দেবব্রত সিংহ

কবিতা - আমরা সিধু আমরা কানু

দেবব্রত সিংহ

আখনো আমাদে ভগনাডিহির শুকনা মাঠে

জষ্টি মাসের রোদে

শাল ফোঁড়ের ডগে ডগে আগুন জ্বলে

ধো -ধো-ধো-ধো করে

জাড়কালে আঘনমাসের ভিজা ক্ষেতে ছেঁড়া কাঁথা উড়ে

বুড়া বাপের গুনা হাড় কাঁপে

ঠক ঠক ঠক ঠক করে

লিজের রুয়া ক্ষেতে পরের ধান আগুলতে যাইয়ে

সনঝাবেলায় কেউ লাকাড়ে,

হো- হই

হাজার হাজার শুকনা গাছের বুক ফাটে শব্দ ছুটে

হো -হই,

তোরা কারা ?

ক্যানে হে ব,

মানুষ বঠি মানুষ

কালঅ কালঅ শয়ে শয়ে মানুষ

মাটি আর পাথরের বুকে পড়ে থাকা মানুষ

ছেঁড়া টেনা আর চার হাত কাচা পরা মানুষ

সেই মানুষ যারা একদিন দাঁতে দাঁত দিয়ে

কাঁধে কাঁধ দিয়ে

পাথরের পারা গতর লিয়ে

বুনা মাটির দেশে দেশে

পাহাড়ে পাহাড়ে

বনে বনে

গোরা পল্টনের সাহেবদে কাছে

ঝিঙ্গা ফুলা বাঘের পারা গাঙ্গাই বলেছিল,

” শালা, ই দেশ আমার

ই মাটি আমার,

তরা আমার মাকে কাড়েছিস

আমরা তদের জীউ লিয়ে ছাড়ব ।”

আমরা কিন্তুক সবুজ শালবনের

লাল ধুলার ডহরে ডহরে

বাঁশি ফুঁকা মানুষ হে,

আমরা রাতদুফরে জোসটা রাতে পাহাড়ে পাহাড়ে

মাদল বাজানো মানুষ,

আমরা মোহলতলাতে খেদ ভরে মহুয়া খাইয়ে

গাঁয়ের কুলিতে দল বাঁধে

লাচ-গান করা মানুষ

বড়লাট বেন্টিংক সাহেবের কথায়

রাজমহলের কাছে দামিন ই কোহতে

যখেন আমরা পাহাড় ভাঙ্গে জঙ্গল কাটে

বাস করতে আলম

মাটি থাকে কাঁকর আর পাথর সরাই

চাষের জমিন তয়ার করে

সেই জমিনে

সোনার ফসল ফলাতে লাগলম

তখেন আমরা টুকুন সুখেই ছিলম হে

তাবাদে মাততক ক মাস বাদে দামিন ই কোহতে

সব সুখ কাড়্যে লিলেক সাহেবরা।

বলেছিল,

“তোরা বন কাটে আবাদ করবি

তোদের আবার খাজনা কীসের”,

মিছা বলেছিল

যেই দেখলেক ফসল ফলছে গাদা গাদা

অমনি বসাই দিলেক খাজনার উপর খাজনা,

ডাকে আনলেক মহাজন’ আর বেনিয়াদের

বেনিয়ারা নুন তেল বিচে

আমাদে ফসল লুটতে লাগল

মহাজনরা টাকার থলি লিয়ে দাদন দিয়ে

আমাদে গলায় ধারের ফাঁস পরায় দিল

আমরা না খাওয়া পেটে দিনের পর দিন

শুকাই দড়ি হয়ে গেলম ।

দেখতে দেখতে আমাদে বুকের ভিতরে জ্বলতে থাকা

ধিক ধিক করা আগুন

দামিন ই কোহ র গাঁয়ে গাঁয়ে ডহরে ডহরে

দাও দাও করে জ্বলে উঠল একদিন

আমাদে সিধু আমাদে কানু

আমাদে চাঁদ আমাদে ভৈরব

ঠাকুর বাবার নামে শাল গিরা পাঠাই ডাক দিলেক,

“দেলায়া বিরিদ পে

দেলায়া তিঙগুন পে”

“তরা ইবার জাগ তরা ইবার উঠ ”

হাজার হাজার খেরওয়াড় মরদ

টাঙ্গি কুড়াট তীর ধনুক খাড়া করে বললেক,

” দেলায়া বিরিদ পে

দেলায়া তিঙগুন পে”

শুরু হয়ে গেল হুল

গোরা পল্টনদে হাতে বন্দুক আর কামান

আমাদে হাতে তীর কাঁড় টাঙ্গি আর তরোয়াল

মহেশ দারোগার পথ আটকে গুমানি লদীর পাড়ে

আশথতলায় রুখে দাঁড়ালম আমরা,

দারোগা শুদালেক,

” কে তোরা” ?

বুক ফুলাই মাথা খাড়া করে জুয়ান ছেল্যাটা বলল,

” আমি সিধু

ই আমার দেশ’

কানু বলল,

ই আমার মাটি

ই আমার মা”

তাবাদে আমাদে লাখঅ লাখঅ মরদের

লড়াইয়ের মাদল

তাবাদে আমরা ইতিহাস

পরাধীন ভারতের মাটিতে

স্বাধীনতার প্রথম লড়াইয়ের ইতিহাস ।

সেসব দিনের তাগদের কথা

আমরা পাসুরে গেছি হে

দেখছ নাই এগনাতে শিমুল গাছ ট

কেমন শুকাই গেছে

তবু আখনো যখেন শিকার পরবের রাতে

দামিন-ই-কোহ’র জঙ্গলে

ধাতিং ধাতিং করে মাদল বাজে

শাবন মাসে গুমানি লদীর জলে

কলকল করে বান ছুটে

করমপূজার বিহানভোরে

লাখো মরদের হাত-পা লড়ে

যখেন আমাদে হাজার বিঘা ধানজমিতে

কালঅ চিমনির ধুঁয়া উড়ে

আমাদে গাঁয়ের পরে গাঁ তুলে দিয়ে

বাবুদে লদী বাঁধ উঠে

তাবাদে সেই বাঁধের জলে

কন্টাকটারের তাঁবুর আড়ালে

আমাদে জুয়ান বিটিছেল্যার ল্যাংটো গতর ভাসে

তখেন হাড়ে হাড়ে শনশন করে রক্ত ছুটে,

রাতের পর রাতের ঘুম কাড়ে লিয়ে যায় কেউ,

আমাদিকে ডাকে বলে,

তোরা কে?

শালমোহলের বনের উপরে

শয়ে শয়ে চিমনির ধুঁয়া বলে,

তোরা কে?

খা খা করা ছাই উড়া বাঁজা মাটি বলে

তোরা কে?

লদী বাঁধের ঢেউয়ের পরে ঢেউ বলে

তোরা কে?

আমরা বলি চিনতে লারছ,

আমরা ত সেই মানুষ বঠি

আমরা হাজার বছর ধরে মাথা খাড়া করে বাঁচে আছি,

বছরের পর বছর

ধরনে আর জাড়ে

মাটি আর পাথরের বুকে জঙ্গলে আর পাহাড়ে

বাবু আর বেনিয়াদে ফাঁদ পাতা শিকারে

জীবনের লাগে জীবনের লড়াই করে বাঁচে আছি,

ভালঅ করে দেখঅ

আমাদে মুখের দিকে ভাল্যে দেখঅ

আমরা ত সেই মানুষ বঠি

যে মানুষ একদিন ভগনাডিহির মাঠে হয়েছিল সিধু

মউরাক্ষীর লদীতে হয়েছিল কানু,

আর আখন?

আখনো আমরা তাই আছি,

দুজনার থাকে বাড়ে হইছি হাজার হাজার

লাখঅ লাখঅ কোটি কোটি

তুমরা কি নামে ডাকবে সে তুমরাই জানঅ

আমরা জানি

আমরা সিধু আমরা কানু

আমরা সিধু আমরা কানু।

পরে পড়বো
৬৩
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন