সমরেশ-মজুমদারের-গল্প-গুচ্ছ-সমরেশের-সেরা-১০১-গল্প.

শিরোনাম: ভিত মজবুত

গল্পকার: Author Avatar সমরেশ মজুমদার

এখনও এই পরিবারের সদস্যসংখ্যা আঠারো। কাজের লোকদের ধরলে রোজ বিয়াল্লিশজন দুবেলা ভাত-তরকারি মাছের ঝোল খায়। সপ্তাহে একদিন, রবিবার সকালে, প্রত্যেকের জন্য লুচি বেগুনভাজা এবং তরকারি বরাদ্দ থাকে। অন্যদিন যে যার ঘরে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে নেয়। এই ঝামেলা থাকলে অফিসের ভাত ঠিক সময়ে নামবে না, পাড়ার লোক তো বটেই, তিনটি টিভি চ্যানেল এসেছিল অবাক হয়ে। এখনও এই দু-হাজার ছয় সালে এতবড় একান্নবর্তী পরিবার কী করে চলছে? কী করে এত লোকের জায়গা হচ্ছে? খেয়োখেয়ি হচ্ছে না, কাকপক্ষী বসছে, কেমন করে? বড়কর্তা, ভবতোষ, যাঁর বয়েস পঁচাত্তর, চোখ বন্ধ করে হাসেন, দূরদৃষ্টি! আমার পিতামহ ভবিষ্যৎ দেখতে পেতেন। খোদ কলকাতার বুকে তখন পনেরো কাঠা জমি কেনা এমন কোনও সমস্যা ছিল না। কিন্তু তিনি তখনই বাড়ির যে প্ল্যান স্যাংশন করিয়ে রেখেছিলেন যে আজ পর্যন্ত আমাদের কোনও সমস্যা হচ্ছে না।

‘কীরকম?’

‘প্রথমে এই বাড়িটা তৈরি হয়েছিল ছয়টি ঘর নিয়ে। কিন্তু প্ল্যান করা হয়েছিল চব্বিশটার। চারতলা। এখন অবধি আমাদের পরিবারের ইউনিট পাঁচটি। আমরা চারতলা বানিয়ে নিয়েছি। ইউনিট পিছু চারটে ঘরের পরে যেগুলো খালি থাকছে তাতে অন্য কাজ হয়েও থাকছে।’ ভবতোষ বললেন।

‘এই যে এত বড় সংসার, খাওয়াদাওয়া, অন্যান্য খরচ, পাঁচটি ইউনিট ঠিক সমানভাবে টাকা দিচ্ছে?’ কৌতূহলী প্রশ্ন।

‘প্রত্যেক ইউনিটকে পাঁচ হাজার করে মাসে দিতে হয়।’ ভবতোষের উত্তর, ‘সারা মাসে কুড়ি হাজার টাকায় চলে যায় এত বড় পরিবারের খরচ?’

‘তা কি যায়?’ ভবতোষ নির্বিকার, ‘পিতামত, পিতা রোজগার করে যা রেখে গেছেন তাতে সুদ আসে। শেয়ার কিনেছিলেন, তা থেকে ডিভিডেন্ড পাওয়া যায়। তাছাড়া এদিক-ওদিক থেকেও কিছু টাকা আয় হয়। সবমিলিয়ে আগামী পঞ্চাশ বছর দিব্যি চলে যাবে আমাদের।’

‘পার্সোনাল খরচ?’

‘ওই পাঁচ হাজার দেওয়ার পরে যে-যার মতো। পাঁচটা গাড়ি আছে আমাদের। পাঁচ ইউনিটের জন্যে। ই এম আই মাসে ছ-হাজার টাকা। দু-হাজার ইউনিটকে দিতে হয় বাকি চার হাজার ফান্ড থেকে।’

কেউ যদি আলাদা হতে চায়?গল্পে যেমন জায়ে-জায়ে ঝগড়া করে আলাদা হয়ে যায়। তাহলে?

‘পাগল! আলাদা হলে পাঁচ গুণ খরচ বেড়ে যাবে। কেউ বোকা নয়।’

এই বাড়িতে এখন বিবাহযোগ্যা কোনও মেয়ে নেই। শেষ মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে পাঁচ বছর আগে। সে ছিল মেজকর্তা সন্তোষের মেয়ে। তারপর শুধুই ছেলে। এই নিয়ে পাঁচ বউ-এর বেশ হা-হুতাশ আছে। ভবতোষের নাতনির বয়েস সাত। সে-ই এখন একমাত্র মেয়ে। তাকে নিয়েই সবার সাধ-আহ্লাদ। সেজছেলে প্রিয়তোষের কোনও সন্তান নেই। চতুর্থ মনোতোষ বছর আটেক আগে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। তাঁর স্ত্রী এবং সন্তান এখানে থাকেন। ছোটছেলে অনুতোষ তিন। সন্তানের পিতা। সবাই বিবাহিত এবং পুত্রসন্তানের জনক। লোকে বলে দেশে যখন মেয়েদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে তখন ওই বাড়িতে শুধু ছেলে জন্মাচ্ছে। ছেলে মানে ক্যাপিটাল আর মেয়ে। হওয়া মানে লায়াবিলিটি বাড়া। বিয়ে দিতে হাত খালি। কিন্তু যাদের নিয়ে এত কথা তারা চাইছে মেয়ে আসুক। বাড়িটার শ্রীবৃদ্ধি হবে তাহলে।

মনোতোষের ছেলে বিশ্বতোষ ছাত্র হিসেবে ভালো ছিল। একবারে চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি করেছে। এখনই বড় ফার্মে চাকরি করছে। বয়েস পঁচিশের নিচে। বাবা নেই বলে এই পরিবারের সবাই ওর প্রতি একটু বেশি স্নেহশীল। বিশ্বতোষের মা শ্রাবণী একটু শান্ত প্রকৃতির। এক দুপুরে তার জায়েরা খাওয়ার টেবিলে বসে কথাটা তুলল। এবার বিশ্বতোষের বিয়ে দেওয়া দরকার। বাড়িতে ওই বয়েসের মেয়ে নেই কিন্তু বাইরে থেকে তো আনা যেতে পারে। নতুবা বউ এলে খাঁ-খাঁ ভাবটা দূর হয়ে যাবে।

‘শ্রাবণী মাথা নাড়ল, আমি একবার বলেছিলাম, ও রাজি হয়নি।’

‘কী বলে?’ বড়বউ জিজ্ঞাসা করলেন।

‘উন্মাদ না হলে কেউ বিয়ে করে।’

‘বা।’ মেজবউ ফুট কাটলেন, তাহলে ওর জেঠা-বাবা-কাকা সব উন্মাদ। শ্রাবণী বলল, ‘কী বলব আমি?’

বড়বউ বলল, ‘তোমাকে কিছু বলতে হবে না। যা বলার বলব আমরা।’

সেই সন্ধেয় অফিস থেকে ফিরে জলখাবার খেয়ে যখন বিশ্বতোষ বিশ্রাম করছে তখন ভবতোষের নাতনি গিয়ে তাকে খবর দিল।

একটু অবাক হল সে। বড়বউ-এর ঘরে গিয়ে দেখল সেখানে তিন কাকিমা এবং জেঠিমার সঙ্গে মা-ও বসে আছে।

বড়বউ বলল, ‘এখানে বসো।’

বিশ্বতোষ বসল। বড়বউ জিজ্ঞাসা করল, ‘তোর এত বড় আস্পর্দা হয় কী করে?’

‘কেন? আমি কী করলাম?’ হতভম্ব বিশ্বতোষ।

‘কী করলাম?’ মেজবউ চোখ পাকাল।

‘তুমি আমাদের পাগলের বউ বলেছ!’

‘আমি? তোমাদের। কখনও না!’

‘ফের মিথ্যে কথা।’ বড়বউ বললেন, তুই তোর জ্যাঠা-বাবা-কাকাকে পাগল বলিসনি? একথা শুনলে ওদের মনের অবস্থা কী হবে? ওরা পাগল হলে তো আমরা পাগলের বউ ছাড়া আর কী!’

‘তোমরা কী বলছ আমার মাথায় ঢুকছে না।’ বেশ জোরে বলল বিশ্বতোষ।

‘ঢুকছেনা?’ কাকিমা বলল, ‘তুমি বলনি, উন্মাদ না হলে কেউ বিয়ে করে? কী, বলনি একথা?’

বিশ্বতোষ মায়ের দিকে তাকাল। শ্রাবণীর মুখ স্থির।

‘ওকথা আর একথা এক হল!’ বিশ্বতোষ প্রতিবাদ করল,

‘আলবত এক।’ বড়বউ বলল, ‘এত খারাপ কথা তুই বললি কী করে?’

‘তোকে এই অন্যায়ের জন্যে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।’

‘বেশ। কী করতে হবে বলো’–বিশ্বতোষ মিনমিন করে বলল।

‘তিনমাসের মধ্যে বিয়ে করতে হবে।’

‘বিয়ে?’ চোখ বড় করল বিশ্বতোষ, ‘অসম্ভব। আমাকে এক বছরের জন্যে হায়দ্রাবাদ-ব্যাঙ্গালোর করতে হতে পারে। তা ছাড়া–।’

‘তুমি যেখানে ইচ্ছে যাও, বউ আমাদের কাছে থাকবে।’ মেজবউ রায় দিলেন, ‘কোনও কথা শুনছি না।’

‘কী বলি–।’

‘কিছু বলতে হবে না। আমরা মেয়ে দেখছি।’ বড়বউ বললেন, ‘হ্যাঁ, তোর কোনও বক্তব্য থাকলে বল, কীরকম বউ চাস?’

‘আমি জানি না।’ বিশ্বতোষ উঠে বেরিয়ে যেতেই বউরা হেসে উঠলেন। শ্রাবণীও।

খোঁজ-খোঁজ। বউ চাই। চার বউ তো বটেই, শ্রাবণীর বাপের বাড়িতেও খবর পৌঁছে দেওয়া হল। কুড়ি-একুশের মধ্যে সুন্দরী, মার্জিত স্বভাবের পাত্রী চাই। সম্বন্ধ আসতে দেরি হল না। এখন রোজ দুপুরে বউরা ভাবী পাত্রীদের ছবি নিয়ে বসেন। কিন্তু একটা না একটা খুঁত চোখে পড়ছেই। কারও চোখ ছোট তো কারও গোরুর মতো বড়। কারও মুখ একটু চৌকোনা। কারও গলা নেই, কাঁধের ওপর মুখ বসানো। এরা সবাই দূর-সম্পর্কের আত্মীয়দের মেয়ে। তা হোক, তবু জেনেশুনে অন্ধ হতে পারবে না ওরা। মেজবউ-এর বউদির মাসতুতো বোন দিল্লিতে থাকে, তার মেয়ের ছবি এল। বেশ সুন্দরী। মোমের মতো গায়ের রং। কিন্তু। বউরা পরস্পরের দিকে। তাকাল। মেজবউ জিজ্ঞাসা করল, ‘দিদি, বলুন!

‘কী বলব। তোমরা সবাই যা বলবে তাই হবে।’

সেজ বলল, ‘সালোয়ার-কামিজ পরে আছে কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।’

মেজবউ বলল, ‘আমি তো দেখিনি কখনও। বড্ড ভারী বুক। নাঃ, থাক।’

ছোটভাই অনুতোষ পরামর্শ দিল, ‘খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দাও। তা ছাড়া ম্যারেজ ডটকমে খোঁজ করলে ভালো মেয়ে পাওয়া যেতে পারে।’

ছোটবউ বলল, ‘আচ্ছা ছেলে। একটা ভালো মেয়ের সঙ্গে প্রেম করতে পারল না!’

দিনটা ছিল কাজের। বিজ্ঞাপনের জবাবে যেসব চিঠি এবং ছবি এসেছে তাই নিয়ে বসেছিল ওরা।

হঠাৎ একটা ছবিতে পাঁচজনের চোখ আটকাল। আহা! কী ঢলোঢলো মুখ, নাক, ঠোঁট, চুল, সব সুন্দর। ছোটবউ বলল, ‘বেঁটে হবে বলে মনে হচ্ছে।’

‘ছবিতে কী করে বোঝা যাবে। কোথায় থাকে? কলকাতার মধ্যে?’ বড়বউ একটু খুশি হয়ে জিজ্ঞাসা করল।

মেজবউ চিঠির ঠিকানা দেখে অবাক, ‘ওমা, এ যে আমাদের পাড়ার মেয়ে। বায়োডাটা পাঠিয়েছে, কোনও চিঠি লেখেনি।’

‘সে কী?’ বড়বউ অবাক, ‘দেখি, দেখি।’

সত্যি তাই। মেয়ের নাম অঞ্জনা। ইকনমিক্সে অনার্স নিয়ে এখন এম.বি.এ পড়ছে। বাবা দিল্লিতে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে আছেন। মা, দিদিমা এবং বোনকে নিয়ে সে কলকাতায় থাকে। বাবার বদলির চাকরি। টেলিফোন নাম্বার, ঠিকানা দেওয়া আছে কাগজে।

শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হল অঞ্জনার মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত। কিন্তু ভদ্রমহিলা চিঠি না লিখে এরকম বায়োডাটা কেন পাঠিয়ে দিলেন তা ওরা বুঝতে পারছিল না।

সঙ্গে-সঙ্গে ছোটবউ ফোনের বোতাম টিপল। রিং হচ্ছে।

‘নমস্কার। আমি অঞ্জনার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চাই।’

‘বলছি।’

‘ও। আমি, মানে, আমরা কাগজে বিজ্ঞাপনটা দিয়েছিলাম।’

‘কীসের বিজ্ঞাপন?

‘পাত্রী চাই কলমে বিজ্ঞাপন, যার জন্যে আপনি অঞ্জনার ছবি আর বায়োডাটা পাঠিয়েছেন।’ ছোটবউ বিরক্ত হল। বড়বউ ইশারা করল, যেন শান্ত হয়ে কথা বলে। অঞ্জনার মা বললেন, ‘দেখুন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি কাউকে ওসব পাঠাইনি।’

‘পাঠাননি? তাহলে এটা কী? আপনার স্বামী দিল্লিতে থাকেন না?’

‘হ্যাঁ’ ভদ্রমহিলা অবাক।

‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে আছেন তো?’

‘হ্যাঁ।’

‘কলকাতায় আপনি মা আর দুই মেয়েকে নিয়ে থাকেন?’

‘এসব তো সবার জানা। কিন্তু আমি আপনাকে কোনও কিছুই পাঠাইনি।’

ছোটবউ অন্যদের দিকে তাকাল, ‘অদ্ভুত ব্যাপার, অঞ্জনার মা বলছেন উনি কিছুই পাঠাননি। তাহলে এটা এল কী করে?’

বড়বউ বললেন, ‘ব্যাপারটা খুলে বল।’

ছোটবউ মাথা নাড়ল, ‘শুনুন, আমাদের বাড়ির ছেলের জন্যে পাত্রী চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। ছেলে চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, অল্প বয়েস, ভালো চাকরি করে। তার জবাবে যেসব চিঠি এসেছে তার মধ্যে আপনার মেয়ে অঞ্জনার ছবি এবং বায়োডাটা আছে। ওর ছবি দেখে পছন্দ হওয়াতে আমি এই ফোনটা করেছি। আমি ছেলের মেজজেঠিমা।’

‘এতক্ষণে বুঝলাম। বিশ্বাস করুন আমি কিছুই জানি না। আপনারা কোথায় থাকেন?’

‘আপনার বাড়ি থেকে বড়জোর দশ-বারো মিনিট দূরে।’ ছোটবউ গর্বের হাসি হাসল, ‘আমাদের বাড়ির কথা সবাই জানে।’

‘কেন? মানে–।’

‘একমাত্র একান্নবর্তী বাড়ি। এই সময়ে এরকম বাড়ি আর খুঁজে পাবেন না।’

‘ওমা। তাই বলুন। আপনি বিশ্বতোষের জেঠিমা।’

যেন জিভ কামড়াল ছোটবউ, ‘সে কী! আ-আ-আপনি বিশু, বিশ্বতোষকে চেনেন?’

‘কেন চিনব না? মাঝে-মাঝেই আমাদের বাড়িতে আসে, গল্প করে যায়। আপনারা ওর তিন জেঠিমা আর এক কাকিমা, সবাই মায়ের মতো। খুব বলে।’

‘অ।’

‘কিন্তু কে পাঠাল ওসব। কিছু মনে করবেন না ভাই। আমি খোঁজ নিয়ে আপনাকে জানাচ্ছি!’

টেলিফোনের লাইন কেটে গেল।

ছোটবউ-এর মুখের অবস্থা দেখে সবাই চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। শ্রাবণী জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে?’

ছোটবউ বলল, ‘কী কাণ্ড! আমরা কিছুই জানি না।’

‘কী হয়েছে বলবি তো?’ বড়বউ ঝাঁঝিয়ে উঠল।

‘বিশু ওদের বাড়িতে প্রায়ই যায়।’

‘সে কী!’ চারটি গলা থেকেই একটি শব্দ ছিটকে উঠল।

‘শুধু যায় না, বসে গল্প করে, আমাদের কথাও বলেছে।’

বড়বউ বলল, ‘আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। যে ছেলে সাতসকালে অফিসে গিয়ে সন্ধের পরে বাড়ি ফেরে, তার ওসব জায়গায় যাওয়ার সময় কোথায়?’

মেজবউ বলল, ‘তার মধ্যে সময় বের করে নেয়। ওরকম সুন্দরী মেয়ে। তুমি তো ওকে পেটে ধরেছিলে, তুমি জানো না কিছু?

শ্রাবণী মাথা নাড়ল, ‘না। বিন্দুবিসর্গ না।’

ছোট বলল, ‘তাহলে বোঝো! বিয়ে উন্মাদে করে! উঁ! তলে-তলে কত জল। ওই ছবি, বায়োডাটা ওই মেয়েটাকে দিয়ে পাঠিয়েছে।’

‘ওকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। অনুমানে সিন্ধান্ত নেওয়া ঠিক নয়।’ বড়বউ মাথা নাড়ল, ‘হয়তো একদিন গিয়েছিল, তাই রোজ বলে চালাচ্ছে ওরা।’

মেজবউ শ্রাবণীকে বলল, ‘এখনই ফোন কর ওকে।’

সেজবউ বলল, ‘না-না। ও এখন অফিসে। বাড়ি ফিরুক, তারপর।

কিন্তু তার আগেই ফোন এল।

ফোনটা ধরল ছোটবউ, ‘হ্যালো।’

ওপাশে একটু চুপচাপ। ছোটবউ গলা তুলল, ‘কে ফোন করছেন?’

‘আমি।’ মিষ্টি কিন্তু গলায় কাঁপুনি।

‘কে?’

‘আমার নাম অঞ্জনা।’

‘ওমা! ফোনের মুখ চাপা দিল ছোটবউ, ‘ওই মেয়েটাই ফোন করছে।’

চার বউ বিচলিত। বড়বউ বলল, ‘আমাকে দাও তো।’

মেজবউ-এর ইচ্ছে ছিল না, তবু রিসিভার এগিয়ে দিল।

বড়বউ বলল, ‘হ্যাঁ, বলো, কাকে চাই!’

‘না, মানে, ঠিক কাউকে,–কী যে বলি।

‘যা বলতে চাও তা গুছিয়ে বলো।’

‘মা আমাকে খুব বকছেন। মা কিছুই জানেন না।’

‘তাহলে তুমিই পাঠিয়েছ?”

‘হ্যাঁ।’

‘তুমি দেখছি খুব বেহায়া মেয়ে!’

‘না না। আমি বাধ্য হয়েছি, বিশ্বাস করুন।’

‘বাধ্য হয়েছ মানে?’

‘আপনারা, আপনারা ওর বিয়ের সম্বন্ধ করছেন অথচ ও আমার কথা আপনাদের বলতে পারছে না। তাই ভাবলাম যদি ছবি পাঠালে কাজ হয়।’

‘ওর সঙ্গে কতদিনের সম্পর্ক?”

‘ঠিক সম্পর্ক নয়।’

‘তবে?’

‘আমার খুব ভালো লাগে। আমি আর কারও কথা ভাবতে পারি না।’

‘ও জানে?’

‘জানত না, শোনার পর আমি বলে ফেলেছি।’

‘শুনে কী বলল?

‘বলল, সর্বনাশ। আপনাদের বাড়িতে সম্বন্ধ না করে বিয়ে হয় না। আমি কী করব ভেবে না পেয়ে চিঠি আর বায়োডাটা পাঠালাম।’ অঞ্জনা বলল।

‘তুমি এখন কি বাড়িতে আছ?

‘হ্যাঁ।’

‘দশ মিনিটের মধ্যে আমাদের বাড়িতে চলে এসো।’

‘মানে?’

‘ভয় পেয়ো না। তোমাকে আমরা বকব না। যা পরে আছ তাই পরেই আসবে। সাজগোজ করার কোনও দরকার নেই।’ ফোন রেখে দিলেন বড়বউ। অঞ্জনার কথাগুলো জা-দের জানিয়ে বললেন, ‘সামনাসামনি দেখাই ভালো।’

শ্রাবণী বলল, ‘ওর সঙ্গে বিশুর–’

‘বিশুর দিকে দিয়ে কিছু হয়নি, যা হওয়ার ওর দিক থেকে হয়েছে।’

ছোটবউ বলল, ‘তাহলে তো বলতে হবে এই মেয়েটা হ্যাংলামি করেছে। মা-বাবা জানল না, নিজের বিয়ের জন্যে নিজেই উদ্যোগ নিয়েছে।’

আলোচনায় যেসব মতামত পাওয়া যাচ্ছিল তা অঞ্জনার পক্ষে যাচ্ছিল না। এই সময় কাজের মেয়ে এসে বলল, ‘একজন মেয়ে দেখা করতে এসেছে।’

‘এখানে নিয়ে আয়।’ কাজের মেয়ে চলে গেল।

মেজবউ বলল, ‘দিদি, তুমি যেন বেশি উদার হয়ো না।’

‘না-না।’ মাথা নাড়ল বড়বউ।

যে এল তার দিকে কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ তাকিয়ে থাকল পাঁচ বউ। পরনে জিনসের ওপর কাজ করা টপ, চুল কাঁধের নিচে নেমেই থেমেছে। বেঁটে নয় এবং মুখ খুব সুন্দর। বড়বউ বললেন, ‘বসো।’ মেয়ে বসল।

মেজবউ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কি বাড়িতে প্যান্ট পরে ছিলে।’

‘হ্যাঁ।’ মাথা নড়ল সামান্য।

‘সে কী! বাঙালি বাড়ির মেয়ে–।’

‘কী করব! আমি তো সালোয়ার-কামিজ পরতাম। ও বলল, ওসব এখন ব্যাকডেটেড। তা ছাড়া আপনারা নাকি প্যান্ট খুব পছন্দ করেন। আমাকে তাই সবসময়ে প্যান্ট পরা অভ্যেস করতে হবে।’

‘অ্যাঁ! পাঁচ বউয়ের চোখ বড় হল।

‘সত্যি বলছ?’ বড়বউ ধমকালেন।

‘ওমা, মিথ্যে বলব কেন?’

মেজবউ বললেন, ‘তুমি যা করছ তাকে হ্যাংলামি বলে, জানো?’

‘আমি করতে চাইনি, ও আমাকে করতে বলেছে।’

মেজবউ বলল, ‘মিথ্যে কথা। তুমি তো বলেছ, ওর দিক থেকে কিছু নেই, যা আছে, তা তোমার দিক থেকে। তাহলে ও বলবে কেন?

‘আমায় বলল, আমি এসবের মধ্যে নেই। যদি ওঁরা পছন্দ করেন তবে তুমি আমাদের বাড়িতে ঢুকতে পারবে। অ্যাপ্লিকেশন পাঠিয়ে দ্যাখো।’অঞ্জনা বলল।

কাকিমা বলল, ‘আর শোনামাত্র তুমি পাঠিয়ে দিলে! কেন? তোমার সম্মান নেই।’

হাত তুললেন বড়বউ, ‘শোনো, আমাদের পরিবার একান্নবর্তী। সবাই একসঙ্গে চলি। বিশু আমাদের ছেলে। তুমি যা বলছ তা যদি সত্যি হয় তাহলে বলব সে খুব অন্যায় করেছে। তোমাকে উৎসাহ দিচ্ছে অথচ আমাদের কিছু বলেনি।’

‘আপনারা রেগে যাবেন, তাই।’

‘থাক, আর ওর হয়ে সা ফাঁই গাইতে হবে না। হ্যাঁ, ও আমাদের ছেলে, কিন্তু সবাই মিলে তো ওকে পেটে ধরতে পারি না, ধরেছে একজন। এখন বলো তো, আমাদের মধ্যে কে ওর গর্ভধারিণী?’ বড়বউ জিজ্ঞাসা করলেন।

‘আমার মনে হয়,’ মুখ নামাল অঞ্জনা, ‘আমাকে যিনি একটাও প্রশ্ন করেননি তিনি বোধহয়।‘

বড়বউ হেসে ফেলল, ‘শ্রাবণী, ওকে একটু মিষ্টি দাও, প্রথম এল।’

সঙ্গে-সঙ্গে উঠে দাঁড়াল অঞ্জনা, প্লিজ, আমাকে মিষ্টি খেতে বলবেন না। আমি ওর কথায় মিষ্টি ছেড়ে দিয়েছি। আমি যাই?

অঞ্জনা যেন চলে যেতে পেরে বেঁচে গেল। পাঁচ বউ হাঁ হয়ে তাকিয়েছিল। তারপরেই পাঁচটি কণ্ঠ থেকে হাসির ফোয়ারা ছিটকে উঠল।

দোতলার ঘরে দিবানিদ্রা থেকে উঠে এসে ভবতোষ সেই হাসি শুনতে পেয়ে খুশি হলেন। পাঁচ বউ একসঙ্গে হাসলে এই পরিবারের ভিত মজবুত হবে।

এখন পর্যন্ত গল্পটি পড়া হয়েছে ৫১ বার
যদি গল্পটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
    মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন