গোলেস্তান
গোলেস্তান! অনেক দিন পরে তোমার বুকে ফিরে এসেছি। আঃ মাটির মা আমার, কত ঠান্ডা তোমার কোল! আজ শূন্য আঙিনায় দাঁড়িয়ে প্রথমেই আমার মনে পড়ছে জননীর সেই স্নেহবিজড়িত চুম্বন আর অফুরন্ত অমূলক আশঙ্কা, আমায় নিয়ে তাঁর সেই ক্ষুধিত স্নেহের ব্যাকুল বেদনা,… সেই ঘুম-পাড়ানোর সরল ছড়া, –
ঘুম-পাড়ানি, মাসি-পিসি ঘুম দিয়ে যেয়ো,
বাটা ভরে পান দেব গাল ভরে খেয়ো!
আরও মনে পড়ছে আমাদের মা-ছেলের শত অকারণ আদর-আবদার! সে মা আজ কোথায়?
দু-এক দিন ভাবি, হয়তো মায়ের এই অন্ধ স্নেহটাই আমাকে আমার এই বড়ো-মা দেশটাকে চিনতে দেয়নি। বেহেশ্ত হতে আবদেরে ছেলের কান্না মা শুনতে পাচ্ছেন কিনা জানিনে, কিন্তু এ আমি নিশ্চয় করে বলতে পারি যে, মাকে হারিয়েছি বলেই – মাতৃ-স্নেহের ওই মস্ত শিকলটা আপনা হতে ছিঁড়ে গিয়েছে বলেই আজ মার চেয়েও মহীয়সী আমার জন্মভূমিকে চিনতে পেরেছি। তবে এও আমাকে স্বীকার করতে হবে, – মাকে আগে আমার প্রাণ-ভরা শ্রদ্ধা-ভক্তি-ভালোবাসা অন্তরের অন্তর থেকে দিয়েই আজ মার চেয়েও বড়ো জন্মভূমিকে ভালোবাসতে শিখেছি। মাকে আমি ছোটো করচি নে। ধরতে গেলে মা-ই বড়ো। ভালবাসতে শিখিয়েছেন তো মা। আমার প্রাণে স্নেহের সুরধুনী বইয়েছেন তো মা। আমাকে কাজ-অকাজে এমন করে সাড়া দিতে শিখিয়েছেন যে মা! মা পথ দেখিয়েছেন, আর আমি চলেছি সেই পথ ধরে। লোকে ভাবছে, কী খামখেয়ালি পাগল আমি! কী কাঁটা-ভরা ধ্বংসের পথে চলেছি আমি! কিন্তু আমার চলার খবর মা জানতেন, আর সে-কথা শুধু আমি জানি।
আমায় লোকে ঘৃণা করছে? আহা, আমি ওই তো চাই। তবে একটা দিন আসবেই যেদিন লোকে আমার সঠিক খবর জানতে পেরে দু-ফোঁটা সমবেদনার অশ্রু ফেলবেই ফেলবে। কিন্তু আমি হয়তো তা আর দেখতে পাব না। আর তা দেখে অভিমানী স্নেহ-বঞ্চিতের মতো আমার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না আসবে না। সেদিন হয়তো আমি থাকব দুঃখ-কান্নার সুদূর পারে।
চমন
আচ্ছা মা! তুমি তো মরে শান্তি পেয়েছ, কিন্তু এ কী অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে গেলে আমার প্রাণে? আমি চিরদিনই বলেছি, না – না – না, আমি এ পাপের বোঝা বইতে পারব না, কিন্তু তা তুমি শুনলে কই? সেকথা শুধু হেসেই উড়িয়ে দিলে, যেন আমার মনের কথা সব জান আর কী! … এই যে বেদৌরাকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে গেলে, এর জন্যে দায়ী কে? এখন যে আমার সকল কাজেই বাধা! কোথাও পালিয়েও যে টিকতে পারছিনে! … আমি আজ বুঝতে পারছি মা, যে, আমার এই ঘর-ছাড়া উদাস মনটার স্থিতির জন্যেই এই পুষ্প-শিকলটা তোমার চির-বিদায়ের দিনে নিজের হাতে আমায় পরিয়ে গিয়েছ। ওই মালাই তো হয়েছে আমার জ্বালা! লোহার শিকল ছিন্ন করবার ক্ষমতা আমার আছে, কিন্তু ফুলের শিকল দলে যাওয়ার মতো নির্মম শক্তি তো নেই আমার। … যা কঠোর, তার উপর কঠোরতা সহজেই আসে; কিন্তু যা কোমল পেলব নমনীয়, তাকে আঘাত করবে কে? তারই আঘাত যে আর সইতে পারছিনে!
হতভাগিনি বেদৌরা! সে কথা কি মনে পড়ে – সেই মায়ের শেষ দিন? – সেই নিদারুণ দিনটা? – মায়ের শিয়রে মরণের দূত ম্লান মুখে অপেক্ষা করছে – বেদনাপ্লুত তাঁর মুখে একটা নির্বিকার তৃপ্তির আবছায়া ক্রমেই ঘনিয়ে আসছে, – জীবনের শেষ রুধিরটুকু অশ্রু হয়ে তোমার আর আমার মঙ্গলেচ্ছায় আমাদেরই আনত শিরে চুঁইয়ে পড়ছে। মার পূত সে শেষের অশ্রু বেদনায় যেমন উত্তপ্ত, শান্ত স্নেহভরা আশিসে তেমনই স্নিগ্ধ-শীতল! তোমার অযতনে-থোওয়া কালো কোঁকড়ান কেশের রাশ আমাকে সুদ্ধ ঝেঁপে দিয়েছে, আর তার অনেকগুলো আমাদেরই অশ্রু-জলে সিক্ত হয়ে আমার হাতে-গলায় জড়িয়ে গিয়েছে – আমার হাতের উপর কচি পাতার মতো তোমার কোমল হাত দুটি থুয়ে মা অশ্রু-জড়িত কণ্ঠে আদেশ করছেন, – ‘দারা, প্রতিজ্ঞা কর, বেদৌরাকে কখনো ছাড়বিনে।’
তারপর তাঁর শেষের কথাগুলো আরও জড়িয়ে ভারী হয়ে এল, – ‘এর আর কেউ নেই যে বাপ, এই অনাথা মেয়েটাকে যে আমিই এত আদুরে আর অভিমানী করে ফেলেছি!’
সে কী ব্যথিত-ব্যাকুল আদেশ, গভীর স্নেহের সে কী নিশ্চিত নির্ভরতা!
তারপরে মনে পড়ে বেদৌরা, আমাদের সেই কিশোর মর্মতলে একটু একটু করে ভালোবাসার গভীর দাগ, গাঢ় অরুণিমা। … মুখোমুখি বসে থেকেও হৃদয়ের সেই আকুল কান্না, মনে পড়ে কি সে সব বেদৌরা? তখন আপনি মনে হত, এই পাওয়ার ব্যথাটাই হচ্চে সব চেয়ে অরুন্তুদ! তা না হলে সাঁঝের মৌন আকাশতলে দুজনে যখন গোলেস্তানের আঙুর-বাগিচায় গিয়ে হাসতে হাসতে বসতাম তখন কেন আমাদের মুখের হাসি এক নিমেষে শুকিয়ে গিয়ে দুইটি প্রাণ গভীর পবিত্র নীরবতায় ভরে উঠত? তখনও কেন অবুঝ বেদনায় আমাদের বুক মুহুর্মুহু কেঁপে উঠত? আঁখির পাতায় পাতায় অশ্রু-শীকর ঘনিয়ে আসত? …
আজ সেটা খুব বেশি করেই বুঝতে পেরেছি বেদৌরা। কেননা এই যে জীবনের অনেকগুলো দিন তোমার বিরহে কেটে গেল, তাতে তোমাকে না হারিয়ে আরও বড়ো করে পেয়েছি। তোমায় যে আমি হারিয়েছিলাম সে তোমাকে এত সহজে পেয়েছিলাম বলেই। বিরহের ব্যথায় জানটা যখন ‘পিয়া পিয়া’ বলে ‘ফরিয়াদ’ করে মরে, তখনকার আনন্দটা এত তীব্র যে, তা একমাত্র বিরহীর বুকই বোঝে, তা প্রকাশ করতে আর কেউ কক্ষনো পারবে না। দুনিয়ায় যত রকম আনন্দ আছে, তার মধ্যে এই বিচ্ছেদের ব্যথাটাই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি আনন্দময়।
আর সেই দিনের কথাটা? – সেদিন বাস্তবিক সেটা বড়ো আঘাতের মতোই প্রাণে বেজেছিল! আমার আজও মনে পড়ছে, সেদিন ফাগুন আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে আকাশে বাতাসে ফলে ফুলে পাতায় … আর সবচেয়ে বেশি করে তরুণ-তরুণীদের বুকে!
আঙুরের ডাঁশা থোকাগুলো রসে আর লাবণ্যে ঢল-ঢল করছে পরিস্তানের নিটোল-স্বাস্থ্য ষোড়শী বাদশাজাদিদের মতো! নাশপাতিগুলো রাঙিয়ে উঠেছে সুন্দরীদের শরম-রঞ্জিত হিঙুল গালের মতো! রস-প্রাচুর্যের প্রভাবে ডালিমের দানাগুলো ফেটে ফেটে বেরিয়েছে কিশোরীদের অভিমানে-স্ফূরিত টুকটুকে অরুণ অধরের মতো। পেস্তার পুষ্পিত খেতে বুলবুলদের নওরোজের মেলা বসেছে। আড়ালে আগডালে বসে কোয়েল আর দোয়েল-বধূর গলা-সাধার ধুম পড়ে গিয়েছে, কী করে তারা ঝংকারে ঝংকারে তাদের তরুণ স্বামীদের মশগুল করে রাখবে। উদ্দাম দখিন হাওয়ার সাথে ভেসে-আসা একরাশ খোশবুর মাদকতায় আর নেশায় আমার বুকে তুমি ঢলে পড়েছিলে। শিরাজ বুলবুলের ‘দিওয়ান’ পাশে থুয়ে আমি তোমার অবাধ্য দুষ্টু এলো চুলগুলি সংযত করে দিচ্ছিলাম, আর আমাদের দুজনারই চোখ ছেপে অশ্রু বয়েই চলেছিল।
মিলনের মধুর অতৃপ্তি এই রকমে বড়ো সুন্দর হয়েই আমাদের জীবনের প্রথম অধ্যায়ের পাতাগুলো উলটে দিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় সব উলট-পালট হয়ে গেল, ঠিক যেমন বিরাট বিপুল এক ঝঞ্ঝার অত্যাচারে একটা খোলা বই-এর পাতা বিশৃঙ্খল হয়ে যায়। … সে এলোমেলো পাতাগুলি আবার গুছিয়ে নিতে কী বেগই না পেতে হয়েছে আমায় বেদৌরা! … তা হোক, তবু তো এই ‘চমনে’ এসে তোমায় ফের পেয়েছি। তুমি যে আমারই। বাঙালি কবির গানের একটা চরণ মনে পড়ছে –
তুমি আমারই যে তুমি আমারই,
মম বিজন জীবন-বিহারী।
তারপর সেই ছাড়াছাড়ির ক্ষণটা বেদৌরা, তা কি মনে পড়ছে? আমি শিরাজের বুলবুলের সেই গানটা আবৃত্তি করছিলাম, –
দেখনু সেদিন ফুল-বাগিচায় ফাগুন মাসের উষায়,
সদ্য-ফোটা পদ্মফুলের লুটিয়ে পরাগ-ভূষায়,
কাঁদচে ভ্রমর আপন মনে অঝোর নয়নে সে,
হঠাৎ আমার পড়ল বাধা কুসুম চয়নে যে!
কইনু, – ‘হাঁ ভাই ভ্রমর! তুমি কাঁদচ সে কোন্ দুখে
পেয়েও আজি তোমার প্রিয়া কমল-কলির বুকে?’
রাঙিয়ে তুলে কমল-বালায় অশ্রু-ভরা চুমোয়
বললে ভ্রমর, –‘ওগো কবি, এই তো কাঁদার সময়!
বাঞ্ছিতারে পেয়েই তো আজ এত দিনের পরে,
ব্যথা-ভরা মিলন-সুখে অঝোর ঝরা ঝরে।’
এমন সময় তোমার মামা এসে তোমায় জোর করে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল; আমার একটা কথাও বিশ্বাস করলে না। শুধু একটা উপেক্ষার হাসি হেসে জানিয়ে দিলে যে, সে থাকতে আমার মতো একটা ঘর-বাড়ি ছাড়া বয়াটে ছোকরার সঙ্গে বেদৌরার মিলন হতেই পারে না।…
আমার কান্না দেখে সে বললে যে, ইরানের পাগলা কবিদের ‘দিওয়ান’ পড়ে পড়ে আমিও পাগল হয়ে গিয়েছি। তোমার মিনতি দেখে সে বললে যে, আমি তোমাকে জাদু করেছি।
তারপর অনেক দিন ঘুরে ঘুরে কেটে গেল ওই ব্যাকুল-গতি ঝরনাটার ধারে। যখন চেতন হল তখনও বসন্ত-উৎসব তেমনই চলেছে, শুধু তুমিই নেই! দেখলুম, ক্রমেই তোমার আলতা-ছোবানো পায়ের পাতার পাতলা দাগগুলি নির্ঝরের কূলে কূলে মিলিয়ে আসছে, আর রেশমি চুড়ির ভাঙা টুকরোগুলি বালি-ঢাকা পড়ছে।
আমি কখনও মনের ভুলে এপারে দাঁড়িয়ে ডাকতুম, – বেদৌরা! – অনেকক্ষণ পরে পাথরের পাহাড়টা ডিঙিয়ে ওপার হতে কার একটা কান্না আসতে আসতে মাঝপথেই মিলিয়ে যেত – ‘রা – আঃ – আঃ!’ সারা বেলুচিস্তান আর আফগানিস্তানের পাহাড় জঙ্গলগুলোকে খুঁজে পেলুম, কিন্তু তোমার ঝরনা-পারের কুটিরটির খোঁজ পেলুম না।…
একদিন সকালে দেখলুম, খুব উন্মুক্ত একটা ময়দানে একা একজন পাগলা আশমান-মুখো হয়ে শুধু লাফ মারছে, আর সেই সঙ্গে হাত দুটো মুঠো করে কিছু ধরবার চেষ্টা করছে। আমার বড্ড হাসি পেল। শেষে বললুম – ‘হ্যাঁ ভাই উৎরিঙ্গে! তুমি কি তিড়িং তিড়িং করে লাফিয়ে আকাশ-ফড়িং ধরছ?’
সে আরও লাফাতে লাফাতে সুর করে বলতে লাগল –
এ-পার থেকে মারলাম ছুরি লাগল কলা গাছে,
হাঁটু বেয়ে রক্ত পড়ে চোখ গেল রে বাবাঃ।
এতে যে মরা মানুষেরও হাসি পায়। অত দুঃখেও আমি হোহো করে হেসে বললুম, – ‘তুমি কি কবি?’ সে খুব খুশি হয়ে চুল দুলিয়ে বললে – ‘হাঁ হাঁ, তাই!’ আমি বললুম, – ‘তা তোমার কবিতার মিল হল কই?’ সে বললে, – ‘তা নাই বা হল, হাঁটু দিয়ে তোর রক্ত পড়ল তো।’ এই বলেই সে আমার নবোদ্ভিন্ন শ্মশ্রুমণ্ডিত গালে চুম্বনের চোটে আমায় বিব্রত করে তুলে বললে, – ‘অনিলের নীল রংটাকে সুনীল আকাশ ভেবে ধরতে গেলে সে দূরে সরে গিয়ে বলে, – “ওগো, আমি আকাশ নই, আমি বাতাস, আমি শূন্য, আমায় ধরা যায় না। আমায় তোমরা পেয়েছ। তবুও যে পাইনি বলে ধরতে আস, সেটা তোমার জবর ভুল।”
এক নিমেষে আমার মুখের মুখর হাসি মূক হয়ে মিলিয়ে গেল। ভাবলাম, হাঁ ঠিকই তো। যাকে ভিতরে, অন্তরের অন্তরে পেয়েছি, তাকে খামখা বাইরের-পাওয়া পেতে এত বাড়াবাড়ি কেন? তাই সেদিন আমার পোড়ো-বাড়িতে শেষ কান্না কেঁদে বললুম, – ‘বেদৌরা! তোমায় আমি পেয়েছি আমার হৃদয়ে – আমার বুকের প্রতি রক্ত-কণিকায়।’ তারপর এই যে হিন্দুস্থানের অলিতে গলিতে ‘কমলিওয়ালে’ সেজে ফিরে এলুম, সে তো শুধু ওই এক ব্যথার সান্ত্বনাটা বুকে চেপেই। ভাবতুম, এমনি করে ঘুরে ঘুরেই আমার জনম কাটবে, কিন্তু তা আর হল কই? আবার সেই গোলেস্তানে ফিরে এলুম! সেখানে আমার মাটির কুঁড়ে মাটিতে মিশিয়ে গিয়েছে, কিন্তু তারই আর্দ্র বুকে যে তোমার ওই পদচিহ্ন আঁকা রয়েছে, তাই আমায় জানিয়ে দিল, যে, তুমি এখানে আমায় খুঁজতে এসে না পেয়ে শুধু কেঁদে ফিরেছ!
সেই পাগলটা আবার এসে জানিয়ে দিলে গেল যে, তুমি চমনে ফুটে শুকিয়ে যাচ্ছ।…
আমি এসেই তোমায় দূর হতে দেখে চিনেছি। তবে তুমি আমায় দেখে অমন করে ছুটে পালালে কেন? সে কী মাতালের মতো টলতে টলতে দৌড়ে লুকিয়ে পড়লে ওই খোর্মা গাছগুলোর আড়ালে! সে কী অসংবৃত অশ্রু ঝরে পড়ছিল তোমার! আর কতই যে ব্যথিত অনুযোগ ভরে উঠেছিল সে করুণ দৃষ্টিতে!
কিন্তু কোথা গেলে তুমি? – বেদৌরা, তুমি কোথায়?…
কেন আমি মূর্ছিত হয়ে পড়লুম?
– ওঃ!
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন