ভুতু এসে একটু খুনসুটি করে গেলো। ” কিরে কি ব্যাপার চুলে কলপ করছিস যে, হঠাৎ হঠাৎ বেড়িয়ে যাচ্ছিস, গায়ে পারফিউম লাগাচ্ছি, কোথাও প্রেম টেম করছিস নাকি?? আমাকে বলল, আমি কথা বলি,,”
আমি বললাম ” বিয়ে হয়ে গেছে তো কি হয়েছে কান মুলে দেবো, দাদার সাথে ইরাকি মারা বেরিয়ে যাবে।”
ভুতু বললো ” আমি কি করবো। টোটন তো মাকে গিয়ে নালিস করলো। দেখো দিদা মামু কলপ করছে, আবার।”
সত্যি আমার কলপ লাগানোর মতো চুল পাকে নি। টোটন আমার ভাগ্না। আমার মাথায় দুই একটা পাকা চুল থাকলে সুবিধা হয়। ও নালিশ করছে কারণ ওর পাকা চুল তোলার চাকুরীটা চলে যাবে যে। ও আমার পাকা চুল তোলার বদলে চকলেট খাওয়ার পয়সা নেয়।
মাত্র দুই বছর আগে ভুতু আমাকে জোর করে কলপ লাগনো চেষ্টা করছিল। সেইদিন তৃণা সাথে আমার দেখা করা কথা ছিলো। ঢিল ছোড়া দূরত্ব তৃণার বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে। কিন্তু ওর মামা ঘটকালি করেছিলেন আমাদের বিদেশে বসে। বিয়ের সব কিছু ঠিক ছিলো। তবু আমি দেখা করতে চেয়েছিলাম তৃণার সাথে একটু একা।তৃণার সাথে দেখা হাওয়া প্রথম দিনটার কথা যদিও আমি আজো ভুলতে পারিনি। তবে তৃণার সেইদিন কোন দোষ ছিলো না আজো নেই।
সেইদিন উৎসাহ নিয়ে, টাইমের আধঘন্টা আগেই চলে গিয়েছিলাম রেস্টুরেন্টে। জীবনের প্রথম কোন মেয়ের সাথে ডেটিং বলে কথা।গিয়ে দেখি তৃণা দেবী তাঁর বন্ধু সাথে কথা বলতে ব্যাস্ত। আমাকে উনি চেনেন না। তাই ওনাদের পিছনে বসে ওনাদের আলোচনা শুনতে মন চাইলো। যদিও এ বয়সে তৃণা দেবী মতো সুন্দরী পাত্রীকে বিয়ে করতে চাই যেকোন মূল্যে । তবু কথপকথন শুনে কিছুটা চরিত্রের বিশ্লেষণ করে দেখে নিতে চাইছিলো মন উনি সত্যি আমার জন্য সেরা পাত্রী কিনা।
ঠান্ডা পানীয়তে চুমুক দিয়ে তৃণা দেবীর বান্ধবী বললো ” সরকারী চাকরী পেলে আর প্রবাসী হলেই হলো, কোচি সুন্দরী বৌ লাগবে বুড়ো গুলোর। রকি মতো ছেলে ছেড়ে তুই অচেনা অজানা একটা মানুষকে বিয়ে করবি। তাছাড়া তোর মামার বন্ধু মানে, মাই গড, নিগাধ কোন টেকো বুড়ো হবে। তুই রাজী হলি কি ভাবে।”
তৃণা দেবী বললো” সঙ্গীতা। প্লিজ রকি নাম উচ্চারণ করিস না আমার সামনে। ওর কথা আর বলিস না। ওর জন্য আমি বিয়েটা করতে বাধ্য হবো। একে ও ওর ধর্মীয় পরিচয় গোপন করেছে। তার ওপর এখন ভুল ভাল প্রস্তাব দিচ্ছে। ওকে আমার সহ্য হচ্ছে না।”
সঙ্গীতা দেবী বলেন ” কেন কি বলছে? ”
তৃণা বললো ” ও বলছে বিয়েটা করে নাও । জাহাজে চাকুরী করে। এক মাসের পর চলে যাবে। আবার নয় মাস পর আসবে। আমি তার মধ্যে একটা কিছু ব্যবস্থা করে নেবো। তখন ডিভোর্স দিয়ে চলে আসবে আমার কাছে। ক্ষতি পূরণ হিসাবে কিছু টাকা পয়সাও চলে আসবে আমাদের হাতে। আচ্ছা একথা বিয়েটা কি ছেলে খেলা।”
সঙ্গীতা দেবী বললেন ” রকি চাকুরী নেই , তাই ও সব ভুল ভাল বলছে। কিন্তু তাবলে তুই তোর মামার বন্ধু , কোন ভুড়ি ওয়ালা রাঁধুনিকে বিয়ে করবি। তোর স্টেটাস কোথায় চলে যাবে ভেবে দেখেছিস?”
তৃণা দেবী বলেন ” কিন্তু আমি নিরুপায়। NRI পাত্র বলেই আরো সবাই চাপ দিচ্ছে।”
সঙ্গীতা দেবী বললেন” NRI হোক আর যাই হোক ভেবেদেখ মফস্বল মাল কিন্তু জীবনটা হেল হয়ে যাবে। অশিক্ষিতের মানুষের সাথে ঘর করবি কি করে??”
নিজের সম্পর্কে অচেনা মানুষেদের আলোচনা শুনে খারাপ লাগছিলো। আমি হঠাৎ করে ওনাদের আলোচনা মধ্যে ঢুকে পড়লাম। বললাম ” আমি কি এখানে বসতে পারি?”.
সঙ্গীতা দেবী একটু বিব্রত হয়ে বললেন। ” চিনি না জানি না বসতে পারি বলছেন মানে!”
আমি বললাম ” চেনে না জানেন না, এমন মানুষের সম্পর্কে কথা বলতে তো কোন অসুবিধা হয়নি। আমি সেই মফস্বল, ভুড়ি ওয়ালা, বুড়ো, রাঁধুনি যাকে বিয়ে করলে আপনার বান্ধবীর লাইক হেল হয়ে যাবে ।”
সঙ্গীতা দেবী বললেন” sorry.. কিন্তু আপনি তো অনেক ইং আর সুন্দর,”
আমি বললাম” রাঁধুনি হলেই অশিক্ষিত , আর ভুড়ি হতে হবে এ কথা কে বলছে?? রাঁধুনি পেশাটা আপনার কাছে ছোট্ট কাজ মনে হলেও লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে অনেক মানুষ একজন ভালো রাঁধুনী হয়। আপনি সৌন্দর্য আপনার বয়স ধরে রাখতে পারে একজন পেশাদার রাঁধুনি।”
তৃণা দেবী বললেন” আসলে আমার মামার বন্ধু তাই আমরা ভেবেছিলাম আপনি অনেক বেশি বয়স্ক হবেন বোধহয়।”
আমি বললাম” আপনি তো সাহিত্য নিয়ে এম করছেন। রবীন্দ্রনাথের কাবুলি ওয়ালা পড়েন নি। বন্ধুত্বের কোন বয়স হয় না। উনি আমাকে স্নেহ করেন। সেই জন্য হয়তো নিজের ভাগ্নির সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন আমার সাথে।’
সঙ্গীতা দেবী বললেন ” না না। আসলে জেনারেশন গ্যাপের কথা ভেবেই আমি আসলে বলছিলাম। ”
আমি বললাম ” আপনারা মেয়েরা সবসময় সফল ছেলেকেই বিয়ে করতে চান। অথচো বয়স্ক হলে আপত্তি। আমি মাস্টার শেষ করার আগে থেকেই সরকারি চাকুরী পরীক্ষা দিতাম। এম পরীক্ষা পাশ করে আর দুই তিন বছর চেষ্টা করে, দেখলাম চাকুরী পাওয়ার সম্ভাবনা কম তখন বিদেশে পাড়ি দিলাম। সেটেল হতে একটু সময় লাগবেই। সরকারি চাকুরী পাওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকলেও বয়স বাড়তো। কিন্তু আমি রকি মতো বেকার থাকলে আপনি কি আমাকে বিয়ে করতে চাইতেন?? আপনারা নিরাপত্তা চান, কিন্তু সফলতা পেতে একটু সময় লাগে। আমাদের বাবা মায়েদের বয়স পার্থক্য তো অনেক তাঁরা কি সুখী নয়। আর মফস্বল মাল বলে কি আমাদের সখ আল্লদ নেই।”
সঙ্গীতা দেবী বললেন” sorry.. আপনাকে না দেখে কথা বলেছি বলে। সত্যি আপনি সুন্দর দেখতে, আপানার দেখে যে কেউ প্রেমে পড়ে যাবে।”
আমি বললাম ” দেখুন আপনার বন্ধুকে আমি বিয়ে করতে চাই কিন্তু সেটা রূপ দেখে নয়, আজকাল মেকআপ করে সবাই সুন্দর দেখতে হয়ে যেতে পারেন। আমি ওনার গান শুনেছি। লেখা পড়েছি। গুনকে ভালোবাসুন রূপকে নয়। রূপতো দুই দিনের। যাইহোক নিরূপায় আমাকে বিয়ে করতে হবে না। মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান, কলেজ জীবনে ক্যারিয়ার তৈরি করতে গিয়ে , প্রেম করা হয়নি। বিয়ে পরে ভালোবাসা হীন জীবন চাই না আমি।”
সেইদিন তৃণা দেবী ছেড়ে চলে এসেছিলাম । কিন্তু ঠিক একবছর পর পর ঐ রেস্টুরেন্ট যে সপিং মলে ছিলো , সেই সপিং মলে ওনার সাথে আবার আমার দেখা হয়ে গেলো।
আমি সাধারণত নিজের জন্য কিছু কিনি না। তাছাড়া সপিং মলে থেকে জিনিস কেনার অভ্যাস নেই। কারণ একটা রাজনৈতিক আদর্শকে ছোটবেলা থেকেই সমর্থন করি। মল সংস্কৃতি আসলে বৃহৎ পুঁজির জয়। ছোট ছোট ব্যবসা গুলো হারিয়ে যাবে একদিন তারপর প্রতিষ্ঠিত হবে একচেটিয়া ব্যবসা এই সব মল গুলোর, শোষণ করবে সাধারণ মানুষকে। উপভক্তার কখনো আর উদ্যোগতা হতে পারবে না।
এখানে এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।নিজের অজান্তেই একটা সাদা টি সার্টের হাত পেয়ে গেছিলো । কিছু একটা ভাবতে ভাবতে ওটা নাড়াচাড়া করছিলো। হঠাৎ সম্বিত ফিরল তৃনা দেবীর গলা। উনি বললেন ” ওটা নিয়ে নেন , আপনাকে ভালো মানবে। যদিও টি সার্ট বোধহয় আপনি পরেন না। নয়তো ইন্টারভিউ পোশাক পরে কেউ পাত্রী দেখতে আসে।” কথা শেষ করেই হাসতে লাগলেন।
উনার হাসিটা খুব সুন্দর। পাহাড়ের ঝর্না মতো। আরো দুই চারটো কথা সৌজন্য মুলক। উনি এই মলে সেলস গার্ল। তাই ছুটি পর কফি পান প্রস্তাব দিলো উনি নিজেই। আমি প্রস্তাব দিলাম ফুটপাত চা আর ফুচকা খাওয়ার। রাজী হয়ে গেল। এক দিন দু দিন দেখা তারপর ” আপনি থেকে তুমি হয়ে আমাদের সম্পর্কটা।
রকির প্রসঙ্গটা এরিয়ে গেছিলো বার বার তৃণা। কিন্তু সম্পর্কটা যখন একটা ভরসার জায়গায় আসতেই তৃণা বললো” রকি বাঙালি নয়। বাঙালি সংস্কৃতিতে ধর্মের ভাদাভাদ আমরা কোনদিন বুঝিনি। বিয়ের পর ও ওর বাড়িতে নিয়ে গেলো। কাফের মেয়েকে বিয়ে করছে তাই একটা উৎসবের আমেজ ছিলো প্রথম মাসটা। সমাজ মাথা থেকে একটা মোটা টাকা পেলো , ও ব্যবসা শুরু করলো কলকাতায় ফিরে। বৌ হিসাবে পুরোনো হতেই কদর কমলো আমার, ঘরে কাজ ভুল হলেই , ওর বাড়ির লোকজন মারধর করতো। আর ওর , ভাই, দাদা, বাবা, সান্ত্বনা দিতে এসে চেষ্টা করতো শীলতাহানীর। আমি সবকিছু বলতাম ওকে ও পাত্তা দিতো না। আসতে আসতে সব কিছু মেনে নিতে শুরু করলাম। শারীরিক নির্যাতন মনে নেওয়া যায় কিন্তু অন্যপুরুষের ছোঁয় মনতো ঘৃণা ভরে যায়। তবু অপেক্ষা করতে লাগলাম রকির ফেরার। ও ফিরলো কিন্তু সেটা আমার কাছে আরো কষ্টকর। ও সঙ্গীতাকে বিয়ে করে আনলো। সঙ্গীতাও অসহায় হয়েই ওকে বিয়ে করেছে। কারণ ও তখন পাঁচ মাসের গর্ভবতী। বলো ঐ সম্পর্ক টাতে আর থাকা যায়? জানো বারবার মনে হচ্ছিল তখন তোকে কষ্ট দিয়েছি বলেই আমার আজ এই হাল।”
ওর চোখ ভরা জল। আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম “তোমার কোন দোষ নেই। সব নিয়তি খেলা। চলো আবার আমরা বিয়ে করে নিই। ”
তৃনা আমাকে জড়িয়ে ধরলো আসতে আসতে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো” ভিড় রাস্তায়, হাত ধরতে সাহস পাও না। কিন্তু কিন্তু করো , আজ যে জরিয়ে ধরলে? কি ব্যাপার সত্যি সত্যি প্রেমে পড়লে নাকি?”
আমি বললাম” প্রথম দিন থেকেই প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। তুমি টের পাও নি।”
তৃনা আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো বললো” জানি তাইতো শুধু তোমার কাছে এসেছি।”
আমি বললাম ” চল বিয়ে করে নিই ”
তৃনা বললো” আর একটু সময় এরকম থাকি না। বিয়েটাই কি সব??”
প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে আমি পারলাম না। সত্যি বিয়েটা কি?? একটা সম্পর্ক সামাজিক স্বীকৃতি । একটা মেয়ে সামাজিক নিরাপত্তা জন্য বিয়ে করে একটা পুরুষকে। পুরুষের প্রয়োজনে একটা নিরাপত্তা একটা সম্পর্কের। একটা সম্পর্ক যা তাঁর শারীরিক ও মানসিক খিদা মেটাতে পারে। এক কথায় সাতপাকে বন্ধন একটা মেয়েকে ধর্ষণ করার অধিকার দেয় আপনাকে , ভাত কাপড়ের দায়িত্বের বিনিময়ে। কিন্তু আধুনিক সমাজে মেয়েরা স্বনির্ভর তাই বিয়ে সম্পর্কটা আগের শর্ত গুলো অচল।
তাই ছয় মাস পর আজ তৃণা বলছে ওদের বাড়ি যেতে ওর সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। আমি তাই আজ কলপ লাগালাম বয়স লুকাতে। এর মধ্যে মা এসে গেছে পিছনে। মা জিজ্ঞেস করলো
” আমার কোন কথার অবাধ্য হও না আজ হলে যে। চুল কলপ লাগনো খারপ বলেছি না। সব চুল তো এখন সাদা হয়ে যাবে…”
আমি মায়ের পায়ে প্রনাম ঢুকে বললাম” sorry তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি আজ তৃণার বাড়িতে যাচ্ছি ওর বাবার সাথে কথা বলতে আমাদের বিয়ের ব্যাপারে।”
তৃণা নামটা শুনে মা চমকে উঠলো চিৎকার করে বললো” ভুতে এ দিকে আয় মা। আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে, তোর দাদা কি বলছে দেখ।”
মা মাটি বসে পড়লো। ভুতে ছুটে এসে জিজ্ঞেস করলো” কি হয়েছে তোমার?”
মা বললো ” তোর দাদা কি বলছে শোন। তৃণা নাকি ওকে বিয়ে করবে??”
ভুতে আমাকে বললো “তুই কি বলছিস ! তৃণা ”
আমি বললাম ” হুঁ। কাল বিকালে দেখা করতে এসে ও তো বললো , আজ ওদের বাড়ি গিয়ে কথা বললে।”
ভুতে বলল ” তুই জানিস আজ ওদের বাড়িতে কি আছে ??”
আমি বললাম” না ”
ভুতে বলল” আজ তৃণা মৃত্যু বার্ষিকী। আজ থেকে এক বছর আগে ও আত্মহত্যা করেছিল। ”
আমি ছুটে গেলাম ওর বাড়ি। রজনীগন্ধার মালার মাঝখানে থেকে ও হাসছে। হঠাৎ কানের কাছে এসে তৃণা বললো ” ইশ্ কলপ লাগনোটা বৃথা হয়ে গেলো!!”
কলপ গল্পটা ভালো লাগলো। তবে লেখক কে অনুরোধ লেখার সময় বানান আর শব্দ গঠনের দিকে নজর দিন।
ধন্যবাদ। চেষ্টা করবো