দেবব্রত সিংহ

কবিতা - বুধেশ্বরের মা

দেবব্রত সিংহ

“সে রাতে গ্রামে যখন পুলিশ ঢুকল বুধেশ্বর তখন বাড়ির দাওয়ায় বসে লন্ঠনের আলোয় পড়ছিল।

জঙ্গলমহলের লালগড় কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিল ২১ বছরের বুধেশ্বর ।

পুলিশ খুঁজছিল বুদ্ধদেব মাহাতো কে। কিন্তু বুধেশ্বর মাহাতো কে নিয়ে গেল।

থানায় লেখা হল বুদ্ধদেব ওরফে বুধেশ্বর। আজ বুধেশ্বর এর বয়স ৩৪ বছর।

এখনো সে প্রেসিডেন্সি জেলে আদালতের তারিখের অপেক্ষায়।”

খবরটা কি দেখেছ তুমরা

তুমরা সবাই কি দেখেছ এই খবরটা

কাগজে কিন্তুক বেরাইছিল

প্রথম পাতায় লয়

ভিতরের পাতায় ছোট করে বেরাইছিল

আমি টিপছাপ দিয়া মানুষ

মুখ্য সুখ্যু মানুষ

গাঁয়ের ছেল্যাগুলান কাগজটা পড়ে না শুনালে

আমি জানতেই পারথম নাই খবরটা

কি বলব তুমাদিকে

আমার ত বলার পারা কিছু নাই

শুদু একটা কথা সেই থাকে

উটুঘুটু করছে দিনরাত

ছেল্যাগুলানকে শুদাইছিলম

সব ইস্কুলে পড়া ছেল্যাপেল্যা

উয়ারা কেউ বলতে লারলেক

তাবাদে আমাদে পাইমারি ইস্কুলের

মাস্টারকেও শুদাইছিলম

সেও পারলেক নাই

ইবারে বাকি আছে উকিল বাবু

টাউনের উকিল বাবু

তার কাছে ত আর যাতে পারি নাই যখন তখন

তাই তুমাদিকে বলছি

এই “রাষটরদোরহী”কথাটার মানে কি বঠে

বলতে পার অ

কাগজ আউলারা লেখেছে কথাটা

তারা লেখেছে “রাষটরদোরহী” ছেল্যাকে

একবার চোখের দেখা দেখতে চান মা

ঠিক কথাটাই লেখেছে

আজ আতগুলান বছর ধরে তাই চাইছি আমি

বুধাকে একবার দেখতে চাইছি

চোখের দেখা দেখতে চাইছি

ছেল্যাটা বাঁচে আছে না মরে গেছে

সেটা একবার লিজের চোখে দেখতে চাইছি

উকিল বাবু কে বলেছি

কতবার কত করে বলেছি

বাবুর খালি একটাই কথা

ইটা যে সে কেস লয়

ইটা আলাদা কেস

এই কেসে জেলখানায় দেখা করাটা কি

মুখের কথা বঠে

যত কাগজপততর সব

জমা দিতে হবেক সরকারের ঘরে

তাবাদে সেসব দেখে টেখে

সরকার যদি বলে

তবেই হবেক দেখা

তার আগে কিছু হবেক নাই

সেই বলা কওয়ার কাজটা হয় নাই আখনও

কি আর করব বল অ

আমার ত করার কিছু নাই

ছেল্যাটার লাগে হা হুতাশ করে

চোখের জল ফেলা ছাড়া

আমার আর কি করার আছে

উয়ার বাপ বাঁচে থাকলে

তবু দুটা কথা বলথম

দুজন মিলে যুক্তি পরামশ করথম

সে আর হল কই

বাবুদে দুয়ারে দুয়ারে কম ঘুরেছে মানুষটা

ছেল্যার লাগে যে যা বলেছে তাই করেছে

পাটি বাবু প্রধান বাবু এমএলএ বাবু

কেউ কিছু পারে নাই করতে

শেষে ওই জমিজমা যতটুকুন যা ছিল

সব বিচে টিচে দিয়ে

টাউনের উকিল বাবুর কাছে

তা বাদে আর কি

মাসের পর মাস বছরের পর বছর

ছেল্যার কথা ভাবতে ভাবতে

একদিন এক রাতের বেলায়

বুক বেদনায় হুট করে চলে গেল মানুষটা

কি বলব দিনমজুরি খেতমজুরি করে

বহুত আশা লিয়ে কলেজে ভর্তি করেছিল ছেল্যাটাকে

উয়ার লেখাপড়ায় মাথাও ছিল খুব

সাতে নাই পাঁচে নাই

কেবল দিনরাত পড়ে থাকতক বই লিয়ে

পাড়ার লোকে গাঁয়ের লোকে

এমনকি বড় ইস্কুলের মাস্টাররা পর্যন্ত

সবাই কত নাম করতক উয়ার

সেই ছেল্যাকে কেমন করলেক দেখ অ

“রাষটরদোরহী”

আমার আখনো মনে আছে সব

তের বছর আগের সেই সনঝারাতটা

আমার একবারি ছবির মতন মনে আছে

চোখের সামনে ভাসছে সব

সেদিন উয়ার বাপ ছিল নাই ঘরে

সনঝাবেলায় দাওয়াতে বসে লন্ঠনের আলোয়

বই পড়ছিল ছেল্যাটা

আমি উনুন ধরাই ভাত চাপাব বলে

কাঠ কুটা আনতে গেছি এগনাতে

তখন দেখি পুলিশ

একদল পুলিশ

আমি ত দেখে থ হইয়ে গেছি

বলি ইখানে কী বঠে

কী বঠে ইখানে

তারা আমার কথার কোন জবাব না দিয়ে

সটান দাওয়াতে উঠে

বুধাকে ধরেছে ঘিরে

-তোর নাম কি?

-আমার নাম বুধেশ্বর মাহাতো

-তোর ভালো নাম কি বুদ্ধদেব?

-না আমার কোনো ভালো নাম নাই

আমার এই একটাই নাম

আমি লালগড় কলেজে পড়ি।

-হইছে হইছে লে

আর বলতে হবেক নাই কিছু

তোকে আখন যাতে হবেক আমাদে সঙ্গে ।

কী বলব তুমাদিকে

টানতে টানতে এক লিমিষে

লিয়ে চল্যে গেল ছেল্যাটাকে

আমাকে একটা কথা পর্যন্ত

দিলেক নাই বলতে

আখন তুমরা বল অ

ইটা কেমন জুলুম বঠে

এটা কেমন দেশ বঠে

আমি বলে দিইছি উকিলবাবুকে

যারা আমার বুধা কে

বুদ্ধদেব মাহাতো সাজাইছে

তাদের কাউকে ছাড়ে দিব নাই আমি

ভিটা মাটি ঘর দুয়ার সব বিচে

আমি শেষ দেখে ছাড়ব

আমি ইয়ার শেষ দেখে ছাড়ব

তুমরা বল অ

আত সবের পরেও পাটিবাবুরা বলতে আইছিল

আজ মিছিল বেরাবেক স্বাধীনতার

সেই মিছিলে যাতে হবেক তোকে

আমি বলেছি

মুখের উপর বলে দিইছি বাবুদিকে

স্বাধীনতাটা কীসের

কাদের স্বাধীনতা

গায়ের জোরে জুলুম করে টানতে টানতে

লিয়ে গেল ছেল্যাটাকে

একটা গরীব ঘরের নিরীহ ছেল্যা

কেউ বলারও নাই

কেউ করারও নাই

শুদু চোখের জলে ভাসে গেছে এগনাটা

তখন কুথায় ছিল স্বাধীনতা

তখন তুমাদে স্বাধীনতা ছিল কুথায়

মিথ্যা কেসে জড়াই দিয়ে

ছেল্যাটার জীবনটাকে দিলেক লষট করে

ইটা কীসের স্বাধীনতা

ইটা কাদের স্বাধীনতা

আজ তের বছর বিনা দোষে জেল খাটছে যে ছেলেটা

তুমরা আমাকে বুঝাই বল অ দেখনি

তার মায়ের স্বাধীনতা টা কীসের

তার মায়ের কীসের স্বাধীনতা

পরে পড়বো
৬৩
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন