আজকে দিনটা সকাল থেকেই খারাপ তিথীর।বেয়াদপ ছেলেটা কথা মনে পড়তেই ও যেনো তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো।শহরে মামা বাড়ির আদরেই মানুষ হয়েছে তিথি। গ্রামের বাড়িটাকে খুব মিস করে ও। বছর একবার করে আসতো ও আগে দেশের বাড়ি , দূর্গাপূজা পূজার সময় তাও ছয় সাত বছর আসা হয় না। হুঁ মাধ্যমিক এর পর থেকেই আসে না ও।মাধ্যমিক পড়ার চাপ। উচ্চ মাধ্যমিক ভালো রেজাল্ট আর প্রবেশিকা পরীক্ষা জন্য নিজেকে তৈরি করতে গিয়ে আসতে পারেনি।উচ্চ মাধ্যমিক পর চার বছর পড়াশোনা করতে হলো রাজের বাইরে। কারণ এ রাজ্যে পড়াশোনা করে কোন ভবিষ্যতে নেই। তাই কোলকাতা ফিরেই ও ছুঁটে এলো ওর ঠাম্মির কাছে। এখন বর্ষা কাল, মাঠ ঘাট জল ভরাট, গ্রাম বাংলার থাকার মজাই আলাদা। সবাই নিষেধ অমান্য করে, ও ওর মামাতো ভাই রাতুল কে নিয়ে চলে এলো গ্রামের বাড়ি।
গ্রামে ঢুকতেই বেয়াদপ ছেলেটার সাথে দেখা। তিথির তেমন কোন দোষ ছিলো না। গ্রাম ঢুকতেই ও ওর ডাইভার রামুকে বললো ও গাড়ি চালাবে। মালিক ভাইঝির আবদার সে অমান্য করে কি করে? চালাতে দিলো। রাস্তাটা খারাপ ছিলো ও একটু বেপরোয়া গাড়ি চালাচ্ছিলো। তাই পথে একটা ছোট দূর্ঘটনা হলো। একটা সাইকেলের সাথে অক্সিডেন্ট। প্রথমে গালিগালাজ করতে শুরু করলেও। দরজা খুলে রামু কাকা বেড়াতেই সাইলেন্ট মুড নিয়ে নিলো। যতই হোক ওর কাকা এ অঞ্চলের পঞ্চায়েত প্রধান। কিন্তু কোথা থেকে ঐ
বেয়াদপ ছেলেটা লোকটার হয়ে উকালতি করে লোকজন জরো করে পাঁচ শত টাকা জরিমানা আদায় করলো।পাঁচ শত টাকা বড় কথা নয় তিথীর কাজ। ওর সবার সামনে দোষী সাব্যস্ত হওয়াটাই খারাপ লেগেছে। তাছাড়া বেয়াদপ ছেলেটার নাম নালিশ করার পর ওর চাচুও কোন স্টেপ নিলো না। শহরের জন্য বেড়িয়ে গেল রামু কাকা নিয়ে।
বেয়াদপ ঐ বেয়াদপ ছেলেটা সাথে তর্ক বিতর্ক করতে গিয়ে ও আর রাতুল জলে ভিজলো। অবশ্য দুপুরে পুকুরে অনেকক্ষন চান করলো এখন জ্বর বাঁধিয়ে বসেছে। চাচু আর রামু শহরের গেছে রাত হয়ে গেছে। এ গ্রামে ডাক্তার নাই কি করবে বুঝতে পারছে না। এমন সময় মালতি খেতে ডাকতে এলো ওদের। ও জানালো রাতুল বেশ জ্বর সন্ধ্যা থেকেই ভুল বকছে। সব মালতি তারাতারি ঠাম্মি খবর দিলো।
তিথি ওর ঠাম্মিকে খবরটা দিতে চাই ছিলো না বুড়ি মানুষ কোনো চিন্তা করবে। বাড়িতে কেউ নেই যে কোথাও থেকে ডাক্তার নিয়ে আসবে। ঠাম্মি খালি খালি চিন্তা করবে। ঠাম্মি রাতুলের গা পরীক্ষা করে। নিশ্চিত একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো। যাতো মালতি ছোট্টকে একবার ডেকে নিয়ে আয়।
ছোট্ট নামে কোন ডাক্তার হতে পারে নাকি? ছোট্ট সাধারণত চায়ের দোকানে বা হোটেলে কাজ করা ছেলে হয়। সত্যি একটা চায়ের দোকানের সামনে এসে থামতে বললো মালতি। চায়ের দোকানে আড্ডা চলছে তখন। চায়ের দোকানটা চেনা তিথির। ওর মালিক শম্ভু কাকা। বাদই গান শিল্পী।
ও বোধাহয় বাদাই গানের আসর বসিয়েছে।
বাদাই গান সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রথমেই বলতে হয় ‘বাদাই‘ শব্দটি এসেছে বিবরণ বা বাদ–বিতণ্ডা থেকে, ব্যুৎপত্তিগত অর্থ [বি+ষ(সৎ)। আসলে বাদাই গানের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে শ্রীকৃষ্ণের জন্মকাহিনী এবং মহাভারত থেকে বিভিন্ন কটূ প্রশ্ন এক পক্ষ গানের মাধ্যমে অন্যপক্ষকে পেশ করে। অন্যপক্ষ সেই প্রশ্নের জবাব দিয়ে আবার নতুন প্রশ্ন করে। এভাবেই লড়াই চলতে থাকে যতক্ষণ না এক পক্ষ হার স্বীকার করছে।
প্রাচীন লোকগানগুলির মধ্যে বাদাই গান অন্যতম। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম কাহিনী নিয়ে বাদাই গান রচিত হত শুরুতে । এই গানের আসর বসত মূলত গ্রামের নাট মন্দিরে, বারোয়ারি তলায় বা কোনও অভিজাত গৃহস্থের বাড়ির উঠনে। আবার বিভিন্ন সাজে সজ্জিত হয়ে অভিনয় করে গান গেয়ে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়াতো শিল্পীরা। সাথে বাদ্যযন্ত্র হিসাবে থাকতো ঢোল, কাঁসি, বাঁশি, বাঁশরী, খঞ্জনি, নুপূর প্রভৃতি। কীর্তনের সুরে বাদাই গান গাওয়া হলেও পরবর্তী সময়ে টপ্পা, ঝুমুর, গাজনের সুরেও গান গাইতে শুরু করেন শিল্পীরা। সময়ের সাথে সাথে বাদাই গানের ভাষা ও সুরে আধুনিকতার ছোঁওয়া লেগেছিল। তাই গানের উপস্থাপনা এক থাকলেও ভাষায় ধর্মীয় কাহিনীর পাশাপাশি জায়গা নিয়েছিল লোকশিক্ষা, সমাজচিত্র। বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এই বাদাই গান।
যাইহোক তিথীকে একটু অবাক করে। ” বাবা তুমি তাহলে , দোকান সামলাও একটু চৌধুরী বাড়ি থেকে ডাক এসেছে। রুগী এসেছে বলে বেরিয়ে এলো বেয়াদপ ছেলেটাই। পথে মালতি এই বেয়াদপ ছেলেটার গুন কীর্তণ করতে করতে এলো। মুম্বাই দিল্লির মতো বড় বড় শহরে বড়ো হাসপাতালের থেকে ডাক পেয়ে এই ছেলেটা নাকি গ্রাম পড়ে আছে ডাক্তার হিসেবে, শুধু মাত্র ছোট বেলায় পাশের বাড়ির মেয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে দেখে।
বেয়াদপ ছেলেটার একটা ভালো লাগা তরি হয়ে গেল গোপনে তিথীর । বেয়াদপ ছেলেটার ভালো নাম জানতে মনে পরে গেলো এই ছেলেটা কথা ও সোস্যাল মিডিয়া পড়েছে পাঁচটার ডাক্তার নামে প্রতিবেদনে। ও পোস্ট লাইক সেয়ার করছে। কিন্তু সামনে সামনি দেখে চিনতে পারলো না। সবচেয়ে বড় কথা, বছর দশেক আগে এই ছেলেটার দাদার কাছে, ও আর এই বেয়াদপ ছেলেটা, মানে ছোট্ট সাইকেল শিখেছিলো। আজো সেই সাইকেলর পিছনে ডাক্তারি ব্যাগ টা প্লাস্টিক মুড়ে ডাক্তার সাহেব চলেন ওদের সাথে।
বেয়াদপ ছেলেটা আসতেই ঠাম্মি কি খুশি। কথায় কথায় বললো।” তোর দাদা ডাক্তার হয়ে ও গায়ে ও গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, শহরে কলেজে কলেজে লেকচার দিয়ে বাড়াচ্ছে গায় কথা তার মনে পড়ে না। তুই আছিস বলে তবু রক্ষা। গ্রামে মানুষ গুলো আর শহরে ছুটে হয় না।”
বেয়াদপ ছেলেটা ওর ঠাম্মিকে জরিয়ে ধরে বললো ” সেক্সী তোমাকে ছেড়ে আমি কোথায় যাবো। আর কতবার বলেছি দাদা ডাক্তার না ডক্টরেট। ও গ্রামে গঞ্জে ঘুরে ঘুরে আমাদের হারিয়ে যেতে বসা গ্রাম গান , পালা গান ,নাচ নিয়ে লেখালেখি করছে। দেখো বাবার বাদাই গান এখন কেউ তেমন শোনে। ও চেষ্টা করছে যাতে মানুষ জন বাদাই গান, পুতুল নাচ, পালাগান, মনসা গান শোনে। আমি যেমন মানুষের অসুখ সারাছি, ও আমাদের সংস্কৃতির অসুখ ছাড়াছে।”
ছোট বেলায় ওর ঠাম্মিকে জরিয়ে ধরতো। তখন তিথি খুব ঝগড়া কতো।বেয়াদপ ছেলেটা ওপর আগের মতো রাগ ওঠলো না আজ। রোগা পটকা ছেলেটা আজ সুপুরুষ। প্রথমে চিনতেই পারিনি ও বেয়াদপ ছেলেটা। কিন্তু মনের গোপন এখন একটা ভালো লাগা আছে ওর জন্য।
রাতুলের জন্য সারারাত বাড়ি গেলো না বেয়াদপ ছেলেটা, সুস্থ হবার পর বাড়ি গেলো । তিথির বেয়াদপ ছেলেটার প্রতি ভালোলাগাটা বেরে গেলো। তিথি আজ সারাদিন জলে ভিজেলো ইচ্ছে করে । সন্ধ্যায় যাথা রিতি জ্বর এলো। ডাক পেয়ে বেয়াদপ ছেলেটা এলো ওর বাড়িতে।
বেয়াদপ ছেলেটা তিথিকে বকা দিয়ে বললো” তোর কি আগের মতোই মাথা গন্ডগোল আছে। এখন বড়ো হস নি, ইচ্ছে করে জলে ভিজে জ্বর বাঁধিয়েছিস কেন?”
তিথির ওকে ” গাড়ির অক্সিডেন্ট করেছি জরিমানা নিলি, তুই আমাকে চিনতে পারলি না, আমি চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু আপনি আপনি করে ঝগড়া করলি। তুই বদলে গেছিস আমি তো বদলে যাই নি। কিন্তু যখন বুঝতে পারলাম তুই ইচ্ছে করে না চেনার ভান করেছিস তখন ঠিক করলাম তোকে শাস্তি দিতে হবে। তাই জ্বর বাঁধিয়েছি। আর জ্বর না বাধালে তুই তো দেখা করতেও আসতি না।”
তিথির বেয়াদপ ছেলে রজত বললো” ও চিরকাল শুরু শাস্তি দিয়ে গিলি। আর কিছু দেবার মুরাদ হলো না তোর ”
তিথি একটা নতুন বই ওর হাতে দিলো আর বললো ” এটা তোকে দিতেই এ গ্রামে এসেছি।”
বই এর প্রথম পাতায় তিথি লিখে রেখেছে।
তোর জন্য একরাশ প্রেম,
আছে এখনো গোমনে মনে
তোর জন্য এখনো আমার মনের বাগানে
ফোটে গোলাপ জুঁই…
পৃথিবীর এই হাজার ভিড়েও আমার মনে
আছিস শুধু তুই
বই টা লেখক নামের জায়গায় জ্বল জ্বল করছে রজতের নাম। রজতের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরলো। বললো “আমার জন্মদিন কোন দিন হয়নি বলে খুব দুঃখ ছিলো মনে মনে, কিন্তু আমার জন্মদিনে যে উপহার তুই দিলি , সেটা আমার জীবনের সেরা উপহার।”
তিথি বললো ” ও সব ধন্যবাদ দিয়ে কাজ চলবে না রিটার্নি গিফট চাই।”
রজত বললো” কি রিটার্নি গিফট চাই বল”
তিথি বললো ” একটা হাগ কর ”
রজত হেসে বললো” এ সব কি ছেলে মানুষী ”
তিথি বললো” জরিয়ে ধরে দেখ চাই আমার জন্য তোর বুকে ভালোবাসা বেঁচে আছে কিনা?”
বেয়াদপ ছেলেটা দুষ্টু হেসে বললো” ভালোবাসা বাকি আছে অনেক, সারারাত পরে আছে সুদে আসলে শোধ নেবো , শুধু একটা হাগে হবে না।”
তিথি ওর বেয়াদপ ছেলেটার কলার ধরে টেনে কাছে নিয়ে বললো ” আমি কি না করেছি কখনো??”
,,,
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন