দেবব্রত সিংহ

কবিতা - তাহাদের শ্রাবণগাথা

দেবব্রত সিংহ

সে এক অবিশ্রান্ত শ্রাবণ

সে এক নিশিরাতের শ্রাবণ

দু দিকে দুই গ্রামের মাঝে

ঝোপ জঙ্গলে ঘেরা পলাশের ডাঙ্গায়

তাদের মাটির কুঁড়েঘরে

তার চেহারাটাই আলাদা

একেবারে আলাদা

বাদল দিনে দিন ফুরনো আলোর পরে

কখন যে আঁধার নামে

কখন যে সন্ধ্যের পরে গড়িয়ে যায় রাত

সে টের পাওয়া যায় না এখানে

এমন বাদল রাতে রাত বাড়লেই

কেমন একটা কষ্ট হয় সারি র

দমবন্ধ করা কষ্ট

সন্ধ্যারাতে রাতের খাওয়ার পাট চুকিয়ে

কুবড়ি লম্ফ র বাতি কমিয়ে

ছেলে মেয়েদের ঘুম পাড়িয়ে

তালপাতার তালাই পেতে

একা একা ঘুমুতে যাওয়ার সময়

ঘুম আসে না

কিছুতেই আসেনা ঘুম

চোখ বুজলেই চোখের সমুখে ভেসে ওঠে মানুষটা

সেই মুখ

সেই চোখ

সেই হাসি

সেই সব

বুকের মধ্যে উঠে আসে হাহাকার

এই বৃষ্টি বাদলের রাতে সে বেড়ে যায়

আরো বেড়ে যায়।

সেদিন সারাদিনের পরে

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতেও সমানে বৃষ্টি

তুমুল বৃষ্টি

টিনের ভাঙা দরজার ফাঁক দিয়ে

ছাঁট ঢুকছে বৃষ্টির

সঙ্গে শনশন করা দমকা হাওয়া

তারা ধাক্কা দিচ্ছে দরজায়

থেকে থেকে কেমন একটা শব্দ উঠছে

দড়ি দিয়ে বাঁধা টিনের দরজা টা কেঁপে যাচ্ছে

যেন খুলে যাবে

এখনি খুলে যাবে

দেখে শুনে বিছানা ছেড়ে উঠে এলো সারি

তারপরে দরজার ফাঁকে চোখ রেখে

খানিক চুপচাপ বসে থেকে

অন্ধকার উঠানটার দিকে তাকাতে গিয়ে

এক নিমেষে কেমন যেন ওলটপালট হয়ে গেল সব ।

মানুষটা নেই কোথাও

এই জনপদে কোথাও নেই সে

পলাশডাঙ্গা ,ঘরগেরস্তি, মাঠ ঘাট, ডাঙ্গা ডহর

কোনো জায়গাতেই আর পাওয়া যাবে না তাকে

ইহজগতের কোথাও সে আর নেই ।

তবু কি জানি কি ভেবে বারে বারে মনে হতে লাগলো

এত রাত বেড়ে গেল

এখনো এলো না কেন সে

কেন এলো না এখনো।

এমনটা যে হয়নি কখনো

তা কিন্তু না

হয়েছে

বহুবার হয়েছে

দিনভর বৃষ্টি আর বৃষ্টি

আকাশ জুড়ে বাদল মেঘের নিকষ কালো অন্ধকারে

ঝমঝম করা বৃষ্টি

তার মাঝে নিভে এসেছে দিনের আলো

সন্ধ্যা গড়িয়ে নেমেছে রাত

ঘুমিয়ে পড়েছে ছেলে মেয়ে দুটো

তখনো আসেনি সে

তখনো থামেনি বৃষ্টি

জল থৈ থৈ উঠানের দিকে তাকিয়ে

ঘরের দুয়ার খুলে

অন্ধকারে দাওয়াতে একা দাঁড়িয়ে সারি

এই আসছে এই আসছে করে সময় যায় গড়িয়ে

তারপরে সে আসে একসময়

মাথায় পলিথিন এর শিট নিয়ে

জলকাদা ভেঙ্গে

বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আসে

দূর থেকে বউকে দেখে

সে সাত তাড়াতাড়ি বলে ওঠে,

“আর বলিস না

দেরি হয়ে গেল লালুর দোকানে

ওই তুরুলি আর গণা

উয়ারা ছাড়লেক নাই আমাকে

উয়াদে সঙ্গে চা খাতে যাইয়ে

দেরি হইয়ে গেল”

সারি বলতো না কিছু

দাঁড়িয়ে থাকতো চুপচাপ

তাই দেখে সে খুব নরম করে বলতো,

“তুই রাগ করেছিস সারি

ঠিক আছে লে

ইবার থাকে আর করব নাই ইরম”

বলতে বলতে ঘর ভিতরে ঢুকে যেত মানুষটা

সারি ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলতো,

“আহা-হা দাঁড়াও দাঁড়াও

তুমি করছ টা কী

ছেলাগুলান ঘুমাচ্ছে

শুকনো ঘরটা ভিজে চুবড়ি ভিজা হইয়ে যাবেক।”

বেচারী থমকে যেত দোরগোড়ায়

তার এক মাথা কোঁকড়ানো চুল বেয়ে

হাঁটু অব্দি গোটানো খাকি রঙের প্যান্ট বেয়ে

ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়তো মাটিতে

ভিজে গায়ে সে আর পারতো না থাকতে

বলতো,”আমার কাঁপুনি ধরে যাচ্ছে রে সারি

শুকনো গামছা টামছা কিছু লিয়ে আয়

আগে মাথাটা মুছি”

সারি কুবড়ি লম্ফ র বাতি উস্কে

গামছা টামছা খুঁজতো ঠিকই

কিন্তু তখুনি কিছু পেত না হাতের কাছে

বাচ্চাকাচ্চার ঘর

তারা কোথায় যে কি রাখে

তার ঠিক নেই

মানুষটার তর সইত না

বলতো,”তুই আয়

তোকে আর খুঁজতে হবেক নাই

তুই আলোটা লিয়ে আয় ইদিকে’।

অসহায় সারি লম্ফ হাতে

বর্ষণসিক্ত মানুষটির সামনে এসে দাঁড়াতো

তখন সুবোধ বালকের মতো মাথা ঝুঁকিয়ে

সে বলতো,

“লে -লে আর পারছি নাই

তোর কাপড়টা দিয়ে মুছাই দে মাথাটা”

সারি আর কি করে

মানুষটার হাল দেখে

কিছু আর পারত না ভাবতে

শাড়ির আঁচলটা দিয়ে তার মাথা দিত মুছিয়ে

সে তখন ছাড়তো না

দু হাতে জড়িয়ে ধরে

চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিত

মরদের আদরের চোটে অস্থির হয়ে উঠত সারি

ভিজে যেত সারা গা

শ্রাবন’এর ঘনঘোর বর্ষণে বাঁধভাঙ্গা বৃষ্টির মতন

ভালোবাসার প্লাবনে ভাসিয়ে দিত মানুষটা

সে এক অন্য ভালোবাসা

সে এক অন্য শ্রাবণ।

ফেলে আসা সেই সব টুকরো স্মৃতি

আজ আবার নতুন করে

এই নিশি রাতের শ্রাবণে

ভেসে উঠলো সারির মনে

রাত বেড়ে গেছে ঢের

তেড়ে আসছে বৃষ্টির ছাঁট

এমন বৃষ্টি বাদলের দিনে

কতবার কত রাতে তাকে ঘুম থেকে তুলে

কত কি কথা বলতে চাইতো মানুষটা

সারি কাঁচা ঘুমে উঠে

একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলতো,

“তুমি মাঝ রাতে ঘুম ভাঙ্গাই

ইসব কি ক্ষ্যাপামি করছ বলঅ ত’।

মানুষটা বলতো,” আঃ তুই একটুন শুন না

আমার কথা,

জানিস সারি

ইরম ঝমঝম বাদল হলে আমার কি হয় জানিস ।

সারি শুধাতো,”কী হয় তুমার “?

সে বলতো,”আমার খুউব মন ভালো হয়ে যায়,

তোর মনে আছে

পাগলার সেই ভাদরি ঝুমুরের কথা মনে আছে

সেই যে রে সেই গায়েনটা ।”

সরি জানতে চাইত,

“কোন গায়েনের কথা বলছ তুমি “?

সে কোনো কথা বলত না

তার চোখে-মুখে উপছে পড়ত খুশি

কুঁড়েঘরের মাটির কুলুঙ্গিতে জ্বলতে থাকা

টিম টিম করা লম্ফ র আলোয়

তা দেখতে পেত না সারি

অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে আবার শুধাতো,

“কোন গায়েনের কথা বলছ বল না গো ।”

মানুষটা তখন অবিশ্রান্ত শ্রাবণের নিশি রাতে

অন্ধকার উঠান টার দিকে তাকিয়ে

নিজেকে উজাড় করে দিয়ে গাইত,

“আষাঢ় অ শাবন অ মাসে

কি বারি বরিষিছে হে

কি বারি বরিষিছে

এত রাত কীসে বধুঁ

এত রাত কীসে — – – -”

কবে কোন বৃষ্টি বাদলের রাতে

সে প্রথম গেয়েছিল এই গান

সে আর মনে পড়ে না

গানটা নিয়ে কোনোদিন কোনোসময়ে

ভাবতেও বসেনি সারি

এমন করে কোনদিন ভাবেনি

আজ মন উচাটন করা এই নিশিরাতের শ্রাবণে

সেই গান যে এভাবে আবার আসবে ফিরে

সে ভাববে কেমন করে

এখন শুধু মনে হয়

একটা কথাই ঘুরেফিরে মনে হয়

কেন অমন করে গাইত গানটা

গানের ওই শেষ কলি টা

কেন অমন করে গাইত সে

আহা তখন কেন শুধনো হয়নি তাকে

কেন জানতে চাওয়া হয়নি তখন,

“এমন হা হুতাশ করে তুমি গাইছ কেন গানটা

এত কষ্ট নিয়ে কেন গাইছ তুমি

বলো না গো

তুমার এত কষ্ট কিসের

বলো না

আমি তো আছি তুমার সঙ্গে

তুমি আমায় বলো না গো।”

শ্রাবণের অবিশ্রান্ত বর্ষণের এই মধ্যরাত্রে

সে কথা ভাবতে ভাবতে

কখন যে ভালোবাসার মানুষের সেই গান

সারি নিজেই তার কণ্ঠে নিয়েছে তুলে

কখন যে শ্রান্তিহীন শ্রাবণের অঝোর ধারার সঙ্গে

তার ব্যাকুল বিরহের অশ্রুধারা

গানের সুরে মিলেমিশে গেছে একাকার হয়ে

তা সে টের পেলে না কিছুই।

তখন নিশুতি রাতের বাদল হাওয়ারা

তখন অবাধ্য সব বৃষ্টিকণারা

মাটির কুঁড়েঘরের সেই শ্রাবণ গাথা

মাটির কুঁড়েঘরের সেই বিরহগাথা

ছড়িয়ে দিলে সমগ্র চরাচরে

ছড়িয়ে দিলে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে

“এত রাত কীসে বঁধু

এত রাত কীসে

তুমার পা ধুয়াব নয়ন জলে

গা মুছাব কেশে

লাল শালুকের ফুল ফোটে আঁধার রাতে

যার সঙ্গে যার মনের মেল

সে মরিলে কি টুটে

ও বঁধু সে মরিলে কি টুটে।”

পরে পড়বো
৪২
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন