সকালবেলায় কামারশালায়

কাজ করছিলেন মানুষটি

গ্রামের সবচেয়ে পুরনো মানুষ

বয়স হয়েছে ঢের

আজকাল কানেও কম শোনেন

চোখেও কম দেখেন

তবুও কামারশালার গনগনে আগুনে

লোহা পেটানোর কাজ ছেড়ে

বাড়িতে বসে থাকার জো নেই তাঁর

রুটি রুজির খোঁজে শহরে গিয়ে আর ফেরেনি ছেলেরা

বাড়িতে শুধু দুজন মানুষ

বউ মারা যাওয়ার পরে

ছোট মেয়েটি ছাড়া সঙ্গে আর নেই কেউ

শহর থেকে দূরে

বহুদূরে

দেশের একেবারে শেষ প্রান্তে

রাইন নদীর পাড়ে

পাহাড় দিয়ে ঘেরা

সীমান্ত ঘেঁষা গ্রাম

নিরিবিলি নিস্তরঙ্গ গ্রাম

সেই গ্রামে সাতসকালে হাজির হলে

সৈনিকের দল

বন্দুক কাঁধে সৈনিকের দল

সঙ্গে গুপ্তচর, শিকারি কুকুর ও আরো অনেক কিছু

তল্লাশি চলছে

সারা দেশজুড়ে চলছে তল্লাশি

সন্দেহভাজনদের খোঁজে

বিরুদ্ধবাদীদের খোঁজে

ঘরে ঘরে চলছে তল্লাশি

আদেশ দিয়েছেন তিনি

ক্ষমতা দখলের পরে নয়া রাজত্বের ক্ষমতাধরের

এটাই প্রথম আদেশ

খুঁজে বার করতে হবে

শহরে গ্রামে প্রতিটি জনপদে

বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে

খুঁজতে হবে

কারা কারা সাহায্য করতো সম্রাট কে

কারা কারা এখনো সমর্থন করে সম্রাটকে

নতুন রাজত্বকে স্বাগত জানায় নি কারা

সম্রাটের পুরনো রাজত্বকে ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন

এখনো কারা দেখে

কামারশালার বৃদ্ধ মানুষটির কাছে

এতসবের কোন কিছুরই খবর ছিল না

এই পালাবদলের

এই ক্ষমতা দখলের

কোন খবরই জানতো না সে

তবু গ্রামে ঢুকে তল্লাশির সময়

সৈনিকেরা তাঁকেই প্রথম ধরল ঘিরে

কানে খাটো জেনে চিৎকার করে তারা শুধালে,

“তুমি কার দিকে আছো বলো

তুমি আছো কার দিকে

কোন রাজত্বে আছো

সেটা আমাদের খুলে বলো”

সাতসকালে কামারশালায় বন্দুকধারী সৈনিকদের দেখে

তিনি ঘাবড়ে গেছিলেন খুব

কানে দড়ি দিয়ে বাঁধা চশমাটা পরে নিয়ে

ভালভাবে নজর করে দেখে

তিনি উঠে দাঁড়িয়েছিলেন ঠিকই

তবে তাঁর পা দুটো যাচ্ছিল কেঁপে

তাই দেখে সৈনিকরা আরো কাছে এসে

প্রায় গা ঘেঁষে

জানতে চাইলে তাঁর কাছে,

” এই রাজত্বে তুমি কার দিকে আছো বলো

আমরা জানতে চাই

তুমি আছো কার দিকে”

তিনি তখন শুকিয়ে যাওয়া গলায়

ঢোক গিলে বললেন,

“বাবা আমরা তো চিরকাল একজনাকেই জানি

তিনি আমাদের সম্রাট

তিনি আমাদের পিতা মাতা

তিনি আমাদের- – -”

কথা শুনে ধমক দিয়ে উঠল সৈনিকরা

“হয়েছে হয়েছে

আর বলতে হবে না

আর কিছু বলতে হবেনা তোমাকে”

” এই দড়ি কোথায়

একে দড়ি দিয়ে কোমরে বেঁধে নিয়ে চলো”

তখন মেয়েটি এলো ছুটে

পায়ে ধরে কেঁদে কেটে কত করে বোঝালে সে

” বাবাকে তোমরা ছেড়ে দাও

বাবা সেকেলে মানুষ

পুরনো যুগের মানুষ

বাবা এসব জানে না কিছুই

কোন কিছুরই খবর রাখে না বাবা

আমরা আছি

আমরা সবাই তোমাদের সঙ্গে আছি”

সৈনিকরা তার কোন কথায় কান দিলে না

তারা বৃদ্ধ মানুষটি কে কোমরে দড়ি দিয়ে বেঁধে

টানতে টানতে নিয়ে চলে গেল নিমেষের মধ্যে।

তারপরের ঘটনাক্রম খুবই সংক্ষিপ্ত

সন্দেহভাজন বিরুদ্ধবাদীদের সবার ভাগ্যে

যেমনটা ঘটে ঠিক তেমনটাই

গিলোটিন এর কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন যিনি

তিনি দেশের ক্ষমতাসীন একাধিপতি

বৃদ্ধের হাত জোড় করে প্রাণভিক্ষার আকুল প্রার্থনাতে

তিনি টলে গেলেন না একটুকুও

তাঁর মনে কোথাও উদ্রেক হলো না একফোঁটা করুণার

তার বদলে তিনি অনুভব করলেন উল্লাস

সন্দেহভাজন বিরুদ্ধবাদীদের নিশ্চিহ্ন করার

এক পৈশাচিক উল্লাস

ইতিপূর্বে ষোলো হাজার পাঁচ শ নিরানব্বইজনকে

তিনি এভাবেই চড়িয়েছেন গিলোটিনের ফাঁসিকাঠে

তখন একবারের জন্যও বুক কাঁপেনি তাঁর

আজও কাঁপলো না

তবু সৈনিকরা যখন গিলোটিনে চড়িয়ে দিয়েছে বৃদ্ধকে

তখন কী জানি কী ভেবে

একবার তাকাতে গিয়ে দেখলেন

তাঁর দিকে তাকিয়ে বড় অদ্ভুত ভাবে

হাসছে বৃদ্ধ

ফ্রান্সের প্রবল প্রতাপশালী কর্ণধার

ম্যাক্সমিলন রোবসপিয়ার আরো দেখলেন

বৃদ্ধ শুধু একা নয়

তার সঙ্গে গিলোটিন এর ফাঁসিকাঠটাও হাসছে

ফ্রান্সের দন্ডমুন্ডের একাধিপত্যের অধিনায়ক

মহামান্য রোবসপিয়ার এর বড় আশ্চর্য লাগল এই দৃশ্য

তিনি চোখের ভুল ভেবে চোখ কচলে

যতবার দেখলেন

ততবার সেই একই দৃশ্য

আসলে সন্ত্রাসের রাজত্বের একচ্ছত্র অধিপতি

কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না

সেই আপ্তবাক্যের কথা

তিনি কিছুতেই পারছিলেন না বুঝে উঠতে –

সন্ত্রাস কখনো শেষ কথা বলে না

শেষ কথা বলে মানুষ

সেই মানুষ

যারা আর কিছুদিন পরেই

তাকেও চড়াবে গিলোটিনে

গিলোটিনে চড়াবে তাকেও ।

১৮
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন