অন্তর চন্দ্র

আলোচনা - দাউদ হায়দারের কবিতা প্রহর: একটি নীরিক্ষা

অন্তর চন্দ্র
বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫

নিপুণ কাব্যশৈলী সৃষ্টিতে যে সাধক পেয়েছিল পুরস্কারের বদলে নির্বাসন, সত্যের বদলে প্রহসন, পঙ্ক্তির বিনিময়ে চোখের জল আর মৃত্যুর সাথে লড়াই করার দুঃসাহস। কবিতা যাকে দিয়েছে অনন্য শান্তি, দুর্বার গতি, অদম্য সাহস ঠিক সেই মানুষটিকে অবহেলায় কাটিয়ে দিল একটা প্রজন্ম; এই লজ্জা বইতে বইতে আর কতকাল কবি দাঁড়াবে জনতার মঞ্চে, ডেস্কে-টেবিলে, মাটির শরীরে, হাতে কলমে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে একটা সমুদ্র আঁকতে পারবে— অক্ষরবিন্যাসে। দাউদ হায়দার একটা সময়কে উপেক্ষা করেছিলেন আর আমরা সেই সময়টিকেই কাঁধে বয়ে বেড়াচ্ছি আজীবন! আমাদের কবিতা প্রহরগুলো প্রেম, ভালোবাসা ও বিচ্ছেদি প্রকরণের উন্মাদনা; দ্রোহ ও সাহসীকতার কাব্যসৃষ্টিতে নজরুলকে পার হয়ে এসে একজন দাউদ হায়দার পেয়েছিলাম, যিনি কবিতাকে জনজীবনের হাতিয়ার রূপে গড়ে তুলেছিলেন কিন্তু ১৯৭৪ —এর পর আমরা তাকে ভুলে গিয়েছি। কবিতাকে জাগাতে হবে! কবিতা প্রখর হবে! কবিতা নিপুন হবে! কবিতা একা আলপথ ধরে বয়ে চলে যাবে সমুদ্রের গর্জনে—‌ মেঘের সন্ধানে, যাপনের কোলাহলে; কবিতাকে মুক্তি দিন, কবিতা পৌঢ় হৃদয় নিয়ে যুবাদের বর্শা খোচিত দেহে শব্দশৈলী নির্মাণ করবে।

‘এই আমার দেশ’ কবিতাটি যখন তিনি লিখেন তখন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছিল; এরকম একটা সময়ে তার এই নিরীক্ষাপ্রবণ লেখাটি একেবারে তৎকালীন সময়ে যে বিভীষিকার বয়ান উপস্থাপন করেছে তা কিন্তু বাঙালির রক্তে রঞ্জিত। ‘আমার স্বদেশ মিছিলে-মৃত্যুতে উজ্জ্বল’ মৃত্যুই একমাত্র মুক্তি এনে দিতে পারে। কবি বলেন, মৃত্যুই আলোকিত হ‌ওয়ার পথ সুগম করে দেয়। ‘এই আমার দেশ’ কবিতায় তিনি ব্যথিত কিন্তু আলোকিত, উজ্জ্বল নক্ষত্র।

‘আমাদের বাংলা কবিতা’য় তিনি বাংলা কবিতার প্রতি আমাদের অবহেলার কথা বলেছেন, ‘দ্যাখো, গত এক শতাব্দী ধরে/আমাদের বাংলা কবিতা অভুক্ত, মৃতপ্রায়’ মৃত কবিতার দিকে আমরা ঝুঁকছি; ঝুঁকি বাড়ছে, এখন কবিতা লিখতেও ভয় হয়, কথা বললে ওরা লিরিক নষ্ট করে দেয়, সে দিকেই যে মানুষ এগোচ্ছে তা এই কবিতার মাধ্যমে উঠে এসেছে, তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘তুমি, নিরাপত্তার অভাবে এখনি মোহ্যমান’ কবিতার যেখানে নিরাপত্তা নেই, সেখানে কবির অবস্থা কি দাঁড়ায় সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখি না। তার জন্য কবি বর্তমান শতাব্দীর মানুষদেরকেই দায়ী করেছেন। এই দায় কি আমাদের সবার নয়? সমাজের নয়?

‘যে দেশে সবাই অন্ধ’ ব‌ইটি ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয়। প্রচ্ছদ এঁকেছেন আরেক বিখ্যাত কবি পূর্ণেন্দু পত্রী। বইটির বিষয় নিয়ে আলোচনা করার অনেক উপাদান রয়েছে কিন্তু কে শুনবে কার আলোচনা তার কারণ ব‌ইটির শিরোনামেই উল্লেখিত। ‘আমরা সবাই নেতা’ কবিতায় তিনি যে প্রেক্ষাপটের ইতিহাস থেকে বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক আলোচনার উৎস খোঁজেন, তার গোড়াতেই গলদ, শাসকের আসনে শোষকশ্রেণী, একদল নেতা, চিবিয়ে খাচ্ছে, তোমাকে-আমাকে; বর্তমানে প্রেক্ষাপটে এই কবিতাটি সবচেয়ে উৎকৃষ্ট, কবি যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন, সেই বাংলাদেশ এখন একটি কলঙ্কিত অধ্যায়, হায়েনাদের থাবায়, বিষাক্ত, বর্বর। ১৯৮৩ সালের ‘আমরা সবাই নেতা’ কবিতাটি’র সম্পূর্ণ উল্লেখ না করলেই নয়!

দর্পনে ও-কার মুখ, তোমার আমার নাকি প্রত্যেকের
নাকি, মানব নামধারী কংসের?

হয়তোবা তাই। হয়তোবা সবাই শাসকের
ভূমিকায় অবতীর্ণ; ধরবে দণ্ড রাজবংশের।

দ্যাখো, কী অবস্থা দেশের, দশের ভাগ্যে আজ
মৃত্যু ছাড়া কিছু নেই। প্রতিবাদী কেউ নয়; অথচ সবাই
ভুলেছি বাহান্ন, একাত্তর;–বিস্মৃত জাতির সাজ
সত্যিই পিপীকিকা-তুল্য; বোঝাবে কে, তেমন বুদ্ধিজীবী
রাজনীতিবিদ কই! “শুধু চাই
সিংহাসব;” ব’লে আমি-তুমি প্রত্যেকে নেমেছি পথে,
কেউবা ভিখিরীর সাজে, কেউবা সৈনিক বস্ত্রে—
যে যেমন সাজে, সজ্জিত হতে চাও মারণ-অস্ত্রে।

–আমরা সবাই নেতা, আমাদের এই নেতার রাজত্বে।

‘যে দেশে সবাই অন্ধ’ কবিতার আলোচনাও এখন মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে; যেখানে কবি-বুদ্ধিজীবি থেকে শুরু করে সমাজের নানান পেশার মানুষ রয়েছে, সেখানেও অন্ধকার, কেউ চক্ষুষ্মান ন‌য়; সমাজে কোথাও শান্তির অবকাশ নেই, চারদিকে শ্মশান, বিপর্যয়, অন্ধের উন্মাদনা। তার লেখায় ফুটে উঠেছে অন্ধ সমাজব্যবস্থার বিপর্যয়ের কথা, রাজনৈতিক অপশক্তি, কুসংস্কার, অপসংস্কৃতি, জনজীবনে দুর্ভোগ ও শিল্প-সাহিত্যের অবনতি। মানুষের ইতিহাসে হিংস্রতা যেন পশুত্বকেও হার মানিয়েছে; পশুতুল্য সমাজের নিঃস্বহায় মানুষের বেঁচে থাকার কথা কবি বলেছেন কিন্তু সে পথ যে রুদ্ধ হয়ে গেছে একদল নিকৃষ্ট মানুষের জন্য, সমাজব্যবস্থার ভঙ্গুর দশা, এই কি আমাদের সমাজ?

আমাদের দেশজ সমাজে, তাই
দিবানিশি অন্ধকার। যেদিকে তাকাই
দৃশ্যত কিছু নেই; আগমন শ্মশান-নরক
আমাদেরই দেশজ সমাজে, ঘরে ঘরে বাংলায়। ( যে দেশে সবাই অন্ধ/ দাউদ হায়দার)

ষাটের দশকের উত্তাল রাজনীতির সময় তাকে লিখতে হয়েছিল অসম্ভব সব কবিতার পঙক্তি, সে সময় যা কঠিন ছিল ঠিক তাই তার কাছে সহজ রূপে ধরা দিয়েছিল; লিখেছেন, ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’ —এই আক্ষেপ তীব্রতা, অন্ধকার, জেল, বোহেমিয়ান মানুষের ব্যাথা, যন্ত্রণা, কবিতাকে সহ্য করেছিল— উন্মাদ সময়ে; চোখে উর্দি পরা মানুষগুলোর জন্য ছাড়তে হয়েছে জন্মভূমি বাংলাদেশ। ১৯৭৩ সালে ‘জন্ম‌ই আমার আজন্ম পাপ’ ব‌ইটি প্রকাশিত হয়। ব‌ইটির মুখ্যবিষয় ছিল দেশের প্রতি ভালোবাসা। মুক্তিযুদ্ধের কিছুকাল পরেই ব‌ইটির প্রকাশ কিন্তু কবির জীবনের অন্ধকার সমাগত। লিখেছিলেন, ‘কালো সূর্যের কালো জোৎস্নায় কালো বন্যায়’ তার পরেই বাঁধে বিতর্কের একঝাঁক; এই বিতর্কের মাধ্যমে কবিকে দেওয়া হল নির্বাসন, এ বিতর্কের উৎস হচ্ছে বিশ্বাসের ভাইরাস, অতিমাত্রার অন্ধত্ব আর একজন প্রাজ্ঞকে চিরদিনের জন্য মুছে ফেলার চেষ্টা কিন্তু ওরা জানে না যে একজন কবিকে কখনোই মুছে ফেলা যায় না, বরং সে ফুঁসে ওঠে, কথা বলে, লিখে এবং প্রতিবাদ করে। বাক্ ও শব্দলিপি কবির একমাত্র সম্বল! ওটাই তার শক্তি ও ভক্তির উৎস। উন্মাদ সময় পার করে এসে— এখন মনে হচ্ছে, দাউদ হায়দারের কবিতার বাণী কখনোই মিথ্যা ছিল না, তিনি যে সত্যের বাহক ছিলেন তা আমরা বুঝতে পেরেছি সেজন্যই ওদের গায়ে জ্বালা; বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের ‘মানুষ’ ‘নারী’ ইত্যাদি কবিতা ও প্রবন্ধে পাওয়া যায়, ধর্মগ্রন্থগুলি সব মানুষের তৈরি, মাথায় ঘোমটা দেওয়া মানে দাসত্ব, স্বয়ংসম্পূর্ণ নারী চাই, কোনো পুরুষ নিয়ন্ত্রিত নারী নয়! এগুলো যখন নজরুল বলেন তখন তো একদলের গায়ে জ্বালা ধরবেই, নজরুলের সারবত্তাকে ধারণ করার মতো একজন মানুষ‌ও আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে জন্মাননি! রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের দিপ্ত তেজের অনির্বাণ কথাগুলো কে বুঝবে? ‘সুলতানার স্বপ্ন’ একদিন সত্যি হবে! হ্যাঁ, হবে! ঐ ব‌ই পুস্তকে বাস্তবে না। আমাদের সেই মাথা নেই, মগজ নেই, শূল, বিদ্রুপ আর অহংকারের দোসর হয়ে জীবনভর অমানবিকতার প্রদর্শন, আত্মবিলাপ, সংঘর্ষ, রক্তপাত —এই সৃষ্টিকে উপহত করে রেখেছে। ধর্মের দোহাই দিয়ে কাউকে নির্বাসনে পাঠানো এ যুগের উপহাস বলে গণ্য তবুও একদল এটাকে লালন করে আসছে, ধর্ম যেন মুড়ি-মুড়কির মত ব্যাবসায়ের আড়তখানা, কেনা-বেচা হয়, কাটাকাটি, হানাহানি, মগজাস্ত্র আর চরম উৎপীড়নের বস্তু-সাদৃশ্য। মানুষের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ধর্মগুলো হয়ে পড়ছে লাগামহীন নির্যাতনের শিকার, ভালো দিকগুলো আজ অসহায়, নির্বাক এইসব স্বার্থান্বেষী সমাজের জন্য, সভ্য-সমাজের কাছে এরা অপরাধী কিন্তু কে করবে তাদের বিচার? ওদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু লিখলে, বললে অথবা চুপ করে থাকলেও জেল, জরিমানা, নির্বাসন কিংবা মৃত্যুর মতো অমানবিকতার স্বীকার হতে হয়! দাউদ হায়দারের কবিতা ছিল অনির্বাণ শিখা, যে শিখা একবার জ্বলে উঠলে আর নেভানোর কোন সুযোগ থাকে না, হ্যাঁ, সে আগুন এখনও নিভবার নয়! কবি রফিক আজাদের ভাষায় বলতে গেলে, ‘ধর্ম ভালো/সব ভালো তো আমার দরকার নেই’ —এই ভালো আর মন্দের বেড়াজালে কতদিন মানুষ মরবে? যার যেটা ভালো লাগে সে সেটা করুক না, তাতে অসুবিধা কি? ব্যক্তি স্বাধীনতার তো একটা মানে আছে। সবদোষ ধর্ম ব্যবসায়ীদের মুখোশ উন্মোচন করতে গিয়ে, যেটা দাউদ হায়দারের পক্ষে সক্ষম, তাই বলে আমি দাউদ হায়দারের পক্ষে সব সম্মতি জ্ঞাপন করছি না! আপনার যেটা ভালো লাগেনি সেটা আপনি নেবেন না, তার জন্য কেন নির্বাসন দিবেন? এটি মোটেও যুক্তির কথা না! নজরুল যদি এই যুগে জন্মগ্রহণ করতেন, নজরুলকেও নির্বাসন দেয়া হতো, রবীন্দ্রনাথ‌ও নির্বাসনে থাকতেন যেমনটা নারীদের অধিকার নিয়ে লেখার জন্য তসলিমা নাসরিন নির্বাসনে, হুমায়ূন আজাদ কিংবা অভিজিৎতের বুকে অস্ত্র নিক্ষেপ! তার মানে আপনি সত্যকথা বলতে পারবেন না, সত্য বললে আপনাকে মেরে ফেলা হবে। একদল জঙ্গিগোষ্ঠী দিনরাত পরিশ্রম করে এইসব অরাজকতা সৃষ্টি করার জন্য উন্মত্ত থাকে। দাউদ হায়দার তার ব্যক্তিগত জীবনে সাহসীকতার পরিচয় দিয়ে চলে গেলেন, মৃত্যুলোকে, বার্লিনের মাটিতে, সেখানেও তাকে কয়েকবার আক্রমণ করা হয়, কিন্তু তিনি যদি বাংলাদেশে থাকতেন নজরুলের পরের আসনটি তাঁকেই দেয়া হতো। দানবতন্ত্রের শিকল ভেঙ্গে একজন কবি দাঁড়াতে পেরেছেন জনতার মঞ্চে; অথচ তাকেই নির্বাসন।

দানবতন্ত্র যারা সৃষ্টি করেছিল, অতি উন্মাদে, সাধারণ মানুষের চেতনায় আলকাতরা মাখিয়ে দিয়ে, অজ্ঞতাকে প্রয়োজনের হাতিয়ার বানিয়েছিলেন, তারা এখন‌ও বাংলাকে ছিঁড়ে-চিঁড়ে খাচ্ছে, বস্তুতঃ ভোগের উপকরণ বানিয়েছে কিন্তু বাঙালির মুক্তবুদ্ধির চর্চা ব্যাহত, জ্ঞান সীমাবদ্ধ, সংস্কৃতির ধারকেরা মুখ লুকোচ্ছে কিন্তু দাউদ হায়দার বুক চিতিয়ে তার বাণী বলেছিলেন….

“বাংলাদেশ কি আসলেই শোকের দুঃখের না যুদ্ধের?”

কবি কেন এইসব প্রশ্ন করবেন?… বাংলাদেশ তো হওয়া উচিত বিনির্মাণের! মুক্ত স্বাধীন-চেতনার উন্মেষের। মুক্তিযুদ্ধে একাত্তরে নির্মমতার ছায়াবৃত্ত পাড়ি দিয়ে— চেতনার জলাঞ্জলি বলি দেওয়াকে কবি প্রশ্নবিদ্ধ করছেন, কিন্তু কোথায় এই প্রশ্নের উত্তর?… উত্তর তো খুঁজতে হয় সহজ লোকের ভিড়ে, বাঁ পাঁজুরে অনুভূতিতে নয়! চিন্তাকে শান দাও, ধাঁধানো গোলকে ক’জন পারে সুখ ও দুঃখের পরিপাটি জানতে। কবিতা হচ্ছে শব্দের খোরাক; মানোগ্রাহী ব্যঞ্জনার অনুপম শব্দের দ্যোতনা। দাউদ হায়দার শব্দকে শক্তিরূপে প্রয়োগ করেছেন, তাঁর কবিতায় ভক্তি বা প্রেমিক আবেশের ভিড়েও সিংহের গর্জন— এখানেই কবির সার্থকতা।

“জন্মই আমার আজন্ম পাপ, মাতৃজরায়ু থেকে নেমেই জেনেছি আমি
সন্ত্রাসের ঝাঁঝালো দিনে বিবর্ণ পত্রের মত হঠাৎ ফুৎকারে উড়ে যাই” (জন্মই আমার আজন্ম পাপ/ দাউদ হায়দার)

“এখন নদী হচ্ছে রক্তের
দেশ হচ্ছে যুদ্ধের
মানুষ হচ্ছে হিংস্র
পশু হচ্ছে ভদ্র” ( আলোর গভীরে/দাউদ হায়দার)

কবি একজন মানবতাবাদী, মানব হৃদয়ে তার ভাব ব্যঞ্জনার অভিব্যক্তি; অথচ সে হৃদয় কলুষিত করে একদল বেহায়াপনা করছে— মানুষে মানুষে বিভেদ, দেশে দেশে যুদ্ধ, রক্তপাত, হিংসা-নিন্দা, বাতাসে কান্নার রেওয়াজ, কোথাও যাওয়ার নেই, মানুষ কোথায় যাবে? হিংস্র হায়নার ক্ষুধা নিয়ে একদল শাবক পৃথিবীকে দায়ী করতে পারে না। আমাদের যেতে হবে আলোর গভীরে…

“আমরা সবাই আলোর গভীরে যেতে চাই
যেতে চাই উজিয়ে সকল বাধা
পেতে চাই কবিতা ও মানুষের ভালবাসা। তাই না? হাঁ!” (আলোর গভীরে/ দাউদ হায়দার)

একজন দেশ প্রেমিক দাউদ হায়দার, দেশকে প্রেমিকার চোখে দেখেছেন, এলোমেলো খোলা চুলে রূপসী তাঁর দেশ, সবুজ সিঁথিতে নেমে আসে বৈকালী সূর্য; নদীতে কলকল অথৈ, ভোরের স্নিগ্ধ শোভন কেমন নিবিড় হয়ে আসে— কবিতার ছলে। কবি সেই কাব্যের চিত্রকর, যে কবিতার জন্য কবিকে হতে হয়, পরবাসী কিন্তু ভালোবাসার কমতি রাখেনা কখনো জন্মভূমির প্রতি; জার্মানির বার্লিনে থেকেও দেশের জন্য ভেবেছেন, অথচ নির্বাসনের কঠিন শৃঙ্খল তার পায়ে কিন্তু কবিতাকে তো রুদ্ধ করা যায় না, কবিতা অবরুদ্ধ, কবিতার বিরুদ্ধে কেউ যেতে পারে না— তাই কবি অনায়াসে লিখে চলেছেন তার জীবনের অবদমিত কোলাহল। কবি দুঃখিত হয়েছেন, তিনি আর রক্তপাত চান না, প্রেমের সাগরে মগ্ন হতে চান, একমাত্র প্রেমই আনতে পারে হৃদয়ের জোয়ার, মানুষের সাথে মানুষের, জীবনের সাথে জীবনের, হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের।

“মাঝে মাঝে মনে হয়
অসীম শূন্যের ভেতর উড়ে যাই ।
মেঘের মতন ভেসে ভেসে, একবার
বাংলাদেশে ঘুরে আসি ।’’ ( তোমার কথা/ দাউদ হায়দার)

আবেগ আর ঘন অনুভূতির দেশ বাংলাদেশ! সেখানে চিরল পাতার মতন লেপ্টে থেকে কবি নিজেকে মেলে ধরতে চান, সে চাওয়া কি পূর্ণ হবে— কোনোদিন। তিনি মেঘ হয়ে ভেসে আসতে চান চির সবুজের দেশে! কি অপূর্ব কথার ব্যঞ্জনা। বাংলাদেশ নিয়ে তার এত এত স্বপ্ন, এত ভালবাসা, হৃদয়ের টান কেন যে মলিন হয়ে যায়, কবি সে চোখের জল কোথায় লুকাবে, তার একমাত্র প্রেমিকা বাংলাদেশ, বিচ্ছেদী সাইরেন রচনা করে যন্ত্রণার জোগান দেয়।

বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার ভঙ্গুর বিপর্যয়ের মধ্যে কবিতার দ্রোহের প্রকরণগুলো নিস্তেজ হয়ে গেল। বহুমুখী প্রতিভারগুলোর বিসর্জন, বেহাল দশা, ঘৃণা-আক্রোশ এখন আমাদের ভাষা, লজ্জা আমাদের আচ্ছাদন, চারপাশে কাঁচা ইটের ভগ্নস্তুপ, কোথাও যাওয়ার নেই। জীবনের প্রান্তে এসে— কবির উপলব্ধির ভাষা, দেশের প্রতি শ্রদ্ধা, এতটুকুও কমেনি। অথচ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ক্ষতবিক্ষত মাতৃভূমি তার প্রেমিকা ভালোবাসার একমাত্র জায়গা। ভালোবাসার জন্য যদি সে ভালোবাসা হয় তা মৃত্যুকেও অমৃত করে তোলে— দাউদ হায়দার সে কথাই বলেন।

লেখাটি যখন শুরু করেছিলাম, তখন কবি জীবিত ছিলেন‌। আর যখন শেষ করলাম, তখন তিনি মরলোকে পাড়ি জমিয়েছেন। কবির মৃত্যুর অন্ততঃ বছরখানেক আগে লেখাটি শুরু করেছিলাম। ভাবনা ছিল, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লিখি কিন্তু পারলাম না। আমাদের তরুণদের ভাবনার জগতে দাউদ হায়দার ততটা পৌঁছাতে পারেনি! তার একমাত্র কারণ ওনার থেমে থাকা, নির্বাসন এবং অন্যান্য। তারপর‌ও আমরা যারা খুঁজে খুঁজে পড়ি; জানার জন্য জানতে চাই, তারা দাউদ হায়দারের কবিতার পঙ্ক্তিগুলো অবশ্যই পড়বেন।

৪২
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন