আজ সকালে যখন বেলটা বেজেছিল তখন সুচরিতার ঘুম সদ্য ভেঙেছে। এসময় অনেকেই আসে। দুধওয়ালা, কাগজওয়ালা। কিন্তু এত জোরে ওরা বেল বাজায় না। আজকাল শব্দের বাড়াবাড়ি খুব খারাপ লাগে তাঁর। বিছানা থেকে নামার আগেই দরজায় যমুনা। সুচরিতাকে বসে থাকতে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। সেই চিৎকার জড়ানো কান্না থেকে আবিষ্কার করা গেল ওর ভাই এসেছে মায়ের মৃত্যুসংবাদ নিয়ে। ওকে এখনই চলে যেতে হবে।
কিছু টাকা আর জামাকাপড় ব্যাগে পুরে যখন যমুনা ভাইয়ের সঙ্গে বেরিয়ে গেল তখনও পাশের বেডরুমের দরজা ভেজানো। এই যে একটা মেয়ে মায়ের শোকে চেঁচিয়ে কাঁদল তাতেও মানুষটার ঘুম ভাঙেনি একথা বিশ্বাস করেন না সুচরিতা। ভেঙেছে কিন্তু ঘাপটি মেরে পড়ে আছে। বেরিয়ে এলে যদি সমস্যায় জড়িয়ে পড়তে হয় সেই ভয়ে দেখা দিচ্ছে না। বিয়াল্লিশ বছর ধরে। লোকটাকে দেখে আসছেন। যত দিন যাচ্ছে তত নিজের চারপাশে খোলস বানাচ্ছে।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে কিচেনে ঢুকলেন সুচরিতা। এই কাজটা যমুনা করত। চায়ের জল গরম করতে-করতে মাথাটাই গরম হয়ে গেল তাঁর। সারাদিন ধরে এ বাড়িতে কত কাজ। ঘর। পরিষ্কার, ব্রেকফাস্ট বানানো, দুপুরের খাবার, বিকেলের চা, রাতের খাবার, বাজার করা, বাসন ধোয়া, থাকতে হলে এইসব কাজ ঘাড়ের ওপর চেপে বসবে। যমুনা আছে বছর দশেক। সাতদিনের ছুটি নেয় পুজোর ঠিক আগে। প্ল্যান করে যায় বলে বদলি একজনকে দিতে পারে। সে যে-বাড়িতে কাজ করে সেখান থেকে বাৎসরিক ছুটি নিয়ে এসে উপরি রোজগার করে। এখন তাকে মরে গেলেও পাওয়া যাবে না।
চা বানালেন সুচরিতা। কিছুটা লিকার পটে রেখে নিজেরটা নিয়ে টেবিলে গিয়ে বসলেন। কী করা যায়! মনে পড়ল, কেবলে বিজ্ঞাপন দেখে ফোন নাম্বারটা টুকে রেখেছিলেন। ফোন করলেই বাড়িতে খাবার দিয়ে যায়। একটা সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। যমুনাকে ওই সময়েও তিনি বলেছেন যত তাড়াতাড়ি পারে চলে আসতে। এই তাড়াতাড়িটা যে কতদিনে হবে তা ঈশ্বর জানে। হঠাৎ কীরকম অসহায় মনে হল নিজেকে। ঘড়ি দেখলেন, এখন সন্তুদের শুয়ে পড়ার
সময় হয়নি। রিসিভারটা তুলে বোতাম টিপলেন তিনি। রিং হচ্ছে। সুতপার গলা পাওয়া গেল, হ্যালো!
কেমন আছ তোমরা? সুচরিতা জিজ্ঞাসা করলেন।
ও, মামাই, ভালো আছি, তোমার কি খবর?কালই তো ও ফোন করেছিল, না? সুতপার গলায় বিস্ময়।
হ্যাঁ। সন্তু নেই? সুচরিতা বিরক্ত হল।
ছেলের গলা পেলেন তিনি, বলো মা, কী ব্যাপার?
এমনি। এমন কিছু নয়। যমুনার মা মরে গেছে, ও দেশে চলে গেল।
তাই? কাউকে বদলি দিয়ে গেছে?
কী করে দেবে? খবর পাওয়ামাত্র চলে গেল।
আশ্চর্য! তুমি ছাড়লে কেন? কোনও দায়িত্ববোধ নেই?
ওপাশ থেকে সুতপা বোধহয় জিজ্ঞাসা করল। সন্তু তাকে জানাল। সুতপা আবার কিছু বলতে সন্তু হাসল, সুতপা বলছে আমাদের তো এতবড় বাংলো, কোনও ঝি-চাকর নেই, এটা আমাদের কাছে কোনও প্রবলেম নয়। যাক গে, কদিন ম্যানেজ করে নাও। আর কিছু?
না। রাখছি। রিসিভারটা রেখে দেওয়ার পর মনে হল খুব বোকামি করা হল। অতদূর থেকে এ ছাড়া আর কী বলতে পারে ওরা। হ্যাঁ, একবার দেশে গিয়ে দেখে এসেছিলেন কাজের লোক। ছাড়া কীভাবে ওরা সংসার করে। সব তো হাতের সামনে। তা ছাড়া সুতপা একা তো কিছু করে না, সন্তুও সমানে খাটে। সন্তুকে রাঁধতে দেখেছেন তিনি। লনের ঘাস ছাঁটা থেকে কার্পেট ক্লিনিং ওই করে। বড়-বড় কথা। বিয়ের পর সুচরিতাকেও তো সব করতে হয়েছিল। এখানে নয়, বহরমপুরে। একান্নবর্তী পরিবার, চার ভাইয়ের বউ, কাকার ফ্যামিলি সব এক বাড়িতে। সেখানে বউদের রান্না করতে হত, ঘর মুছতে হত, বাসন ধোয়ার জন্যে অবশ্য লোক ছিল। কিন্তু এত লোকের রান্না কাঠের আগুনে করা যে কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার তা সুতপারা কোনওদিন বুঝতে পারবে না। তিনমাসেই সুচরিতার চেহারায় কালি পড়ে গিয়েছিল। সুতর বাবা কাজের লোকের হাতের রান্না খাবেন না। ওইরকম বুর্জোয়া শখ মেটাতে চার বউকে পালা করে রাঁধতে হত। ভাবা যায়?
চা শেষ করলেন যখন সুচরিতা তখন পাশের বেডরুমের দরজা খুলল।
পাজামা-পাঞ্জাবি পরে সুস্নাত টেবিলের উলটোদিকে এসে বসলেন, কাগজ দেয়নি? যমুনা–
তোমাকে খবরটা জানানো দরকার। যমুনা দেশে গিয়েছে। ওর মা মারা গেছে।
যাচ্চলে!
কবে আসবে জানি না। ওর কান্না নিশ্চয়ই তোমার কানে গিয়েছিল!
ওর কান্না বলে বুঝিনি, ঘুমের ঘোরে ভেবেছিলাম বাংলা সিরিয়াল হচ্ছে!
আপাতত আমি চা করেছি। পটে আছে, কিচেন থেকে নিয়ে নাও। ইচ্ছে করেই বললেন সুচরিতা। সাতসকালে বাংলা সিরিয়ালের কান্না শুনছে। কোনওদিন ওই সময় সিরিয়াল হয়? সুচরিতার মনে পড়ল না ও কখনও নিজে চা বানিয়ে খেয়েছে কিনা। কিন্তু এখন বেশ চলে গেল কিচেনে। খানিক বাদে চা আর বিস্কুট নিয়ে ফিরতেই বেল বাজল। সুচরিতা দরজা খুললেন। একসঙ্গে কাগজওয়ালা এবং দুধওয়ালা। এ বাড়িতে দুটো কাগজ রাখা হয়। একটা টেবিলে রেখে সুচরিতা ইচ্ছে করেই আর একটা নিয়ে বসলেন। অন্যদিন সুস্নাত এখানে একা বসে দু-কাপ চা। নিয়ে খবরের কাগজ পড়ে।
অন্যদিনের থেকে আজকের পার্থক্যটা ওকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না।
সুস্নাতর এখন সত্তর। চুল পেকেছে, দাঁতও পড়েছে কয়েকটা কিন্তু বার্ধক্য ওকে তেমনভাবে দখল করতে পারেনি। কাজকর্ম শেষ করেছে অনেকদিন। এখন বই নিয়ে পড়ে থাকে। বিকেল হলে সেজেগুঁজে বের হয়। ক্লাবে যায়। সেখানে নিয়ম করে মদ্যপান করে নটার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসে। সারাদিন মুখ বন্ধ করে থেকে ওখানে গিয়ে বোধহয় রাজাউজির মারে। বছর পাঁচেক আগেও সুচরিতার ফিগার প্রায় ঠিকঠাক ছিল। ষাট বছর বয়সে যতটা ঠিক থাকা সম্ভব।
খবরের কাগজে মন দেওয়া সম্ভব হয় না সুচরিতার। তিনি কাগজ নিয়ে তাঁর ঘরে চলে গেলেন। সঙ্গে-সঙ্গে মুখ তুললেন সুন্নাত। হয়ে গেল, আজ থেকে যমুনা না ফেরা পর্যন্ত এ বাড়ি আর। শ্মশানের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। খবরের কাগজে মন দেওয়ার চেষ্টা করলেন তিনি। সেই যৌবনের মাঝামাঝি থেকে তাঁর সিদ্ধান্ত, সমস্যা এলে বুক চিতিয়ে মোকাবিলা করা নেহাতই বোকামি। এ অনেকটা সমুদ্রে নেমে স্নান করার মতো। বিশাল ঢেউ গড়িয়ে-গড়িয়ে আসছে। সোজা দাঁড়িয়ে থাকতে চাইলে ঢেউ শরীরটাকে তুলে নিয়ে বালিতে এমন আছাড় মারবে যে হাড় না ভাঙলেও ছড়ে যাবে শরীরের নানান অংশ। এক্ষেত্রে বুদ্ধিমানরা হয় লাফিয়ে ঢেউয়ের ওপর। উঠে যায় নয় ডুবে গিয়ে ওটাকে মাথার ওপর দিয়ে চলে যেতে দেয়। এইসব তাৎক্ষণিক সমস্যাগুলো ঢেউয়ের মতো চলে গেলে নির্বিষ জলের মতো ফিরে যায়। সুস্নাত নিজের ঘরে চলে এলেন। আর তখনই টেলিফোনটা বাজল। মূল রিসিভারটা ডাইনিং টেবিলের পাশে থাকলেও দুটো বেডরুমে তার এক্সটেনশন রয়েছে। সুস্নাত রিসিভার তুললেন।
হ্যালো, সুস্নাত বলছি।
বাবা, কী হয়েছে? যমুনা কেন চলে গিয়েছে?
নীপার গলা।
হকচকিয়ে গেলেন সুন্নাত, তুই কী করে খবর পেলি?
এইমাত্র দাদা ফোন করেছিল।
তোর দাদা লং আইল্যান্ডে বসে কী করে জানতে পারল?
ও, তুমি বড় প্রশ্ন করো। মা ফোন করেছিল দাদাকে, তুমি জানো না?
ও! আমাকে না জানালে জানব কী করে!
তোমরা এই কদিন কোনও হোটেলে গিয়ে থাকো না। কলকাতায় না থাকতে চাও, দীঘা বা দার্জিলিং-এ চলে যাও। দয়া করে বোলো না তোমার টাকা নেই। মা এমনভাবে ফোন করেছে যে দাদা চিন্তায় পড়ে গেছে!
তোরা যে এত চিন্তা করছিস তা জেনে খুব ভালো লাগছে রে!
ওয়েল, তুমি ঠাট্টা করছ। আমি তোমাকে কতবার বলেছি ওই ফ্ল্যাট বিক্রি করে সোজা চলে এসো মাকে নিয়ে। কিন্তু তুমি আসবে না! মেয়ের বাড়িতে গিয়ে থাকা যায় না, এই প্রিমিটিভ আইডিয়া থেকে তোমরা মুক্ত নয়। মেয়ের গলায় অভিমান।
তোর দাদার ওখানে তো আমরা যাচ্ছি না!
আমি জানি কেন যাচ্ছ না। কিন্তু। যাক গে, হোটেলে যদি যেতে না চাও তো মাকে বলো সাদামাটা কিছু রাঁধতে এবং তুমি মাকে হেল্প করো। বুঝলে! বাবা, ট্রাই টু রিয়েলাইজ, মা ছাড়া তোমার পাশে এখন কেউ নেই। আমি এত দূর চলে এসেছি যে চেষ্টা করলেই তোমার সাহায্যে লাগতে পারব না।
নীপার টেলিফোন রেখে দেওয়ার পর সুস্নাতর মনে হল মেয়েটা খুব সত্যি কথা বলল, ও অনেক দূরে চলে গিয়েছে? কলকাতা থেকে অস্ট্রেলিয়া তো অনেক দূরে। যমুনা এই ফ্ল্যাট থেকে চলে গিয়েছে ঘণ্টাখানেক আগে, নাকি আর একটু বেশি? কিন্তু তার মধ্যেই নিউইয়র্কে খবরটা পৌঁছে গিয়েছে। নিউইয়র্ক জানিয়েছে অস্ট্রেলিয়াকে। কলকাতার কোনও খবরে সমস্যার গন্ধ পেলে। ভাইও বোনকে সেটা জানিয়ে দেয়। সুস্নাত মেয়েকে কোনও কড়া কথা বলতে চাইলেও পারেন না। এই মেয়েটার ওপর তাঁর দুর্বলতার কথা সবাই জানে। ভালো ছাত্রী ছিল। ওর দাদা পরিশ্রমী বলে ভালো ফল করেছিল কিন্তু ওর মতো মেধাবী ছিল না। অনেকগুলো ডিগ্রি পেয়ে সহপাঠীকে বিয়ে করে অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেল। সিডনিতে ভালোই আছে ওরা। আর কিছু নয়, একেবারে। সমবয়সিকে বিয়ে করার ব্যাপারে অস্বস্তি ছিল সুন্নাতর। মেয়ে জানতে পেরে অভয় দিয়েছিল, তুমি বুঝতে পারছ না। বেশি বড় হলে ও আমার কথা শুনত না। এখন শুনবে। আমাদের সম্পর্কটা দেখো ভালো থাকবে।
মেয়ে অস্ট্রেলিয়ায় ছেলে আমেরিকায়। অনেক কাল ছেলে মায়ের ছেলে হয়ে ছিল। এখন বউয়ের স্বামী। তবু ভদ্রমহিলার হুশ হয় না। যে-কোনও সমস্যায় পড়তেই তড়িঘড়ি ছেলেকে ফোন করেন। যেন সঙ্গে-সঙ্গে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। রাবিশ!
মেয়ের কথাটা কানে বাজছে। ট্রাই টু রিয়েলাইজ, মা ছাড়া তোমার পাশে এখন কেউ নেই। এই পৃথিবীতে চোখের সামনে যে এল সে-ই এখন উপদেশ দিচ্ছে। কেন নেই?তুই নেই কেন? তোর দাদা নেই কেন? তোর কাকা পিসিরা নেই কেন?কথাটা মনে আসতেই খেয়াল হল নীপা ওর পিসিদের দুজনকেই কখনও দেখেনি। ও জন্মাবার আগেই তাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল।
কলকাতা থেকে ডিগ্রি এবং প্রেম নিয়ে বহরমপুরে ফিরে গিয়েছিলেন যুবক সুস্নাত চাকরি করতে। ওঁদের পিতৃদেব চেয়েছিলেন চার ছেলে বাড়িতে থেকেই কাজকর্ম করুক। সবাই একত্রিত থাক। সুতর প্রেমের প্রসঙ্গ জানাজানি হওয়ার পর মায়ের উদ্যোগে বিয়েটা হয়েছিল। কলকাতার মেয়ে সুচরিতা বউ হয়ে গিয়েছিল বহরমপুরে।
তারপরে কী যন্ত্রণা। যে মেয়ে চিরকাল বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হিসেবে কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করে থাকেনি, চাইলেই যে সব পেয়েছে তার পক্ষে একান্নবর্তী পরিবারে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা একসময় করুণ চেহারা নিল। রাত্রে বিছানায় এসে কান্নাকাটি প্রায় নিত্যকার ঘটনা হয়ে গেল। ননদরা কে কীরকম খোঁটা দিয়েছে, সিনেমায় যেতে চাইলে কেন দুজনে আলাদা। যেতে পারবে না, কাঠের আগুনে রান্না করা যার অভ্যেস নেই তাকে কেন সপ্তাহে চাররাত। রান্নাঘরে ঢুকতে হবে, এই ধরনের নানান অনুযোগে সুস্নাত ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলেন। এই সময় হঠাৎ শ্বশুরমশাইয়ের আগমন। মেয়েকে দেখে যেন তাঁর খুব কষ্ট হল, মেয়েরও শোক উথলে উঠল। কদিনের জন্যে মেয়েকে নিয়ে গেলেন কলকাতায়। সেখানে গিয়ে জানালেন মেয়ের ইচ্ছে এম. এ. পড়ার। সুতর পিতৃদেব বললেন, তোমার যদি আপত্তি না থাকে বউমার পড়াশুনার ব্যাপারে আমি আপত্তি জানাব কেন!
সুস্নাত এলেন কলকাতায়। বুঝলেন, পড়াশুনাটা নেহাতই বাহানা। বহরমপুরের জীবনে ফিরে যেতে প্রবল আপত্তি সুচরিতার। এদেশে প্রেমের সময় ছেলেমেয়েরা পরস্পরকে বড়জোর দশ শতাংশ জানতে পারে। বিয়ের পর বাকি নব্বই শতাংশ স্রেফ জুয়োখেলার চেহারা নেয়। সুস্নাত ফিরে গেলেন বহরমপুরে। এবং তারপরেই পিতৃদেবের মৃত্যু। খুঁটিটা নড়ে গেল। একান্নবর্তী। পরিবারের সমস্যাগুলো দাঁত বের করল। মায়ের পক্ষে সেটা সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ল। কোনও ভাইয়ের ভাগে ঘর কম হচ্ছে, কোনও ভাইয়ের অনুযোগ তার তুলনায় অন্য ভাই সংসারে কম টাকা দিয়েও সমান সুখ ভোগ করছে, ব্যাঙ্কে পিতৃদেবের যা রয়েছে তার বিলিব্যবস্থা কীভাবে হবে ইত্যাদি সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। সুস্নাত লক্ষ করত ওরা যখন কথা বলেছে তখন সুচরিতাকে বাদ দিয়েই বলেছে। যেন সুচরিতা এই বাড়ির কেউ নয়। একদিন কথাটা তুলতেই বড়বোন, যে তখন সদ্য বিবাহিতা, বলে ফেলল, কিছু মনে কোরো না দাদা, এ বাড়ি থেকে বউদির বেরিয়ে। যাওয়াটা বাবা মেনে নিতে পারেনি বলে এত তাড়াতাড়ি চলে গেল। এখানে কেউ জানল না, তুমিও কিছু জানো না, হঠাৎ এমএ পড়ার ইচ্ছে হয়ে গেল? আর এমএ তো যখন-তখন পড়া যায় না, তারও তো সময় আছে। আমরা নিশ্চয়ই ঘাসে মুখ দিয়ে চলি না। যাই বলল, শুরুটা কিন্তু তোমার বউই করল।
বাড়ির মধ্যে বাড়ি, ঘরের মধ্যে ঘর, মায়ের অবস্থা অসহায়। আর সেই সময় কলকাতার চাকরিটা চলে এল হাতের মধ্যে। মায়ের আপত্তি ছিল খুব। যেন সুস্নাতই তার ভরসা। তিনি পাশে থাকলে ভাঙনটাকে মা রুখতে পারবেন। কিন্তু সুচরিতা নিজের ভবিষ্যৎ, আকাশে ওড়ার স্বপ্ন টেনে নিয়ে এল সুস্নাত কলকাতায়। দমদমের ভাড়া করা ফ্ল্যাটে তখন অপার আনন্দ। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে সকাল আসে। রবীন্দ্রনাথের গান বাজে সুচরিতার গলায়, রেকর্ডে। সুচরিতার পড়াশুনা, সুতর চাকরির বাইরের সময়টা যেন থমকে থাকে ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে। পড়া শেষ হলে সুচরিতা চাকরি পেল, সুতর উন্নতি। সেই সঙ্গে ছেলেমেয়ে চলে এল কয়েক বছরের ব্যবধানে।
ছেলে আসার পর যা হয়নি মেয়ে এলে তা হল। মেয়ের ওপর সুম্নতর আগ্রহ নিয়ে রসিকতা। করত সুচরিতা। যা ছিল এতকাল উদারতায় চাপা দেওয়া তা যে কখন উন্মুক্ত হয়ে পড়ল তা ওরা নিজেরাই জানে না। এ বাড়িতে সুচরিতার দিদির অবারিত যাতায়াত। তাঁর সন্তানদের আঁকড়ে ধরেছে সুচরিতার ছেলে-মেয়ে। দিদি কেবলই বোঝাচ্ছেন, আর কতদিন ওরা ভাড়া করা ফ্ল্যাটে থাকবে! ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজেদের ফ্ল্যাট হওয়া উচিত। সুচরিতাই উদ্যোগী হলেন। ওঁর জামাইবাবু এই ফ্ল্যাট বুক করিয়ে দিলেন। সেসময় দুজনের রোজগার থেকে যা বাঁচত তার সবটাই চলে যেত ফ্ল্যাটের ইনস্টলমেন্ট মেটাতে। সেই সময় বহরমপুরে ভাগাভাগি হয়ে গিয়েছে। মা যে ভাইয়ের সঙ্গে আছেন তার রোজগার কম। মায়ের জন্যে টাকা পাঠানোর অনুভব করেন সুস্নাত। সুচরিতা বলেন, তোমার মাকে তুমি নিশ্চয়ই সাহায্য করবে। কীভাবে করবে তা তুমিই ঠিক করো। তবে তোমার ভাইয়ের সংসার চালানোর দায়িত্ব নিশ্চয়ই তোমার নয়। আর সেটা তুমি নিজের ছেলেমেয়েকে বঞ্চিত করে করতে পারো না।
তার মানে?
তুমি তোমার মায়ের জন্যে কত পাঠাবে? খাওয়াদাওয়া, ওষুধ ইত্যাদির জন্যে কত টাকা? ধরো পাঁচশো। তা তোমার মা নিশ্চয়ই সেই টাকায় বাজার করে নিজের জন্যে রাঁধবেন না। তাঁকে টাকাটা দিতে হবে ছেলের হাতে।
মা কীভাবে খরচ করবেন সেটা তাঁর ওপর নির্ভর করছে। সুস্নাত বলেছিলেন।
মাকে পাঁচশো টাকা পাঠাতে বাড়তি খাটতে হচ্ছিল। কিন্তু সব মাসে ঠিকঠাক সময়ে পাঠাতে পারছিল না সে। আর তখনই হঠাৎ বিদেশে যাওয়ার আমন্ত্রণ এল চাকরির সূত্রে। এক বছরের জন্যে। ফিরে এল অনেকটা ধাপ ওপরে ওঠার আনন্দ নিয়ে। কিন্তু ইতিমধ্যে মা মারা গিয়েছেন। ভাইদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই।
সুস্নাত জানেন, নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করা সত্বেও ভাইদের ধারণা তিনিই সবচেয়ে সুবিধেবাদী। সবচেয়ে বেশি রোজগার করা সত্বেও এক-এক ভাই যখন বিপদে পড়ে টাকা চেয়েছে তখন তিনি দিতে পারেননি। সুচরিতা ঠিকই বলতেন, দিলে ফেরত পাবে? বাড়ি বানাবার জন্যে দু-লাখ। চেয়েছে, শোধ করবে? একজনকেই দুই দিলে আর একজন হাত বাড়াবে। তখন তাকেও দেবে?
যুক্তিযুক্ত কথা। কিন্তু ভেতরে-ভেতরে একটা তিরতিরে যন্ত্রণা রয়েই গেল। একসময় তিনি খবর পেতেন কাজেকর্মে ভাইরা কলকাতায় আসে অথচ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে না। বহরমপুরের এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তাঁর মুখে শুনলেন, সেজো ভাইয়ের ছেলে যাদবপুরে পড়ছে। অথচ তিনি জানেন না। ইচ্ছে হয়েছিল ছেলেটাকে দেখে আসার কিন্তু ওরা যখন নিজেরাই দূরত্ব রাখছে তখন তিনি কেন উদ্যোগী হবেন?আর এইসব করতে-করতে আবিষ্কার করলেন ছেলে এবং মেয়ে মাসতুতো ভাইবোনকে চেনে, জানে, নিজের মনে করে কিন্তু বাবার তরফের কাউকে জানে না। এবং জানবার আগ্রহও নেই। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কোনওদিন সুস্নাতর ছিল না। এ নিয়ে সুচরিতার অনুযোগ খুব। শেষপর্যন্ত মেনে নিয়েছিলেন তিনি।
এইসময় শ্বশুর মারা গেলেন। শাশুড়ি একা। সুচরিতার দিদির ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেছে। প্রায় ঝাড়া হাত-পা। অতএব তিনি গেলেন মায়ের সঙ্গে থাকতে। ভাইরাভাইয়ের পৈতৃক বাড়ি। দুই ভাইয়ের ব্যবস্থা আলাদা। কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু দুজন মহিলা একা থাকবেন কী করে তাই ছেলে গেল দিদিমার বাড়িতে। সুস্নাত টের পেলেন তখন থেকেই দুই বোনের সম্পর্কে চিড় ধরেছে। অথচ প্রকাশ্যে কেউ কাউকে সেটা জানাচ্ছে না। সুচরিতা ছেলেমেয়েকে মাসির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করার ব্যাপারে ঘুরিয়ে সতর্ক করছেন। একবার নিজেই চলে গেলেন ছেলেকে নিয়ে। মায়ের সঙ্গে থাকবেন বলে। মেয়ে গেল না। ফিরে এলেন দিন-তিনেক বাদে। কারণটা জানালেন না। মেয়ে জানাল, মা খুব রেগে গেছে। যেহেতু সুচরিতা জানাননি তাই সুস্নাত জানতে চাইলেন না। কখন কেমন করে দুটো কম্পার্টমেন্ট তৈরি হয়ে গিয়েছে, কেউ কারও ব্যাপারে নাক গলান না।
প্রথমে ছেলে পড়তে গেল আমেরিকায়। ফুল স্কলারশিপ পেয়ে। কথা হল, পড়াশুনো শেষ করেই ফিরে আসবে। কথা হয়েছিল মায়ের সঙ্গে, সুস্নাত জানতেন ছেলে ফিরবে না। সেটা জানাতে সুচরিতা রেগে গেলেন। জানালেন, সুস্নাত কখনই ছেলেকে পছন্দ করে না। ছেলে পড়া শেষ করে চাকরি নিল সেখানে। বছরে একবার আসতে লাগল। সুচরিতা তাকে বিয়ের কথা বলতেই রাজি হয়ে গেল। সুতপাকে পছন্দ করল সুচরিতা। সুস্নাত কোনও মন্তব্য করেননি। বিয়ের পর ওর। মাকে নিয়ে ওরা চলে গেল। চাকরির দোহাই দিয়ে ফিরে এলেন সুচরিতা। সেই শেষ। আর যাওয়া হয়নি। মেয়ের বিয়ের সময় সুচরিতা যেন সবকিছু মেনে নিচ্ছিলেন। যেন সুস্নাতকে জব্দ করার জন্যেই ওই মেনে নেওয়া। বিয়ের পর যখন অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেল ওরা, আর তার কিছু পরেই শ্বশুর-শাশুড়িকে নিয়ে গেল তখন থেকে সুচরিতার কাছে মেয়ে বাতিল হয়ে গেল যেন। নীপা তার দেওরকে ওখানে নিয়ে গিয়েছে শুনে বলেছিলেন, বাপের মতোই কাণ্ডজ্ঞান নেই।
সুস্নাত লক্ষ করেন, মানুষ সারাজীবন ধরে একটার-পর-একটা সম্পর্ক স্বার্থের কারণে ছিঁড়ে ফেলে। প্রথমে স্বামী-স্ত্রীর স্বার্থ, বাকি পৃথিবীটা আলাদা। তারপর স্বামী-স্ত্রী-সন্তানের স্বার্থ, তারপর নিজের এবং সন্তানের স্বার্থ, তারপর সন্তান আলাদা, স্বামী আলাদা, শুধু নিজের স্বার্থ। পিতৃদেব বেঁচে থাকতে সুস্নাত যা ভাবতে পারতেন না তিনি মরে যাওয়ার পর তা পেরেছেন। অনায়াসে। মা চলে যাওয়ার পর আরও সহজ হল। ছেলেমেয়ে বড় হয়ে যে-যার নিজের জগৎ তৈরি করে নেওয়ার পর তাদের জন্যে চিন্তা করার দায় ঘুচল।
আর সুচরিতা? বিয়ের বছর দশেকের মধ্যেই মনে হয়েছিল যে, নারীকে তিনি আবাল্য কল্পনা করে এসেছিলেন সেই নারী সুচরিতা নয়। ঝগড়াঝাঁটি করার মতো নিম্ন রুচি তার নেই, আলাদা হয়ে যাওয়ার মতো মনের জোরও নেই। সেই জোর তৈরি হয়নি সন্তানদের জন্যেও।
এখন দশটা বাজে। সুস্নাত ঘর থেকে বের হলেন। পাশের বেডরুমের দরজায় গিয়ে নিচুগলায় বললেন, শুনছ!
সুচরিতা, গলা পাওয়া গেল, কী ব্যাপার?
ভেতরে আসতে পারি?
আসছি।
সুচরিতা নিজেই বাইরে এলেন। সুস্নাত বললেন, নীপা ফোন করেছিল। ওকে ওর দাদা জানিয়েছে যে যমুনা চলে গেছে।
জেনে সে কী উপদেশ দিল?
উপদেশ বলছ কেন?
নয়তো কি! তিনি অস্ট্রেলিয়ায় বসে শাশুড়ি, দেওরকে নিয়ে সংসার করতে-করতে আর কী করতে পারেন। সুচরিতার কথায় ছুরির ধার।
সেটা তো সন্তুও করতে পারে না।
কেন? পারে না কেন? সুতপা উপদেশ দিয়েছে তাকে অনুসরণ করতে। আমেরিকায় ওরা নিজেরাই সব করে। কে কেমন আমার সব জানা হয়ে গেছে।
সুচরিতার কথা শুনে অনেকদিন বাদে সুস্নাতর খুব ভালো লাগল। সে বলল, নীপা বলছিল, যমুনা যতদিন না ফিরছে ততদিন কোথাও গিয়ে হোটেলে থাকতে। ইনফ্যাক্ট অনেকদিন বাইরে যাওয়াও হয়নি।
বেশ তো। যাও। তুমি এখানে না থাকলে আমার কোনও প্রবলেম হবে না, তা জানি।
ধন্যবাদ। নীপা বলছিল আমি যদি তোমাকে হেল্প করি।
তুমি? হেল্প করবে? কোনওদিনও খাওয়ার পর প্লেট ধুয়েছ? হেল্প করতে গেলে তিনগুণ সমস্যা তৈরি করবে। তার চেয়ে কোথাও ঘুরে এসো।
তুমিও যেতে পারো। হোটেলে থাকলে কোনও পরিশ্রম হবে না।
অসম্ভব। এ বাড়িতে আছি, ঠিক আছি, অভ্যস্ত হয়ে গেছি। হোটেলে গিয়ে একঘরে থেকে মুখ বন্ধ করে বসে থাকতে পারব না। তুমি তো জানোই, কথা বললেই আজকাল ঝামেলা হয়। কী দরকার প্রেশার বাড়াবার।
বেশ, তাহলে তুমিই কোথাও ঘুরে এসো। আমি এখানে হোটেলে খেয়ে নেব। আমার কোনও সমস্যা হবে না।
সেটা মন্দ নয়। যাওয়া যেতে পারে। দীঘায় যেতে কতক্ষণ লাগে?
ঘণ্টা পাঁচেক বড়জোর। দুপুরে বাস আছে।
সুচরিতা খুশি হলেন। বললেন, অনেকদিন সমুদ্র দেখা হয়নি।
সুস্নাত নিজের ঘরে ফিরে গেলেন। হঠাৎ তাঁর মনে হল, সুচরিতা নয়, তাঁরই উচিত ছিল দীঘায় যাওয়া। এতগুলো বছরে সুচরিতা কখনও একা কোথাও যায়নি। দীঘাতে তাঁরা গিয়েছিলেন ছেলে হওয়ার পরের বছরে। এখন নিশ্চয়ই কোনও মিল পাওয়া যাবে না। সেখানে গিয়ে হোটেল খুঁজে বের করে থাকার মধ্যে একটু অনিশ্চয়তা আছে। তা ছাড়া অনেক হোটেলে মেয়েদের একলা জায়গা দেওয়া হয় না। অবশ্য সুচরিতাকে এখন ঠিক মেয়ে বলা যায় না। আবার নিজে যে যাবেন সে ব্যাপারেও অস্বস্তি আছে সুতর। ধর্মতলায় গিয়ে বাস ধরতে হবে, অতদূর যাওয়া, হোটেলে থাকা, কীরকম পরিশ্রমের ব্যাপার বলে মনে হল।
এদিকে আসবে?
সুচরিতার গলা শুনে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলেন সুস্নাত।
শোনো, আমি একটা লাঞ্চমতো বানাচ্ছি। তোমাকে আর দুপুরে খেতে বেরুতে হবে না। স্টকে ডিম নেই। গোটা চারেক ডিম এনে দাও।
ডিম!
কেন? মেয়ে তো উপদেশ দিয়েছে, শোনননি!
অতএব সুস্নাত বেরুলেন। শেষ কবে বাজারে গিয়েছিলেন মনে পড়ে না। অবশ্য ডিম কিনতে বাজারে যেতে হবে না। রাস্তার উলটোদিকেই মুদির দোকান রয়েছে।
চারটে ডিমের দাম কত?
হাঁস না মুরগি? ছেলেটা জিজ্ঞাসা করল।
সর্বনাশ। ফাঁপড়ে পড়লেন সুস্নাত।
এই সময় হাসির আওয়াজ কানে এল। সুস্নাত দেখল মিসেস পাকড়াশি পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, আজ কি দেখছি, আপনি ডিম কিনছেন?
আর বলবেন না, কাজের লোক দেশে গিয়েছে–!
তাহলে রান্নাবান্না–। আপনার মিসেসের শুনেছি গ্যাসের কাছে যাওয়া বারণ। আপনি রান্না করছেন নাকি?
হেসে মাথা নেড়ে চারটে হাঁসের ডিম কিনে বাড়ি ফিরল সুস্নাত। হ্যাঁ, সুচরিতার নিশ্বাসের একটা কষ্ট আছে। কথাটা খেয়াল ছিল না।
শোনো, ওগুলো থাক। আমি দোকান থেকে কিছু কিনে আনছি।
ডিম আনোনি?
এনেছি।
দয়া করে পেঁয়াজগুলো একটু কুচিয়ে দিতে পারবে?
নিশ্চয়ই।
ব্যাপারটা কিছুই নয় কিন্তু বেশ হিমসিম খেল সুস্নাত। হঠাৎ নিজেকে অপদার্থ বলে মনে হল তাঁর। কত মানুষ আছে যারা সব কাজকর্ম করেও চমৎকার রাঁধতে পারে। এই সন্তুটাও। শুনেছেন, নীপার বর নাকি দশ-বারোজনের ডিনার একাই বানিয়ে ফেলে। আর তিনি পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে চোখের জল ফেলছেন।
ছাড়ো। ওইভাবে কাটলে আমার খাওয়া হবে না। তুমি দয়া করে একটা কাজ করো। ফোন করে জেনে নাও সিট রিজার্ভ করা যাবে কিনা, কখন বাস কোত্থেকে ছাড়বে আর দীঘার হোটেল বুক। করা যাবে কিনা! তৎক্ষণাৎ সরে আসছিল সুস্নাত, সুচরিতা বলল, ভেবো না তোমার ফেবার। নিচ্ছি। পেঁয়াজ না কেটে ওই কাজটা তুমি করছ।
আধঘণ্টা বাদে সুস্নাত জানল, টেলিফোনে টিকিট বুক করা যায় না। বাস ছাড়বে বারো, সাড়ে বারো এবং একটায় মনুমেন্টের কাছ থেকে। দীঘায় এখন ট্যুরিস্টদের ভিড় নেই, সব হোটেল খালি যাচ্ছে।
শুনে খুশি হল সুচরিতা, বারোটা? এখনও দেরি আছে। ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাব। একটাই ব্যাগ নিচ্ছি। সুতপা সেবার একটা সুইমিং কম নিতে চেয়েছিল, নিয়ে নিলে আচ্ছা করে সমুদ্রস্নান করা যেত। গিয়ে ফোন করে হোটেলের নাম্বার দিয়ে দেব। যমুনা এলে জানিয়ে দিও।
সমুদ্রের জলে শুনেছি স্কিন অ্যালার্জি হয়।
তোমার তো সবকিছুতেই অ্যালার্জি। আমাতেও।
এই সময় টেলিফোন বাজল। সুচরিতা গিয়ে ফোনটা ধরল, হ্যালো! কে? ও! কি খবর? অ্যাঁ? তাই নাকি? খুব ভালো কথা। কোত্থেকে বলছ? শেয়ালদা স্টেশন? হ্যাঁ, তোমার দাদা আছে। ফোনে কী কথা বলবে, চলে এসো সোজা। আরে এসো। ঠিকানাটা জানো? বেশ তো। আমি অবশ্য বাইরে যাচ্ছি, তোমার দাদা তো রইল।
অবাক হয়ে তাকিয়েছিল সুন্নত। সুচরিতা বলল, তোমার আর কোনও চিন্তা নেই, হোটেলে খেতে হবে না। এই ফ্ল্যাটে বসে মায়ের রান্না খেতে পারবে।
মায়ের রান্না?
কেন? তোমার ছোটবোন মায়ের কাছে রান্না শেখেনি?
সে কি? ইতি ফোন করেছিল? হঠাৎ?।
মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছে। হোটেলে উঠবে। দাদা শহরে থাকতে হোটেলে কেন? পাত্রপক্ষ কি ভাববে? তাই বলে দিলাম চলে আসতে।
তুমি বলে দিলে? সুস্নাত তখনও অবাক।
হ্যাঁ। খালি ফ্ল্যাট। তবে আমার বেডরুমটা যেন ওরা ব্যবহার না করে। তিনজন আছে। তোমার ভালোই লাগবে।
তুমি চলে যাচ্ছ–।
তো কি? নিশ্চিন্তে যাচ্ছি। দরজা ভালো করে বন্ধ না করে তুমি বেরিয়ে গেলে চোর ঢুকত, এখন সেটা হবে না। বউদি তো ওদের চোখে খুব খারাপ, আমি না থাকলে তাই ভাববে। বেশি আর কী!
স্নান সেরে এসে সুচরিতা টেবিলে খাবার সাজাল, তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। ওরা এসে পড়লে অসুবিধে হবে। দুজনের জন্যে বানিয়েছিলাম।
অতএব খেতে বসতে হল। মন্দ হয়নি। কিন্তু ইতির মুখটা মনে করার চেষ্টা করল সুস্নাত। কত বছর ছোটবোনকে দেখেনি। ভাইদের মুখ কেমন ছিল? বড়বোনের?ইতির মেয়ে তাহলে বিয়ের বয়সি? তাকে তো দেখেইনি। হঠাৎ একটু কৃতজ্ঞবোধ করল সে সুচরিতার কাছে।
খাওয়া যখন শেষ তখন প্রথম বেলটা বাজল। সুচরিতাই দরজা খুলল। স্মার্ট চেহারার একটি যুবক দাঁড়িয়ে আছে, আমি তাজ ইন্ডিয়া থেকে আসছি। আপনাদের জন্যে একটা লাঞ্চ প্যাকেট আছে।
লাঞ্চ প্যাকেট? কে অর্ডার দিল?
ই-মেলে অর্ডার এসেছে নিউইয়র্ক থেকে, ক্রেডিট কার্ডে পেমেন্ট করেছেন। এটা নিন আর দয়া করে এখানে সই করে দিন।
লোকটিকে বিদায় করে বড় প্যাকেটটা নিয়ে অপূর্ব হাসলেন সুচরিতা, দ্যাখো সন্তুর কাণ্ড। যমুনা নেই বলে ফাইভস্টার হোটেলকে বলেছে বাড়িতে লাঞ্চ পাঠিয়ে দিতে। নিশ্চয়ই সুতপা জানে না।
এরকম করা যায় তাই আমি জানতাম না। বিড়বিড় করল সুস্নাত।
তুমি তো কিছুই জানোনা। প্যাকেট খুললেন তিনি। তারপর উচ্ছ্বসিত হলেন, কী কাণ্ড! ফ্রায়েড রাইস, চিলি চিকেন, চিকেন কাবাব, এটা কি? এ তো দুজনেও শেষ করা যাবে না। হয়তো ভেবেছে রাত্রেও খাব। জানে না তো, আমি দীঘায় চলে যাচ্ছি। সুচরিতা বললেন।
তুমি সঙ্গে নিয়ে যাও।
নষ্ট করতে! এত একা খাওয়া যায়? নাকি, সন্তু পাঠিয়েছে বলে তোমার খেতে অরুচি হচ্ছে। সুচরিতার কথা শেষ হতেই বেল বাজল।
দ্যাখো, তোমার বোন এল!
অতএব সুস্নাত দরজা খুললেন। আর একটি তরুণ দাঁড়িয়ে, হাতে বাক্স, মিস্টার সুস্নাত–।
হ্যাঁ, আমি।
এই নিন। আপনাদের লাঞ্চ প্যাকেট। হোটেল গ্র্যান্ড থেকে আসছি, অস্ট্রেলিয়া থেকে ই-মেলে অর্ডার এসেছিল। ক্রেডিট কার্ডে পেমেন্ট হয়ে গেছে। সই করুন।
ছেলেটিকে বিদায় করে হাসিমুখে বাক্সটাকে টেবিলে রাখলেন সুস্নাত, দ্যাখো মেয়ের কাণ্ড। উপদেশ দেওয়ার পরেও খাবার পাঠিয়েছে। ই-মেলে আজকাল কত কী করা যায়। খুলে দ্যাখো তো, কী আছে!
তোমার মেয়ে পাঠিয়েছে, তুমিই খোলো।
সুচরিতা মুখ ফেরালেন।
সুস্নাত খুলল। ফ্রায়েড রাইস, চিলি চিকেন, চিকেন কাবাব, আর একটা যেন কী! চারজন খেতে পারবে। বললেন, যাই বলল, মেয়ে আমাদের কথা ভাবে।
আমাদের বোলোনা, আমার বলো।
ঠিক সেই সময় আবার ফোন বাজল। সুচরিতাই ফোন ধরল, হ্যাঁ, কি হল ইতি? তোমরা হোটেলে যাচ্ছ, কেন? আরে এতদিন যোগাযোগ রাখোনি তো কী হয়েছে? তুমি যেমন রাখোনি তেমন। আমরাও তো রাখিনি। না না, তোমার ফোন আসার আগেই আমি ভাবছিলাম বাইরে যাব। তুমি আসছ বলে চলে যাচ্ছি তা ভাবছ কেন? শোনো, তোমরা যদি না আসে তাহলে খুব দু:খ পাব। তোমরা আসবে বলেই বোধ হয় বড় হোটেলের খাবার এসেছে। গুড। এসো।
সুচরিতা উঠলেন। খাবারগুলোকে হটবক্সে রাখতে হবে।
সুস্নাত জিজ্ঞাসা করলেন, কী বলল?
আমি থাকব না বলে আসতে চাইছিল না। এখন আসছে।
তুমি চলে যাচ্ছ জেনেও আসছে?
আমি চলে যাচ্ছি কে বলল? যাচ্ছি না।
ও!
ছেলেমেয়ে কষ্ট করে বিদেশে রোজগার করে, সেই টাকায় কেনা খাবার ফেলে দিতে তো পারি না। তা ছাড়া ননদের মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ হচ্ছে, বাড়ির বউ হিসেবে না হয় একটা কর্তব্য করা যাক।
কিন্তু রান্নাবান্না–এত লোকের।
সবাই তো তোমার মতো অকর্মার ঢেঁকি নয়। এই খাবারে আজ চলে যাবে, কাল থেকে ইতি নিজেই রান্নাঘরে ঢুকবে। সমস্যার যখন সমাধান হয়ে যাচ্ছে তখন বাইরে যাওয়ার দরকার কি! খাবারগুলো হটবক্সে ফেলতে-ফেলতে বললেন সুচরিতা।
নিজের ঘরে চলে এলেন সুন্নত। তাঁর সিদ্ধান্ত হল, যমুনা না ফেরা পর্যন্ত যে করেই হোক ইতিকে এখানে আটকে রাখতে হবে। যৌবনে একান্নবর্তী বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন, একের-পর এক জায়গা বদল করেছেন, কিন্তু এখন আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। এখন শুধু অন্ধকারের সঙ্গে লড়াই করে যাওয়া, যে কটা দিন পারা যায়।
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন