দেবব্রত সিংহ

কবিতা - কবিতা যাত্রা

দেবব্রত সিংহ

মেডিকেল কলেজের হাসপাতালের জেনারেল বেডে

আর আই সি ইউ এর কাচের ঘরে

সব মিলিয়ে টানা সাতদিন সাতরাত থাকার পরেও

শেষ রক্ষা হল না

রোগটা কিন্তু তেমন কিছু না

হাঁপের রোগ

ডাক্তারিতে যাকে বলে অ্যাজমা

ফিবছর শীত এলে যেমনটা হয় আর কি

তাই নিজে থেকে তিনি যেতে চাননি হাসপাতালে

বাড়ির লোকেরা একরকম জোর করেই দিলে ভর্তি করে

কি অদ্ভুত মানুষ

হাসপাতালের বেডে শুয়ে

এমনকি আইসিইউ এর কাচের ঘরে

অক্সিজেনের মাস্ক পরে

দিনরাত বিড়বিড় করে আওড়ে গেছেন কবিতা

ভিজিটিং আওয়ার্স এ দেখা করতে এসে

মুখ ঝামটা দিয়েছেন তাঁর সহধর্মিণী

টাউনের বিনোদিনী গার্লস এর বড়দিমণি,

“তুমি এখানেও সেই ছাইভস্ম করতে লেগেছ

ছি ছি

কোথায় একটু চুপচাপ শুয়ে থাকবে তা না

বিড়বিড় করে সমানে নেড়ে যাচ্ছ ঠোঁট”

তবু তাঁর কবিতা বলা দমেনি

তবু তাঁর কবিতা বলা থামেনি

তাই দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন বড়দিমণি

“জীবনটা তুমি এই কবিতা কবিতা করে ঘুচিয়ে দিলে

নইলে জজকোর্টের ওকালতির রোজগার কি কম

এই করেই সবাই বানিয়ে নিলে গাড়ি বাড়ি সব

সেখানে তুমি কি করলে

একটা পোকায় কাটা কালো গাউন পরে

ঠনঠনে রিকশায় চড়ে

বাড়ি থেকে কোর্ট

আর কোর্ট থেকে বাড়ি করে গেলে

যাও বা জুটতো মক্কেল

সেও তুমি চেম্বারে বসে কবিতা আওড়ে খোয়ালে

কী কাজে লাগলো তোমার কবিতা” ।

ছেলেরা সবাই মাথা হেঁট করে

হাসপাতালের করিডোরে বসে

ছেলেরা সবাই বড়দিমণির ভয়ে

সিঁটিয়ে আছে একপাশে

ছেলেরা মানে উকিলবাবুর কবিতার ছেলেরা

তারা অবশ্য এখন আর কেউ ছেলে নেই

একসময় দাদার কাছে কবিতা শুনে বড় হয়েছিল ওরা

বড়দিমণিকে তারা তখনো ভয় পেত

বড়দিমণিকে তারা এখনো ভয় পায়

তবু তাদের ইচ্ছে করছিল বলতে,

“ও বড়দি এখন আর এসব কথা না শোনাতেই পারতেন

ও বড়দি সারাজীবন তো এই কথাগুলোই

শুনিয়ে এসেছেন ।”

পরের দিন রাতভোরে

সবাই যখন ঘুমের ঘোরে

তখন তিনি চুপি চুপি পাড়ি দিলেন ঘুমের দেশে

না ফেরা সেই ঘুমের দেশে

তারপর আর কিছু না

তারপর হাসপাতাল ফেরত একজন

অতি সাধারণের শ্মশান যাত্রা

সে যেমন হয় তেমনি

একখানা সস্তার খাটিয়া

রজনীগন্ধার গোছা

ফুলের মালা

ধূপের কাঠি

তুলসী পাতা

গঙ্গা মাটি

শুকনো খই

ইত্যাদি ইত্যাদি ।

বড় রাস্তার মোড় ছাড়িয়ে অলি গলির ভিতরে

একতলা দালানবাড়ি

সানে বাঁধানো এক চিলতে উঠোন

সেখানে তুলসীথানে শোয়ানো

তাঁর মরদেহ

লোকজনের ভিড় নেই তেমন

লোক বলতে কজন আত্মীয়-স্বজন

তার সঙ্গে ওই ছেলেরা

উকিলবাবুর কবিতার ছেলেরা

তাদের কারো মুখে কোনো রা নেই

তারা জটলা পাকিয়ে একপাশে আছে দাঁড়িয়ে

অন্য কিছু না

দাদার শেষ যাত্রায় কাঁধ দেওয়ার খুব ইচ্ছে তাদের

সে ইচ্ছে থাকলে হবে কি

সামনে দাঁড়িয়ে তিনি

বড়দিমণি

কী আশ্চর্য পাষাণ মহিলা

স্বামীর মৃত্যুতে

কোনও শোক নেই

দুঃখ নেই

কান্না নেই

হা-হুতাশ নেই

কিছুই নেই।

দেখতে দেখতে সময় যাচ্ছিল গড়িয়ে

তার মাঝে কোমরে গামছা বেঁধে

হাজির হলে পাড়ার শ্মশান যাত্রীরা

সঙ্গে খোল করতাল নিয়ে কীর্তনের দল

তারা উঠোনে পা রেখে

বল হরি হরিবোল বলে

সবে যখন ধরেছে কীর্তন

তখন হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন বড়দিমণি

“থামো – থামো তোমরা

এখন আর হবে না ওসব

এখন কবিতা হবে

এই ছেলেরা বল না

তোরা চুপ দিয়ে দাঁড়িয়ে কেন

সেই কবিতাটা বল না

দাদার সেই প্রিয় কবিতাটা”।

ক মুহূর্ত মুখ দিয়ে কোনো কথা সরেনি ওদের

ক মুহূর্ত শুধু তাকিয়ে থাকা অবাক চোখে

তারপর একে একে এগিয়ে এলো ওরা

তারপর শ্মশানযাত্রায় খাটিয়া কাঁধে তোলার আগে

সবাই মিলে শুরু করলে কবিতা

দাদার প্রিয় কবিতা ।

তখন বিনোদিনী গার্লস এর বড়দিমণি

চশমার কাচ মুছে নিজের চোখে দেখলেন

দিনের আলোয়

একেবারে স্পষ্ট দেখলেন

চওড়া গোঁফের তলায় দুখানা ফ্যাকাশে ঠোঁট নড়ছে

ভারী আশ্চর্যভাবে নড়ছে

বিনোদিনী গার্লস এর বড়দিমণি

নিজের কানে শুনলেন

ছেলেদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে

গমগমে গলায় কবিতা বলছে মানুষটা —

“এতদিন যে দিনরাত্রির মালা গেঁথেছি বসে বসে

তার জন্যে অমরতার দাবি করব না তোমার দ্বারে

তোমার অযুত নিযুত বৎসর সূর্য প্রদক্ষিণের পথে

যে বিপুল নিমেষগুলি উন্মীলিত নিমীলিত হতে থাকে

তারই এক ক্ষুদ্র অংশে কোনো একটি আসনের

সত্যমূল্য যদি দিয়ে থাকি

জীবনের কোনো একটি ফলবান খণ্ডকে

যদি জয় করে থাকি পরম দুঃখে

তবে দিয়ো তোমার মাটির ফোঁটা র একটি তিলক আমার কপালে

সে চিহ্ন যাবে মিলিয়ে

যে রাত্রে সকল চিহ্ন পরম অচিনের মধ্যে যায় মিশে

হে উদাসীন পৃথিবী

আমাকে সম্পুর্ন ভোলবার আগে

তোমার নির্মম পদপ্রান্তে

আজ রেখে যাই আমার প্রণতি ।”

রেখে যাই আমার প্রণতি।

পরে পড়বো
৮৭
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন