শিরোনাম: আবিষ্কার
গল্পকার: শংকর ব্রহ্ম
ছোটগল্প
আবিষ্কার
শংকর ব্রহ্ম
চালুনির ভিতর দিয়ে গুঁড়ো পড়ছে, তেমনি কুয়াশা রোদ্দুরে চিকচিক করছে ঘরের ভিতরটা। জানলার বাইরে বকফুল গাছের মগডালের উপর বসে একটা কাক, এ’দিক ও’দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে, আর মাঝে মাঝে কা’ কা’ রবে ডাকছে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে, হাত মুখ ধুয়ে, প্রথম কাপ চায়ের সঙ্গে সিগারেট টানতে টানতে খবরের কাগজ পড়া আমার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। আজও সে রকম সকালে উঠে হাত মুখ ধুয়ে, জানলা দিয়ে প্রকৃতিক দৃশ্যে চোখ বুলিয়ে নিয়ে, খবরের কাগজ হাতে চায়ের টেবিলে এসে বসি। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে, খবরের হেড লাইনগুলোর উপর চোখ বোলাতে বোলাতে, পাঁচ পাতার বক্সে দেওয়া একটি সংক্ষিপ্ত খবরে চোখ আটকে গেল।
” যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাসায়নিক
বিভাগের বিজ্ঞানীরা দীর্ঘকাল গবেষণার পর, একটি ওষুধ আবিস্কার করেছেন, ওষুধটির নাম তারা দিয়েছেন, ‘আমলাতন্ত্র নিবারক বটিকা’ সংক্ষেপে ‘আ.নি.ব’।
খবরটি পড়ে আমি নড়ে চড়ে বসলাম।
ওই ওষুধ প্রয়োগ করার লোভ আমি কিছুতেই সামলাতে পারলাম না।
সকাল এগারোটার পর, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাসায়নিক বিভাগে ফোন করে খবরটির সত্যতা যাচাই করলাম প্রথমে। তারপরে গিয়ে তাদের সাথে কথা বলে, ওই বটিকা মাত্র তিনটি সংগ্রহ করতে পারলাম।
একজনকে তিনটের বেশী দেন না।
ওখান থেকে গাড়ি নিয়ে সোজা চলে গেলাম,নবান্নে। সত্যিকারের আমলাদের অফিস।
ছোট ছোট করে ছাঁটা একমাথা চুল,
মোটা গোঁফ, উচিংড়ে চেহারার এক ঝকঝকে যুবক, চিফ সেক্রেটারীর পি.এ, আমার মুখ চেনেন, বললেন, চিফ আজ খুব বিজি, সি.এম- এর সাথে মিটিং আছে।
সেই সময়, চিফ সেক্রেটারীর আর্দালি এক কাপ চা নিয়ে তার ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন, আমি আড়াল করে লুকিয়ে, তার সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে বলতে, একটা বড়ি তার চায়ের কাপে ফেলে দিলাম।
প্রতীক্ষায় কাটতে লাগল, কি ঘটে তা দেখবার জন্য। দশ মিনিটও পার হয়নি, হঠাৎ দেখি চিফ সেক্রেটারী অমায়িক হাসি হেসে আমার দিকে এগিয়ে এলেন।
অনুরোধের ভঙ্গিতে বললেন, প্লীজ বলুন আপনার জন্য আমি কি করতে পারি?
প্রশ্নটা তিনি এমন ভাবে করলেন, যেন আমি তার উর্দ্ধতন কোন অফিসার। তিনি আরও বললেন, আপনার জন্য কিছু করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করব, খুশিতে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। পরম আগ্রহে তিনি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন, আমার হাত চেপে ধরলেন।
তার ছবির মতো সাজানো চেম্বারে আমাকে নিয়ে গেলেন। যত্ন সহকারে গদি আঁটা চেয়ারে বসালেন। নরম গদিতে শরীর ডুবে যাচ্ছিল।
বিনীত কন্ঠে তিনি আবার বললেন, এবার বলুন স্যার, আপনার জন্য কি করতে পারি?
– আমার একটা সার্টিফিকেট দরকার ছিল।
– মাত্র একটা?
– হুম, আপাততঃ একটা হলেই চলবে।
– বেশ, বেশ, এ তো সৌভাগ্য আমার।
– এক সপ্তাহের মধ্যে পেয়ে যাব আশা করি
– ছি ছি, কি যে বলেন, একটা সার্টিফিকেটের জন্য এক সপ্তাহ লাগবে কেন?
– তবে কাল আসি?
– আবার কাল কেন? আপনি দশ মিনিট বসুন, আমি এক্ষুনি করে দিচ্ছি।
– আপনি আজ খুব ব্যস্ত আছেন শুনলাম, আমি না হয় কালই একবার আসব।
– তাতে কি? একটা সার্টিফিকেটের জন্য আপনি দু’বার করে আসবেন কেন? ছি ছি, আপনি একটু বসুন, আমি এক্ষুনি করে এনে দিচ্ছি।
সুয়িংডোর ঠেলে তিনি বেরিয়ে গেলেন। শুনলাম, পাশের ঘরে তিনি তার পি. এ – কে বলছেন, আমাকে দেখলেই দম দেওয়া পুতুলের মতো লাফিয়ে ওঠেন কেন? আর সব সময় মুখে অমন পুরু করে মাখনের প্রলেপের মতো বিনয়ের হাসি মাখিয়ে রাখেন কেন?
আজকে তো দেখছি, সাক্ষাৎকারী মাত্র একজন, সম্ভাব্য সব জায়গায় ফোন করে খোঁজ নিয়ে দেখুন, আর কারও কোনও প্রয়োজন আছে কি না, আমার কাছে।
কোন দরখাস্ত চিঠিপত্র থাকলে রেডি করে রাখুন। এই ভদ্রলোকের সার্টিফিকেটটা দিয়েই আমি সে সব চিঠিপত্র দরখাস্ত নিয়ে বসবো।
একটু পরেই তার ঘর থেকে, সর্টিফিকেট নিয়ে আমি বেরিয়ে এলাম। আরও দুটি বটিকা আমার সঙ্গে আছে।
দেখি, শিল্পমন্ত্রীর আর্দালী জলের গ্লাস নিয়ে তার ঘরের দিকে যাচ্ছে। সবার অলক্ষে দ্বিতীয় বড়িটি তার জলের গ্লাসে ছেড়ে দিলাম। দেখি কী হয় এবার?
একটু পরেই দেখি শিল্প-মন্ত্রী হাল্কা প্রজাপতির মতো শরীর নিয়ে পাখা দোলাতে দোলাতে বাইরে বেরিয়ে এলেন। আমাকে দেখতে পেয়েই বললেন, আরে আসুন আসুন! আপনার জন্যই আমি অপেক্ষা করছিলাম। অনেকদিন ধরেই আপনার ফাইলটা আমার কাছে আটকে আছে, জমি জটিলতার কারণে, আজই আপনার ফাইলটা আমি ছেড়ে দেবো। আপনাকে অনেকবার আসতে হয়েছে বলে, সত্যিই আমি দুঃখিত।
– না না, আপনি এভাবে বলছেন কেন? আপনি কত ব্যস্ত মানুষ।
– ছি ছি, এভাবে বলবেন না। সমস্ত ব্যস্ততা তো আপনাদের জন্যই। আপনারাই তো সব। আপনাদের জন্যই তো আমারা, আপনারা না থাকলে, আমাদের আর কি দরকার থকতো বলুন?
এই বলে, তিনি আমার সঙ্গে করমর্দন করলেন, তারপর বললেন,আসুন ভিতরে। তার সাথে তার ক্যাবিনেটে ঢুকলাম। চোখ বুলিয়ে দেখলাম, ছবির মতো সাজানো সব কিছু। সিনেমায় যে রকম দেখা যায়।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তিনি আমার বহুদিনের আটকে থাকা ফাইলটা সই কর ছেড়ে দিলেন। বললেন, আশা করি এবার আর কোন অসুবিধা হবে না। হলে, শুধু একবার ফোন করে আমাকে জানাবেন।
ফোন নম্বরটা রাখুন আমার, বলে তিনি তার ভিজিটিং কার্ডটা আমার হাতে দিলেন। ফিরে আসবার সময় বললেন, দরকার হলেই একটা ফোন করে চলে আসবেন, মনে থাকে যেন। আপনারাই তো সব।
আমি ফাইলটা নিয়ে, বেরিয়ে এলাম।
পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের জোয়ার আসছে
শুনে, আমি বায়োকেমিক সার কারখানার জন্য রাজারহাটে এক একর জমির জন্য আবেদন করেছিলাম, সরকারের কাছে। আজ এতো সহজে তার অনুমতি পেয়ে যাব ভাবতে পারিনি।
[তৃতীয় বটিকাটি এখনও আছে আমার কাছে। কারও প্রয়োজন হলে যেগাযোগ করতে, অবশ্য এক্সপায়ারী ডেট ফুরবার আগেই।]
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন