রাখবে। মানে, ভাই আমার, হ্যাঁ কি না?
মেজদাদার কথাগুলো হঠাৎ বিবশ করে দিল মানেকে। সে সন্মোহিতের মতো ঘাড় নাড়তেই। সমবেত মানুষ হর্ষধ্বনি করে উঠল। মেজোভাই হাত জোড় করে বলল, তাহলে আর দেরি নয়। দ্বিতীয় বিবাহে তো বেশি নিয়মের দরকার হয় না। আজই কাজ সেরে ফেলা যাক। বড়া দাজু সন্মতি দিলেন এই প্রস্তাবে।
পাহাড়ে রাত নামে সন্ধের আগেই। আর সেটা ঘন হয় বাতাসের ঝাঁপটা লাগলেই। নিয়মকানুন চুকে গেলে মানে চোরের মতো বসেছিল। গাঁয়ের বিভিন্ন ঘর থেকে যারা এসেছিল তারা রাতের দোহাই দিয়ে ফিরে যাওয়ার আগে শুনল এর পরের পূর্ণিমায় খাওয়া-দাওয়া হবে। শেষ লোক যে গেল তার নাম পূরণ। জাতবজ্জাত লোকটা। হাতে কাঁচা পয়সা আছে। জমির ধার ধারে না, মানেভঞ্জন দার্জিলিং-এ গিয়ে ট্যুরিস্টবাবুদের গাইড হয়। যাওয়ার আগে সে কানে-কানে বলে গেল, তোর বউ-এর খাঁই খুব। শরীরটা যেন চোরাবালি। চট করে ডুবে যাস না যেন। তোকে। আমার হিংসে হচ্ছে রে।
শেষ কথাগুলো যে একদম বুক থেকে বলা তাতে সন্দেহ নেই। তার ডবল বয়সের এই লোকটা এতদিন তাকে পাত্তাই দিত না অথচ আজ এমন ভঙ্গিতে বলে গেল যেন কতকালের বন্ধু। শালার যে বড়াভাবির ওপর নজর ছিল তা এই গ্রামের কার না জানতে বাকি আছে! মানে উঠল। বিয়ের পর বউকে সে-রাতের মতো সরিয়ে নেয় না কেউ, কিন্তু বড়াভাবি নিজেই উঠে গেছে তার নিজের ঘরে যেখানে সে বড়াভাইয়ের সঙ্গে শুতে।
মানের নিজের কোনও ঘর নেই। আর পাঁচটা বাচ্চার সঙ্গে বুড়িদাদির ঘরে তার রাত কাটত। সে ঘরে নিশ্চয়ই এখন রাত কাটানো যাবে না। মানে বাইরে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই তাকে দেখতে পেল মেজোভাই, আই, কোথায় যাচ্ছিস?
ঘুরতে।
মাথা খারাপ হয়েছে নাকি? এই ঠান্ডায় কেউ বাইরে যায়? তারপর কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল মেজোভাই, আজ তুই আমার বুকে শান্তি এনে দিয়েছিস মানে। এই জমির অংশ চলে গেলে আমাদের পরিবারটা বাঁচত না। ওই পূরণ শালা জমিটা কিনবার জন্যে ঘুরঘুর করছিল, তুই বাঁচিয়েছিস। যাক, এখন এই তুই ওকে বড়াভাবি বলে ভাববি না, নিজের বউ-এর মতো দেখবি। প্রয়োজনে কড়া হবি। যা ঘরে যা।
কোন ঘরে?
বড়দাদার ঘরে।
না, ওই ঘরে আমি শোেব না। বড়াভাই আমার বাপের মতো।
মেজোভাই হকচকিয়ে গেল, তাহলে? আমাদের আর একটা নতুন ঘর তুলতে যে সময় লাগবে?
লাগুক। তাতে আমার কী? আমি চললাম বুড়ির চালায়।
বুড়ির চালা? ওখানে তো হাওয়া ঢোকে।
ঢুকুক। আমার কম্বল আছে। কথাটা বলে হনহন করে হাঁটতে লাগল মানে। তার খুব রাগ হচ্ছিল। সমস্ত ব্যাপারটাই এমন হুটহাট করে ঘটে গেল যেন সে একটা পুতুল।
ক্রোধ মানুষের অন্য অনুভুতিগুলিকে ভোঁতা করে দেয়। মানে জানলই না ঠান্ডার কামড় কতখানি। চালায় ঢোকার পর সে প্রথম ঠান্ডা টের পেল। কম্বলের তলায় শরীরটা কনকন। করছে। চালাটা নোংরা নয়। বোধহয় বাচ্চারা এখানে খেলা করে বলেই বেশি ধুলো জমেনি। ধুলো জমলে নাকে গন্ধ আসত। ফাঁক-ফোকর দিয়ে বাতাস আসছে। একটা দেওয়াল ঘেঁষে বাঁশের খুঁটির ওপর বাঁশ পেতে খাট করা। কোনও বিছানাপত্র নেই। দরজা একটা আছে বটে তবে সেটা ঠান্ডা বাঁচানোর জন্যে, আত্মরক্ষার জন্যে নয়। একটা আলো সঙ্গে রাখলে ভালো হত। বাড়ি থেকে বেরুবার সময় যে উত্তেজনাটা বুকে ছোবল মারছিল এখন সেটার মাজা ভেঙেছে। অন্ধকারেরও নিজস্ব একটা আলো থাকে। চোখ সয়ে নিয়ে সেই আলোটাকে আবিষ্কার করে। মানে সেই আলোর ফাঁক-ফোঁকরগুলো ভরতি করতে চাইল। প্রায় মিনিট দশেকের চেষ্টায় বাতাস ঢোকা বন্ধ হল। কিন্তু এটা অত্যন্ত সাময়িক প্রতিরোধ। একটু ঝড় উঠলে বা বরফ পড়লেই যে-কে সেই হবে।
বাঁশের মাচাটা কনকন করছে ঠান্ডায়। আর একটা কম্বল আনলে হত। বাবুরা পাহাড়ে বেড়াতে যায় এক ধরনের থলি নিয়ে। শরীরটাকে ঢুকিয়ে দিলে আর ঠান্ডা লাগে না। সেরকম একটা হলে বেশ হত। কম্বল মুড়ি দিল মানে। এই চালাটা কারও নয়। জমিটায় পাথর বলে কোনও মালিক নেই। এই চালাটাই সারিয়ে নিলে কেমন হয়। বড়া দা জ্বর কাছে অনুমতি নিতে হবে। অবশ্য গাঁয়ের লোকেরা পাঁচটা ওজর দেখাবে সঙ্গে-সঙ্গে।
শরীরটায় ঠান্ডা কিছুতেই যাচ্ছে না। মানে উঠল। ঘরের কোণায় কয়েকটা মোটা কাঠ দেখেছিল। সেগুলো জড়ো করে কয়েকটা কুচো কাঠে দেশলাই ঠুকল সে। যদিও এই কাঠেরস নেই তবু ধরানো খুব মুশকিল। ফুঁ দিতে-দিতে শেষপর্যন্ত আগুনের দেখা পেল। তারপর সেটাকে লালন করতে-করতে আরও একটু বাড়ল। দুটো হাত সেঁকে নিল মানে। আর তার পরেই চোখে পড়ল একটা নেড়ি জুলজুল করে তাকে দেখছে মাচার নিচে বসে। এটার বোধ হয় এটাই আস্তানা এখন। তাড়াতে গিয়েও মন পালটালো সে। থাক বেচারা। আগুনটা মাঝখানে বাড়ছে। বেশ তাত ছড়াচ্ছে। চালায় একটা লালচে আভা কাঁপছে। আবার কম্বলটাকে টেনে নিল সে। মোটা কাঠের গুঁড়িটায় আগুন ধরছে। সারারাত জ্বলবে নিশ্চয়ই। শরীরে আর তেমন ঠান্ডা ভাব নেই। শুধু বাঁশের খাঁজগুলো পিঠে লাগছে। চোখ বন্ধ করল মানে। আজ তার বিয়ে হয়ে গেল। কত সোজা ব্যাপার যেন। অথচ সে বিয়ে করতে পারত একটা ডাঁসা মেয়েকে। ওই আজ যারা কলসি মাথায় করে জল নিয়ে এসেছিল তাদের সবচেয়ে চুপচাপ মেয়েটাকে। ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলল সে। নিজের শরীরে যে যৌবনের ফুলকি জন্মেছে সেটা কিছুদিন থেকেই বুঝতে পারছিল সে। কিন্তু–। হাঁ করে নিশ্বাস নিতেই দরজায় শব্দ হল। কেউ যেন শব্দটা ইচ্ছে করেই করল। দরজাটা খুলল এবং বন্ধ হল। তারপরেই চাপা গলায় প্রশ্ন, এখানে এসে শোওয়া হয়েছে যে?
মানে সাড়া দিল না। বড়াভাবির বলার ধরন এইরকম। সে যখন বাড়ন্ত হল, হাতপায়ের গুলি শান্ত হল তখন থেকেই ওইরকম ঠোকরানো কথাবার্তা।
আজকের রাতে কেউ আলাদা শোয় নাকি?
আমি এখানেই শোব। চোখ না খুলে বলল মানে।
এখানেই শোব?ই-ই! শোব বললেই হল! শুতে দিচ্ছে কে? এই খোলা মাঠের মধ্যে আমি শুতে পারব না। ওঠো, ঘরে চলো। লোকে বলবে কী? শেষ বাক্যটা এমন নরম গলায় যে চোখ না। খুলে পারল না মানে। আর খুলতেই সে চমকে উঠল।
বিয়ের আসরে বড়াভাবিকে সে দেখতে পায়নি। মাথা থেকে পা পর্যন্ত কাপড়ে ঢাকা ছিল তার। ঘোমটার ফাঁকে চিবুকের যে অংশ দেখা যাচ্ছিল সেদিকেও নজর দিতে ইচ্ছে করেনি। কোনও আকর্ষণ বোধ করেনি সে ওদিকে তাকাতে। কিন্তু একী সাজ সেজেছে বড়াভাবি। গায়ে কম্বল। জড়ানো বটে কিন্তু মাথার চুল খুব কায়দা করে বাঁধা, মুখে পাউডার, খোঁপায় ফুল, আর দু-হাত ভরতি নানান রঙের চুড়ি। কেমন যেন অন্যরকম দেখাচ্ছে। প্রতিদিনের আটপৌরে গন্ধটা একটুও শরীরে নেই।
বড়াভাবি ততক্ষণে মাচায় এসে বসেছে। বসে বলল, আমার অবশ্য ওই বাড়িতে থাকতে একদম ইচ্ছে করে না। আমি তো বাপের বাড়িতে চলে যাব বলে ঠিকই করেছিলাম। ওখানে কত ছেলে। আমার জন্যে হা-পিত্যেশ করে বসে আছে। শুধু ওখানে কেন, এই গ্রামে নেই নাকি? যেমন ধরো পূরণ। সে বলেছিল তুমি বাপের বাড়িতে চলে যাও আমি তোমাকে সাদি করে ফের এই গ্রামে। নিয়ে আসব। কিন্তু লোকটা ধান্দাবাজ, একসঙ্গে পাঁচটা মেয়ের পেছনে ঘোরে। তারপর যখন তোমার মেজোভাই আমার হাতে-পায়ে ধরল, বলল, জমি বাঁচাও, বিধান মানো, আমার বাপটাও যখন তাই বোঝাল, তখন আমি বললাম, মরে গেলেও ওই রদ্দি নুলো দেওরটাকে বিয়ে করতে। পারব না। বিয়ে যদি করতেই হয় তো তোমাকে। কথাটা বলে হাত বাড়িয়ে মানের চিবুক ধরে নেড়ে দিয়ে মদির হাসল সে, তরতাজা জোয়ান, যত বয়স হবে তত গাছের মতো মজবুত হবে। এইরকম জোয়ান না হলে সুখ হবে কি করে বলো! তাই রাজি হয়ে গেলাম। চলল, ওঠো, ঘরে যাই। দু-হাত দু-পাশে ছড়িয়ে হাই তুলল বড়াভাবি।
আমি এখানেই থাকব। মিনমিন করে বলল মানে।
এখানে কেন? এই নোংরা জায়গায় আমি থাকতে পারব না। ফোঁস করে উঠল গলার স্বর।
বড়াভাবি, তুমি আমাকে মাপ করে দাও।
ব-ড়া-ভা-বি। হি-হি করে হেসে উঠল, যেন এর চেয়ে হাসির কথা সে জীবনে শোনেনি, আমি আজ থেকে তোমার বউ, তুমি আমার সম্পত্তি। ওসব বলে খবরদার ডাকবে না।
দু-চোখ বড় করে তার রক্ত দেখাল যেন সে, আমার নাম নিমা, তাই বলবে।
মানে ঢোঁক গিলল, ওই ঘর বড়াভাই-এর। ওখানে গেলে–।
ও এই কথা। দূর পাগল। তোমাদের বড়াভাই একটা মানুষ ছিল নাকি! একটা পিঁপড়ের ক্ষমতাও ওর চেয়ে বেশি ছিল। যে পুরুষ বউকে সুখ দিতে পারে না সে আবার পুরুষ নাকি? তার জন্যে মন কেমন করার কোনও দরকার নেই। চলো। এবার হাত ধরে টানল নিমা।
হঠাৎ ভেঙে পড়ল মানে, আমার মন মানছে না।
কেন, মন মানছে না কেন? আমি কি খারাপ? গ্রামের সব ছোঁড়াবুড়ো আমায় পেলে বর্তে যায়, তা জানো? গর্জে উঠল নিমা, নাকি অন্য মতলব! কোনও বাচ্চা মেয়ের কাছে ফেঁসে গেছ এর মধ্যে! ডাগর ছাগল পেলে রাক্ষুসিরা তো ছাড়ে না। সত্যি বলো?
না, আমি ওসবের মধ্যে নেই।
নেই তো? ভালো। শোনো, তোমায় একটা কথা বলি। ওই যে হাড়জিরজিরে বাচ্চা মেয়েরা, ওরা কোনও কম্মের নয়। এক-হাঁটু ঝোরায় স্নান করতে কী মজা লাগে? স্নানের জন্যে চাই ডুবজল, ইচ্ছেমতন সাঁতার দেওয়া যায় যেখানে। কথাটা মনে থাকবে?
মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল মানে, তা হোক, তবু আজ আমি এখানে থাকি।
কিছুক্ষণ কথা না বলে নিমা ওর দিকে তাকিয়ে থাকল। যেন মতলবটা বুঝতে চাইল। আগুনটা এখন জব্বর জ্বলছে। তার লাল আভায় নিমার মুখটা রহস্যময় দেখাচ্ছিল। শেষপর্যন্ত একটা। নিশ্বাস ফেলে সে উঠে দরজার কাছে গেল। বাইরে মুখ বাড়িয়ে সঙ্গে-সঙ্গে সরিয়ে নিল, আই বাপ, কী ঠান্ডা!
তারপর দরজাটা বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করল কিছু সময়, এটা তো বন্ধই হয় না। না হোক, এত ঠান্ডায় আর কে আসবে! সরো কম্বলটা পেতে দিই ওই মাচার ওপরে। একটা নিচে আর একটা গায়ে দেব। তুমি ততক্ষণে আগুনটা আরও জোরদার করে দাও। তাহলে রাতটা গরমে গরমে কাটবে। চোখ মটকে হাসল নিমা।
হুকুম পালন করতে-করতে বড়াভাবি, নানিমার সুবৃহৎ নিতম্ব দেখে মানে আরও জবুথবু হয়ে যেতে লাগল। এই মেয়েমানুষটাকে খুড়ি, জেঠি এবং বড়াভাবি ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যায় না। এখন ওর মতলব এই চালাতেই রাত কাটানো। মানে পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে আগুনে ধরিয়ে নিল। তারপর চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগল তার কি করা উচিত! ভেবে কূল পাচ্ছিল না সে।
উঃ, কী ঠান্ডা রে বাবা! আমাকে সুখটানটা দাও তো!
মানে চোখ তুলে দেখল একটা সাদা পাইথন তার সামনে নড়ছে। ওটা যে নিটোল হাত, যার কোথাও আবরণ নেই, কম্বলের তলায় শোওয়া শরীরটা থেকে বেরিয়ে এসে তার সামনে। প্রত্যাশায় আঙুল নাড়ছে তা বুঝতে সময় লাগল। সে সম্মোহিতের মতো বিড়িটা এগিয়ে দিতেই লাল ফুলকিটা টিপের মতো আর একটা ঠোঁটে আটকে গেল যেন। তারপর ভুল করে খানিকটা ধোঁয়া ছেড়ে বিড়ির শেষ অস্তিত্বটাকে আগুনে ছুঁড়ে দিয়ে ডাকল, এই এসো!
মানে এবার আবিষ্কার করল বড়াভাবি কিংবা নিমা যে কিনা এখন থেকে তার বউ সমস্ত কাপড়জামা ওপাশে ছেড়ে রেখে কম্বলের তলায় শুয়ে আড় ভাঙছে আর সেই ভঙিমায় কম্বল সরে যাওয়ার আগুনের রং লাগছে খোলা চামড়ায়।
এসো, এসো না!
জঙ্গলে আগুনের হাত শক্তিশালী হলে বাতাস তার বন্ধু হয়ে যায়। কোনও ঝরনার সাধ্য নেই সেই আগুন নেবায়। এই নিস্তব্ধ চরাচরে, বাইরে যখন ধারাল বাতাস বইছে শীতের ছুরি মুখে, কোথাও কোনও প্রাণের অস্তিত্ব নেই তখন আগুনের বুকে কাঠের জোড়গুলো ফাটছিল নিঃশব্দে।
এত ক্লান্তি এই জীবনে আসেনি মানের। একটা দেশলাই কাঠি যখন একগাদা শুকনো কাঠের ওপর পড়ে তখন আগুনের চেহারাটা বদলে যায়, কাঠিটাই পুড়ে মরে। ভোরের আগে হাতেপায়ে ধরেছিল নিমা। বারংবার ক্ষমা চেয়েছিল, নিষ্কৃতি চেয়েছিল এই রাত্রের জন্য। একটা পনেরো। বছরের উদ্দামতার কাছে হার মেনেছিল সে। জ্বলে ওঠার পর মানে যেন পাগল হয়ে গিয়েছিল। সেই নিশ্বাসে সমুদ্র শুষে নেওয়ার পর তাকে দেওয়ার কিছু ছিল না নিমার। পরাজিতা অথচ। ভীষণ সুখী দেখাচ্ছিল তাকে। এখন চালার মাঝখানে জ্বালানো নিবন্ত আগুনে শিশুর মতো তার ঘুমন্ত মুখটা দেখে উঠে দাঁড়াল মানে। ক্লান্তি শরীরে, কিন্তু ঘুম আসছে না।
সমস্ত শরীর কম্বলে মুড়ে দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসতেই ঠান্ডা চাবুক কষাল। মানে পায়ে-পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। তার শরীরে একটুও শক্তি নেই। কিছুদিন আগে তার এইরকম অবস্থা হয়েছিল। ওদের জমির পাশে যেখানে পাহাড়ের শুরু সেখানে খানিকটা সমান জায়গা আছে। সারাদিন। কোদাল নিয়ে মাটি কুপিয়েছিল সে। অনেকটা জমি কোপানোর পর যে আনন্দ তা টুক করে চলে গেল বিকেলবেলায়। কোদালের ফলা ঠং করে বাজল পাথরে। জমির তলায় পাথরের আস্তরণ। তখন যে ক্লান্তি শরীরে এসেছিল এটা সেইরকম। কোথায় যাচ্ছিল খেয়াল নেই, পাতলা অন্ধকারে হেঁটে যেতে-যেতে হঠাৎ ও মাটির গন্ধ পেল। তারপর মুখ তুলে দেখল সামনের আকাশে লালের ঘোর লেগেছে। কাঞ্চনজঙ্ঘার শরীরে রং পালটাচ্ছে। আর সে দাঁড়িয়ে আছে তাদের শূন্য চাষের জমির সামনে।
এই ফসলকাটা হয়ে যাওয়া খেত আর কোনওকালে বাড়বে না। উবু হয়ে বসে ভাঙা মাটিতে হাত রাখল মানে। বড়াভাবি কিংবা নিমা অথবা তার বউয়ের মা হওয়ার বয়স ফুরতে আর বেশি দেরি নেই। অথচ সে বাপ হতে পারে আরও দু-কুড়ি বছর। তদ্দিন যদি বড়াভাবি কিংবা নিমা অথবা তার বউ বেঁচে থাকে তাহলে তার বংশধর আসবে না। না এলে সংসার বাড়বে না। বড়াভাই ছেলেমেয়ে রেখে যায়নি। সেজোভাই পঙ্গু, অথর্ব। সে-প্রশ্নই নেই। চারভাই-এর এই জমিটা আর কিছুকাল পরেই মেজোভাই-এর দুই ছেলের হয়ে যাবে। চার থেকে দুই-এ। কাল রাত্রে সোহাগের সময় মেয়েছেলেটা বলেই ফেলল সে আর বাচ্চা চায় না, তাতে যৌবন মরে যায়। এ থেকে আর একটা রহস্যের আড়াল সরল। বড়ভাই-এর কি সবটাই দোষ ছিল?
মানে আরও কয়েক পা হাঁটল। সেই পাহাড় কেটে সমান করা জমিটার সামনে ও এখন। এই জমি কেউ ছোঁয় না, কারও লোভ নেই। সারাদিন কুপিয়ে যখন সে এর তলায় পাথরের আস্তরণ পেয়ে ভেঙে পড়েছিল হতাশায় তখন গ্রামের মানুষ হেসেছিল। এই অচাষযোগ্য জমির ওপর কারও লোভ নেই, তাই মমতাও নেই। মানে নিজেদের চাষযোগ্য জমিটার দিকে তাকাল। মেয়েমানুষটাকে বিয়ে করে সে ওই জমিটাকেই শুধু বাঁচায়নি, জমির অনেক দায়ও বাঁচিয়ে দিল। এখন থেকে ফসল খাওয়ার মুখ কমবে এই পরিবারে।
হাত বাড়িয়ে পাথুরে জমির মাটি স্পর্শ করল সে। শিশিরে কাদা-কাদা হয়ে আছে। এই মাটি ফসল ফলাবে না, তাই কারও আকাঙ্খ নেই, ভালোবাসা নেই এর ওপর। কিন্তু এর তলায় যে পাথরের আস্তরণ তার সীমা কতদূর! পৃথিবীর গভীর থেকে গভীর নিশ্চয়ই চলে যায়নি। ওই। পাথরের আস্তরণের নিচে নিশ্চয়ই নরম মাটি আছে উর্বর হয়ে। একবার যদি পাথরের আস্তরণটা তুলে ফেলা যায়–মানে রোমাঞ্চিত হল। পাওয়া যায়? একথা কেউ তাকে বলেনি।
দূরে কুয়াশায় ঢাকা বুড়ির চালাটার দিকে তাকিয়ে সে রোমাঞ্চিত হল। সামান্য মাটি খুঁড়ে সে পাথরটাকে আবিষ্কার করেছিল কিন্তু আরও খুঁড়লে যদি উর্বর মাটি মেলে? কাল রাত্রের অভিজ্ঞতা বলেছে পাথরের শক্তিও সীমিত। তাহলে? জ্যা-মুক্ত তিরের মতো মানে ছুটল তাদের বসতবাড়ির দিকে, একটা কোদাল খুঁজতে।
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন