বাংলা সাহিত্যে ব্যতিক্রমী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি একদিকে বিদ্রোহী অন্যদিকে ভাব-তন্ময় সাধক। সাম্যবাদী ভাবধারা বিকশিত তাঁর লেখনীতে। পাশাপাশি সম্প্রীতির প্রেমময় বানী বহমান তাঁর শিরা ধমনীর রক্তস্রোতে। নজরুল মানস যেন এক সীমাহীন বৈচিত্র্যময়তা। বাংলা সাহিত্যের এই অনন্য শিল্পী তাঁর অবিস্মরনীয় সাহিত্যকর্মের নান্দনিক প্রাঙ্গণে স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্যতার সমুজ্জ্বল গুণবত্তায় সদা ভাস্বর এক জ্যোতিষ্কের ন্যায় দেদীপ্যমান। দিগন্ত বিস্তৃত প্রখর রবীন্দ্র প্রভার যুগে কাজী নজরুল ইসলাম নিজেই বাংলাদেশের ইতিহাস। সাহিত্যের প্রতি তাঁর সমসাময়িক চিন্তাভাবনা বাংলা সাহিত্যকে আরও সম্পদযুক্ত করে তোলে।নৈর্ব্যক্তিক কল্পনায় জীবনের নতুন দিশা আবিষ্কার ও শৈল্পিক অভিব্যক্তিতে সাহিত্যের ইতিহাসকে আলোকিত করার অন্যতম কারিগর কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলার মননে-চিন্তনে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম।
২৯ আগস্ট ১৯৭৬। ঢাকার পি জি হাসপাতাল।ডাক্তার নার্সদের ব্যস্ততা।জীবনমৃত্যুর সাথে লড়াই করে চলেছেন এক অশীতিপর মানুষ। চলছে ৭৭ বছর বয়সী নির্বাক, মূক অপলক দৃষ্টির এই মানুষকে বাঁচানোর লড়াই। না হেরে গিয়েছিল গোটা হাসপাতাল। অমোঘ মৃত্যু ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছে সেই মানুষটিকে।তারপর সবটাই ইতিহাস।বাংলাদেশ বেতার তরঙ্গে সমগ্র বিশ্ব জানাল দীর্ঘ ৩৪ বছর নির্বাক, মূক অপলক দৃষ্টি নিয়ে আজও বেঁচে ছিলেন কবি নজরুল। দুই বাংলা জুড়ে পালিত হল তাঁর স্মরণ সভা।তাঁর নামে গড়ে উঠল অগণন সভা, সমিতি।এই বিষয়ে বড় ব্যথায় তিনিই বলেছিলেন,“যেদিন আমি দূর তারার দেশে চলে যাব … তারপর হয়ত বড় বড় সভা হবে। কত প্রশংসা, কত কবিতা বেরুবে হয়ত আমার নামে। দেশপ্রেমিক, ত্যাগী, বীর বিদ্রোহী–বিশেষণের পর বিশেষণ! টেবিল ভেঙে ফেলবে থাপ্পড় মেরে–বক্তার পর বক্তা! এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রাদ্ধ দিনে–বন্ধু! তুমি যেন যেয়ো না। যদি পার চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোনো একটি কথা স্মরণ করো। তোমার আঙিনায় বা আশে পাশে যদি একটি ঝরা, পায়ে পেষা ফুল পাও, সেইটাকে বুকে চেপে বলো—বন্ধু, আমি তোমায় পেয়েছি।’’ বস্তুত:১৯৭৬ সালের ২৯শে আগষ্ট কবির প্রয়াণের বহু আগেই আমরা তাঁকে হারিয়েছিলাম।হারিয়েছিলাম সেদিন–যেদিন তাঁর কন্ঠ রুদ্ধ হয়। তারপর চৌত্রিশটা বছর তাঁর কেটেছে অনাদরে, অবহেলায়। এ বেদনার ইতিহাস ভোলার নয়।
ব্রিটিশ শাসিত পরাধীন ভারতবর্ষে কবি নজরুল ইসলামের জন্ম, বেড়ে ওঠা। মাতৃভূমির পারধীনতা ও দাসত্বশৃঙ্খল তাঁকে পীড়া দিত। তখন একদিকে মধ্যযুগীয় অন্ধতা, গোঁড়ামি, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানসিকতা, অপরদিকে সামন্ততন্ত্র ও বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের শাসন-শোষণ। দুর্বিসহ সাম্রাজবাদী ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুক্ত-স্বাধীন দেশ ছিল তাঁর আজীবনের সাধনা।সুনিপুণ বলিষ্ঠতায়, চরিত্র-চিত্রণে পার্থিব মানবতাবাদের জয়গান গেয়েছিলেন তিনি। কাজী নজরুল ইসলামকে বল হয় বিদ্রোহী কবি–কিন্তু বস্তুত বিদ্রোহী নন, তিনি ছিলেন বাংলার বিপ্লবী কবি। কারণ তিনি শুধু ভাঙার কথাই বলেননি, বরং বলেছেন, ‘নতুন করে গড়তে চাই বলেই তো ভাঙি–শুধু ভাঙার জন্যই গান আমার নয়। আর ঐ নতুন করে গড়ার আশাতেই তো যত শীঘ্র পারি ভাঙি, আঘাতের পর নির্মম আঘাত হেনে পুরাতনকে পতিত করি।’
কবির জীবন গড়ে উঠেছে বিচিত্র ছন্দে–বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে। জীবনের প্রারম্ভে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে রাস্তার লেটোর দল, কবিগানের দলে গান গেয়েছেন নজরুল। সেই সময় ভারতবাসীর অন্তরের আকুতি, দেশপ্রেমের আঁচ লেগেছিল তাঁর মনে। বিপ্লবী যুগান্তর দলের সংগঠক নিবারণচন্দ্র ঘটকের আদর্শ, কর্মপন্থা, মুরারিপুকুর মামলার আসামী বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী সহ বিপ্লবীদের সান্নিধ্য তাঁর মধ্যে দেশপ্রেমের চেতনাকে একটু একটু করে গভীর করে তুলেছিল। কিশোর বয়সে একদিন এক বন্ধুর এয়ারগান পেয়ে পেঁপে গাছকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে সফল হয়ে সে কী আনন্দ-উচ্ছাস নজরুলের। বন্ধু শৈলজানন্দ লিখেছেন, ‘প্রথম যেদিন লাগলো পেঁপের গায়ে নজরুলের সে কী আনন্দ। যেন একটা বড় ভূখণ্ড জয় করল। সেই পেঁপে গাছটাই হল বড়লাট। তারপরের গাছটা ছোটলাট। তার পরেরটা ম্যাজিস্ট্রেট, তারপর এস ডি ও। তারপর থানার দারোগা, ছোট দারোগা ইত্যাদি ইত্যাদি। বলেছিলাম, না না থানার দারোগাদের মেরো না। ওরা তো ইংরেজ নয়, ওরা বাঙালি। নজরুল বলেছিলেন, হোক বাঙালি। ওরা বিশ্বাসঘাতক। একদিনে সব চাকরি ছেড়ে দিয়ে ইংরেজের রাজত্বটাকে অচল করে দিয়ে চলে যাক না।’এমনই ছিল কৈশোর চেতনায় নজরুলের দেশপ্রেমের অভিব্যক্তি। বৃটিশের অধীনতা থেকে দেশকে মুক্ত করার মানসিকতা থেকেই তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন যুদ্ধ বিদ্যা শিখতে। সুষ্পষ্টভাবে পরে তিনি বলেছেন, ‘রাজনীতি করব না তো সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলাম কেন?’
কবি নজরুলের বহুমুখী প্রতিভা এদেশের নবজাগরণের ইতিহাসকে বহুক্ষেত্রেই সমৃদ্ধ করেছে। তিনি শুধু কবি ছিলেন না। তিনি গল্প লেখক, উপন্যাস রচয়িতা, গীতিকার, নাট্যকার, পত্রিকা সম্পাদক, চলচ্চিত্র পরিচালক, চলচ্চিত্র কাহিনীকার, সুরকার–এমনকিঅভিনেতাও।
মূল তিনটি পর্যায়ে তাঁর জীবন ইতিহাসের। তাঁর জন্ম, দারিদ্যের কষাঘাতে বিচিত্র পেশায় দিনযাপন, লেখাপড়া, সেনাবাহিনীতে যোগদান, সেখান থেকে গল্প-কবিতা লেখাঁর চর্চা প্রাথমিক পর্যায়ের জীবন। প্রাথমিক পর্যায়ের পরে যখন তিনি যুদ্ধ থেকে ফিরে এলেন, সেই সময় থেকে পুত্র বুলবুলের মৃত্যু পর্যন্ত বিস্তৃত তাঁর দ্বিতীয় পর্যায়। সাহিত্য সৃষ্টিতে দ্বিতীয় পর্যায়টিই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। মানবতাবাদের জয়গান সেখানেই সুস্পষ্ট।
যেখানে তিনি মানুষকে করে তুলেছেন এমন, যাদের মাথা ‘ভুলোক দ্যুলোক, গোলক ভেদিয়া খোদার আসন আরশ ছেদিয়া’-উঠেছে। কী গভীর প্রত্যয়ে তিনি বলেছেন, “আমি সেই দিন হব শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না / অত্যাচারীর খড়গকৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না………… আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন, / আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন! / আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন! / আমি খেয়ালী-বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!” তাঁর বিদ্রোহ এক গভীর মূল্যবোধের আধারে ছিল প্রোথিত। দ্বিতীয় পর্যায়টিতে নারীমুক্তির জয়গান গেয়েছেন তিনি কী বলিষ্ঠতার সাথে! ‘জ্ঞানের লক্ষী-গানের লক্ষী-শষ্য-লক্ষী-সুষম-লক্ষী নারী’ কে আহবান করেছেন,
“আজ তুমি ভীরু আড়ালে থাকিয়া নেপথ্যে কও কথা!
চোখে চোখে আজ চাহিতে পারনা; হাতে রুলি,পায়ে মল,
মাথার ঘোমটা ছিঁড়ে ফেল নারী, ভেঙ্গে ফেল ও শিকল!
যে ঘোমটা তোমা করিয়াছে ভীরু উড়াও সে আবরণ!
দূর করে দাও দাসীর চিহ্ণ, ঐ যত আভরণ!”
কবির কৈশোর-যৌবনকালে, দেশের রাজনীতি উত্তাল। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন, ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকীর বোমা নিক্ষেপ, ফাঁসির মঞ্চে হাসিমুখে ক্ষুদিরামের আত্মবলিদান, মানিকতলা বোমার মামলা, জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ড প্রবল আলোড়ন তুলেছিল জনমানসে। এরই ঘাত-প্রতিঘাতে ঘটেছে নজরুলের রাজনৈতিক চেতনার ক্রম-উত্তরণ। একদিকে আপসপন্থীদের আন্দোলন। অপরদিকে সশস্ত্র সংগ্রামের ধারা। দেশব্যাপী কংগ্রেসের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনের জোয়ারে কংগ্রেসের সঙ্গে নজরুলের প্রথম যোগ। লিখেছিলেন ‘চরকার গান।শৃঙ্খলিত কারাবন্দীদের উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন অভিনন্দনগীত। কুমিল্লার তরুণ সম্প্রদায়ের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গেয়ে বেড়িয়েছিলেন–‘আজি রক্ত নিশি ভোরে একী এ শুনি ওরে/মুক্তি কোলাহল বন্দি শৃঙ্খলে/ওই কাহারা কারাবাসে মুক্তি হাসি হাসে/টুটেছে ভয় বাধা স্বাধীন হিয়াতলে।’ তবু একথা সত্য, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রশ্নে আপসপন্থাকে তিনি কখনই সমর্থন করেননি’ রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজি, দেশবন্ধু প্রমুখের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা থাকলেও তাদের মতবাদকে নজরুল গ্রহণ করেননি। তিনি বলেছেন, ‘‘আমি যতটুকু বুঝতে পারি, তার বেশি বুঝবার ভান করে যেন কারুর শ্রদ্ধা না প্রশংসা পাওয়ার লোভ না করি। তা সে মহাত্মা গান্ধিরই মতো হোক আর মহাকবি রবীন্দ্রনাথেরই মতো হোক কিংবা ঋষি অরবিন্দেরই মতো হোক, আমি সত্যিকার প্রাণ থেকে যতটুকু সাড়া পাই রবীন্দ্র, অরবিন্দ বা গান্ধির বাণীর আহ্বানে, ঠিক ততটুকু মানব। তাঁদের বাণীর আহ্বান যদি আমার প্রাণে প্রতিধ্বনি না তোলে, তবে তাঁদের মানব না। এবং এই ‘মানি না’কথাটা সকলের কাছে মাথা উঁচু করে স্বীকার করতে হবে।’’………..স্তাবকতার রুচিহীন পথ নজরুল চিরকালই পরিহার করে চলেছেন তাঁর জীবনে।তিনি বলেছেন, ‘‘কাহারও তোষামোদ করি নাই, প্রশংসার এবং প্রসাদের লোভে কাহারও পিছনে পোঁ ধরি নাই, – আমি শুধু রাজার অন্যায়ের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করি নাই – সমাজের, জাতির, দেশের বিরুদ্ধে আমার সত্য-তরবারির তীব্র আক্রমণ সমান বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে, – তার জন্য ঘরের-বাইরের বিদ্রুপ, অপমান, লাঞ্ছনা, আঘাত আমার উপর পর্যাপ্ত পরিমাণে বর্ষিত হয়েছে, কিন্তু কোনো কিছুর ভয়েই নিজের সত্যকে, আপন ভগবানকে হীন করি নাই, লাভ-লোভের বশবর্তী হয়ে আত্ম-উপলব্ধিকে বিক্রয় করি নাই’”
ধূমকেতুর সম্পাদকীয়তে কবি লিখলেন, “দেশের যারা শত্রু, দেশের যা-কিছু মিথ্যা, ভণ্ডামি, মেকি তা সব দূর করতে ‘ধূমকেতু’হবে আগুনের সম্মার্জনী!‘ধূমকেতুর এমন গুরু বা এমন বিধাতা কেউ নেই, যার খাতিরে সে সত্যকে অস্বীকার করে কারুর মিথ্যা বা ভণ্ডামিকে প্রশ্রয় দেবে।‘ধূমকেতু’সে-দাসত্ব হতে সম্পূর্ণ মুক্ত। ‘ধূমকেতু’ কোনোদিনই কারুর বাণীকে বেদবাক্যি বলে মেনে নেবে না, যদি তার সত্যতা প্রাণে তার সাড়া না দেয়। না বুঝে বোঝার ভণ্ডামি করে পাঁচ জনের শ্রদ্ধা আর প্রশংসা পাবার লোভ ‘ধূমকেতু’ কোনোদিনই করবে না।” একের পর এক নজরুলের মুক্তিকামী লেখা প্রকাশিত হয়েছে ধূমকেতুর প্রতিটি সংখ্যায়। নজরুলই প্রথম তাঁর লেখনীতে বলেন, স্বরাজ নয়, চাই পূর্ণ স্বাধীনতা।”
বিদ্রোহীর বাণী কবিতাতে শোনালেন,
“বুকের ভিতর ছ-পাই ন-পাই, মুখে বলিস স্বরাজ চাই,
স্বরাজ কথার মানে তোদের ক্রমেই হচ্চে দরাজ তাই!
‘ভারত হবে ভারতবাসীর’ – এই কথাটাও বলতে ভয়!
সেই বুড়োদের বলিস নেতা– তাদের কথায় চলতে হয়!”
স্বাধীনতার দৃপ্ত চেতনায় উদ্বুদ্ধ কবি পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য কলম ধরেছেন–বিপ্লবপন্থাকে মহীয়ান করে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। তাই তাঁর ‘ধূমকেতু’বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ তে সত্যসাধক নজরুল বললেন, ‘‘সত্য স্বয়ংপ্রকাশ। তাহাকে কোন রক্ত আঁখি রাজদণ্ড নিরোধ করতে পারে না।….আমি মরব, রাজাও মরবে, কেননা আমার মতন অনেক রাজবিদ্রোহী মরেছে, কিন্তু কোন কালে কোন কারণেই সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হয়নি–তার বাণী মরেনি। সে আজ তেমনি করেই নিজেকে প্রকাশ করেছে এবং চিরকাল ধরে করবে। আমার এই শাসন-বিরুদ্ধ বাণী আবার অন্যের কণ্ঠে ফুটে উঠবে।’’
“মোরা সবাই স্বাধীন, মোরা সবাই রাজা” প্রবন্ধে কাজী নজরুল ইসলাম লিখলেন, “একবার শির উঁচু করে বলো দেখি বীর, ‘মোরা সবাই স্বাধীন, সবাই রাজা!’ দেখবে অমনি তোমার পূর্ব-পুরুষের রক্ত-মজ্জা-অস্থি দিয়ে গড়া রক্ত-দেউল তাসের ঘরের মতো টুটে পড়েছে, তোমার চোখের সাত-পুরু-করে বাঁধা পর্দা খুলে গেছে, তিমির রাত্রি দিক-চক্রবালের আড়ালে গিয়ে লুকিয়েছে। তোমার হাতে-পায়ে গর্দানে বাঁধা শিকলে প্রচণ্ড মোচড় দিয়ে বলো দেখি বীর – ‘মোরা সবাই স্বাধীন, সবাই রাজা!’ দেখবে অমনি তোমার সকল শিকল সকল বাঁধন টুটে খান খান হয়ে গেছে।…………বলো, কারুর অধীনতা মানি না, স্বদেশিরও না, বিদেশিরও না। যে অপমান করে তার চেয়ে কাপুরুষ হীন সে-ই, যে অপমান সয়। তোমার আত্মশক্তি যদি উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে তবে বিশ্বে এত বড়ো দানব-শক্তি নেই, যা তোমাকে পায়ের তলায় ফেলে রাখে। নির্যাতন যদি সয়ে থাক, তবে সে দোষ তোমারই। নিজের দুর্বলতার জন্য অন্যের শক্তির নিন্দা কোরো না। জাগো অচেতন, জাগো! আত্মাকে চেনো! যে মিথ্যুক তোমার পথে এসে দাঁড়ায়, পিষে দিয়ে যাও তাকে, দেখবে তোমারই পতাকা-তলে বিশ্ব শির লোটাচ্ছে। তোমারই আদর্শে জগৎ অধীনতার বাঁধন কেটে মুক্ত উদার আকাশতলে এক পঙ্ক্তিতে এসে দাঁড়িয়েছে”।
কবি নজরুলের গানে-কবিতায় বাংলার বিপ্লববাদ ব্রিটিশ শাসনের ভিতকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসক বাংলার দামাল-কামাল-মুক্তিকামী বীর যুবাদের বিচারের নামে দুঃসহ প্রহসনে বিনা বিচারে আটকে রেখেছেন। মুক্তিপাগল বিপ্লবীদের কারবারণে কারাগারগুলি পরিপূর্ন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ কারারুদ্ধ। বাসন্তী দেবীর আহবানে নজরুল লিখলেন সেই কালজয়ী সংগীত,
“কে মালিক? কে সে রাজা? কে দেয় সাজা
মুক্ত-স্বাধীন সত্য কে রে?
ওরে ও পাগ্লা ভোলা, দেরে দে প্রলয়-দোলা গারদগুলা
জোরসে ধ’রে হ্যাঁচকা টানে।
মার্ হাঁক হায়দরী হাঁক্ কাঁধে নে দুন্দুভি ঢাক ডাক ওরে ডাক
মৃত্যুকে ডাক জীবন-পানে॥
নাচে ঐ কাল-বোশেখী, কাটাবি কাল ব’সে কি?
দে রে দেখি ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি’।
লাথি মার, ভাঙ্রে তালা! যত সব বন্দী-শালায় —
আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা, ফেল্ উপাড়ি॥”
‘জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন’ অভয় মন্ত্রে যখন বাংলার বিল্পবী সেনাদল অকাতরে হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়িকে আলিঙ্গন করছেন, আত্মবলিদানের মধ্যে দিয়ে হাজার হাজার যুবককে উদ্বুদ্ধ করছেন দেশমাতার পরাধীনতা ছিন্ন করতে জীবনপণ লড়াই করে রাত্রির গাঢ় অন্ধকার হতে স্বাধীনতার মুক্তিসূর্যকে ছিনিয়ে আনতে, ঠিক তখনই স্বাধীনতা আন্দোলনের আপসকামী নেতৃত্ব আন্দোলনের রাশ টেনে ধরতে চেয়েছেন, তাকে তীব্র কটাক্ষ করেছেন নজরুল। তিনি কোন রকম ‘রাখ ঢাক না করেই বলেছেন,
“পেটে এক আর মুখে আর এক – এই যে তোদের ভণ্ডামি,
এতেই তোরা লোক হাসালি, বিশ্বে হলি কম-দামি।
নিজের কাছেও ক্ষুদ্র হলি আপন ফাঁকির আপশোশে,
বাইরে ফাঁকা পাঁইতারা তাই, নাই তলোয়ার খাপ-কোশে।
তাই হলি সব সেরেফ আজ
কাপুরুষ আর ফেরেব-বাজ,
সত্য কথা বলতে ডরাস, তোরা আবার করবি কাজ!
ফোঁপরা ঢেঁকির নেইকো লাজ”
তরুণ-যুবদের আহবান করছেন,
“বল রে তোরা বল নবীন –
চাইনে এসব জ্ঞান-প্রবীণ!
স্ব-স্বরূপে দেশকে ক্লীব করছে এরা দিনকে দিন,
চায় না এরা – হই স্বাধীন!
কর্তা হবার শখ সবারই, স্বরাজ-ফরাজ ছল কেবল!
ফাঁকা প্রেমের ফুসমন্তর, মুখ সরল আর মন গরল!
এবার তোরা সত্য বল॥…………………..
তরুণ চাহে যুদ্ধ-ভূম!
মুক্তি-সেনা চায় হুকুম!
চাই না ‘নেতা’, চাই ‘জেনারেল’, প্রাণ-মাতনের ছুটুক ধূম!
মানব-মেধের যজ্ঞধূম।
প্রাণ-আঙুরের নিঙরানো রস – সেই আমাদের শান্তি-জল।
সোনা-মানিক ভাইরা আমার! আয় যাবি কে তরতে চল।……….
যেথায় মিথ্যা ভণ্ডামি ভাই করব সেথায় বিদ্রোহ!
ধামা-ধরা! জামা-ধরা! মরণ-ভীতু! চুপ রহো!
আমরা জানি সোজা কথা, পূর্ণ স্বাধীন করব দেশ!
এই দুলালুম বিজয়-নিশান, মরতে আছি – মরব শেষ!
নরম গরম পচে গেছে, আমরা নবীন চরম দল!
ডুবেছি না ডুবতে আছি, স্বর্গ কিংবা পাতাল-তল!”
চরকা দিয়ে স্বাধীনতা আসতে পারে কি? বিপ্লবীরা ছিলেন তার বিরুদ্ধে। বাংলা এবং পাঞ্জাবের বিপ্লবীরা সত্যাগ্রহ-অসহযোগ-চরকা-কাটা দিয়েই স্বাধীনতা আসবে, একথা মেনে নেননি। তারা ‘ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান’গেয়েছেন।নজরুল তাঁর কবিতায় লিখলেন,
“সূতা দিয়া মোর স্বাধীনতা চাই বসে বসে কাল গুনি
জাগরে জোয়ান বাত ধরে গেল মিথ্যার তাঁত বুনি।”
স্বাধীনতার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর লেখনীতে। প্রকাশ পেয়েছিল দৃঢ় প্রত্যয়ও। বলেছেন, ‘ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায় ভারতের দিবাকর / উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার।’ তাই স্বাধীনতার প্রয়োজনে জীবন দিতে হবে। বাংলার বিপ্লবীরা দলে দলে আপসপন্থার পথকে পরিত্যাগ করে জীবন দিতে এগিয়ে এসেছে বারবার। কোন ভাবেই তাদের গতিপথ রুদ্ধ করা যায়নি। নজরুল লিখলেন সেই সত্য কথাটি
“যতবার বাঁধি ছেঁড়ে সে শিকল
মেরে মেরে তারে করিনু বিকল,
তবু যদি কথা শোনে সে পাগল!
মানিল না রবি-গান্ধীরে।”
ধূমকেতুর পৃষ্ঠায় যখন কবি নজরুল পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী উত্থাপন করেছিলেন, কংগ্রেসনেতৃত্ব তখনও তা’ করেন নি। গান্ধীপন্থীরা ডোমিনিয়ান স্ট্যাটাসের কথাই চিন্তাভাবনা করে চলেছেন। বৃটিশ রাজের কাছে এই আবেদনের পথকে প্রত্যাখ্যান করেছেন নজরুল। বলেছেন,
“ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন,
বেলা ব’য়ে যায়, খায়নি ক’বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন।…….
আমরা ত জানি, স্বরাজ আনিতে পোড়া বার্তাকু এনেছি খাস!
কত শত কোটি ক্ষুধিত শিশুর ক্ষুধা নিঙাড়িয়া কাড়িয়া গ্রাস
এল কোটি টাকা, এল না স্বরাজ!………….
প্রার্থনা ক’রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ”
এই সত্যভাষণ বৃটিশরা মেনে নেয়নি।ধূমকেতু পত্রিকায় ‘আনন্দময়ীর আগমনে’নামে কবিতাটি প্রকাশ হওয়ার পরে নজরুলকে এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। তাঁর ‘বিষের বাঁশি’ও ‘ভাঙার গান কবিতা-গ্রন্থ দুটিও বৃটিশ সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
ব্রিটিশ শাসিত ভরতবর্ষে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে দেশ আচ্ছন্ন। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির বিরুদ্ধে কবির সংগ্রাম স্মরণীয় থাকবে আবহমানকাল। তাঁর উদাত্ত আহবান,
“হিন্দু না ওরা মুসলিম, ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।”
নিপীড়িত মানুষের মুক্তির প্রশ্নে ভারতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান সমস্যা অন্যতম গভীর সমস্যা হিসাবে বর্তমান ছিল।সমান বহমান আজও। সেই হিন্দু-মুসলমান সমস্যা এবং বিপ্লবাত্মক আন্দোলনের মানসিকতার সংমিশ্রণে রচিত ‘কুহেলিকা’উপন্যাসে তিনি বলেছেন, ‘‘আমার ভারত মানচিত্রের ভারতবর্ষ নয়… আমার ভারতবর্ষ, ভারতের এই মূক, দরিদ্র নিরন্ন, পরপদদলিত তেত্রিশ কোটি মানুষের ভারতবর্ষ। …এই ভারতবর্ষ তোদের মন্দিরের ভারতবর্ষ নয়, মুসলমানদের মসজিদের ভারতবর্ষ নয়;–এ আমার মানুষের মহামানবের মহা-ভারত’’।তাঁর হিন্দু-মুসলমান প্রবন্ধ তো আজও প্রাসঙ্গিক।বর্তমান একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও সমান তাৎপর্যবাহী। বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে পথের দিশা।বর্তমান সময়ে লক্ষ্য করলেই আমার দেখব “হিন্দু মুসলিম দিনরাত হানাহানি জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র, ঋণ, অভাব অন্যদিকে লোভী ও অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষান স্তুপের মত জমা হয়ে আছে”, এই “অসাম্য ভেদ দুর” করে “কাব্যে, সঙ্গীতে, কর্মজীবনে অভেদ সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত” করতেই প্রাণের কবি, বিদ্রোহের কবি, প্রেমের কবি, মানবতার কবি, কাজী নজরুল তাঁর জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। মানুষকে আহবান করেছেন, “মানবতার এই মহা-যুগে একবার গন্ডি কাটিয়া বাহির হইয়া আসিয়া বল যে, তুমি ব্রাহ্মণ নও, শূদ্র নও, হিন্দু নও, মুসলমান নও, তুমি মানুষ, তুমি সত্য।”
পুরাতনকে ভেঙে নতুন সৃষ্টির পথে চলতে গিয়ে কবির উপর ‘আঘাত, নিন্দা, বিদ্রূপ, লাঞ্ছনা বর্ষিত হয়েছে।’তবু তিনি এ ব্যাপারে অবিচল থেকেছেন। তদানীন্তন সমাজে ‘বিদ্রোহী’ বলে যে বিশেষণে তিনি বিশেষিত হয়েছিলেন সেই প্রসঙ্গে নিজেই বলেছেন, ‘বিদ্রোহীর জয়তিলক আমার ললাটে অক্ষয় হয়ে গেল আমার তরুণ বন্ধুদের ভালবাসায়। একে অনেকেই কলঙ্কতিলক বলে ভুল করেছে, কিন্তু আমি করিনি’ তিনি দৃঢ় প্রত্যয়েই বলেছেন, ‘কারুর পান থেকে এতটুকু চুন খসবে না, গায়ে আঁচড়টি লাগবে না, তেল কুচকুচ ভুঁড়িও বাড়বে এবং সমাজও সাথে সাথে জাগতে থাকবে–এ আশা আলেম সমাজ করতে পারেন, আমরা অবিশ্বাসীর দল করিনে।’
নজরুলের জীবনসাধনাকে বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই, তাঁর আকাঙ্ক্ষার মধ্যে নিপীড়িত জাতির মুক্তির প্রশ্নটিও প্রতিফলিত হয়েছে বারে বারে। চাষী মজুরের উপর নির্মম শোষণ তাঁকে ব্যথিত ও পীড়িত করেছে, সেই শোষণযন্ত্রণা ফুটে উঠেছে তাঁর রচনার ছত্রে ছত্রে। লিখেছেন, ‘…চাষী সমস্ত বৎসর ধরিয়া হাড় ভাঙা মেহনত করিয়া মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়াও দু-বেলা পেট ভরিয়া মাড়ভাত খাইতে পায় না; হাঁটুর উপর পর্যন্ত একটা টেনা বা নেঙটি ছাড়া তাহার আর ভাল কাপড় পরা সারাজীবনেও ঘটিয়া উঠে না, ছেলেমেয়ের সাধ-আহলাদ মিটাইতে পায় না, অথচ তাহারই ধান-চাল লইয়া মহাজনরা পায়ের উপর পা দিয়া বার মাসে তেত্রিশ পার্বণ করিয়া নওয়াবী চালে দিন কাটাইয়া দেন।’ কাব্যের ছন্দেও এই নির্মম সত্যকে তিনি প্রকাশ করেছেন—
“জনগণে যারা জোঁকসম শোষে তারে মহাজন কয়,
সন্তান-সম পালে যারা জমি তারা জমিদার নয়।
মাটিতে যাদের ঠেকে না চরণ
মাটির মালিক তাঁহারাই হন’…।”
প্রাকৃতিক সম্পদের অসম ব্যবহারে ব্যথিত হয়েছেন কবি নজরুল। প্রাকৃতিক সম্পদে সকলের সমান অধিকর দাবী করেছেনা সদর্পে। ‘ফরিয়াদ’ কবিতায় শোনলেন,
“রবি শশী তারা প্রভাত-সন্ধ্যা তোমার আদেশ কহে-
‘এই দিবা রাতি আকাশ বাতাস নহে একা কারো নহে।
এই ধরণীর যাহা সম্বল,-
বাসে-ভরা ফুল, রসে-ভরা ফল,
সু-স্নিগ্ধ মাটি, সুধাসম জল, পাখীর কন্ঠে গান,-
সকলের এতে সম অধিকার, এই তাঁর ফরমান!”
বেদনাহত নজরুল সে সময়ের সমাজে গ্রামীণ জীবনের ভয়াবহতা সম্পর্কে তাঁর লেখায়-উপন্যাসে-কবিতায় মর্মস্পর্শী ছবি তুলে ধরেছেন। ‘চোর-ডাকাত’ কবিতা শোনালেন,
‘‘ডাকু ধনিকের কারখানা চলে নাশ করি কোটি ভিটে।
দিব্যি পেতেছ খল কলওলা মানুষ-পেষানো কল,
আখ-পেষা হয়ে বাহির হতেছে ভূখারি মানব-দল!
কোটি মানুষের মনুষ্যত্ব নিঙাড়ি কলওয়ালা
ভরিছে তাহার মদিরা-পাত্র, পুরিছে স্বর্ণ-জালা!
বিপন্নদের অন্ন ঠাসিয়া ফুলে মহাজন-ভুঁড়ি
নিরন্নদের ভিটে নাশ করে জমিদার চড়ে জুড়ি!
পেতেছে বিশ্বে বণিক-বৈশ্য অর্থ-বেশ্যালয়,
নীচে সেথা পাপ-শয়তান-সাকি, গাহে যক্ষের জয়!
অন্ন, স্বাস্থ্য, প্রাণ, আশা, ভাষা হারায়ে সকল-কিছু
দেউলিয়া হয়ে চলেছে মানব ধ্বংসের পিছু পিছু।”
মনে হয় যেন নজরুল এ দেশের স্বাধীনতার পঁচাত্তরোত্তর বৎসর উদযাপনের সময়কার দৃশ্যকেই বর্ণনা করেছেন।
এই পর্যায়ে সেই মানবতাবাদের বলিষ্ঠতার সাথে কিছুটা অধ্যাত্মবাদী চিন্তার ছায়া পড়েছিলতাঁর জীবনে। বেদনাবিদ্ধ হৃদয়ে তিনি সেই দিনগুলি কাটিয়েছেন। নজরুল তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’দিয়েই বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী আসন করে নেন।এ কাব্যগ্রন্থের অর্ধেক কবিতাই ছিল ইসলামি কবিতা। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ‘রণভেরী’, ‘খেয়াপারের তরুণী’, ‘মোহররম’, ‘কোরবানী’,‘শাত-ইল-আরব’ ‘কামালপাশা,‘আনোয়ার’ প্রভৃতি কবিতা। এছাড়াও ‘বিশের বাঁশী’, ‘ফাতেহা-ই-দোয়াজদহম’ ‘জিঞ্জির, ‘ঈদ-মোবারক’, ‘আয় বেহেশতে কে যাবি আয়’, ‘চিরঞ্জীব জগলুল’, ‘খালেদ’, ‘উমর ফারুক’, ‘সুবহে সাদেক’, ‘আমানুল্লাহ’ ‘জীবনে যাহারা বাঁচিল না’, ‘আজাদ’,‘এক আল্লাহ জিন্দাবাদ’, ‘মুনাজাত’,‘শহীদি ঈদ’, ‘কৃষকের ঈদ’, ‘হজরত রাসূলুল্লাহ’ (সা.)-এর জীবননির্ভর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘মরু-ভাস্কর’, ‘কোর-আন’ শরীফের আমপারা’র পদ্যানুবাদ ‘কাব্য-আমপারা’ এবং ‘নবযুগ’সহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এবং কাব্যগ্রন্থ সমূহে আরও অনেক কবিতায় ইসলামি ঐতিহ্য, ইসলামি ভাব ও ইসলামি জাগরণ, বিষয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলাম উজ্জ্বতার স্বাক্ষর রেখেছেন। নজরুল কাব্যে অধ্যাত্মবাদ এবং ইসলামি সাম্য সূচিত হয়েছে মানবিকতায়। তার ইসলামি কবিতা মানবাত্মার বিকাশ ও মানবিকতার উদ্বোধন। আধ্যাত্মিক শক্তি তার আপন আত্মার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। মানবিক ধর্ম হচ্ছে আত্মত্যাগ। এই আত্মত্যাগে ইসলাম আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। ভোগীদের সংহার করার প্রেরণা নজরুল কবিতায় উচ্চারিত।ইসলামের সুমহান শিক্ষাকে তুলে ধরে “আজাদ” কবিতায় তিনি লিখলেন,
“আজ মুখ ফুটে দল বেঁধে বলো, বলো ধনীদের কাছে,
ওদের বিত্তে এই দরিদ্র দীনের হিস্সা আছে!
ক্ষুধার অন্নে নাই অধিকার; সঞ্চিত যার রয়,
সেই সম্পদে ক্ষুধিতের অধিকার আছে নিশ্চয়।
মানুষেরে দিতে তাহার ন্যায্য প্রাপ্য ও অধিকার
ইসলাম এসেছিল দুনিয়ায়……..”
নজরুলকে বাংলার মুসলিম রেনেসাঁর প্রাণপুরুষ বলা হয়। রেনেসাঁর একটা প্রধান ধর্ম হলো- যাবতীয় কুসংস্কার, ভন্ডামি, গোঁড়ামি, নিষ্প্রাণ গতানুগতিক আনুষ্ঠানিকতা ও সকল প্রকার সঙ্কীর্ণতাকে আক্রমণ করে সত্য, ন্যায়, উদার মানবিকতা ও চিন্তার স্বাধীনতার জয় ঘোষণা করা। নজরুল তার কবিতায় এটা করে দেখিয়েছেন অত্যন্ত সফলভাবে। তাইতো আমরা দেখি, কবির বহু ইসলামি গান ও কবিতায় এর বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের ক্ষুরধার তরবারি বারবার ঝলসে উঠেছে।‘কৃষকের ঈদ’ কবিতায় তিনি শোনালেন,
“নামাজ পড়েছ, পড়েছ কোরান, রোজাও রেখেছ জানি,
হায় তোতাপাখি! শক্তি দিতে কি পেরেছ একটুখানি?
ফল বহিয়াছ, পাওনিকো রস, হায় রে ফলের ঝুড়ি,
লক্ষ বছর ঝরনায় ডুবে রস পায় নাকো নুড়ি!
আল্লা-তত্ত্ব জেনেছ কি, যিনি সর্বশক্তিমান?
শক্তি পেল না জীবনে যে জন, সে নহে মুসলমান!”
তৃষিত পথিক যেমন বুক ভরে জল পান করে পরম শান্তি ও স্বস্তি লাভ করেন তেমনই পার্থিব শোক-দুঃখে কাতর নজরুলের শূণ্য হৃদয় আধ্যাত্মিকতার স্বাদে তৃপ্ত হল যোগসিদ্ধ সাধক লালগোলা এম.এন. একাডেমী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক বরদাচরণ মজুমদারের সান্নিধ্যে এসে। পরমার্থ সাধনের পথে আকৃষ্ট হলেন কবি নজরুল। সৃজনশীল শ্যামাসংগীত রচনার মাধ্যমে মাতৃবন্দনাকে আঁকড়ে হয়তো ভুলতে চেয়েছিলেন সন্তান হারানোর সীমাহীন শোক। ফলত বাংলা সাহিত্যের শাক্তসংগীতের ধারা যা নিরাকার ব্রহ্মসংগীতের প্রবাহের টানে ক্ষীণতোয়া হতে যাচ্ছিল তা ক্রমশ আবার পুষ্ট থেকে পুষ্টতর হয়ে পুনরুজ্জীবন লাভ করে কবি নজরুলের কলমের সুনিপুণ সৃজনশীলতায়।
জীবনের সর্বক্ষেত্রেই আপসহীন কবি কাজী নজরুল ইসলাম।অথচ তাঁর শেষ জীবন বড়ই মর্মান্তিক। রোগাক্রান্ত হওয়ার পর বেঁচেছিলেন চুড়ান্ত অবহেলায়। পুরোপুরি অসুস্থ হওয়ার আগেও তিনি জীবন-যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। তাঁরই এক লেখায় তাঁর জীবনের শেষ অধ্যায়ের সে দ্বন্দ্ব ফুটে উঠেছিল। পুত্রশোকাতুর নজরুল গভীর বেদনায় বলেছেন, ‘আমার সুন্দর পৃথিবীর আলো এক নিমেষে নিভে গেল। আমার আনন্দ, আমার কবিতা, হাসি, গান যেন কোথায় পালিয়ে গেল, আমার বিরহ আমার বেদনা সইতে না পেরে। এই প্রথম আমার প্রশ্ন জাগল—কোন নিষ্ঠুর এই সৃষ্টি করে, কেন সে শিশু সুন্দরকে কেড়ে নেয়? …গোপনে পড়তে লাগলাম বেদান্ত, কোরান। আমার পৃথিবীর আকাশ কোন বজ্রনাদে ও তড়িৎলেখা্র তলোয়ারে বিদীর্ণ হয়ে গেল।’ আবার এর বিপরীতে তিনি ভেবেছেন, ‘আমি ব্রহ্ম চাই না, আল্লাহ চাই না, ভগবান চাই না। এসব নামের কেউ যদি থাকেন তিনি নিজে এসে দেখা দিবেন। আমার বন্দিনী মাকে অসুরের অত্যাচার থেকে উদ্ধার করে আবার পূর্বশ্রীসুন্দর, আনন্দসুন্দর না করা পর্যন্ত আমার মুক্তি নেই, আমার শান্তি নেই।’
রাজনৈতিক নেতাদের নীতিহিনতা, ভ্রষ্টাচার আর দেশপ্রেমের নাম আত্মপ্রেম, যেনতেন প্রকারে ক্ষমতা দখল মানতে পারেননি নজরুল ইসলাম। শিখা কবিতায় শোনালেন,
“হায় রে ভারত, হায় যৌবন তাহার
দাসত্ব করিতেছে অতীত জরার!……..
দেখায়ে গলিত-মাংস চাকুরির মোহ
যৌবনের টিকা-পরা তরুণের দলে
আনিয়াছে একেবারে ভাগাড়ে শ্মশানে।……..
যে হাতে পাইত শোভা খর তরবারি
সেই তরুণের হাতে ভোট-ভিক্ষা-ঝুলি
বাঁধিয়া দিয়াছে হায়! – রাজনীতি ইহা!
পলায়ে এসেছি আমি লজ্জায় দু-হাতে
নয়ন ঢাকিয়া! যৌবনের এ লাঞ্ছনা
দেখিবার আগে কেন মৃত্যু হইল না?”
না। যৌবনের লাঞ্ছনা দেখার আগে তাঁর মৃত্যু হয়নি। মৃত্যু হয়েছে তাঁর চেতনার। তাই দীর্ঘ ৩৪ বছর তিনি কাটিয়েছেন নির্বাক, মূক, বধির জীবন। আজকের ভারতবর্ষেও যুবকদের অবস্থা ত থৈ বচ। এই যুবকদেরই তিনি বলেছেন,
“অতীতের দাসত্ব ভোলো! বৃদ্ধ সাবধানী
হইতে পারে না কভু তোমাদের নেতা।
তোমাদেরই মাঝে আছে বীর সব্যসাচী
আমি শুনিয়াছি বন্ধু সেই ঐশীবাণী
ঊর্ধ্ব হতে রুদ্র মোর নিত্য কহে হাঁকি,
শোনাতে এ কথা, এই তাঁহার আদেশ।”
সমাজ চেতনা থেকে দূরে গিয়ে কাব্যসাধনার পথকে তিনি চিরকালই পরিহাস করেছেন। তিনি বলতেন–‘ফুল ফোটানোই আমার ধর্ম। তরবারি হাত আমার হাতে বোঝা। কিন্তু তাই বলে আমি ফেলে দিইনি। সুর আমার সুন্দরের জন্য, আর তরবারি সুন্দরের অবমাননা করে যে–সেই অসুরের জন্য’। এরকম প্রাণচঞ্চল সত্যসুন্দরের সাধক আর এক কবির অভ্যুত্থানের প্রতীক্ষায় রয়েছি আমরা। যৌবনের কাছে তাঁর আবেদন আজও অনুরণিত হয়, ‘‘জরাগ্রস্ত পুরাতন পৃথিবী চেয়ে থাকে যুগে যুগে তোমাদের এই কিশোরদের এই তরুণদের পানে।…কত কাজ তোমাদের, ধরণীর দশদিক ভরে কত ধূলি, কত আবর্জনা, কত পাপ, কত বেদনা, তোমরা ছাড়া কে তার প্রতিকার করবে? কে তার এলাজ করবে? তোমাদের আত্মদানে, তোমাদের আয়ুর বিনিময়ে হবে তার মুক্তি। শত বিধিনিষেধের, অনাচারের জিঞ্জীরে বন্দিনী এই পৃথিবী আজাদীর আশায় ফরিয়াদ করছে, তোমাদের প্রাণের দরবারে–তার এ আর্জি কি বিফল হবে?’’
মূলত কবি কাজী নজরুল ইসলাম একটি যুগ। জরাগ্রস্ত একটি জাতির চেতনা। স্বল্প পরিসরে তাঁর সার্বিক বিবরণ দেওয়া সম্ভব নয়। তাঁর লেখনী সমগ্র বাঙালি জাতিকে উদ্বুদ্ব করেছিল জাতীয় চেতনায়। কবি নিজ জীবনেও তাঁর কোন মূল্যই পাননি , চরম দারিদ্রতা , কবিপুত্র বুলবুলের মৃত্যু , শারীরিক অসুস্থতা, ঋণ, চিত্তরঞ্জনের মৃত্যু, রবীন্দ্র প্রয়াণ, স্ত্রী প্রমীলার পক্ষঘাত, একের পর এক কাব্যগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত হওয়া , প্রকাশকদের নিকট থেকে পারিশ্রমিক না পাওয়া , সমকালীন রাজনৈতিক বিভাজন, প্রবল সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ কবির জীবনে নামিয়ে আনে চরম অসুস্থতা। বাক শক্তি হারান কবি। তারপর দীর্ঘ ৩৪ বছর পর আবারও জাতীয় চেতনা জেগে ওঠে। বাংলাদেশ বেতারে তাঁর মৃত্যু সংবাদ প্রকাশের মধ্যে দিয়ে। আজও ভারতীয় উপমহাদেশের চলমান রাজনৈতিক দুরবস্থা, শোষণ-শাসন , সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প, যুবকদের বিপথগামীতা থেকে একমাত্র নজরুল সাহিত্যই পারে পথ দেখাতে। আজও নবযৌবনের অগ্রদূত কাজী নজরুল ইসলাম। তাই বলতেই হয়,
“কখনও ভাবিনি,
তোমাকে তোমারই মত
আজও——
‘উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল’
‘আকাশে-বাতাসে’
মাঠে-ময়দানে,
ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়।
এখন তুমি,
না-ফেরার দেশে!
এ ঘোর সংকটে,
“যুগের না হয়, হুজুগের কবি”
জাগাতে দেশ, নবযৌবন,
“কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মত!”
তাই, আজও প্রতিক্ষায়,
কবি, নজরুল।”
ঋণ স্বীকার:
১) বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক ওয়েব ম্যাগাজিন “পরবাস”প্রকাশিত তেজোদ্দীপ্ত মানবতাবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলামঃ কয়েকটি কথা -চন্ডিদাস ভট্টাচার্য
২) সাহিত্য শৈলী (ফেসবুক পেজ)
৩) নজরুল রচনাবলী
৪) অর্ধ-সাপ্তাহিক ঝিঙেফুল বৈদ্যুতিন পত্রিকায় প্রকাশিত এই সংকলের সংকলিত প্রবন্ধ “চেতনার কবি কাজী নজরুল ইসলাম” ও কবিতা “কবি কাজী নজরুল স্মরণে”
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন