ছেলেটার বয়স তখনও চব্বিশ পেরিয়ে পঁচিশ হয়নি

পরাধীন দেশের জেলখানায়

এক নিঃসঙ্গ জেল কুঠুরিতে

বিনা বিচারে আটক থাকার সময়

অসুস্থ অবস্থায়

খাবারে বিষ মিশিয়ে

মেরে ফেলা হয় তাকে

তার অপরাধ

সে ছোটনাগপুরের আদিবাসী মুলুকে

ব্রিটিশ রাজের অবসান ঘটিয়ে

প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল স্বাধীন মুন্ডা রাজ

তার অপরাধ

মাত্র কুড়ি বছর বয়সে সে স্বপ্ন দেখেছিল

এক সর্বাত্মক গণ বিদ্রোহ উলগুলানের

তার অপরাধ

মাত্র কুড়ি বছর বয়সে সে মুন্ডাদের গ্রামে-গঞ্জে

আওয়াজ তুলেছিল,

“সাহেব সাহেব এক টোপি”।

তারপর একদিন এক নিশুতি রাতের অন্ধকারে

এক বিশাল পুলিশবাহিনী

তাকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে গেল জেলখানায়

তখন সে সবে ঊনিশ পেরিয়ে পা দিয়েছে কুড়িতে

তবু একতরফা বিচারে তার কপালে জুটল

দু বছরের সশ্রম কারাদণ্ড

সেসব কাটিয়ে যেদিন জেলখানা থেকে

বেরিয়ে এলো সে

সেদিন ডাক দিলে উলগুলানের

সেদিন ডাকদিলে স্বাধীন মুন্ডা রাজ প্রতিষ্ঠার

সেই ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এলো

হাজারে হাজারে মানুষ

ছোটনাগপুরের গা গেরামের আদিবাসী মানুষ

জ্বলে উঠলো আগুন

উলগুলানের আগুন

সেই আগুন নেভাতে মিলিটারিদের সঙ্গে নিয়ে

ছুটে এলেন ডেপুটি কমিশনার স্ট্রীটফিল্ড সাহেব

শুরু হয়ে গেল বিট এন্ড সার্চ অপারেশন

মুন্ডাদের ঘর দুয়ার তছনছ করে

শস্যক্ষেত্রে আগুন লাগিয়ে দিয়ে

খোঁজ চলল তার

শেষমেষ সেনেত্রার দুর্গম জঙ্গলে

পাহাড়ের চূড়ায় গোপন ডেরায়

অতর্কিতে হানা দিয়ে

ধরে ফেলা হলো তাকে

তবু সে ভয় পেলোনা এতোটুকু

মিলিটারিদের সামনে বুক চিতিয়ে নির্ভীক কন্ঠে

তার অনুগামীদের শেষ আদেশ দিয়ে সে বললে,

“তোরা ভাঙে পড়িস না

তোরা কাউকে ডর করিস না

আমি তোদের মাথা উচাই বাঁচতে শিখাইছি

তোরা সেই লড়াই ছাড়বি না

ছোটনাগপুরের জল জঙ্গল আর জমিনের

লড়াই ছাড়বি না ।”

তারপর তাকে হাতে পায়ে শিকল বেঁধে

জেলখানার একলা এক নিঃসঙ্গ ঘরে

ফেলে রাখা হলো বন্দি করে

সাক্ষ্য প্রমাণ জোগাড় হয়নি বলে অজুহাত দেখিয়ে

পিছিয়ে দেওয়া হল তার বিচার

তবু স্বপ্ন দেখা ছাড়েনি সে

ওইটুকু এক ছোট একখানা ঘরে

একা একা শিকল টেনে হেঁটে বেড়ানোর সময়

স্বাধীন মুন্ডা রাজ এর স্বপ্ন দেখা ছাড়েনি সে

একদিন আর শোনা গেল না শিকলের শব্দ

দিনটা ছিল ঊনিশশো খ্রিস্টাব্দের ৯ই জুন

সেদিন তার নিথর দেহ থেকে শিকল খুলে ফেলে

অত্যাচারী ব্রিটিশ সরকার চুপি চুপি জেলের ভিতরে

কাউকে কিছু না জানিয়ে

পুড়িয়ে ফেললে তার মৃতদেহ

তবু যে কিভাবে জানাজানি হয়ে গেল সব কে জানে

তখন একদিকে জেলখানার ভিতরে

উলগুলানের আগুন নিভিয়ে

ব্রিটিশ রাজের অনুগত সিপাহিদের উল্লাস

অন্যদিকে জেলখানার বাইরে

তামাম ছোটনাগপুরের উচ্চকিত সিংহনাদ

“উলগুলানের মরণ নাই

ধরতি আবার মরণ নাই

ভগবান বীরসার মরণ নাই ।”

১৫
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন