আজকের দিনটি ভীষণ অদ্ভুত ছিল রঞ্জনের জন্য। ৬০ বছর বয়সে এসে হঠাৎ তার মনে হলো, তার জীবনটা যেন আরেকবার ফিরিয়ে নিয়ে আসা উচিত। সময়ের রেলগাড়ি, কতগুলো ঘটনা, স্মৃতি, তার পুরনো দিনের সুখ-দুঃখ—সব যেন কেমন করে গুচ্ছিত হয়ে গিয়েছিল। হ্যাঁ, আজ সে মনের মধ্যে এক বিশাল শূন্যতা অনুভব করছিল।
রঞ্জন এক সময় ছিলেন শহরের পরিচিত ব্যবসায়ী, প্রাণবন্ত, সদা হাস্যজ্জ্বল। যুবক বয়সে তার জীবনে ছিল এক উজ্জ্বল স্বপ্নের পৃথিবী। সে ছিল এমন একজন, যার কথা সবাই মনে রাখত। কিন্তু এখন? ৬০ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর তার জীবন এখন এক জায়গায় থেমে গেছে। ব্যবসা, পরিবার, বন্ধু—সব কিছু নিয়েই নানা ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু কিছুই আর সেভাবে মনে হয় না। মাঝে মাঝে তিনি ভাবতেন, “কী ছিল সেই দিনগুলো? কোথায় হারিয়ে গেল?”
একদিন রঞ্জন যখন বসেছিলেন পুরনো অফিসের সোফায়, তার চোখে পড়ল একটি পুরনো ফটোগ্রাফ। ছবিটিতে ছিল তার প্রথম প্রেম, মিতালী। সেই হাস্যোজ্জ্বল তরুণী, যাকে রঞ্জন জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ মনে করেছিল। সে কীভাবে তাকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে এসেছিল, সেই সময়ের কথা ভেবে রঞ্জনের হৃদয় আজও কাঁপে।
“মিতালী… তুমি কোথায়?” মনে মনে বললেন রঞ্জন। তিনি ভেবেছিলেন, মিতালী তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল বহু বছর আগে, তবে তার ছায়া যেন এখনও তার হৃদয়ে বেঁচে ছিল। সময়ের সাথে সব কিছু পাল্টে গেছে, কিন্তু তার সঙ্গে কাটানো একদিনের স্মৃতি ছিল আজও জীবন্ত।
সে দিনগুলির কথা যখন রঞ্জন ভাবছিল, তার মনে পড়ে গেল ছোটবেলার সেই গ্রামের পথ। মনে পড়ে সেই পথের ধারে বসে থেকে একসাথে হাতে হাতে কিছু কথা বলা—হাসি-ঠাট্টা, অস্থিরতা। মনে পড়ে, তার ছেলেবেলার বন্ধু আর পরিবার যারা কখনোই তার জীবনের পথে থেমে না গিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু জীবন এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে, সবাই নিজেদের পথে চলে গিয়েছিল। রঞ্জনের মনে হয়েছে, জীবনের এক বড় অংশ হঠাৎ করে হারিয়ে গেছে, যদিও সে জানত, সময়ের সাথে এসব আসতে-যেতে থাকে।
এখন, যখন রঞ্জন নিজের জীবনের শেষ অধ্যায়ে পৌঁছেছে, সে অনুভব করল, জীবন আসলে কোন কিছুই হারায়নি। কিছু না কিছু, সব কিছু বদলে গিয়েছিল। স্মৃতির মধ্যে সব কিছু জীবন্ত ছিল। হয়তো বয়স বাড়ার সঙ্গে তার শরীর স্লথ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু মনের ভিতর সে তখনও সেই তরুণ রঞ্জন, যেখানে স্বপ্ন ছিল, ভালোবাসা ছিল, এবং আশা ছিল।
রঞ্জন এখন জানতো, জীবন আসলে এক অমূল্য উপহার। সময় চলে গেলেও, তার পুরনো দিনগুলি আর সঙ্গীরা সব কিছুই তার জীবনের অমূল্য অংশ হয়ে রয়ে গিয়েছিল। স্মৃতির আলোয় তিনি আজও তাদের অনুভব করছিলেন।
“আমরা তো সবাই একদিন কোথাও চলে যাব, কিন্তু স্মৃতির আলোয় ফিরে আসা, সেই অদ্ভুত শান্তি, কী শান্তি!” এসব ভেবে রঞ্জন নিজেকে এক নতুন আলোয় দেখল, মনে হলো, যেন জীবন আবার নতুনভাবে শুরু হলো।
৬০ বছর পর, রঞ্জন বুঝল—জীবন আসলে শুধুই একটি যাত্রা, যেখানে কিছু অভিজ্ঞতা থাকে, কিছু সম্পর্ক থাকে, কিছু মুহূর্ত থাকে। সেগুলো কখনও মুছে যায় না। এগুলি তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন, যে অর্জন কোনো সময়ের সাথে হারায় না।
এখন, রঞ্জন জানতো, সময়ই আসল সত্যি, তবে স্মৃতির আলো কখনও ম্লান হবে না।
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন