রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

গল্প - কর্ম্মফল (তৃতীয় পরিচ্ছেদ)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | কর্মফল
শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫ অন্যান

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

মন্মথ। ওকি ও, তোমার ছেলেটিকে কি মাখিয়েছ?

বিধু। মুর্চ্ছা যেয়ো না, ভয়ানক কিছু নয়— একটুখানি এসেন্স মাত্র। তাও বিলাতি নয়— তোমাদের সাধের দিশি!

মন্মথ। আমি তোমাকে বারবার বলেছি ছেলেদের তুমি এ সমস্ত সৌখিন জিনিষ অভ্যাস করাতে পারবে না।

বিধু। আচ্ছা যদি তোমার আরাম বোধ হয় ত কাল হতে কেরোসিন্‌ এবং কাষ্টর্‌ অয়েল মাখাব।

মন্মথ। সেও বাজে খরচ হবে। যেটা না হলেও চলে সেটা না অভ্যাস করাই ভাল। কেরোসিন্‌ ক্যাষ্টর্‌ অয়েল গায় মাথায় মাখা আমার মতে অনাবশ্যক।

বিধু। তোমার মতে আবশ্যক জিনিষ ক’টা আছে তাত জানিনা, গোড়াতেই আমাকে বোধ হয় বাদ দিয়ে বসতে হয়।

মন্মথ! তোমাকে বাদ দিলে যে বাদ-প্রতিবাদ একেবারেই বন্ধ হবে! এতকালের দৈনিক অভ্যাস হঠাৎ ছাড়লে এ বয়সে হয় ত সহ্য হবে না! যাই হোক্‌, এ কথা আমি তোমাকে আগে হতে বলে রাখছি ছেলেটিকে তুমি সাহেব কর বা নবাব কর বা সাহেবিনবাবির খিচুড়ি পাকা ও তার খরচ আমি জোগাব না। আমার মৃত্যুর পরে সে যা পাবে তাতে তার সখের খরচ কুলবে না।

বিধু। সে আমি জানি! তোমার টাকার উপরে ভরসা রাখলে ছেলেকে কপ্‌নি পরানো অভ্যাস করাতেম!

বিধুর এই অবজ্ঞাবাক্যে মর্ম্মাহত হইয়াও মন্মথ ক্ষণকালের মধ্যে সামলাইয়া লইলেন। কহিলেন আমিও তা জানি! তোমার ভগিনীপতি শশধরের পরেই তোমার ভরসা! তার সন্তান নেই বল ঠিক করে বসে আছ তোমার ছেলেকেই সে উইলে সমস্ত লিখে পড়ে দিয়ে যাবে। সেই জন্যই যখন তখন ছেলেটাকে ফিরিঙ্গি সাজিয়ে এক গা গন্ধ মাখিয়ে তার মেসোর আদর কাড়বার জন্য পাঠিয়ে দাও! আমি দারিদ্র্যের লজ্জা অনায়াসেই সহ্য করতে পারি কিন্তু ধনী কুটুম্বের সোহাগযাচনার লজ্জা আমার সহ্য হয় না।

এ কথা মন্মথর মনে অনেকদিন উদয় হইয়াছে —কিন্তু কথাটা কঠোর হইবে বলিয়া এ পর্য্যন্ত কখনো বলেন নাই। বিধু মনে করিতেন স্বামী তাঁহার গূঢ় অভিপ্রায় ঠিক বুঝিতে পারেন নাই, কারণ, স্বামী সম্প্রদায় স্ত্রীর মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে অপরিসীম মুর্খ। কিন্তু মন্মথ যে বসিয়া বসিয়া তাঁহার চাল ধরিতে পারিয়াছেন হঠাৎ জানিতে পারিয়া বিধুর পক্ষে মর্ম্মান্তিক হইয়া উঠিল।

মুখ লাল করিয়া বিধু কহিলেন—ছেলেকে মাসীর কাছে পাঠালেও গায়ে সহে না এত বড়। মানীলোকের ঘরে আছি সে ত পূর্ব্বে বুঝতে পারিনি।

এমন সময় বিধবা জা ঘরে প্রবেশ করিয়া কহিলেন—মেজ বৌ তোদের ধন্য। আজ সতেরো বৎসর হয়ে গেল তবু তোদের কথা ফুরাল না! রাত্রে কুলায় না শেষকালে দিনেও দুইজনে মিলে ফিস্ ফিস্! তোদের জিবের আগায় বিধাতা এত মধু দিন রাত্রি জোগান কোথা হতে আমি তাই ভাবি! রাগ কোরোনা ঠাকুরপো, তোমাদের মধুরালাপে ব্যাঘাত করব না, একবার কেবল দু মিনিটের জন্য মেজ বৌয়ের কাছ হতে শেলাইয়ের প্যাটার্ণ্‌টা দেখিয়ে নিতে এসেছি!

৪৬
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন