কখোন তার হৃদয় থেকে এটা আশ্চর্য পাখি উড়তে চেয়েছিল সে জানে না। কিন্তু গোলাপের মতো নরোম হচ্ছিল যে তার যাবতীয় স্বপ্ন, সে তা বুঝতে পেরেছিল এবং বুঝতে পেরে, পৃথিবীর মানুষের ক্ষণিক অবধারণকে বাঁয়ে রেখে যেখানে কেউ যায় না (ক্কচিৎ দু’একজন ছাড়া) সেখানে বুক ভরে নির্জনতা নিয়ে সে বসবাস বেঁধেছিল। দূর থেকে তার প্রাণ-প্রেমিক, মাতা-আত্মীয়স্বজন, অভিশাপময় অবেলায় হাত নেড়ে নেড়ে কিছু বলাতে যে প্রত্যুত্তর হয়েছিল জগৎবাণীর গভীর স্বরে তার অর্থ করলে দাঁড়ায়–ঐ লোকটা তিন মাথাওলা পশুর চেয়ে নির্জন! অথবা নদীর অন্তরালের অবেলার চেয়েও অসহায়–ওকে আর তোমরা পিছনে ফিরতে বলো না।
সে জানে তার জীবনী কেউ লিখবে না। সে কোথায় কোন দয়ার শিং এর গুতোয় বুকের হৃদয় ভেঙ্গেছিল, শিশু বেলায়; নরোম বল নিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে অন্ধকারে গিয়ে আবার নির্জন স্তব্ধতার মতো আত্মধ্বংসের উল্লাসে মেতেছিল, তাও কেউ গল্পচ্ছলে লিখবে না। এসব জেনেও তবুও তার দুঃখ নেই।
এক ইংরেজ কবির দুটো স্তবক, সেই কবেকার কিশোর বেলায় ভাঙ্গা-বেঞ্চির উপর বসে, যার মাস্টার ছিলেন আজীবন-কুমার এক বন্ধু নাম সোজ সেন-সেই বটগাছটার ছায়া খাওয়া ক্লাসটায় বসে সেই ইংরেজ কবির যে দুটো স্তবক সে মনে মনে নিজের কথা বোলে আত্মার বর্ষার জোয়ারের মতো হঠাৎ জলমগ্ন হয়ে গিয়েছিল, সেই দুটো স্তবক আজ তাকে নিজের সন্দর্শনের ভাষ্যে খেলিয়ে শান্তির হাওয়া দেয়। রক্তের মধ্যে মিশে যাওয়াতে সেই দুটো স্তবক ঠিক কথাগুলো তার মনে নেই, কিন্তু ভোর না হতেই পাখিগুলোর মনময় কলস্বর শুনলেই সে বুঝতে পারে সেই কবির মতো তারও এ এক অন্ত-স্বাদ! “আমাকে কেউ না জানুক–কেউ না জানুক–কেউ ভুলেও আমার নাম না করুক–এই-ই চাই প্রভু আমাকে একটা তুচ্ছ পাথরের মতো বাঁচতে দাও। যে পাথরের দিকে কেউ কোনো দিন ফিরে তাকায় না। ঠিক তেমন এক শ্যাওলায় ধূসর পাথরের মতো।” হয়েছিল তাই। হবে না কেন? মানুষের অন্তর্ময় গুঞ্জন নাকি এক রকম দেবদূতের আবির্ভাব হয়। তারা আপনাপন কর্মের বাইরে ওড়ে না। ঐ লোকটার দেবদূত তার বাসনা মাফিক নির্জনের কালো অববাহিকায় ওকে ঘর বানিয়ে দিয়েছিল। যার কূল থেকে দেখা যায়–শোনা যায়, সূর্য ওঠা স্তোত্র ঢেউ পরপারের দৃশ্যময় সান্ত্বনা আর সফেন-সুন্দর তরুণীদের বাওয়া স্বৰ্গফেরত সাম্পান যে সব তরুণীদের কোলে জীবিত মৃনাল ফুটতে দেখা যায় না, যাদের চোখের কোণাভূমি দাঁড়ালে পিছনের কান্না জগৎটাকে মনে হয় মৃত কবর-কবর-কবর।
পশ্চাৎ থেকে এ দূর এই অচেনায় চলে আসায় সেই লোকটাকে কেউ চেনে না আজকাল। অথচ এই অচেনায় থেকেও সব চেনার ভেতরে তার বসবাস পদ্মপাতার পুকুরে গোলাপের সুগন্ধে মৃতদের কবরে, সদ্য ঘাস জাগা যুবর ভেতর থেকে শুভসংবাদের কমল ভাসান আজ তার নির্জনতার সোবরে।
মায়ের আভাসগুলো ছিল ঠক পাখিওড়া ভোরের মতো–ফুল ফোঁটানোর যন্ত্রণার মতো–একজন বুলবুলির গোলাপগ্রস্ত মৃত্যুর মতো।
মা তো বোলতেন, গর্ভস্থিত বাসনা ছিলি–গর্ভে ফিরে যাবি। মাত্র দু’পায়ের এই এতটুকু পথ-এর উপরের কোনো পথিকের জল পিপাসার জল জোগানোই যেন আজীবনের প্রেম হয় তোর।
আর সেই প্রত্যুত্তরে নির্জন লোকটা মনে মনে বোলেছিল একমাত্র দেবী তুমি, তোমার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আলো পেয়েছিলুম–আলোর কণার অভ্যর্থনা নিয়ে আবার সব কথার সৎ ব্যবহারে কোরে উৎসে ফিরে যাবে।
সেই কথার অম্বেষাই এখন তার মরণের অনাবিল নদী তার বোধির সব কোলাহলময় জঞ্জাল ভাসিয়ে নিয়েছে। একটা কোলাহলহীন প্রয়োজনীয় মৃত্যু তাকে আশীর্বাদ দিয়ে প্রেমিকার অভাব খুঁচিয়ে দিয়েছে।
আর তাই একে একে লিফটের সিঁড়ির মতো অন্ধকার-বন্ধু-জীবন-প্রেম জ্ঞান সব পেরিয়ে–পৃথিবীর উচ্চতম এক শ্বেত প্রাসাদের সর্বোচ্চ নির্জনে সে বসবাস নিয়েছে, যেখান থেকে দেখা যায় পরপারে সেই স্বর্গ-ফেরত সাম্পান নিয়ে কোলিকোবিদ জগৎহীন তরুণীদের যাদের চোখের অভ্যন্তরে পৃথিবীর সবুজ অরণ্যের যন্ত্রঘর্ঘরহীন মাইল মাইল ঘুমের সমাহিতি।
এখন তাই সে সব নিয়ে নির্জন। নির্বাসনাময় সব পাওয়ার দেবতা। তার জীবনের দর্পনে হাওয়া দেয় সবুজ গাছপালা। গোধূলির সন্ধিতে উল্লাস করে মাইল মাইল অরণ্য। তার বাইরের পৃথিবী এখন ভিতরের ঈশ্বরের হয়ে তার অনুপম দোসর।
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন