শিরোনাম: গল্প হলেও সত্যি – অষ্টম পর্ব
গল্পকার: শংকর ব্রহ্ম
গল্প হলেও সত্যি – অষ্টম পর্ব
অষ্টম পর্ব
শূন্য থেকে শুরু
(মনোরঞ্জন ব্যাপারি)
শংকর ব্রহ্ম
তিনি এক সময় তার আগে মুটে-মুজুরি করেছেন। চায়ের দোকানে কাপ গ্লাস ধোওয়ার কাজ করেছেন। খিদের জ্বালাল ডাষ্টবিনে ফেলে দেওয়া রুটির টুকরো, কুকুরের আগে ছুটে গিয়ে, কুকুর মুখে নেওয়ার আগেই নিজে তুলে নিয়ে খেয়েছেন। মারপিট করে জেলে গেছেন, সেখানে একমাস দেড়মাস নিশ্চিন্তে খাবার জুটবে বলে। তখন ছিল তার না খাওয়া শীর্ণকায়, চোখ কোটরে বসে যাওয়া, গালের হনু বেরিয়ে আসা, দুর্বল শরীর। তার দ্বারা কোন ভারী তাজ করানো যাবে না বুঝে, তাকে জেলের ভিতরে ‘ফালতু’-র কাজ করানো হতো।
এইভাবে একদিন মদ খেয়ে এক দোকানদারের সঙ্গে মারপিট করার ফলে তার দীর্ঘকাল কারাবাস হয়ে যায়। ওই কারাবাসের সময়ই, তিনি মেঝেটে ইঁটের টুকনো দিয়ে অ আ ক খ লিখতে শেখেন। এরপর যখন কারাবাস শেষ করে বেরিয়ে আসেন। তারপর শুরু করেন যাদবপুর স্ট্যাশনে রিক্সা চালাবার কাজ। যাদবপুর স্টেশনেই শুয়ে থাকতেন তিনি। সেখানে নিজের আগ্রহেই নানারকম বই পড়া শুরু করেছিলেন। এই সময় একদিন সৌভাগ্যক্রমে মহাশ্বেতা দেবীর সাথে পরিচয় হয়। মহাশ্বেতা দেবী তাকে তার পত্রিকা ‘বার্তিকা’-য় তার অভিজ্ঞতার কথা লেখার জন্য আমন্ত্রণ জানান। ‘বর্তিকা’-য় লিখে তিনি বিশিষ্টতা অর্জন করেন। সেই লেখা ইংরেজীতে অনুবাদ হয়ে বিশিষ্ট জনের কাছে পৌঁছে যায়।
শ্রমিক কর্মী শঙ্কর গুহ নিয়োগীর সাথে তার ঘনিষ্ঠতাও লক্ষণীয় বিষয়।
মনোরঞ্জন ব্যাপারির জন্ম তুরুক-খালী, পিরোজপুর , বরিশাল , পূর্ববঙ্গে এক নমশূদ্র পরিবারে।
তাদের পদবী আসলে ব্যাপারি নয়, মন্ডল ছিল।
তিনি কোনদিন স্কুলে পড়ার সুযোগ পাননি। অথচ তার লেখা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। তার লেখা পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হওয়া, সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
তার পরিবার পশ্চিমবঙ্গে স্থানান্তরিত যখন তার বয়স তিন বছর। প্রথমে বাঁকুড়ার শিরোমণিপুর শরণার্থী শিবিরে। তারপর, তারা ঘুটিয়ারী শরীফ , দক্ষিণ ২৪ পরগণার ঘোলাদোলতলা শরণার্থী শিবির সহ বিভিন্ন স্থানে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য করা হয়, সেখানে তারা ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত বসবাস করেছিল।
চৌদ্দ বছর বয়সে, তিনি তার পারিবারিক আবাস ছেড়ে অর্থ উপার্জনে তাগিদে বেরিয়ে পড়েন। কাজের সূত্রে ঘোরেন অসম, লখনউ, দিল্লি এবং এলাহাবাদের মতো বিভিন্ন শহরে।
দণ্ডকারণ্যে দুই বছর থাকর পর, তিনি ১৯৭৩ সালে কলকাতায় ফিরে আসেন। সেখানে একজনের পরামর্শে ঘুষিকাটা বাজার থেকে মাছ কিনে এনে, বাঘাযতিনে পাইকারি দরে বেচেছেন। পরের দিন মাছ আনার সময় গাড়ির এক্সেলেটার খারাপ হওয়ার জন্য, তা মল্লিক বাজার থেকে কিনে এনে লাগাতে দেরি হওয়ায় সব মাছ পচে গিয়ে সেই ব্যবসা লাটে ওঠে।
তিনি মধ্য ভারতে থাকার সময় নকশালদের সাথে সাময়িকভাবে যুক্ত হন। তিনি বিয়ে করেছেন। তার স্ত্রীর নাম – অনিতা ব্যাপারি। তাদের দুই সন্তান আছে।
বর্তমানে তিনি একজন রাজনীতিবিদ, লেখক, সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মী। বর্তমানে তিনি বলাগড়ের বিধায়ক। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য থেকে আগত বাংলায় দলিত সাহিত্যের ক্ষেত্রে অগ্রগামী লেখকদের একজন। আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে, তিনি আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাননি। নিজের উদ্যোগে তিনি পড়াশুনা শিখেছেন। একসময় তিনি দোষী রিকশাচালক হিসাবে জেল খেটেছেন। বর্তমানে তিনি শতাধিক ছোট গল্প এবং নন-ফিকশন প্রবন্ধ ছাড়াও বারোটি উপন্যাস সহ উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন।
তিনি ২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে অল ইন্ডিয়া তৃণমূল কংগ্রেসের (AITC) প্রতিনিধিত্ব করে বলাগড় বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বিধানসভার সদস্য (এমএলএ) হিসাবে, নির্বাচনে জয় লাভ করেছিলেন ।
“বাংলায় কি দলিত লেখা আছে?” শিরোনামে তার প্রভাবশালী প্রবন্ধ প্রকাশের পর তিনি বিশিষ্টতা অর্জন করেন। যেটি মীনাক্ষী মুখার্জি অনুবাদ করেছিলেন এবং ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলিতে প্রকাশিত হয়েছিল। তার পাণ্ডিত্যপূর্ণ অবদানের মধ্যে, তিনি এই মতবাদ পোষণ করেন যে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উচ্চবর্ণের উদ্বাস্তুদের কলকাতায় পুনর্বাসনের সময় অগ্রাধিকারমূলক আচরণ করা হয়েছিল। তদুপরি, তার জীবনের বর্ণনামূলক একটি তথ্যচিত্র রাজ্যসভা টিভি তৈরি করেছে।
(তার বই)
তিনি বাংলায় “ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন” শিরোনামের একটি স্মৃতিকথা লিখেছেন , যা পরবর্তীতে শিপ্রা মুখার্জি দ্বারা “ইন্টারোগেটিং মাই চন্ডাল লাইফ: অ্যান অটোবায়োগ্রাফি অফ আ দলিত” (ঋষি-সাম্য) শিরোনামে ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছিল এবং এটি হিন্দু পুরস্কার লাভ করে। এই সাহিত্যকর্মটি বাংলায় দলিতদের নিপীড়ন এবং প্রান্তিকতার অগণিত অভিজ্ঞতার নথিভুক্ত করে, একটি অঞ্চল যা প্রায়ই প্রচলিত ভদ্রলোক আখ্যান দ্বারা ‘বর্ণহীন সমাজ’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। একজন দলিত হিসাবে তার পরিচয় তার সাহিত্যিক অভিব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অংশ, যেখানে তিনি জোর দিয়েছিলেন, “আমি জন্মগতভাবে একজন দলিত। শুধুমাত্র একজন দলিত, সামাজিক শক্তি দ্বারা নিপীড়িত, জীবনে প্রকৃত দালান (নিপীড়ন) অনুভব করতে পারে। দলিত সাহিত্যে দলিত হিসেবে আমার কিছু লেখা দলিত জীবনকে কেন্দ্র করে, নিরপেক্ষ মূল্যায়নের যোগ্য। তিনি জন্মসূত্রে এবং ক্রোধের (ক্রোধ চণ্ডাল) প্রকাশের মাধ্যমে চন্ডাল হিসেবে তার দ্বৈত পরিচয় প্রকাশ করেন।
তার প্রাপ্ত পুরস্কার
২০১৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি কর্তৃক সুপ্রভা মজুমদার পুরস্কার প্রদান করা হয়।
২০১৫ সালে শর্মিলা ঘোষ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।
২০১৯ সালে নন-ফিকশনে হিন্দু সাহিত্য পুরস্কার।
২০২৩ সালে শক্তি ভাট পুরস্কার।
২০২৩ সালে সাহিত্যের জন্য JCB পুরস্কার , তাঁর বই দ্য নেমেসিস সাহিত্যের জন্য JCB পুরস্কারের জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত হয়েছিল।
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন