শিরোনাম: রাজ-সমাচার

রাজ-সমাচার
শংকর ব্রহ্ম

বাপ মা আদর করে নাম রেখেছিল রাজা।
বন্ধুরা ডাকত রাজু। তারা থাকে রেল লাইনের ধারে কাঁকুলিয়া বস্তিতে। তার একটা আদরের বোন ছিল,নাম রাণী। সকলে ডাকত রাণু।
সকলের স্নেহ মায়া কাটিয়ে একদিন সে বস্তির একটি মুসলমান ছেলের সঙ্গে বাড়ি থেকে কোথায় পালালো। মা বাবা কেউ তা মেনে নিতে পারেনি ছেলেটা মুসলমান বলে। তার ঘরের পথ সেদিন থেকেই বন্ধ হয়ে গেছে। এখন কোথায় আছে, কেমন আছে, কে জানে?

বাবা জুয়া খেলত, মদ খেত, সুযোগ পেলে চুরি ছিনতাইও করত। মা সেটা মেনে নিতে পারত না।
তাই নিয়ে বাবার সাথে মায়ের নিত্যদিন ঝগড়া অশান্তি লেগে থাকতে। মাকে ধরে পিটতো বাবা। একদিন কি কারণে বাবা খুন হয়ে গেল। লাশটা পাওয়া গিয়েছিল লাইনের উপর। মা খুব কান্নাকাটি করল। বলল, জানতাম এ’রকম কিছু একটা হবে, কতদিন বারণ করেছি, শোনেনি মিনসে। আমার মতো একটা মুখ্য মেয়েমানুষের কথা শুনবে কেন? আমার কোন কথা কোনদিন শোনেনি। শুনলে কী আজ তার এমন দশা হতো?
তার শোক একটু নিস্তেজ হয়ে এলে, মা বাবুর বড়িতে রান্নার কাজ নিল। সংসারে এখন রাজু আর তার মা, থাকে সেই কাঁকুলিয়া বস্তিতেই।

রাজু গড়িয়াহাট মার্কেটে মুটে-মজুরের কাজ করে। মাধ্যমিক ফেল ছেলেকে, কে আর কাজ দেবে? তাদের তেমন চেনা-জানা কেউকেটা নেই। বয়স তার পঁচিশ বছর।
রাজু হাঁটতে হাঁটতে আলেয়া সিনেমা হলের সামনে এসে দাঁড়ালো। সিনেমার বিজ্ঞাপনের দিকে মুখ তুলে তাকালো। কে যেন ডাকছে মনে হলো তার। ফিরে তাকালো পিছনে। না কেউ নেই। সে এবার বিজ্ঞাপনটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। সেই চিরাচরিত দৃশ্য। এক লাস্যময়ী যুবতী, তার বসন হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে, শরীরের নিষিদ্ধ অঞ্চল তাতে খানিকটা দেখা যাচ্ছে, তার পাশে এক সুঠাম সুদর্শন যুবক নায়িকার কোমড় জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
চোখদুটি হিংসায় জ্বলে উঠলো রাজুর। সিনেমার নায়কের প্রতি এক তীব্র ঘৃণা অনুভব করলো সে। ভাবল, মাইরি খাসা আছে, সিনেমার এই ঢেমনা-ঢেমনীগুলি।
সে একদলা থুতু ছুড়ে দিলো হোর্ডি পোষ্টারটার দিকে মুখ করে। তারপর আবার হাঁটতে শুরু করলো, ফুটপাথ ধরে। আর পাঁচজন বেকারের মতোই সে হেলেদুলে এলোমেলো মন্থর গতিতে এগোতে লাগলো। কত লোকই তো হাঁটছে, কই, কেউ তো তার মতো এতটা নির্লিপ্ত নয়। সকলেই যেন অস্থির, উদ্বিগ্ন। একজন নিষ্কর্মা লোকের মতো নিশ্চিন্ত হতে পারা এতটা সহজ নয় মনে হলো তার। সে মনে মনে হেসে ফেললো।
তারপর আবার দুলকি চালে হাঁটি হাঁটি পা পা করে গড়িয়াহাট মোড়ের দিকে এগোতে লাগলো। এইভাবে হাঁটা ভদ্রলোকের কর্ম, তার পক্ষে শোভন নয়। এতে খাদ্য হজমের সুবিধা হয় বটে, তবে তার মতো নিষ্কর্মা মজুরের যেখানে যখন খাবারই জোটে না, সেখানে – ‘হা হা হা হা হা’ হাসি পেলো আবার তার।
হাঁটতে হাঁটতে সে একটা বইয়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো, দেখলো দোকানে ঢোকার মুখে দেওয়ালে আঁকা শিল্পীর একটি বিমূর্তছবি। সে এবার দাঁত খিঁচোয়। রাগের মাথায় এক বিশেষ ভঙ্গিতে হাত উঁচু করে ধরে। শিল্পী সাহিত্যিকদেরও রেয়াত করে না। ঘৃণায় উচ্চারণ করে, শালা – যত্ত সব ধূর্ত, শুয়োরের বাচ্চা।
এমন সময়, দোকানের ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটা বাজল। রাজু ভাবে সময়ের বারটা বাজলো নাকি বারটা বাজলো এই সমাজের। যেখানে তার মতো একজন সকাল থেকে নির্জলা, এক কাপ চা-ও এখনও পেটে পড়েনি তার।
যা দিনকাল পড়েছে, তা’তে যে সে দুনিয়ায় টিঁকে আছে, এটাই বড় কথা এখন, মনে মনে ভাবলো সে। অবজ্ঞা ভরে সে রাস্তায় থুতু ছেটাতে ছেটাতে এগিয়ে চললো। আর কত থুতু ছেটাবে, গলাটাও শুকিয়ে কাঠ হয়ে উঠেছে।
একটা সাজানো মিষ্টির দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল সে। নিষিদ্ধ ফলের মতো সে’গুলোর দিকে লোভাতুর ক্ষুধার্ত দৃষ্টিতে তাকালো। কাঁচের শো-কেসটক তছনছ করে দেবার একটা তীব্র তাগিদ অনুভব করলো সে। তার হাতদু’টো পিছনে সরিয়ে আনলো, কারণ সে জানে, এই হাত দু’টোয় অসীম ক্ষমতা, যা কিছু করে ফেলতে পারে। শয়তানেরও গলা টিপে ধরে শেষ করে দিতে পারে। সে তার মায়ের কথা ভেবে, এ’সব কিছু সে করতে পারে না। তা না হলে কবেই – সে তা করে ফেলতো।
তার মনেহয়,দেশের আইন আসলে এই শয়তাদের রক্ষা কবজ।এই আইন আছে বলেই বদমাইশরা রক্ষা পেয়ে যাচ্ছে। দুর্বলদের জন্যই যত নিয়ম – কানুন, আর সবলরা যা করে সেটাই আইন হয়ে দাঁড়ায়।
রাজু তেমন শিক্ষিত নয়ন, যে সমাজ বদলের কথা ভাববে। তবে, ভাবতে পারলে কী যে হতো বলা যায় না।