শিরোনাম: পাথরের চোখ

গল্পকার: Author Avatar শংকর ব্রহ্ম

পাথরের চোখ
শংকর ব্রহ্ম

আমাদের দপ্তরেই লোকটা চাকরি করত। মাস কয়েক আগে জয়েন করেছে এখানে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, কারও সঙ্গে মিশত না সে , কথাও বলত না খুব একটা। কারও কোন ব্যাপারেই সে সাথে পাছে থাকত না। একা একা ক্যান্টিনে গিয়ে টিফিন করত। তার সম্পর্কে মেয়েদের কৌতূহলের শেষ ছিল না।
অফিসে আমরা পরস্পর, পরস্পরের সঙ্গে কত কথা বলতাম, রাজনীতি নিয়ে ,খেলা নিয়ে গল্প করতাম , সিনেমা নিয়ে, বইমেলা নিয়ে আলোচনা করতাম। সে সব সময়ই থাকত নীরব। কোন ব্যাপারে যেন তার কোন কৌতূহল ছিল না। সে কখনও কোন মতামত প্রকাশ করত না, আমাদের আলোচনার বিষয়।
যতবার আমি তার চোখের দিকে তাকিয়েছি, দেখছি যেন পাথের এক-জোড়া চোখ, ভাষাহীন।
অফিসের মেয়ে মহলে তার প্রসঙ্গে আলোচনা উঠলে, বুদ্বুদের মতো কয়েকবার ভুড়ভুড়ি উঠেই আবার হঠাৎ মিলিয়ে যেত। কারণ কেউ তার সম্পর্কে বেশী কিছু জানত না, ফলে আলোচনা আর বেশী দূর এগোতে পারত না।
কখনও সখনও সে আমার কাছ থেকে গল্পের বই বা পত্রিকা চেয়ে নিয়ে পড়ত। কিন্ত সেই বই সম্পর্কেও কখনও কোন মন্তব্য প্রকাশ করত না।
তাকে দেখে আমার মনে হত, গোবেচারা স্বভাবের ভাবলেশহীন মানুষ একজন সে। যার আমাদের কারও সম্পর্কে কোন কৌতূহল নেই, বিস্ময় নেই । আশ্চর্য মানুষই বটে একজন।

পুরনো অফিস ক্যান্টিন ভেঙে আবার নতুন করে গড়া হচ্ছে। ফলে, অনেকেই নিজের টেবিলে চা আনিয়ে খাচ্ছে। কেউ কেউ আবার ভাঙা ক্যান্টিনের আশেপাশে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে। লোকটিও একপাশে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিল দেখলাম। কিছু দূরে দাড়িয়ে আমি, একটা চায়ের অর্ডার দিয়ে, হাতের পত্রিকাটা খুলে দেখছি। চায়ে চুমুক দিতে দিতে সে আমার দিকে এগিয়ে এলো। দাঁড়ালো। আমার হাতের পত্রিকাটির দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর ওই পত্রিকাটি একবার আমার কাছে দেখতে চাইল । দিলাম তাকে। হাতে নিয়ে সে নব-বিবাহিতদের পাতায় একটি ছবি দেখে, তার হাত থেকে চায়ের কাপটি পড়ে গেল। হঠাৎ সেও ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেল দেখলাম। এই দেখে কয়েকজনে হৈ চৈ করে ছুটে এলো।
আমরা ভেবে ছিলাম প্রেসার বেড়েছে, কিংবা সুগার ফল করেছে। তাকে তুলে এনে অফিসের পাখার নীচে শোয়ালাম। তারপর চোখে জলের ঝাপটা দিতে, কিছুক্ষণ পরে তার জ্ঞান ফিরে এলো। সে উঠে বসলো। আমরা তাকে বললাম, আপনার শরীর ভাল নেই, আপনি বাড়ি চলে যান আজ।
– আপনার ঐ পত্রিকাটি একটু নিতে পারি?
– হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিন না। বললাম আমি।
– ওর থেকে একটা ছবি কেটে নেবো?
– দরকার হলে, নিশ্চয়ই কেটে নেবেন। পত্রিকটাই না হয় আপনি নিয়ে বাড়ি চলে যান । আর ফেরৎ দিতে হবে না।
– বেশ। বলে পত্রিকাটি নিয়ে সেদিন বাড়ি চলে গেল সে।

পরের দিন সে আর অফিসে আসেনি। তারপর দিনও না। মাসখানেক পরে খবর নিয়ে শুনলাম, তিনি চাকরী ছেড়ে দিয়েছেন।
তার কথা প্রায় ভুলেই গেছিলাম। জীবনে কত লোকের সঙ্গে আলাপ,পরিচয়, হৃদ্যতা হয়, কিন্তু ক’জনের কথাই বা মনে থাকে বলুন?
কয়েকমাস পর পোষ্ট অফিস থেকে তার একটি চিঠি আসে আমার নামে, তার কথা আবার মনে পড়ল।
তিনি লিখেছেন, আপনার কাছ থেকে যে পত্রিকাটা নিয়ে গিয়েছিলাম, তাতে আমার প্রাক্তন স্ত্রীর ছবি ছিল। ছবিতে তাকে অপূর্ব দেখাচ্ছে। কিন্তু আমি জানি, ছবিতে তার সৌন্দর্য ঠিক সম্পূর্ণ তুলে ধরে যায় না। যার চোখে কবিতার ভাষা আছে সে বুঝবে, ক্যামেরার চোখে তো আর সে ভাষা ধরা পড়বে না।
আর তার এই সৌন্দর্যই শেষ পর্যন্ত কাল হলো। প্রতিবেশী এক তরুণ কবি তার রূপে মুগ্ধ হয়ে, আস্ত একখানা প্রেম-কাব্য উপখ্যান লিখে ফেললো তাকে নিয়ে। সেটা আবার নিজের টাকা খরচ করে ছাপিয়ে তাকে উৎসর্গ করলো।
আরও এও আশ্চর্য, সেও সেই তরুণ কবির প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খেতে লাগল। পাগল হয়ে উঠল যেন সে। কিছুদিন আমি তা লক্ষ্য করে বুঝতে পেরে, প্রথমে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম মনে। তারপরে ভাবলাম যে আমাকে ভালবাসে না তাকে ভুলে থাকাই ভাল। তাই আমি তাকে মিউচুয়ালি ডিভোর্স দিলাম।
গত মাসের সাতাশ তারিখে তার আবার নতুন বিয়ে হয়েছে ওই তরুণ কবির সাথে । তারই ছবি প্রকাশিত হয়েছিল ওই পত্রিকায় যেটা আমি আপনার কাছ থেকে সেদিন চেয়ে নিয়ে এসেছিলাম।
মি আপনার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে ছিলাম।
চিঠিটা পড়ে আমার চোখে, তার ভাবলেশহীন পাথরের চোখ দু’টো ভেসে উঠলো। চোখ দুটো থেকে দু’ফোঁটা জল যেন গড়িয়ে পড়ল আমার হাতে মনেহল। না হলে হাতটা আমার এখন ভেজা কেন? আমি তো আর, তার দুঃখে অশ্রুসিক্ত হয়ে কাঁদিনি।

এখন পর্যন্ত গল্পটি পড়া হয়েছে ৭৭ বার
যদি গল্পটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
    মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন