সে ছিল এক দিন ফুরোনো
চৈত্র বেলা
সে ছিল এক চৈত্রসংক্রান্তির মেলাতলা
তখনো জ্বলেনি হ্যাজাক
তখনো জ্বলেনি বাতি
গ্রামের শেষে মাঠের মাঝে
মুঠো মুঠো আবির গোলা
শেষ সূয্যির আলোয়
গাঁ গেরামের মেলা আমোদী মানুষের মেলাতলা
সে একেবারে উপচে পড়া ভিড়ের মেলাতলা
তার মাঝে এক বাঁশিওয়ালার কাছে
বাঁশি কিনছিল ওরা দুজনে
বাঁশের বাঁশি
ওরা কেউ বাঁশি বাজিয়ে না
ওরা কেউ গান বাজিয়ে না
ওরা উঠতি বয়সের হুজুগে পড়ে
মাঝেসাঝে কখনো-সখনো ফুঁ দেয় বাঁশিতে
তবু পাগলা কিছুটা জানে
ভাদরি ঝুমুরের সঙ্গে বাঁশি বাজাতে
ভালোই জানে সে
জাগরণের ঝোঁক নেই তেমন ওসবে
একেবারেই নেই
তাই বাঁশিওয়ালার কাছে বাঁশি কেনার ফাঁকে
তার চোখ চলে গেল
চড়ক থানে নাগরদোলার ওদিকে
সেখানে তখন দাঁড়িয়েছিল একজনা
দিন ফুরনো আলো আঁধারির মাঝে
আলতা রাঙ্গা শাড়ি পরে
মেলাতলাটা আলো করে দাঁড়িয়েছিল সে
বাঁশি কিনে ওরা দুজনে হাজির হলে সেখানে
তখন চড়কথানে নাগরদোলায়
উঠে বসেছে সে
তার সঙ্গিনী টি ওদের দেখে মুখিয়ে উঠলো তেড়ে,
“না না আমাদে ইখানে জায়গা হবেক নাই তুমাদে
আমাদে ইখানে হবেক নাই”
নাগরদোলার লোকেরা বললে,
“এই খুকি ঠিক করে বস
হইয়ে যাবেক
তোদের সঙ্গে হইয়ে যাবেক”
তবু তারা চাইছিলনা শুনতে
শেষে কে কার কথা শোনে
ওরা দুজনে জোর করে বসে পড়লো সেখানে
এখন বাবুই দড়ির খাটিয়া দিয়ে বানানো
শাল কাঠের নাগরদোলায়
এক জায়গায় তারা চারজন
মুখোমুখি তারা চারজন
জাগরণের সমুখপানে সেই আলতারাঙ্গা শাড়ি
তখনো ঘুরতে শুরু করেনি নাগরদোলা
তার মাঝে তার চোখে চোখ পড়তেই
জাগরণের বুকের ভিতরে
চলতে শুরু করে দিলে রেলগাড়ি
কু ঝিক ঝিক রেলগাড়ি
ঠিক তখনই চড়কথানের লোকেরা
হাতে হাত লাগিয়ে
ঘুরিয়ে দিলে নাগরদোলা
তখন মাঠের মাঝে
চৈত্র দিনের এলোমেলো হাওয়ারা
কোথায় ছিল কে জানে
তারা দলবেঁধে ছুটে এসে উড়িয়ে দিলে
তার শাড়ির আঁচল
তারা উড়িয়ে দিলে
তার ঢেউ খেলানো এলো চুল
এলোমেলো হাওয়ার তোড়ে
আঁচল সামলে খানিক পরে
তার সঙ্গিনী সেই মেয়ের সঙ্গে
সে মেতে উঠলে খেলায়
রুমাল ফেলার খেলায়
নাগরদোলায় খেলাটা ওদের চলছিল ভালোই
শেষের দিকে ওদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল পাগলা ও
সবমিলিয়ে জমে গেছিল খুব
তারপর ঘুরতে ঘুরতে নাগরদোলা টা যখন গেল থেমে
তখন জাগরণের কী হলো কে জানে
সে হঠাৎ আলতারাঙ্গার নীল রুমালখানা
পকেটে নিলে পুরে
তারপর তাই নিয়ে কি ঝগড়া
তারপর তাই নিয়ে কি চেঁচামেচি
জাগরনের হেলদোল নেই কোনও
সে বলে উঠলে,
“এই শুন অ তুমার রুমালটা লিইছি আমি
ইটা আখন আমার কাছে থাকবেক
ইটা আখন আমার কাছে ই থাকবেক’
তাই শুনে ধো ধো করা পলাশের আগুন
এক পলকে ছড়িয়ে গেল আলতারাঙ্গার মুখে
আর তার সঙ্গিনী সেই মুখরা মেয়েটি
সে ফুঁসে উঠলে তখনই,
“মু সামলে কথা বলবি
ছোটলোক কুথাকার”
চেঁচামেচি শুনে একদল ছেলে
জামার হাতা গুটিয়ে এল ছুটে
নাগরদোলার লোকেরা তখন সামাল দিলে অবস্থাটা
“যাও যাও
কিছু হয় নাই ইখানে যাও
ইয়ারা সব আমাদে ঘরের ছেলামেইয়া”
তুমরা যাও”
তারপর আর কি
তারপর মেলা ফেরত রাঙ্গা ধুলোর পথে
পাগলার বাশির সুরে
গান ধরলে জাগরণ
“তোকে মনে লাগেছে করব বিয়া
দাড়ি কাটে লি মাইরি করব বিয়া”
ওদিকে আলতারাঙ্গার সঙ্গী মেয়েটি
বাড়ি ফিরে
সুচ কে ফাল করে
পাড়াসুদ্ধ যত লোক সবাইকে দিলে তাতিয়ে
বাদ গেল না চৌকিদার বাপ ও
সে লাঠি উঁচিয়ে গর্জে ওঠে বললে,
“একটা হাঘরা বাউন্ডুলা ছেলা
তার এত বড় আস্পর্ধা
চৌকিদারের বিটির রুমাল লিইছে কাড়ে
দাঁড়া ইয়ার একটা ইসপার ওসপার করে ছাড়ব আজ”
যার জন্য এত হুংকার
সে তখন মাটির কোঠা ঘরে দোর দিয়ে
একা একা অন্ধকারে
উপুড় হয়ে শুয়ে
রাত পাহারা দেওয়া চৌকিদার বাপ
আর তার সঙ্গে যত পাড়ার লোকজন
আর সেই মুখরা মেয়েটি
তারা কেউ জানতেই পারলে না
চৈত্র সংক্রান্তির মেলায়
চড়কথানের নাগরদোলায়
সেই নীল রুমালের সঙ্গে কখন যে
হা ঘরে বাউন্ডুলে ছেলেটার কাছে
তাদের ফুলপরী মেয়েটার
ফুলের মতন মনটাও খোয়া গেছে
সে তারা কেউ পারলে না জানতে
এমনকি জানতে পারেনি সে নিজেও
মেলাতে ওই রুমাল নিয়ে তার সঙ্গে কত রাগারাগি
কত ঝগড়াঝাঁটি
বাড়ি ফিরে আবার কেন সেই তাকেই
একটিবার
শুধু একটিবার
দেখার জন্যে
উচাটন করে মন
তা কিছুতেই ভেবে পেলে না সে
অন্ধকারে একা একা তার কথা ভাবতে ভাবতে
কখন যে চোখের পাতা গেছে ভিজে
তাও সে টের পেলে না কিছুতেই
কি বলে একে
একে কি বলে
আকাশ-পাতাল ভেবে টেবে
এক সময় মনে হল
একেই বোধ হয় ভালোবাসা বলে
বোধ হয় একেই বলে ভালোবাসা ।

মন্তব্য করতে ক্লিক করুন