বন্ধ জানলার সামনে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করলেন রবার্ট স্টিভেনসন, দেশটা উচ্ছন্নে গেল।
বাইরে তখন গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। ওটা শুরু হয়েছে তিনদিন আগে। আকাশ-ভরতি ভারী মেঘের গম্ভীর চলাফেরা। তাপাঙ্ক নেমে গিয়েছে স্বাভাবিকের খানিকটা নিচে। অথচ এখন এরকমটা হওয়ার কথা নয়। ক্যালেন্ডারে সামার এসে গিয়েছে। এমন নরম-নরম রোদের সামার আর আকাশে অনেকক্ষণ নীল দেখা যায়। রবার্ট কাঁচের আড়ালে রাস্তায় যেটুকু দেখতে পেলেন তাতে বিন্দুমাত্র ভরসা পেলেন না। কোনও মানুষ নেই, বোল্টন শহরটা যেন আঁধা অন্ধকারে জবুথবু হয়ে আছে।
জানালা থেকে সরে এলেন রবার্ট। চমৎকার প্রকৃতি তো আর একা সৎ থাকতে পারে না। নব্বইটা বছর বেঁচে থাকতে হচ্ছে এসব দেখার জন্যে। নিজের শরীরের দিকে তাকালেন। হাত গোটালে বাইসেপটা ভাঙা ডিঙার মতো দেখায় এখনও। মেদটেদ শুকিয়ে গেছে, গাল বসে। গিয়েছে অনেকটা, কিন্তু এখনও তিনি সবল আছেন। মাথাটা যদি সাততাড়াতাড়ি মরে না যেত জীবনটাকে আরও একটু নেড়েচেড়ে দেখতেন তিনি।
টিভি খুললেন রবার্ট। বি.বি.সি-র নিউজ বুলেটিনে ওই এক কথা। মাঝে-মাঝে বৃষ্টি, ঝোড়ো হাওয়া আর মেঘলা আকাশ। এগুলো বলার জন্যে বিদ্যের দরকার হয় না, জানালার বাইরে চোখ মেললেই বোঝা যায়। আগে বি.বি.সি. কি নিখুঁত আবহাওয়ার ভবিষ্যদবাণী করত! আর এখন? সোফায় বসলেন তিনি। আর তখনই নিচে শব্দ হল। কেউ হাতুড়ি ঠুকছে দেওয়ালে। রবার্টের মনে হল তাঁর বুকেই যেন আওয়াজটা হচ্ছে। সঙ্গে-সঙ্গে টেলিফোন তুলে বোতাম টিপলেন। তিনবারের বার গলা পেলেন। কাউড্রেদের মেয়ের গলা। রবার্ট নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করে বললেন, শোনো, যখন তোমার বাবাকে ফ্ল্যাটটা ভাড়া দিয়েছিলাম তখন কথা হয়েছিল দেওয়াল অক্ষত থাকবে। দেওয়ালে পেরেক ঠোকার মতো ভারতীয় অভ্যেস দয়া করে ত্যাগ করো।
মেয়েটা হি-হি করে হেসে উঠল। তারপর বলল, আমি কি একবার ওপরে আসতে পারি?
তোমার বাপ-মা কেউ এখন নেই বুঝি?
না। খুব একা লাগছিল বলে পেরেক ঠুকছিলাম।
ঠিক আছে, মিনিট পাঁচেকের জন্যে আসতে পারো!
রিসিভার নামিয়ে মনে হল কাজটা ভালো না। ভাড়াটের সঙ্গে দহরম করা ঠিক নয়। ইন্ডিয়া থেকে ফিরে ঘুরতে-ঘুরতে এই বোল্টনে এসে মার্থার জন্যেই বাড়ি কিনেছিলেন তিনি। মার্থা চলে যাওয়ার পর নিচটা ভাড়া দিয়েছেন। কিন্তু তিনি একা-একাই বেশ আরামে থাকেন। বেল বাজল।
প্যান্টের ওপর হাফস্লিভ শার্টে তাঁকে নেহাত খারাপ দেখাচ্ছে না। রবার্ট দরজা খুললেন, হ্যালো।
হাই। পনেরো বছরের মেয়েটা খিলখিলিয়ে হাসল। তিনি কিছু বলার আগেই ঘরে ঢুকে পড়ল সে। রবার্ট প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে উঠলেন। মেয়েটার কি কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই! অত ছোট প্যান্ট পরে চলে এসেছে? অথচ ওপরে গলাবন্ধ পুরোহাত সোয়েটার! রবার্ট দরজা বন্ধ করলেন, লুক, আমি চাই না, তোমরা দেয়ালে পেরেক ঠোকো।
মেয়েটা ধপ করে সোফায় বসে পড়ল। তারপর শুরু করল সুর আর গান, উই উইল ফলোনান। বাট ভার্জিনিয়া বটমানি।
রবার্ট খেঁকিয়ে উঠলেন, স্টপ ইট।
মেয়েটা হাসল, কেন? আমাদের প্রিয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী উপদেশ দিয়েছেন এখনই যেন যৌন-জীবন নিয়ে চিন্তা না করি। কিন্তু দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট কী লিখেছে জানো?
কী লিখেছে?
আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ভার্জিনিয়া বটমানি নিজেই কুমারীমাতা ছিলেন।
উঃ, দেশটার কী হল! মেজর কিছু বলছে না?
ছাই। মেজর শেলটার দিচ্ছে। বলছে, ওটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। মেয়েটা রিমোট টিপে টিভি চালাল। দু-তিনটে চ্যানেল পালটেই সে চেঁচিয়ে উঠল, হাই বব, কাম হিয়ার, আহা দেশটার কী হল! কী মজা!
রবার্ট ভ্রূ কুঁচকে টিভির দিকে তাকালেন। পরদায় ফুটে উঠছে, জাতীয় ঐতিহ্যবাহী ডেভিড মিলার পদত্যাগ করেছেন কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সেটা এখনও গ্রহণ করেননি।
এটা একটা মজার খবর নাকি? বিরক্ত হলেন রবার্ট।
বব। তুমি কোথায় বাস করছ? টিভি দ্যাখোনি, কাগজ পড়োনি?
কাগজ আমি পড়ি না, আর ওয়েদার ছাড়া টিভি দেখছি না।
মাই গড! তুমি আন্তোনিও দে সান্টারের নাম শুনেছ?
সে কে?
ওঃ, একজন অভিনেত্রী। আমাদের ঐতিহ্যমন্ত্রী, ব্রিটেনের ঐতিহ্যমন্ত্রী মিস্টার মিলার অভিনেত্রী সান্টারের সঙ্গে যৌনকাজে এত ক্লান্ত হয়ে পড়তেন যে সরকারি কাজে সময় দিতে পারতেন না। এবং তিনি বিবাহিত, ছেলেমেয়ে আছে।
মাই গড! টিভিতে কী বলছে দেখেছ? বিশ্বাস করতে পারছিলেন না রবার্ট।
ভাষ্যকার তখন জানাচ্ছেন, প্রধানমন্ত্রী জন মেজর পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে বলেছেন, এটা মিলারের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত জীবন, তা নিয়ে প্রেস যাতে নাক গলাতে না পারে তার জন্য মেজর একটি নতুন আইনকে সমর্থন করেছেন। এই আইন প্রণয়ন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল স্যার। ডেভিড ক্যালকটকে। এদিকে সংবাদপত্রের মুখ বন্ধ করার জন্যে প্রধানমন্ত্রীর এই প্রয়াসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শুরু হয়ে গেছে।
রিমোট টিপে টিভি বন্ধ করে মেয়েটা বলল, তোমার বয়স কত বব?
আচমকা এইরকম প্রশ্ন কেন বুঝতে না পেরেও তিনি জবাব দিলেন, নব্বই।
মাই গড! আর ওই লোকটা মাত্র তেতাল্লিশ। তোমার চেয়ে সাতচল্লিশ বছরের ছোট। অথচ সান্টারের সঙ্গে সেক্স করে এমন ক্লান্ত হয়ে যায় যে সরকারি কাজ করতে পারে না। আমি এই কথাটাই বুঝতে পারছি না। তুমি আমাকে সাহায্য করতে পারো বব। কত বছর বয়স থেকে। পুরুষরা ওসব করলে ক্লান্ত হয়ে পড়ে?
লুক বেবি, এসব আলোচনা আমার সঙ্গে করা তোমার উচিত হচ্ছে না।
মাই গড। দ্য পিপল প্রকাশ্যে লিখছে ওই জন্যে মিলার কাজ করতে পারছেনা আর আমি আলোচনা করলেই দোষ। আমার এক বান্ধবী বলছিল চার্লি চ্যাপলিন নাকি–
হাত তুলে মেয়েটাকে থামালেন রবার্ট। একটু ভাবলেন। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, সাধারণত শীতপ্রধান দেশে বেশি বয়স পর্যন্ত ছেলেরা সক্ষম থাকে। মিলার স্বাভাবিক নয়। আমি যখন ইন্ডিয়ায় ছিলাম তখন দেখেছি চল্লিশের পুরুষরাও যৌনজীবন ত্যাগ করেছে।
সেইজন্যে তুমি ইন্ডিয়া থেকে চলে এসেছ? হাসল মেয়েটা।
রবার্ট ক্ষমা করলেন ব্যাপারটা, ইন্ডিয়া যখন স্বাধীন হল তখন আমার বয়স ছত্রিশ। মার্থা আর থাকতে চাইল না। এখন মনে হয় থেকে গেলে ভালো করতাম।
কেন?
এইসব শুনতে হয় না। ব্রিটেনের ঐতিহ্যমন্ত্রী যৌন-কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছে আর তার প্রধানমন্ত্রী সেটাকে সমর্থন করছে। ব্রিটিশ হিসেবে কি লজ্জার কথা! এখন কেটে পড়ো, আমার কথা বলতে ভালো লাগছে না।
মেয়েটা বলে উঠল, তোমার একা থাকতে কষ্ট হয় না?
হয়। সেটা আমার সমস্যা।
তুমি আর একটা বিয়ে করছ না কেন!
এবার হেসে ফেললেন রবার্ট, এই নব্বই বছর বয়সে কে আমাকে বিয়ে করবে?
মেয়েটা মাথা নাড়ল, আই ডোন্ট নো! মে বি সামওয়ান, একটা অ্যাড দেওয়া যেতে পারে। সে হাসল। তারপর ছটফটিয়ে চলে গেল।
মেয়েটা চলে যাওয়ার পর খেয়াল হল রবার্টের। ওর নামটা যেন কী? তিন-চারটে নাম একসঙ্গে মারপিট করতে লাগল মাথায়। আজকাল সবকিছু ঠিকঠাক ঠিক সময়ে মাথায় আসে না। দরজা বন্ধ করে তিনি কিচেনে গেলেন। যত্ন করে এককাপ কফি বানালেন। দেশটার কী হল। ঠিক। সময়ে সামার আসে না, কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েও মন্ত্রীর মন্ত্রিত্ব যায় না। চার্লস আর ডায়না তো। এখনও যুবরাজ আর যুবরানি অথচ প্রোফুমোকে পত্রপাঠ চলে যেতে হয়েছিল একরকম। একজন ব্রিটিশের যদি ঐতিহ্য না থাকে তাহলে আর কি থাকল! এই যে ইয়ং জেনারেশন তৈরি হচ্ছে, এদের যৌবনে দেশটা তো আরও উচ্ছন্নে যাবে। এত ছোট প্যান্ট পরে কেউ ঘরের বাইরে যায়?
কফিতে চুমুক দিয়ে জানালায় ঝুঁকে দাঁড়ালেন রবার্ট। বৃষ্টিটা বন্ধ হয়েছে বলে মনে হয়। ছাতা ছাড়াই একটা লোক হেঁটে যাচ্ছে। লোকটা ইন্ডিয়ান অথবা পাকিস্তানি। মেজাজ নষ্ট হয়ে গেল সঙ্গে-সঙ্গে। মার্থা তাঁর সর্বনাশ করে গিয়েছে। লন্ডনের অনেক দুরে বোল্টন নামের এই ছোট্ট শহরের রাস্তায় যদি প্রতি পাঁচজনে একটা ভারতীয় বা পাকিস্তানিকে দেখতে হয়, তাহলে এদেশে ফিরে আসার দরকার কি ছিল? কিছু ব্রিটিশ এখনও রয়ে গেছে ইন্ডিয়ায়। আর তারা আছে রাজার মতো। বাংলো, লন, গল্ফ খেলা, একগাদা ঝি-চাকর, কী আরাম! তখন মার্থা ভয় পেল। যদি ইন্ডিয়ানরা প্রতিশোধ নেয়। তার ওপর মাতৃভূমি টানতে লাগল। বোঝো এখন! এই তো মাতৃভূমি! হয়তো দেখা যাবে গোটা ব্রিটেনের ওয়ানফিফথ মানুষই হল এশিয়ার। লন্ডনের মেয়র একজন ইন্ডিয়ান, এমনটা হতে আর বেশি দেরি নেই। মাঝে-মাঝে মনে হয় মার্থার ভয়টাই ঠিক। ইন্ডিয়ানরা প্রতিশোধ নেবে। ওরা পঞ্চাশ বছরের মধ্যে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর পদে নির্বাচিত হয়ে যাবে। একটাই ভরসা, তাঁকে ততদিন বেঁচে থাকতে হবে না।
রবার্ট আবার বি.বি.সি. ধরলেন। তাঁর চোখ বড় হয়ে উঠল। জেসাস! কী দেখছেন তিনি! রোদ উঠবে! আজই। বিকেল আড়াইটে থেকে তিনটের মধ্যে। থাকবে এক ঘণ্টা। আবহাওয়ার দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। আগামীকাল আরও একটু বেশি সময় ধরে রোদ থাকবে। আঃ! রবার্ট ছুটে গেলেন জানালায়। কাঁচের আড়াল থেকে রাস্তার যেটুকু দেখা যাচ্ছে, মনটা আনন্দে ভরে গেল। টেলিফোনের কাছে ছুটলেন তিনি। মার্থার বান্ধবী এমিকে খবরটা দেওয়া দরকার। বড় বাতের ব্যথায় ভুগছে বেচারা! হ্যালো এমি? শুনেছ? ওহো, বি.বি.সি দ্যাখোনি? আজ রোদ উঠবে। পরিষ্কার ঝকঝকে রোদ। আরে, সকাল থেকে দিনটা কেমন যাবে আজকাল আর বোঝা যায় না। তুমি কখনও ভাবতে পেরেছ ব্রিটেনের ঐতিহ্যমন্ত্রী যৌন-কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েও টিকে থাকবে! হ্যাঁ, খবরটা পাওনি দেখছি। যা হোক, আড়াইটে থেকে তিনটের মধ্যে। বেরুবে নাকি? হ্যাঁ, আমি বের হব। শরীরটাকে একটু চাঙ্গা করা দরকার। যদি হাঁটতে পারো তাহলে চলে এসো পার্কে। বাই।
বেলা বারোটা থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন রবার্ট রোদ উঠলেও একটু ঠান্ডা থাকবে। হালকা পুলওভার পাবেন না মোটা হাফশ্লিভ? এখন মে মাস। হলুদ রঙটা মন্দ নয়। ওয়ার্ডরোব থেকে জামাকাপড় বের করে তা থেকে পছন্দে পৌঁছাতেই অনেকটা সময় গেল। মাঝে-মাঝে জানলায় যাচ্ছেন তিনি। হ্যাঁ, আকাশ পরিষ্কার হচ্ছে একটু-একটু করে। মেঘ সরে যাচ্ছে। এই সময় টেলিফোন বাজল।
হ্যালো। খুশি মনে রিসিভার তুললেন তিনি।
মিস্টার রবার্ট স্টিভেনসন প্লিজ।
হ্যাঁ, কথা বলেছি।
আমি ডিপার্টমেন্ট অফ ফরেন সার্ভিস অ্যান্ড এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ারস থেকে বলছি। আমাদের একজন অনারেবল গেস্ট আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান। আপনি অনুগ্রহ করে কথা বলবেন?
আপনাদের গেস্ট মানে ব্রিটেনের গেস্ট। নিশ্চয়ই বলব। হঠাৎ নিজেকে খুব মূল্যবান বলে মনে হচ্ছিল তাঁর।
হ্যালো। আমার নাম এস. কে. রয়। আমি ভারতবর্ষ থেকে আসছি।
ভারতবর্ষ! বিড়বিড় করলেন রবার্ট।
আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত কিন্তু আমার ঠাকুরদার জন্যে বাধ্য হয়ে কাজটা করতে হচ্ছে। আচ্ছা, আপনি কি কখনও দার্জিলিং-এ পোস্টেড ছিলেন?
দার্জিলিং! হ্যাঁ, ছিলাম। ইন্ডিয়া ইন্ডিপেন্ডেন্ট হওয়ার আগে পর্যন্ত ছিলাম।
তাহলে ঠিক আছে। আপনার একজন বাঙালি সেক্রেটারি ছিল, মনে আছে?
সেক্রেটারি? আমি ওকে বাবু বলে ডাকতাম।
ঠিক। তাঁর নাম শশীকান্ত রায়?
হ্যাঁ, মনে পড়ছে। শশীকান্ত। খুব ভদ্র এবং পরিশ্রমী।
তিনিই আমার ঠাকুরদা।
মাই গড। তা আপনি এখানে কী করছেন?
আপনাদের দেশ আমাকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছে। আমি বিজ্ঞানচর্চা করি। এখানে দিন তিনেক থাকব। ঠাকুরদা বললেন আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। আচ্ছা, মিসেস স্টিভেনসন এখন কেমন আছেন?
মার্থা? সে নেই।
ওহো! দাদু আমাকে একটা খাম দিয়েছিলেন মিসেস স্টিভেনসনকে দেওয়ার জন্যে। বলেছেন ওটা যেন অন্য কারও হাতে না দিই। শুনে উনি দুঃখ পাবেন।
কী আছে খামে? রবার্টের গলার স্বর বদলে গেল।
আমি জানি না। সিল করা। দাদু বলেছেন মিসেস স্টিভেনসনই ওটা ওঁর কাছে রাখতে। দিয়েছিলেন। কোনও গোপন ব্যাপার বোধ হয়। দাদুর শরীর ভালো না, তাই ওটা যার জিনিস তাঁকেই ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
আমাকে দেওয়া যাবে না?
তাহলে দাদুর সঙ্গে ফোনে কথা বলতে হয় আমাকে।
অবাক হলেন রবার্ট, শশী রায়ের বাড়িতে ফোন আছে নাকি?
হ্যাঁ। ওঁর চেষ্টায় আমার বাবা ডাক্তার হয়ে যাওয়ায় অবস্থাটা বদলে গিয়েছে। ঠিক আছে, যদি যোগাযোগ হয়, আমি খামটাকে আপনার কাছে পৌঁছে দেব। বাই।
রিসিভার রেখে দিল ছোঁকরা। হঠাৎ নিজেকে জড়ভরত বলে মনে হল রবার্টের। তাঁর বাবুর ছেলে ডাক্তার, তার ছেলে বৈজ্ঞানিক হয়েছে আর ব্রিটেন তাকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছে? ভাবা যায়? বাবু ভালো ইংরেজি লিখত একথা ঠিক। মাঝে-মাঝে তাঁর ভুলও ধরিয়ে দিত। বাট আফটার অল হি ওয়াজ এ বাবু। লোকটাকে শেষের দিকে তিনি অপছন্দ করতে আরম্ভ করেছিলেন। মার্থা যেন বড্ড বেশি ওর সঙ্গ চাইত। তাঁর সময় ছিল না বলে একবার ওই বাবুর সঙ্গে টাইগার হিলে চলে গিয়েছিলেন মাঝরাতে, সূর্য ওঠার মুহূর্তে হাজির থাকবে বলে। লোকটা এমন অধস্তন যে এ নিয়ে কথা বলা নিচু মনের প্রকাশ হয়ে যেত। কিন্তু মনে-মনে সেটাকে মনে রেখেছিলেন তিনি। জিমখানা ক্লাবে এক বাগানের ম্যানেজার যখন মার্থার সঙ্গে নাচতে চাইল আর মার্থারাজি হল না, তখন খেপে গিয়ে দু-চার কথা শুনিয়েছিলেন। পুষে রাখা রাগটা অন্যভাবে প্রকাশ করতে পেরে বেশ হালকা লেগেছিল তখন।
কিন্তু বাবুর কাছে কি জিনিস রেখে আসতে পারে মার্থা? একটা বন্ধ খামে কি কোনও কাগজ, চিঠি আর সেই বাবুকে নিশ্চয়ই নির্দেশ দিয়ে রেখেছে যাতে অন্য কারও হাতে খামটা না দেয়। অদ্ভুত! পঞ্চাশ বছর কম সময় নয়। এদেশে এসেও মার্থা চল্লিশের ওপর বেঁচে ছিল। কই, তাঁকে একবারও খামটার কথা বলেনি তো! তার মানে মার্থা ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল। একটা ব্যাপার যে লুকিয়ে রাখতে পারে সে অনেক কিছুই গোপন করতে সক্ষম। রবার্টের বুকের ভেতরটা কেমন হু-হুঁ করে হেসে উঠল। তিনি ভাবতেই পারছেন না মার্থা এমন কাজ করতে পারে। তাহলে তো তাঁর অজান্তে মার্থা অন্য লোকের সঙ্গে প্রেম করতে পারত, শোওয়ায়ি হলেও তিনি জানতে পারতেন না। তাঁর সংসারে সব কাজ ঠিকঠাক করে যে মেয়ে ভারতীয় বাবুর কাছে একটা খাম গোপনে রেখে এসে মুখ বন্ধ করে বসে থাকতে পারে তাঁকে আর বিশ্বাস করেন কি করে।
এই মুহূর্তে সামনে পেলে একটা হেস্তনেস্ত করতেন তিনি। জীবনে কখনও মার্থার গায়ে হাত তোলেননি, এখন। বড়-বড় নিশ্বাস ফেললেন রবার্ট। হঠাৎ মনে হল তিনি যেন আগ বাড়িয়ে ভেবে চলেছেন। একজন অধস্তন কর্মচারীর সঙ্গে মার্থা এমন কিছু করতে পারে না। কিছুতেই নয়। তিনি ছোট হয়ে যাবেন এমন কাজ তো নয়-ই। হয়তো সস্নেহে মার্থা কোনওকিছু উপহার হিসেবে দিয়েছিল বাবুকে। বাবু সেটা রেখে দিয়েছিল। এমন হতেই পারে ব্রিটিশদের প্রতি রাগবশত আজ সেটা ফেরত দিতে চায়। যে দিয়েছে তার হাতে দিলেই ভালো লাগবে বলে নাতিকে মার্থার কথা বলেছে।
এমনটা হতেই পারে। মন হালকা হল, সামান্য। আর ব্রিটিশ সরকারের কী হাল হয়েছে দ্যাখো, একজন ভারতীয়কে ডেকে আনতে হচ্ছে অতিথি হিসেবে বিজ্ঞানের ব্যাপারে। যাকে ডাকছে তার পেডিগ্রি কী?বাবুর নাতি। হুঁ।
খুব ধীরে-ধীরে পোশাক পরলেন রবার্ট। টাই বাঁধলেন। ছাতা নিলেন, সঙ্গে টুপি। দরজা বন্ধ করে ধীরে-ধীরে নামছিলেন এমন সময় সেই কিশোরী দরজা খুলল, হাই বব।
হ্যালো।
আমরা এই ফ্ল্যাট ছেড়ে দিচ্ছি। এইমাত্র মায়ের সঙ্গে আমার কথা হল। অন্য ভাড়াটে জোগাড় করে নাও। উইক এন্ডেই চলে যাব। মেয়েটা দরজা বন্ধ করে দিল।
স্তম্ভিত হয়ে গেলেন রবার্ট। ইচ্ছে করছিল বন্ধ দরজায় শব্দ করে বলেন, তোমরা এটা করতে পারো না। উঠে যাওয়ার আগে নোটিশ দিতে হবে। কাগজে-কলমে তাই লেখা আছে। নাঃ, আবার ল-ইয়ারের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
রাস্তায় পা দিলেন রবার্ট। ইতিমধ্যেই শুকিয়ে গিয়েছে পায়ের তলার জমি। মুখ তুলে আকাশটা দেখবার চেষ্টায় ছিলেন হঠাৎ কানে এল, হাউ ফার বব?
চমকে তাকালেন। সামনের মাখনের দোকানের জর্জ ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। লোকটা রসিকতা করতে চাইছে নাকি? তিনি উত্তর দিলেন, তোমার আর আমার থেকে সমান দূরত্ব। তিনি দাঁড়ালেন না।
*
এডওয়ার্ডদের বিয়ারের দোকানের সামনে পৌঁছাতেই আবার চিৎকার, হাই বব! সামার এসে গেল শেষপর্যন্ত।
বব হাসলেন। এড তাঁর চেয়ে ছোট কিন্তু খুব ছোট নয়।
ব্যাবসা কেমন চলছে?
একইকরম। আজকালকার ছেলে-ছোঁকরারা বিয়ারের বদলে ভদকা উইথ টনিক খাওয়া বেশি। পছন্দ করছে। খুঁড়ির ওপর প্যান্ট তুলতে-তুলতে বিশাল চেহারা নিয়ে বেরিয়ে এল এড। ওর গোঁফ পেকে ঝুলে পড়েছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে এড বলল, চললে কোথায়?
প্রথম সামার! রবার্ট হাসলেন। তারপর ইচ্ছে করেই বললেন, মার্থা খুব ভালোবাসত এমন দিনে হাঁটতে।
মার্থা? ওহো! ইয়েস। খুব ভালো মেয়ে ছিল সে।
ওর মুখ মনে আছে তোমার?
তা থাকবে না?কতদিন যাতায়াতের পথে কথা বলে গেছে।
আচ্ছা এড, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
মার্থাকে তোমার কীরকম মনে হত? চরিত্রের কথা বলছি।
দ্যাখো বব, চরিত্র অনেকরকম হয়। ও খুব ভালো মেয়ে এইটুকু মনে আছে।
ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ।রবার্ট হাঁটতে লাগলেন, চরিত্র অনেকরকমের হয়। সুতরাং এড কথাটা এড়িয়ে গেল। যৌবনে এড কী না করেছে। সুন্দরী মেয়ে দেখলেই পেছনে লাগত। আর মার্থা তো সত্যিকারের সুন্দরী ছিল।
হঠাৎ চিৎকারটা কানে এল। থমকে দাঁড়ালেন রবার্ট। উলটোদিক থেকে গোটাকয়েক ছেলেমেয়ে চিৎকার করতে-করতে আসছে কেন? একজন একটা প্যাকেটকে এমনভাবে লাথি কষাল যে। সেটা উড়ে গিয়ে পড়ল মাঝরাস্তায়। এই চিৎকার এবং বেপরোয়া চলাফেরা যে ওদের আনন্দের প্রকাশ তা বুঝতে সময় লাগল। তিনটে কালো ছেলে আছে ওদের মধ্যে। নিশ্চয়ই আফ্রিকা থেকে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে আসা ছেলে। ব্রিটেনকে ওরাও শেষ করে দিচ্ছে। আর ওই সাদা মেয়েটা, তুই কী করে কালোটাকে কোমর জড়িয়ে ধরতে দিলি! এই বোল্টনেই যদি এমন অবস্থা তাহলে লন্ডনে তো হাঁটাই যাবে না। খুব কষ্ট হচ্ছিল রবার্টের। সারা পৃথিবী যেন ও-দেশটাকে কলোনি বানিয়ে ফেলেছে।
তিরতিরে রোদ উঠেছে। আহা! পার্কের সামনে পৌঁছে মুখে হাসি ফুটল তাঁর। এমি আসছে। বেচারার হাঁটতে কষ্ট হলেও সেজেছে খুব।
হ্যালো এমি!
হ্যালো বব!
শেষপর্যন্ত এবারের সামারটাকে দেখতে পেলাম।
বি.বি.সি-ও ঠিক বলল শেষপর্যন্ত।
যা বলেছ। শরীর কেমন আছে?
শরীরের কথা ছেড়ে দাও। দ্যাখো, তোমার চেয়ে আমি বয়সে বড় তবু—
চুপ করো। তোমাকে তিনটে বাচ্চা পেটে ধরতে হয়নি। এমি খ্যাক-খ্যাক করে উঠল, এখন কবরে গেলেই হয়। মাঝে-মাঝে ভাবি মার্থা ভাগ্যবতী।
কেন? কেন মনে হয়?
রবার্ট সতর্ক হলেন।
চলো, বেঞ্চিটায় বসা যাক। পা ব্যথা করছে। এমি এগিয়ে গিয়ে একটা খালি বেঞ্চিতে বসে পড়ল। কয়েকদিন ভিজে-ভিজে সিমেন্টের বেঞ্চিও কেমন স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে। রবার্ট বসতে বাধ্য হলেন। প্রশ্নটা যেন এমির কানেই যায়নি। সে তার বেড়ানো গাল তুলে আকাশ দেখছে। প্রায় এরকম চেহারাই হয়ে গিয়েছিল মার্থার। অ্যাদ্দিন বেঁচে থাকলে বান্ধবীর চেয়ে কম কিছু হত না। কোঁচকানো চামড়া, রোঁয়া ওঠা বেড়ালের মতো।
মার্থা তোমার খুব বান্ধবী ছিল, না?
ব্যাপারটা কী?কথাটা তুমি জানো না?
আচ্ছা, আমি ছাড়া মার্থা অন্য কারও প্রেমে পড়েছে কখনও?
হঠাৎ হেসে উঠল এমি, মাই গড! তুমি কি নিশ্চিত যে তোমার প্রেমে সে পড়েছিল?
না না, আগের কথাটার উত্তর দাও।
আমার তো উত্তর পেয়ে গেলে। মুখ ফিরিয়ে নিল এমি।
মেজাজ খারাপ হয়ে গেল রবার্টের। অতি কুচুটে মহিলা। মার্থা বেঁচে থাকতেই একে তিনি দেখতে পারতেন না। স্ত্রী-র বান্ধবী হওয়া সত্বেও এড়িয়ে চলতেন। হঠাৎ গম্ভীর গলায় তিনি ঘোষণা। করলেন, কিন্তু আমি একটা ঘটনা জানতে পেরেছি।
এমি সন্দেহের চোখে তাকাল, কীরকম?
চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়লেন রবার্ট, পেয়েছি!
যার কথা বলছ সে এখন কবরে শুয়ে আছে।
তাতে তো ঘটনাটা মিথ্যে হয়ে যায় না! অভিনয় করে যাচ্ছিলেন রবার্ট।
বুঝতে পেরেছি। জন তোমাকে বলেছে।
জন? বেশ হতভম্ব হয়ে গেলেন রবার্ট।
ক্যাসিনোর মালিক ছিল। প্রথমে আমার পেছনে লেগেছিল, পাত্তা না পাওয়াতে মার্থাকে জপাতে লাগল। ওর ভদ্রতাবোধকে দুর্বলতা বলে ভুল করল জন।
তারপর? নিশ্বাস চাপলেন রবার্ট।
তারপর আর কি! এসব পুরোনো হেঁদো কথায় এখন লাভ কী? দুজনেই তো মরে গিয়েছে। সারাদিন একা থাকত, ছেলেপুলে হয়নি, বেচারা তাই ক্যাসিনোয় যেত।
গিয়ে জুয়ো খেলত?
তা একটু-আধটু, আমিও খেলেছি।
জনের সঙ্গে সম্পর্কটা, মানে, কতদূর এগিয়েছিল?
দ্যাখো, জন মিষ্টি-মিষ্টি কথা বলত, মার্থা শুনে যেত। ব্যস।
গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলেন রবার্ট। হ্যাঁ, একসময় মার্থা তাঁকে বলত ক্যাসিনোয় যাওয়ার কথা। তিনি যে সেটা পছন্দ করতেন না তাও সে জানত। কিন্তু জন যে প্রেম নিবেদন করত তা। জানা ছিল না। এমির কথা অনুযায়ী জন প্রেম-নিবেদন করেছে, মার্থা কিছুই বলেনি। তিনি ঘুরে তাকালেন, মার্থা তোমাকে ইন্ডিয়ার কথা বলত?মনে করে দ্যাখো তো!
হ্যাঁ। ওর খুব ভালো লেগেছিল ইন্ডিয়ায় থাকতে।
ভালো লেগেছিল? ও-ই তো জোর করে চলে এল।
তা জানি না। যে শহরে থাকত তার গল্প করত খুব। হ্যাঁ, কি একটা জায়গা যেন, যেখান থেকে সানরাইজ খুব ভালো দেখা যায়–
টাইগার হিল। খসখসে গলায় বললেন রবার্ট।
হ্যাঁ। টাইগার হিলের বর্ণনা করত সে। বলত অত ভালো জায়গা নাকি পৃথিবীতে হয় না। আমি ঠাট্টা করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ওখানে টাইগার আছে নাকি? সে জবাব দিয়েছিল, একদম না। তবে বেড়ালের মতো স্বভাবের মানুষ সেখানে গেলে কখনও-কখনও টাইগার হয়ে যায়। ওহো, এবার উঠব বব।
এত তাড়াতাড়ি? রবার্ট বাধ্য হলেন উঠতে, ওখানকার কথা সে বলেছে তোমাকে? কোনও বাবু?মানে আমার এক ক্লার্ক যার সঙ্গে সে টাইগার হিলে গিয়েছিল, তার কথা কিছু বলেছিল?
হাঁটতে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল এমি, তারপর মাথা নাড়ল, একজনের কথা খুব বলত মার্থা। লোকটা ওকে কি করে আত্মবিশ্বাস বাড়ানো যায় শিখিয়েছিলেন। ওহো, মনে পড়েছে। লোকটার সঙ্গে ওর একটা চুক্তি হয়েছিল।
চুক্তি!
হ্যাঁ। দুজনে যা বিশ্বাস করে তা একটা কাগজে লিখে খামে বন্ধ করে দুজনকে দিয়েছিল। তিরিশ বছর পরে দেখা করে সেই খাম খুলে দেখা হবে তখনও সেই বিশ্বাসটা আছে কিনা। মার্থা প্রায়ই বলত কাজটা করা হচ্ছে না। সে চিঠিও দিয়েছিল লোকটাকে কিন্তু জবাব পায়নি। হয়তো ঠিকানা বদলেছে কিংবা মরেই গেছে। এমি হাসল, মজার খেলা, না? আমি বলতাম সময়ের সঙ্গে মন পালটায়, অতএব বিশ্বাসও পালটাবে। মার্থা তখনও স্বীকার করেনি। তাও তো অনেকদিন হয়ে গেল।
তাহলে মাথার কাছে সেই লোকটার খাম ছিল?
থাকার তো কথা। কারণ দুজনের সামনেই সেটা খোলার চুক্তি ছিল।
এমি চলে গেল। নিজেকে খুব অসহায়, ছিবড়ে হয়ে যাওয়া মানুষ বলে মনে হচ্ছিল রবার্টের। তাঁরই এক বাবুর সঙ্গে মার্থা এসব করেছে অথচ তাঁকে কিছুই জানায়নি। এড কিংবা জনকে তিনি মেনে নিতে পারেন, ওরা ইন্ডিয়ানদের মতো অত সেন্টিমেন্টাল নয়। বাট দ্যাট বাবু রবার্ট থপথপ করে হাঁটতে লাগলেন। রোদ চলে গিয়েছে। আকাশে আবার মেঘেদের আনাগোনা, হঠাৎ মনে হল ইন্ডিয়ায় গিয়ে সেই বুড়োটাকে দু-ঘা কষিয়ে দিলে কেমন হয়? শরীরটা নব্বই বছরের না হলে তিনি নিশ্চয়ই যেতেন। ব্যাঙ্কের পাশ দিয়ে রাস্তাটা সংক্ষেপ করতেই এগিয়ে গিয়ে মনে হল পাশেই কবরখানা আর সেখানেই মার্থা শুয়ে আছে। প্রথম-প্রথম প্রতি রবিবার, জন্মদিন, মৃত্যুদিনে যেতেন তিনি ফুল নিয়ে। আজকাল আর যাওয়া হয় না। আজকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করবেন নাকি তাঁর সঙ্গে এমন ব্যবহার মার্থা কেন করল? কবরখানার গেটের দিকে তাকিয়ে তিনি মাথা নাড়লেন। যাকে জিজ্ঞাসা করবেন তার তো একদম ইচ্ছে করে না। মার্থার পাশের জায়গাটা তাঁর জন্যে নির্দিষ্ট করা রয়েছে। ভাবতেই গায়ে কাঁটা ফোটে।
বৃষ্টি নামল। মাঝে-মাঝে রোদ ওঠার একটা খেলা চলল কয়েকদিন ধরে। এই কদিনে রবার্টের কিছু নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে। নিচের ভাড়াটে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে কিন্তু বাড়তি ভাড়া দিয়ে গেছে। ওদের চলে যাওয়ার কারণ অদ্ভুত। মেয়েটা শব্দ করতে চায়। এ বাড়িতে সেটা নিষেধ। বলে চলে যাচ্ছে। এমনটা কে কবে শুনেছে? মার্থার সমস্ত জিনিসপত্র একটা আলমারিতে তোলা ছিল। রবার্ট সেগুলো খুঁটিয়ে দেখেছেন কোনও মুখবন্ধ খাম পান কিনা। কিন্তু তাঁর সব চেষ্টাই বৃথা। হয়েছে। মার্থার রেখে যাওয়া জিনিসপত্রে কোনও গোপন ঘটনা নেই। এমি যা বলেছে তা তাহলে সত্যি নয়। হঠাৎ তাঁর খেয়াল হল মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে মার্থা একটা লকার নিয়েছিল। ব্যাঙ্কে। দুজনের নামেই। যতদূর জানেন তাতে কিছুই রাখা হয়নি। রাখার সময় পায়নি মার্থা। তাদের অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতি বছর লকারের ভাড়া অ্যাডজাস্ট করে নেয় ব্যাঙ্ক। একবার। লকারটা দেখতে হবে।
সোমবার সকালে টেলিফোন বাজল। জামা-প্যান্ট পরে তৈরি হচ্ছিলেন রবার্ট। রিসিভার। তুললেন। তাঁর এজেন্ট বলল, একজন ভাড়াটে পেয়েছি। আগের ভাড়াটের চেয়ে বেটার। মেয়েটি একাই থাকবে।
একা মেয়ে?
আঃ, তাতে তোমার কি সমস্যা বব? এ আওয়াজ করবে না।
ঠিক আছে কিন্তু মেয়েটা কী করে?
জিজ্ঞাসা করিনি। অ্যাডভান্স দেবে, থাকবে। ইন্ডিয়ানরা টাকাপয়সার ব্যাপারে–।
ইন্ডিয়ান? আমার বাড়িতে? ওহো, না। কিছুতেই নয়।
তুমি ঠিক বলছ বব?
একশোবার ঠিক বলেছি। ওরা ব্রিটেনকে ইন্ডিয়া বানাচ্ছে, বোল্টনকে প্রায় বানিয়ে ফেলেছে কিন্তু আমার বাড়িটাকে কিছুতেই ঢুকতে দেব না। টেলিফোন নামিয়ে রেখে দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন বর্ষাতি আর ছাতা নিয়ে।
রাস্তায় লোক নেই, বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে। পাগল ছাড়া কেউ বাইরে বের হবে না। কিন্তু তিনি তো পাগলই হয়ে গেছেন। লকার খুলে উঁকি মারতেই একটা বড় খাম দেখতে পেলেন তিনি। কাঁপা হাতে সেটা বের করতে মার্থার হাতের লেখা নজরে পড়ল, আমি যদি মরে যাই তাহলে দয়া করে নিচের ঠিকানায় পোস্ট করে দিও।
ঠিকানা দেখেই গা জ্বলে উঠল তাঁর। বাড়ি ফিরে এলেন কাঁপা পায়ে।
শোওয়ার ঘরে ঢুকে বড় খামটা খুলতেই একটা খাম বের হল। এটা তাঁর অফিসের খাম, এতদিন বাদেও চিনতে পারলেন। লোকটা অফিসের স্টেশনারি মিস-ইউজ করেছে। খামটার মুখ বন্ধ। কী লিখেছে লোকটা? খুলব-খুলব করেও তিনি খুলতে পারছিলেন না। এতদিনকার শিক্ষা বাধা তৈরি করছিল। শেষপর্যন্ত অনেক অস্বস্তি সত্বেও সিদ্ধান্ত নিলেন ওটাকে ইন্ডিয়াতে পাঠিয়ে দেবেন। মার্থার শেষ অনুরোধ রাখবেন।
সেই বিকেলেই চিঠি এল লন্ডন থেকে। এস. কে. রায় পাঠিয়েছে। সেই বাবুটার নাতি যে ব্রিটেনের অতিথি হয়ে এসেছে। রাগে খামটাকে ছিঁড়ে ফেলতে গিয়েও মনে পড়ে গেল। মার্থা ওই লোকটার কাছে যা গচ্ছিত রেখে এসেছিল তাই রয়েছে এখানে। বাবু এতদিন পরে পাঠিয়ে দিয়েছে। খাম খুললেন তিনি। লন্ডন থেকে এস. কে. রায় লিখেছে, ডিয়ার স্টিভেনসন, আমার দাদুর সঙ্গে কথা বলেছি। মিসেস স্টিভেনসনের মারা যাওয়ার খবর পেয়ে তিনি খুব দুঃখিত এবং আপনাকে সহানুভূতি জানাতে বলেছেন। যা হোক, দাদুর ইচ্ছেমতন খামটা আপনার কাছে পাঠালাম। ধন্যবাদসহ–।
খামটাকে দেখলেন তিনি। সেই একই খাম। মার্থাও স্টেশনারির মিস-ইউজ করেছে। কাঁপা হাতে খামটাকে ছিড়লেন রবার্ট। একটা ভাঁজ করা কাগজ। কাগজে চোখ রাখলেন। তাঁর সব গুলিয়ে যাচ্ছিল। কোনওরকমে শরীর তুলে লকার থেকে আনা খামটার মুখ ছিড়লেন তিনি। একইরকম কাগজ। ওপরে লেখা–দশই মার্চ, ছেচল্লিশ, টাইগার হিলের সকাল। তার নিচে লেখা, আমি। ভগবানে বিশ্বাস করি। আমৃত্যু করব। শশীকান্ত রায়।
রবার্টের মনে হচ্ছিল তিনি শূন্যে ভেসে চলেছেন। প্রথম কাগজটা আবার তিনি তুলে ধরলেন, দশই মার্চ, ছেচল্লিশ, টাইগার হিলের সকাল। আমি ববকে ভালোবাসি। মার্থা স্টিভেনসন।
বাইরে বৃষ্টি পড়ে চলেছে সমানে। রবার্ট টিভি খুললেন। খবর হচ্ছে। লন্ডনের এক পাড়ায় ভারতীয়দের সঙ্গে সাদা ছেলেদের বিরোধ লেগেছে। তিনজন ভারতীয়কে রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। টিভি বন্ধ করলেন তিনি। তারপর টেলিফোন তুললেন, ম্যাক, আমি বব। রবার্ট স্টিভেনসন। হ্যাঁ, তুমি মেয়েটাকে পাঠিয়ে দিতে পারো। বাই।
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন