অরণ্য, তুই

তসলিমা নাসরিন তসলিমা নাসরিন

১.
আমার কাছে এই জীবনের মানে কিন্তু আগাগোড়াই অর্থহীন,
যাপন করার প্রস্তুতি ঠিক নিতে নিতেই ফুরিয়ে যাবে যে-কোনোদিন।
গ্রহটির এই মানবজীবন ব্রহ্মাণ্ডের ইতি-হাসে
এক পলকের চমক ছাড়া আর কিছু নয়।
ওইপারেতে স্বর্গ নরক এ বিশ্বাসে
ধম্মে কম্মে মন দিচ্ছে—কী হয় কী হয়—সারাক্ষণই গুড়গুড়ে সংশয়

তাদের কথা বাদই দিই, সত্য কথা পাড়ি
খাপ খুলে আজ বের করিই না শখের তরবারি!
মানুষ তার নিজের বোমায় ধ্বংস হবে আজ নয়তো কাল,
জগত টালমাটাল।
আর তাছাড়া কদিন বাদে সুয্যিমামা গ্যাস ফুরিয়ে মরতে গিয়ে
পৃথিবীকে পেটের ভেতর এক চুমুকে শুষে নিয়ে
দেখিয়ে দেবে খেলা।
সাঙ্গ হবে মেলা
জানার পরও ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিঁড়ে কামড়ে তুচ্ছ কিছু বস্তু পাওয়ার লোভ,
ভীষণ রকম পরস্পরে হিংসেহিংসি ক্ষোভ।
মানুষের—কই যাবে দুর্ভোগ!
তাকত লাগে ভবিষ্যতের আশা ছুঁড়ে করতে কারও মহানন্দে মুহূর্তকে
ভোগ।
ভালোবাসতে শক্তি লাগে, হৃদয় লাগে সবকিছুকেই ভাগ করতে সমান
ভাগে,
কজন পারে আনতে রঙিন ইচ্ছেগুলো বাগে?
ভুলে যাস এক মিনিটের নেই ভরসা,
তোর ওই স্যাঁতস্যাঁতে-সব-স্বপ্ন-পোষা কুয়োর ব্যাঙের দশা
দেখে খুব দুঃখ করি, দিনদিনই তোর বাড়ছে তবু দিনরাত্তির কাদাঘাটা,
অরণ্য তুই কেমন করে এত বছর কামড়ে আছিস দেড়দুকাঠা!

ধুচ্ছাই!
সমুদ্দুরে চল তো যাই!

২.
অরণ্য তুই আমার জন্য একবার মরে দেখ,
দেখ কেমন করে বাঁচাই আমি তোকে।
একবার ভালোবেসে দেখ,
দেখ কী ভয়ঙ্কর সুখে আমি মরি!

৩.
এই বর্ষায় তুই কোথায় কার সঙ্গে কী করছিস অরণ্য?
কার ঘরে আটকা পড়ে আছিস?
কার ওপর অঝোরে ঝরছিস তুই?
তোর উঠোনে বুঝি এবছরও ছুতোর হাঁটুজল?


আমার সঙ্গে যেমন যেমন করিস, তেমন কি অন্য কারও সঙ্গেও?
কে সেই অন্য কেউ?
ভালোবাসে আমার চেয়েও বেশি?
তা যদি হয় তো ভালোই আছিস,
এদিকে এসে সময় নষ্টের কী দরকার।
এদিকে তো আবার জানিস সত্যিকারের হাঁটুজল।


ওখানেও তোরা খিচুড়ি আর ইলিশের উৎসব করিস!
যার কাছে থাকিস
আমার মতোই বোধহয় সে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ইলিশ
কিনতে,
আমার মতোই বোধহয় মগ্ন থাকে তোকে নিয়ে সারাদিন
কী খাবি, কী পরবি, কোথায় বসবি, শুবি, কীসে খুব আনন্দ পাবি !
আর তোর ওই শরীরের প্রতিটা তিলে তিরিশটা করে চুমু। ও-ও হয়?


একটুখানি দূরে সরলে আমার মতোই বুঝি সে কষ্ট পায়?
আমার মতোই বা বলি কেন, নিশ্চয়ই আমার চেয়েও বেশি।
বেশি না হলে আমার আলিঙ্গণ থেকে ছলে-কৌশলে নিজেকে ছাড়িয়ে
তার কাছেই বা যাবি কেন!
অরণ্য সত্যিই কি তুই সুখে আছিস, আগের চেয়েও অনেক?


৪.
যে আমি এক মুহূর্ত প্রেম ছাড়া বাঁচি না,
তাকে তুই সাতদিন হয়ে গেল প্রেম দিচ্ছিস না,
তাকে তুই সাত কোটি বছর প্রেম দিচ্ছিস না অরণ্য।
তার ত্বকে এখন খরা, বুকের মধ্যে আস্ত একটা মরুভূমি,
ভরা বর্ষা তাকে এতটুকু ছুঁতে পাচ্ছে না,
সারারাতের বৃষ্টি তার একটি লোমকূপও ভেজাতে পারে না।


তোর আঙুলে কি জাদু ছিল অরণ্য?
কী করে স্পর্শ মাত্র নদী হয়ে উঠতাম,
কী করে চুমু মাত্র আনখসমুদ্দুর!

তুই নেই।
জগতটা লু হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে হঠাৎ
চুপসে গিয়ে কালো কোনও গর্তে ঢুকে গেছে।
চারদিকটা হঠাৎ খুব অসহ্যরকম ফাঁকা।
তুই নেই, মাঝে মাঝে মনে হয় আমি বোধহয় আর বেঁচে নেই ।


৫.
মনে মনে মুক্তি চাস তো অরণ্য!
সেই মুক্তিই তোর জুটে যাচ্ছে, এক শরীর স্বাধীনতা পাবি,
রঙিন রঙিন ডানা পাবি। আস্ত একটা আকাশ পাবি।

ফাঁকা আছে কিনা জানতে চেয়ে কাকে এসএমএস করছিস,
কাকে দিকশূন্যপুরে নিযে গেলি, কাকে চুমু খেলি, কার সঙ্গে শুয়ে এলি,
এসব নিয়ে এখন আর পাগল হবো না।
তোকে এখন ততটাই ভালোবাসতে চাই যতটা বাসলে
অন্য কোনও রমণীকে তুই চুমু খেলে কোনও যন্ত্রণা হবে না আমার,
একশ সুন্দরীর সঙ্গে সারারাত সঙ্গম সারলেও কিছু যাবে আসবে না,
কারও প্রেমে উন্মাদ হলেও কোথাও কোনও ক্ষরণ হবে না।
আর কী চাই তোর, অরণ্য।
আমি এখন তোকে ততটাই ভালোবাসতে চাই
যতটা বাসলে মুঠো−ফান বাজলেই মনে হবে না এ তুই,
এসএমএসের শব্দ পেয়ে মনে হবে না এ তোর,
দরজায় কেউ এলে তোকে ভেবে দৌড়ে যাবো না।

এখন ততটাই ভালোবাসতে চাই,
যতটা বাসলে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামলে তোকে কাছে পেতে ইচ্ছে হবে
না,
সামনে এসে দাঁড়ালে হাত ছুঁতে হাত যাবে না তোর হাতের দিকে।
যতটা বাসলে চুমু খেতে ঠোঁট বাড়াবো না, যতটা বাসলে ভিজবো না
ভিতরে বাইরে একফোঁটা।
ততটাই তোকে ভালোবাসবো অরণ্য দেখে নিস, যতটা বাসলে
কোনওদিন আর দেখা না হলেও মনে হবে না দেখা হলে ভালো হত।

৬.
কতদিন এভাবে ভালো তোকে বেসেই যাবো, অরণ্য?
আর কতদিনই বা এভাবে ভালো তুই বেসেই যাবি, বল!
একদিন, মানুষ তো কোনও একদিন নিজের মুখোমুখি দাঁড়ায়!
ছিটেফোঁটা মানুষ যদি অবশিষ্ট থাকে ভেতরে কোথাও
খুঁজে তাকে সামনে আনে একদিন।
ধোঁকা দিতে দিতে, ঠকাতে ঠকাতে, মিথ্যে বলতে বলতে
একদিন থামে, সত্য বলে।
মানুষ তো একদিন দুঃখ পায়, একদিন কাঁদে।
তেমন একদিন তো তোর জীবনে কোনওদিন আসে না অরণ্য,

নন্দিনীর কাছেই ফিরিস প্রতি রাতে, মধ্যরাত হলেও ফিরিস।
নন্দিনীর কাছেই তোর নতমুখ, নতচোখ,
ওকেই মনে মনে দেবী মানিস। আসলেই কি মানিস?
আজ আমি, কাল সে যা কিছুই হোক
নন্দিনী যেন ঠিকঠাক থাকে, যেমন আছে
বাচ্চাজ্ঞশশুর মতো হাসিখুশি, যেন কিছু না বোঝে, কোনও কষ্ট যেন
কখনও না পায়
যেন একবারও না ভাবে ছেড়ে গেছিস।
কী করে পারিস যাপন করতে প্রতিদিন তোর
দ্বিচারী ষিনচারী চতুর্চারী জীবন!

কতদিন তোকে হেঁদিপেঁচির মতো ভালোবাসবো বল!
এবার একটু মানুষ হতে দে অরণ্য, তোকে চোখের আড়াল করি।
মানুষ হই, তোকে না ভালোবাসি।
মানুষ হই, তোকে দুঃখ দিই।
এখন পর্যন্ত কবিতাটি পড়া হয়েছে ৯০ বার
যদি কবিতাটা সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
    মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন