ঢাকার কোলাহলময় জীবনে, মানুষ গুলো ছুটে চলে নিজের মতো করে। কেউ সংসারের দায়ে, কেউ নিজস্ব স্বপ্ন নিয়ে।
এই ভিড়েই দুইটা মুখ—রোহান আর অনন্যা।
দু’জনের পথ এক ছিল না, কিন্তু হৃদয়ের একটা গহীন বাঁকে বারবার এসে মিশে যেত ওদের দুজনের পথ।
রোহান, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রভাষক।
বয়স পঁইত্রিশ পেরিয়েছে, জীবনদর্শনে পরিপক্ব, অথচ চোখে এখনো কাউকে আপন ভাবে পাওয়ার উজ্জ্বল দীপ্তি।
ক্লাসে যেমন অনুপ্রেরণা ছড়ান, একান্তে তেমনি একজন নিঃশব্দ প্রেমিক পুরুষ।
আর অনন্যা—মাত্র কয়েক মাস হলো বিয়ে হয়েছে।
তার জীবন এখন সাজানো ড্রেসিং টেবিল, চায়ের কাপে এক চমক গরম চা, আর শাশুড়ির কথার ইঙ্গিতে মোড়ানো এক নির্বাক সুর।
তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল এক সাহিত্য সম্মেলনে, নজরুল ইনস্টিটিউটে।
রোহান মঞ্চে ছিলেন, কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের “বর্ণনা নয় অনুভব” কবিতাটি ।
শব্দে শব্দে যেন হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া এক ভালোবাসার অচেনা অনুভূতি।
অনন্যা চুপ করে বসে ছিল শেষ সারিতে। চোখের কোনে জল।
সে যেন নিজের জীবনের সব না-পাওয়া মুহূর্ত খুঁজে পেয়েছিল রোহানের উচ্চারণে।
সেই সন্ধ্যায় বইয়ের স্টলে, প্রথম কথা—
“আপনি কীভাবে এত গভীর করে কবিতা বোঝেন?”
রোহানের সহজ উত্তর, “প্রেম বুঝলে কবিতা আপনা -আপনিই বোঝার মত হয়ে যায় ।”
তারপর ধীরে ধীরে—সাহিত্য থেকে শুরু, সন্ধ্যার ফোনালাপ, কিছু হেসে ওঠা মুহূর্ত, আর একেকটা আনন্দঘন দিন অতিবাহিত হওয়া।
অনন্যা জানত—এ প্রেম তার জন্য নয়, আর এটা শেষ পরিণতি কি হবে সেটাও জানত সে।
রোহানও জানত—সমাজ, সংসার, দায়িত্ব এসবের বাইরে প্রেমের নামে কোনো জায়গা বরাদ্দ নেই তার জীবনে ।
তবুও—মনের গভীরে যা থাকে, তা কি মুছে ফেলা যায় সহজে?
ওরা কখনো হাত ধরেনি জনসমক্ষে,কখনো একসাথে ছবি তোলেনি, তবুও প্রতিটি মুহূর্তে তারা একে অপরের গভীর প্রিয় হয়ে উঠেছিল।
একদিন সন্ধ্যায়, বৃষ্টিতে ভেজা এক চায়ের দোকানে অনন্যা বলেছিল,”আমরা যদি সমাজের নিয়ম না মানি?”
রোহান একটু হেসে তাকিয়েছিল তার দিকে আর বলছিল, “তবে আমরা নিজের চোখে নিজেকে কীভাবে দেখব, অনন্যা?”
তারপর একসময় সেই দেখা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।
কারণ রোহান জানতেন—ভালোবাসার আরেক নাম ‘ত্যাগ’।
আর অনন্যা বুঝে গিয়েছিল—প্রেম মানে সব পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নয়, কখনো কখনো চুপ থেকে ভালোবাসা বাঁচিয়ে রাখতে হয়।
শেষবার দেখা হয়েছিল—বৃষ্টির দিনে, শেওড়ার একটি মোড়ের পাশে।
অনন্যার কপালে তখনো সিঁদুর, কিন্তু চোখে ছিল প্রশ্ন।
রোহান শুধু বলেছিল,
“ভালোবাসা মানে পাওয়ার লড়াই নয়, ভালোবাসা মানে কাউকে সম্মান করে ছেড়ে দেওয়ার সাহস।”
তারপর আর কখনো কথা হয়নি।
তবুও—আজও অনন্যা যখন আয়নার সামনে দাঁড়ায়, রোহানের সেই চোখজোড়া দেখতে পায় নিজের প্রতিচ্ছবিতে।
আর রোহান?
প্রতি বছর অনন্যার জন্মদিনে, ডায়েরির এক নিভৃত পাতায় লেখে—
“অবৈধ ছিল, তবু ছিল সবচেয়ে পবিত্র প্রেম।
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন