জানঅ আবা জানঅ মা

ইবারে মুন্ডাদে ঘরে এমন একজনা ছেল্যা জম্মাইছে

যে সরদারদের পুরনো লড়াইটাকে

ছোটনাগপুরের হারানো জমি ফিরে পাওয়ার

মুলুকের লড়াইটাকে

আবার লতুন করে ঘুরাই আনবেক

জানঅ মা লড়াই কেমন জিনিস বঠে জানঅ

লড়াই হল তুষের আগুন

তুমি ভাবছো নিভে গেছে

তা কিন্তুক লয়

লড়াই কখনো নিভবার লয়

তুষের আগুন হাওয়াতে উড়লে

তুষের আগুন আঁধিতে উড়লে

শুকনা ঘাসে শুকনা কাঠে

ইদিক উদিক জ্বলে

ধিক ধিক করে জ্বলে

তুমি বল অ দেখি মা

সেই মুন্ডা ছেল্যাটা কে বঠে ?

কে তার আবা

কে তার মা ?

অত কথা তোকে কে শিখালেক রে

তুই ইসব ভাবনা কুথা পালি ?

দেখঅ মা ইসব ভাবনা সবাই ভাবে

ইসব কথা সবাই বলে

তুমি শুন অ নাই

ই লিয়ে কত গান বাঁধেছে সবাই ।

দেখ বীরসা

বুরজু মিশনে লিখাপড়া করে

তুই যা জানেছিস বহুত জানেছিস

আর লিখাপড়ায় দরকার নাই বাপ

লিখাপড়া তুই যতই করিস

তুই যে মুন্ডা সেই মুন্ডা ই থাকবি

তোকে কেউ বাবু নাই বলবেক

তার থাকে ঘরে আছিস ভালই আছিস ।

বীরসা কি আর ঘরে থাকবার ছেল্যা বঠে রে করমি

বীরসা কি আর ছাগল চরাবার ছেল্যা বঠে

চালকাদ থাকে চাইবাসা

চাইবাসায় সাহেবদের মিশনের আপার প্রাইমারি

পথটা দূর বঠে

পথ যত দূর হোক

উ পথ বীরসা হাঁটবেই ।

কত আর বয়স

বড়জোর এগারো কি বারো

চাইবাসার জার্মান মিশনের ইসকুল

অতটা পথ হাঁটে হাঁটে পা ফাটে রক্ত ঝরছিল বীরসার।

ফাদার বললে, তুমি ফিরে যাও।

বীরসা বলল আমি লিখাপড়া করে বড় হব ফাদার

আর আমি ঘরকে নাই ঘুরব।

ফাদার দেখলে এত বড় আশ্চয্যি জেদ

সেই জেদের জোরে জায়গা হইয়ে গেল বীরসার

রোহানা মাইকা টেংগা ভুটকা

আর দিকু অমূল্যর সঙ্গে হোস্টেল ঘরে জায়গা পায়ে

একটার পর একটা আলোর সিঁড়ি টপকে

এগোতে লাগলেক বীরসা।

উদিকে বাইরে তখন লাগড়া বাজছে

লতুন এক উলগুলানের লাগড়া

সদদারদের মুলুক ই লড়াই এর পরে

মুন্ডারা আবার ঘরের বাইরে বেরাইছে

লতুন একটা ভগবান খুঁজতে বেরাইছে।

আমরা ছোটনাগপুরের মাটি কামড়াই পড়েছিলম

আজো তেমনি আছি পড়ে

তবু দিকরা বলছে সাহেব সরকার বলছে

না না ই মাটি তোদের লয়

ই মাটি আখন আমাদে

তুই পারতিস

তুই আমাদে লড়াইটা লড়তে পারতিস

তুই আমাদে ভগবান হতে পারতিস

সত্যি করে বল দেখনি তুই কে

তুই কে বঠিস?

আমি বীরসা

সুগানা আর করমি মুন্ডার বেটা বীরসা।

তবে আয় আর দেরী না করে

জলদি করে মিশন ছাড়ে বেরাই আয়।

কুথাকে যাব কার কাছকে যাব?

মানুষের কাছে যাবি

মানুষ তোকে খুঁজছে

শুন বীরসা

তোদের মিশনের সাহেবও যা

আর সরকারের সাহেবও তা

সাহেব সাহেব এক টোপি

সাহেব সাহেব এক টোপি।

কে বঠে?

কে বললে হে কথাগুলান?

কেউ নাই

কেউ কুথাও নাই

কে থাকবেক

হোস্টেলের ঘরে খালি দিকু ছেলাটা

ঘুমাই ঘুমাই নাক ডাকছে

তাহালে কি ইটা স্বপুন বঠে।

তখন রাত পোহানো বিহানবেলা

আঁধার কাটে কুসুম রঙা আলো ঢুকছে ঘরে

সেই আলোতে দুয়ার খুলে

ইতিহাস পড়তে লাগলেক বীরসা

ফাদার নট্রটের পড়ানো ইতিহাস,

গোটা বইটা পড়ে দেখলেক

কুথাও মানুষের কথা লেখা নাই

ছোটনাগপুরের জঙ্গল আর জমিনের কথা লেখা নাই

তার বদুলে পাতায় পাতায়

খালি বড় বড় রাজা আর বড় বড় জমিদার

সাত সমুদ্র তেরো লদীর পাড়ে

বিলাতের সব ছোট লাট আর বড় লাট,

কি আশ্চয্যি

তাহলে ইতিহাস মানে কী হে ফাদার

ইতিহাস মানে কী?

ফাদার বললে,

ইতিহাস মানে বড় মানুষের ইতিহাস

তোকে একটা কথা বলি শুন

এসব নিয়ে তুই খামোকা মাথা কেনে ঘামাস

মিশনে আইছিস লেখাপড়া শিখতে

মিশনের উপরে ভরসা রাখিস

দেখবি মিশন তোদিকে সব দিবেক

শুধু লেখাপড়া লয়

মুন্ডাদে যত জমি মুন্ডাদের যত জায়গা

সব ঘুরাই আনে দিবেক।

সে ত লড়াই ছাড়া হয়না ফাদার

আমাদের সদদাররা যেমন লড়েছিল মুলুকের লড়াই।

আবার সরদারদের কথা মুখে আনিস বীরসা

সরদাররা সরকারের সঙ্গে কেস লড়তে গেছল

কি হল আইনের কাছে উয়াদে কথা খাটলো?

শুন বীরসা তুই আমার কথা শুন

সদদাররা জোচ্চোর

সরদাররা ঠগ।

তুমি ই কি বলছ ফাদার?

তুমিই তো শিখাইছিলে

মানুষের ভিতরে কোন কালো নাই

যা আছে সব আলো

তাহালে আবার বলছ কেনে

সদদাররা জোচ্চোর সরদাররা ঠগ?

আমি যা বলছি ঠিকই বলছি

সদদাররা জোচ্চোর সদদাররা ঠগ।

তখন একঘড়িকে বীরসার যত সদদারী রক্ত

যত মুন্ডারী রক্ত

সব উলগুলান এর আগুনের মতন

জ্বলে উঠল

সিংবোঙ্গার লাগড়ার পারা পাহাড়ফাটা গলায়

গাঙ্গাই উঠলেক বীরসা

না না না ফাদার

সদদাররা লয়

সাহেবরা জোচ্চোর সাহেবরা ঠগ।

ফাদার কাঁপতে লাগল ঠকঠক করে

কাঁপতে কাঁপতে ফাদার বললে ,

অ তুই তাহালে

ভিখারীর মতন মিশনে আসে

মিশনের খাইয়ে লেখাপড়া করে

তলে তলে সদদারি করতিস

তুই তাহলে একটা বেইমান

মুন্ডারা সব বেইমান

যা বেরাই যা

আমার মিশন থাকে এখুনি বেরাই যা।

বীরসার চোখ জ্বলতে লাগল ধকধক করে

কি বললে ফাদার আমি বেইমান?

আমাদে জায়গা জমি লদী পাহাড় বন-বাদাড়

সব কাড়ে লিয়ে আমাদিকে বেইমান বলছ?

বীরসা গেল বেরাই

হোস্টেলের ছেল্যারা আল্য ছুটে

দিকু অমূল্য আল্য ছুটে

চল বীরসা ফিরে চল

ফাদারের কাছে মাপ চাইবি চল

এক ঝটকায় সবাইকে ফেলে দিয়ে বেরাই গেল বীরসা,

গেটের বাইরে আসে পা দিতেই

দূরে কোথাও পাহাড় কোলের কোন গাঁয়ের থাকে

লাগড়ার বাজনা আল্য ছুটে

উলগুলান এর লাগড়া

‘সাহেব সাহেব এক টোপি

সাহেব সাহেব এক টোপি’

ক পা যাতে না যাতেই মনে হল

ছোটনাগপুরের যত মুন্ডারী গাঁ আছে

সব গাঁয়ে গাঁয়ে বাজছে লাগড়া

শুধু গাঁয়ে লয়

তার পাথরের পারা বুকের ভিতরে বাজছে লাগড়া।

তখন আবার কে একজনা জোরে জোরে পেছু ডাকছে

বীরসা ও বীরসা

বীরসা কখনো পেছু ফেরে না

বীরসা কখনো ফিরে তাকায় না

তবু হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে আসে ছেল্যাটা

হোস্টেলের সেই দিকু ছেল্যাটা

বীরসা– ও বীরসা।

কে বঠে রে,

কে বঠিস তুই?

অমূল্য নকি?

বল কি বলছিলি বল।

এই লে এই বইটা তুই ফেলে যাচ্ছিলি।

বই?

কী বই?

ইতিহাস।

ইতিহাস?

না– না ও ইতিহাস আমার লয়।

না রে বীরসা এই ইতিহাসটা তোর

হেই দেখ বইটাতে লেখা রইছে তোর নাম।

না–না ও ইতিহাস আমার লয়,

যে ইতিহাসে বড় বড় রাজা আর

জমিদারদের কথা লেখা থাকে

যে ইতিহাসে বিলাতের রানী মহারানী

আর বড়লাটদের কথা লেখা থাকে

সে ইতিহাস মানুষের ইতিহাস লয়

সে ইতিহাস বীরসার ইতিহাস লয়,

ফাদার কে বলিস

ছোটনাগপুরের মাটি আর মানুষকে লিয়ে

ইবার লতুন একটা ইতিহাস গড়ব আমি

আমি বীরসা।

পরে পড়বো
৭২
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন