শিরোনাম: দেশ প্রেমিক
গল্পকার: মনিরুল ইসলাম
গল্প – অনু গল্প
এই ঘটনার নাম, চরিত্র, কাহিনী সম্পূর্ণ কাল্পনিক। কারো জীবনের সাথে মিলে গেলে লেখক দায়ী নয়
দাঁড়িয়ে ছিলাম। একাকী এক নির্জন গলির ধারে। হঠাৎ করেই পিঠে একটা চপেটাঘাতে ঘুরে দাঁড়ালাম। পরে যখন জ্ঞান ফিরে পেলাম তখন দেখি হাসপাতালের সাদা বিছানায় শুয়ে আছি। হাত-পায়ে পট্টি বাঁধা। শরীরটা ভীষন যন্ত্রণা করছিলো। কাকে জানি ডাকতে গেলাম কিন্তু গলাতে এতোটাই আঘাত যে, কথা বেরুচ্ছে না।
আসলে হয়েছিলো কি, সেদিন বাজারে গিয়েছিলাম। দেখলাম কয়েকটা গুন্ডা গোছের লোক একটা ১০১২ বছরের বাচ্চাকে চড় থাপ্পড় মারছে। দাঁড়িয়ে পড়লাম। জিজ্ঞেস করলাম তারা কেন বাচ্চাটাকে মারছে! কিন্তু তারা তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো- এখান থেকে কেটে পড়্। আমাদের কাজে বাঁধা দিস না। কিন্তু বাচ্চাটার সহজ সরল চেহারা দেখে কারন জানার চেয়ে তাকে সেখান থেকে বাঁচানোর পথ খুঁজছিলাম। হঠাৎই মাথায় একটা বুদ্ধি খেললো। দৌড়ে গিয়ে সামনের গাদা থেকে দুই মুষ্টি বালু ছুঁড়লাম গুন্ডাদের চোখে। পরে বাচ্চাটাকে নিয়ে পালালাম। যার ফলে তারা আজ আমাকে হাসপাতালে পাঠিয়েছে।
ছেলেটাকে নিয়ে পালানোর পরে নিজের বাসায় আনলাম। তাকে পরিস্কার করে ক্ষত গুলোতে এন্টিসেপটিক দিয়ে পরিস্কার করলাম। তখনও তার সাথে কথা হয়নি। এবার খেতে দিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম ; কেন তাকে মারছিলো ওই লোকগুলো!
ছেলেটির নাম জিসান। সে আমার পাশের পাড়াতেই থাকে। সে যা বললো তা এরূপ –
গত তিন বছর আগে জিসানের মা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। জিসান তখন ক্লাশ ফোরের ছাত্র। তারপর বেশ কিছুদিন কেটে যায়। জিসানের বাবা ঠিকঠাক তদারকি করছিলেন ছেলের জন্য। হঠাৎই জিসানের বাবার বন্ধু তার বাবাকে নানা ভাবে উস্কিয়ে বিয়ে দেন। ঘরে চলে আসে সৎ মা। বেশ কিছু সময় ভালোই কেটেছে তাদের। একদিন জিসান ক্ষুধার্ত অবস্থায় স্কুল থেকে এসে রান্নাঘর থেকে ভাত খেয়ে ফেলে। যে ভাত তার নতুন মায়ের ছিলো। ভাত খাওয়াকে কেন্দ্র করে চরম মারপিট করে জিসানকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় তার সৎ মা। জিসানের বাবাও তার মায়ের এই কর্মকে সমর্থন করে। পরে জিসান যখন ফুটপাথে ঘুরছিলো সেসময় কিছু লোক তাকে তাদের ডেরায় নিয়ে যায়। তারপর-
জিসানকে নানাবিধ টর্চার করে। তৈরী করে এক ক্ষুদে মাদক পাচারকারী। এমতাবস্থায় জিসানকে দিয়ে বেশ করে চালানো হচ্ছিলো মাদকের রমরমা ব্যবসা। হঠাৎ করেই জিসান পালানোর চেষ্টা করলে তারা তাকে ধরে মারপিট করতে থাকে। আর সেখান থেকে আমি তাকে উদ্ধার করে বাড়ি আনি।
আমার তেমন সামর্থ্য ছিলো না। সেজন্য জিসানকে তার বাড়ি যাওয়ার জন্য বলি। কিন্তু সেখানে সে যেতে চায় না। পরে অগত্যাই বাধ্য হয়ে তাকে একটি এতিমখানায় রেখে আসি। এভাবেই কেটে যায় প্রায় তিন মাস। যথারীতি খবর নিতাম জিসানের। ভালোই ছিলো সে।
সেদিন বাজার থেকে ফেরার পথে সেই গলিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখনই আমাকে আক্রমণ করে সেই মাদক ব্যবসায়ীরা। যাদের কাছ থেকে জিসানকে উদ্ধার করেছিলাম। আর সেই জন্য এখন আমি হাসপাতালে।
পূর্বের কথাগুলো ভাবছিলাম। এমন সময় আমার কেবিনে দেখলাম জিসান দাঁড়িয়ে আছে। রক্তাক্ত দেহ। আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আমি তাকে দেখেই চিৎকার করে ডাক্তারকে ডাকলাম। এবার দেখি জিসান হো হো করে হাসছে। আমি হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি। এবার জিসান চট করে আমার ফল কাটা চাকুটা নিয়ে নিজের পেটে ঢুকিয়ে দিলো। আর আমাকে বললো- ভাইয়া, মাফ করে দিও। আমাদের মতো টোকাইদের জন্য এই পৃথিবী নয়।এই পৃথিবী তাদের ; যাদের টাকা আছে আর ধন সম্পদ- প্রতিপত্তি আছে। যারা সমাজের কালো জিনিসকে সাদা করে টাকা দিয়ে।
কাঁদতে কাঁদতে আবার বললো- ভাইয়া, সেদিন তুমি আমাকে তুলে এনেছিলে এজন্য তাদের ব্যবসায় ক্ষতি হয়। এজন্য তারা তোমাকে মেরে আমাকে এতিমখানা থেকে এনে প্রচুর মারধর করে। আমাকে আবার বাধ্য করতে চায় মাদক বিক্রি করতে। আমি এসব কাজ করে দেশ ও জাতির ক্ষতি করবো না এজন্য নিজেকে শেষ করে দিলাম। তার এতো অল্প বয়সে দেশপ্রেম দেখে বিমূঢ় হয়ে গেলাম। শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসলো।
চেঁচিয়ে বললাম – জিসান তোর কিচ্ছু হবে না। আমি তোর কিচ্ছু হতে দিবো না। আমি ডাক্তারকে চেঁচিয়ে ডাকলাম। ততক্ষণে জিসান পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছে বিধাতার ডাকে। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইলাম তার মরদেহের দিকে। মুখ দিয়ে কথা সরছে না। তার নিষ্পাপ মুখটা যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বারবার জিসানের মরদেহ যেন বলছে – ওরে নিষ্ঠুর পৃথিবীর নিকৃষ্ট কথিত মানুষ নামের হায়েনারা তোরা সত্যিকারের মানুষ হ।
আজ আমাকে হাসপাতাল থেকে ছাড় দিয়েছে। হাসপাতালের গেট থেকে দুটো তাজা গোলাপ কিনে সোজা গেলাম জিসানের কবরের দিকে। তার কবরে দুটো ফুল রেখে স্যালুট জানালাম। আমি তো মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি তবে একজন সত্যিকারের যোদ্ধা দেখলাম। দেখলাম দেশপ্রেমের এক অনন্য নজির।
লেখক মনিরুল ইসলাম।
গণমাধ্যমকর্মী, সাপাহার, নওগাঁ।
২৪ জুলাই -২০২৩ খ্রি. সাপাহার।
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন