শিরোনাম: বেদনার বালুচরে
গল্পকার: শংকর ব্রহ্ম
বেদনার বালুচরে
শংকর ব্রহ্ম
বাস্তবতা অনেক সময় কল্পনাকেও হার মানায়। এটা এমনই বাস্তবের এক মর্মান্তিক করুণ কাহিনী। গল্প হলেও সত্যি।
নজরুলের জীবনের শেষ চৌত্রিশবছর ছিল মর্মান্তিক । অনেক অবহেলা আর বঞ্চনার শিকার হয়েছিলেন তিনি।
১৯৪২এর ৯ই আগষ্ট থেকেই কবি অসুস্থ হয়ে পড়েন । তখন তিনি আক্ষরিক অর্থেই কপর্দকশূন্য । সংসারে দুই শিশুপুত্র , পক্ষাঘাতগ্রস্ত স্ত্রীপ্রমীলা , শাশুড়ি গিরিবালা । ১৭০০ গানের রেকর্ডে লক্ষ লক্ষ টাকা মুনাফার করেও গ্রামোফোন কোম্পানী তার কোন রয়ালটি দেননি ,তাঁর লেখার প্রকাশকরা ফিরেও তাকাননি।
কবির অসুস্থতার কারণ,‘নবযুগ’ সম্পাদনা কালে একবার কবি উত্তরপাড়ার এক অনুষ্ঠান থেকে ফেরার সময় , একদল দুষ্কৃতিদের দ্বারা প্রহৃত হয়েছিলেন,তাঁর ঘাড়ে ও মাথায় কঠিন আঘাত লাগে। নির্বাক কবি যখন বাংলাদেশে (১৯৭২), তাঁর চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেলবোর্ড, কবির ঘাড়ের পুরাতন কঠিন আঘাতের চিহ্নটি সনাক্ত করেছিলেন ।
তার একবন্ধু জুলফিকার হায়দার খবরের কাগজে প্রচার করে দেন নজরুল ‘উন্মাদ’ হয়ে গেছেন ।
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের আর্থিক সহায়তায় কবিকে স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য মধুপুর পাঠানো হল ১৯৪২-এর ১৯ শে জুলাই , কিন্তু অর্থ শেষ হয়ে যাবার পর কলকাতায় ফিরিয়ে আনা হয় ২১শে সেপ্টেম্বর । ১৯৪৪-এর ২৪শে মে আনন্দবাজার পত্রিকার ‘কবি নজরুল পীড়িত’ শিরোনামে একটি আবেদন প্রচারিত হয়।
এরপর কয়েকটি সাহায্য সমিতি গঠিত হয় । কলকাতার সুখ্যাত চিকিৎসকেরা কবিকে দেখেন একাধিকবার , কিন্তু নিরাময়ের কোন লক্ষণ দেখা যায় না । কবি কাজী আবদুল ওদুদের উদ্যোগে গঠিত ‘নজরুল নিরাময় সমিতি’র উদ্যোগে কবিকে রাঁচির মানসিক চিকিৎসালয়ে পাঠানো হয় ১৯৫২র ২৫শে জুলাই । কিন্তু চারমাস চিকিৎসাধীন থেকেও তাঁর কোন উন্নতি না হওয়ায় ফিরিয়ে আনা হয় কলকাতায় । পরের বছর ১০ই মে ১৯৫৩ কবিকে নিয়ে যাওয়া হয় লন্ডনে। সেখানকার চিকিৎসকেরা মতপ্রকাশ করেন যে কবির ব্রেন কুঁকড়ে গেছে অর্থাৎ মষ্টিস্কের সংকোচন হয়েছে । লন্ডন থেকে ১০ই ডিসেম্বর নজরুলকে নিয়ে যাওয়া হয় ভিয়েনায় । সেখানেও চিকিৎসকের অভিমত ছিল কবিকে আর সুস্থ করে তোলা যাবে না । এরপরেও পূর্ব জার্মানীর বন বিশ্বিবিদ্যালয়ের ছাত্ররা এক রুশ ডাক্তারকে দিয়ে পরীক্ষা করিয়েছিলেন । তাঁর অভিমত ছিল যে অনেক দেরি করে রোগীকে আনা হয়েছে। সাতমাস বিদেশে বৃথা চেষ্টার পর কবিকে ফিরিয়ে আনা হয় কলকাতায় ১৯৫৩-র ১৪ই ডিসেম্বর ।
এর পরেও তেইশ বছর জীবিত ছিলেন নজরুল। অভাবের তাড়না, মানসিক কষ্ট দ, নিঃসঙ্গতা, পরিচিত বন্ধুদের দূরে চলে যাওয়া , অবহেলা এসবই ছিল কবির শেষ জীবনের সঙ্গী । পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক বিনা ভাড়ায় থাকার জন্য ফ্ল্যাটের বন্দোবস্ত ও দুইবাংলা থেকেই লিটারারি পেনশনের ব্যবস্থা হওয়ার পর কিছুটা স্বস্তি এসেছিল । ১৯৬২র ২৩শে জুন স্ত্রী প্রমীলার দেহাবসান পর, কবি আরও ভঙে পড়েন।
জীবনের শেষ চারটি বছর কবি বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদায় তাঁর প্রাপ্য সমাদর পেয়েছিলেন । মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় কবিকে সমাহিত করেন বাংলাদেশ সরকার। তারাই মৃত্যুর পর তাঁকে ‘জাতীয় কবি’ হিসাবে সম্মানিত করে কবিকে যোগ্য মর্যদা দিয়েছেন।
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন