লাল মাটির গ্রাম ছাড়িয়ে
নীল জলের নদী ছাড়িয়ে
দূরে বহু দূরে
শাল পলাশের জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ি টিলায়
দিন ফুরানো আলো
ফাগুনের আগুন দিনের আবির ছড়ানো আলো
সেই আলোয় ওরা দুজনে টিলা পাহাড়ের চূড়ায়
সাদা পাথরের চাতালে বসে
জায়গাটা নিরিবিলি
অসম্ভব নিরিবিলি
মেয়েটির পরনে লাল পাড় হলুদ শাড়ি
খোঁপায় পলাশের ফুল
ছেলেটির আদুল গায়ে মোটা কাপড়ের খাটো ধুতি
মাথায় গোলাপী পাগড়ী
হাতে একখানা বাঁশি
বাঁশের বাঁশি
মুখে উপচে পড়া খুশি
বাঁধভাঙ্গা হাসি
মেয়েটির আবদারে এইখানিক আগেও
বাহা পরবের গানের সুরে
বাঁশি বাজিয়ে শুনিয়েছে সে
তারপরে একথা সে কথার শেষে
হঠাৎ করে মেয়েটির হাত ধরে
সে বলেছে,” চল পালাই যাই
ঘর দুয়ার গাঁ গেরাম ছাড়ে
আমরা দুজন পালাই যাই।”
মেয়েটি পারেনি
ছেলেটির কথায় সায় দিতে পারেনি
তার বদলে ভারী অনুনয় করে বোঝাতে চেয়েছে,
” সে আর হয় কি করে বল
আমাকে যে মা খয়রাবুড়ির থানে
সিঁদুর পরাই দিইছে
শাঁখা পরাই দিইছে
আমি আখন যাই কুথায় বলঅ।”
তাই শুনে আর কথা বলেনি ছেলেটি
আবির রাঙানো আকাশের পানে চেয়ে
একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকেছে শুধু
মেয়েটি থামেনি
বলেছে,” বিয়ার পিড়িতে বসার আগেও
তুমাকে কত খুঁজেছি জানো
বহুত খুঁজেছি
কুথাও তোমার হদিস মিলে নাই
কেউ বললেক খাটতে গেছে পূবে
কেউ বললেক হাতি খেদানো হুলা পার্টির সঙ্গে
ঘুরতে ঘুরতে দেশ ছাড়ে চলে গেছে বিদেশে
তখন আমি আর কি করি বলঅ
মায়ের থানে শাঁখা সিঁদুর পরে
শ্বশুরঘরে ঘর করতে যাওয়া ছাড়া
আমার আর কোনো গতিক ছিল নাই
তুমার গা ছুঁয়ে বলছি
মা খয়রাবুড়ির দিব্যি।”
ছেলেটি তবুও গুম হয়ে বসে
তখন মেয়েটি তার হাতে ধরে ব্যাকুল হয়ে বললে,
” এই শুনছ ,
আমার কথা শুনছ গ তুমি”।
ছেলেটি তাও কিছু বললে না
মুখ ফিরে একটিবার তাকালেও না ।
তাই দেখে মেয়েটি আর সইতে পারলে না
ভেঙ্গে পড়লে কান্নায়
আঁচল চাপা ফুঁপিয়ে ওঠা কান্নায়।
এবার মুখ ফেরালে ছেলেটি
বললে,” কাঁদিস কেনে
তুই ইরম করে কাঁদিস কেনে
তোর কাঁদনা দেখলে আমার কত কষ্ট হয় জানিস
তুই কাঁদবি না
একদম কাঁদবি না।”
বলতে বলতে নিজের হাতে মেয়েটির
চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে
তাকে সান্ত্বনা দিয়ে সে বললে,
” মন খারাপ করবি না
একদম মন খারাপ করবি না
যেরম করে সবাই ঘরকননা করে
সেরম করে তুই ও ঘরকননা করবি।”
মেয়েটি কান্না ভেজা গলায় বললে,
” তুমার সঙ্গে ত আর দেখা হবেক নাই
তুমাকে না দেখে কিরম করে থাকব বলতে পারঅ
তুমাকে না দেখে কিরম করে বাঁচব বলতে পারঅ ।”
ছেলেটি বললে ” সবাই যেরম বাঁচে
তুই ও সেরম বাঁচবি
আর দেখার কথা বলছিস
তুই যেখানেই যা সেখানেই দেখা হবেক আমার সঙ্গে
সনঝাবেলায় রোজদিন দেখা হবেক। ”
মেয়েটি অবাক হয়ে শুধালে,
” সে আবার কিরম কথা।”
ছেলেটি বললে”,ইটাই ঠিক কথা
একবারি ঠিক কথা।”
মেয়েটির তবু ঘোর কাটল না
সে একরাশ কৌতুহল নিয়ে জানতে চাইলে,
” সত্যি বলছ ?
তুমার সঙ্গে দেখা হবেক আমার !
রোজদিন সনঝাবেলায় দেখা হবেক !”
ছেলেটি বললে,”হঁ রে রোজদিন সনঝাবেলায়
দেখা হবেক
দিন ফুরালে আঁধার নামলে
যখন তারা ফুটবেক আকাশে
তখন তুই পুবের দিকে ভালে দেখবি
মিট মিট করা তারাদের মাঝে
ঝলমল করা সনঝাতারাকে দেখবি।”
মেয়েটির সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল
তাই সে শুধালে,” পুব আকাশে সনঝাতারাকে দেখলে
কি হবেক ?”
ছেলেটি হেসে বললে,
” আমার সঙ্গে দেখা হইয়ে যাবেক
উয়াকে দেখলেই দেখা হইয়ে যাবেক আমার সঙ্গে ।”

মন্তব্য করতে ক্লিক করুন