গভীর গ্রামবাংলার প্রান্তে এক ছোট্ট গ্রাম, নাম অমৃতপুর। গ্রামটি যেন প্রকৃতির ক্যানভাসে আঁকা এক নিঃশব্দ সৌন্দর্য। পদ্মর ফুল ফুটে আছে পুকুরের বুকে, ধানখেতের নরম বাতাস মিশে যায় মানুষের দুঃখসুখে। এই গ্রামেই বাস করে এক যুবক, নাম তার অনিমেষ। সহজ-সরল ছেলেটি গ্রামের পাঠশালায় শিক্ষকতা করে।
অনিমেষের জীবনটা যেন সাদামাটা ক্যানভাস। তবে এই ক্যানভাসে রঙ এনে দিয়েছিল একটি মেয়ে—নাম তার কুমু। কুমু গ্রামের জমিদার বাড়ির মেয়ে। সে যেমন সৌন্দর্যের প্রতিমা, তেমনই মেধাবী আর বিনয়ী। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সে এসে বসত অনিমেষের পাঠশালার পুকুর পাড়ে। কাশবনের হালকা বাতাসে তাদের দুজনের মনের কথাগুলো যেন বাতাসের সঙ্গে খেলা করত।
কুমু মাঝে মাঝে বলত, “অনিমেষদা, আপনি তো এত ভালো কবিতা লেখেন, কেন এসব লিখে পাঠান না কোথাও?”
অনিমেষ হেসে বলত, “লেখাগুলো তো তোমার জন্য। পৃথিবীর সব জায়গায় ছড়িয়ে দেব কীভাবে? তুমি পড়লেই তো আমার লেখা পূর্ণতা পায়।”
কিন্তু গ্রাম তো চিরদিন এক জায়গায় থেমে থাকে না। কুমুর বাবা তার বিয়ে ঠিক করল শহরের এক ধনী ব্যবসায়ীর সঙ্গে। কুমুর মনের উপর যেন পাহাড় চাপল। সে অনিমেষকে কিছু বলতে পারল না।
বিয়ের আগের দিন সন্ধ্যায় কুমু আবার সেই পুকুর পাড়ে এলো। অনিমেষ সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। কুমু বলে উঠল, “অনিমেষদা, আমি চলে যাচ্ছি। এই সম্পর্ক রাখার কোনো অধিকার নেই আমার।”
অনিমেষ হেসে বলল, “তুমি চলে যাবে, কিন্তু আমার মনের পুকুরে তোমার ছবিটা চিরদিন আঁকা থাকবে।”
কুমু কিছু বলল না, শুধু একটি চিঠি অনিমেষের হাতে দিয়ে চলে গেল। চিঠিতে লেখা ছিল—
“তুমি জানো, ভালোবাসা কখনো পাওয়া-না-পাওয়ার হিসেবের মধ্যে বেঁধে রাখা যায় না। আমি যদি ফিরে আসতে পারি, তবে জানবে, এই ভালোবাসা কখনো মুছে যাবে না।”
বছরের পর বছর কেটে গেল। কুমু বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে বিদেশ চলে যায়। অনিমেষ তার গ্রামের পাঠশালাতেই রয়ে গেল। কিন্তু প্রতিদিন বিকেলে সে পুকুর পাড়ে গিয়ে বসে থাকত, যেন কুমু একদিন ফিরে আসবে।
অনেক বছর পর একদিন গ্রামের মেলায় হঠাৎ এক অপরিচিত নারী এসে দাঁড়াল। বয়সের ছাপ পড়েছে, কিন্তু সেই চেনা মায়াবী চোখের ঝিলিক। কুমু ফিরে এসেছে।
অনিমেষ মৃদু হাসল, “তুমি তো বলেছিলে, যদি ফিরে আসো… তবে জানব, ভালোবাসা মুছে যায় না।”
কুমু চোখের জল মুছে বলল, “ভালোবাসা কখনো মুছে যায় না, অনিমেষ। শুধু সময় তার রং বদলায়।”
পুকুর পাড়ের সেই বিকেল যেন আবার প্রাণ ফিরে পেল। কাশবন, বাতাস, আর সেদিনের আলো আজও তাদের সেই গল্প বলে যায়।
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন