শিরোনাম: ইচ্ছাশক্তি

গল্পকার: Author Avatar ইয়াকুব আলী তুহিন

একটি ছোট্ট গ্রাম নাম তার শালবন। গ্রামটি প্রকৃতির কোলে অবস্থিত। চারিদিকে সবুজ শ্যামল ক্ষেত আর সুনসান পল্লী। এখানকার মানুষের জীবনযাত্রা সহজ সরল, কোলাহলমুক্ত। গ্রামের মূল সড়কের পাশেই একটি প্রাচীন বটগাছ, যা এই গ্রামের প্রতীকস্বরূপ।

গ্রামের মানুষ প্রধানত কৃষিকাজে লিপ্ত। গ্রামের সব চেয়ে পরিচিত চাষী হলেন হরিপদ চাচা। সত্তর পেরিয়েও তিনি প্রতিদিন মাঠে কাজ করেন। তাঁর বাড়িটি গ্রামের মাঝখানে যেখানে একটি ছোট্ট উঠোন, কুয়ো আর আমগাছের ছায়ায় মিশে থাকে তার প্রতিদিনের দিনযাপন।

হরিপদ চাচার একমাত্র ছেলে কিশোর বয়সী মধু। সে স্কুলে যায়, লেখাপড়ায় বেশ ভালো। কিন্তু তার মনে শহরের জীবন নিয়ে অনেক স্বপ্ন। শহরের বড় বড় দালান উজ্জ্বল আলোর ভিড়ে নিজেকে খুঁজে পেতে চায় সে। কিন্তু বাবার চোখে-মুখে সেই আশা দেখেনা, যে আশা সে শহরের জাঁকজমকে দেখতে পায়।

হরিপদ চাচার মেয়ে রমলা কিছুদিন আগে বিয়ে হয়েছে পাশের গ্রামে। মাঝে মাঝে সে আসে পিতৃগৃহে বাবা-মার খোঁজ নিতে। গ্রামের নারীরা সাধারণত ঘরের কাজকর্মেই ব্যস্ত থাকে। তারা শীতল পাটি বোনে, দুধ দোয়ায় আর রান্নাবান্নায় মগ্ন থাকে। তাদের মাঝে সুখ-দুঃখের গল্প হয়, হাসি-ঠাট্টা চলে।

গ্রামের একমাত্র পাঠশালা হেডমাস্টার মশাইয়ের তত্ত্বাবধানে চলে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা সেখানে পড়তে যায়। হেডমাস্টার মশাইয়ের একমাত্র লক্ষ্য গ্রামের শিক্ষার মানোন্নয়ন। কিন্তু সবার পক্ষে লেখাপড়া করা সম্ভব হয়না। অনেকেই চাষাবাদের কাজে ব্যস্ত থাকে, পরিবারের জন্য উপার্জন করতে হয়।

গ্রামে একটি ছোট্ট বাজার বসে প্রতি সপ্তাহে। বাজারের দিন গ্রামের লোকেরা আসে সবজি, ফলমূল, দুধ, ঘি ইত্যাদি বিক্রি করতে। সেই বাজারেই আছে পটলের মিষ্টির দোকান। তার মিষ্টি খেতে গোটা গ্রামের মানুষ ভিড় করে।

গ্রামের মানুষগুলোর মধ্যে অদ্ভুত এক আন্তরিকতা রয়েছে। তারা একে অপরের সুখ-দুঃখে পাশে দাঁড়ায়। গ্রামের মানুষগুলো নিজেরাই নিজেদের উৎসব আয়োজন করে পুজো-পার্বণে মেতে ওঠে। দুর্গাপূজার সময় গোটা গ্রাম যেন এক হয়ে যায়, পুজো মণ্ডপে সেজে ওঠে গ্রাম।

কিন্তু সবকিছুর মধ্যেও গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রায় রয়েছে নানা সমস্যা। গ্রামে একটি মাত্র স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে, যেখানে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাব রয়েছে। রাস্তার অবস্থা খারাপ, বর্ষাকালে চলাচলে দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

একদিন হরিপদ চাচা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মধু তার বাবাকে নিয়ে গেলো সেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। কিন্তু প্রয়োজনীয় ওষুধ সেখানে মেলেনি। গ্রামবাসীরা চাঁদা তুলে তাকে শহরের হাসপাতালে পাঠাল। সেখানে গিয়ে মধু প্রথমবার শহরের রঙিন জীবন দেখল। তার স্বপ্ন যেন আরও গভীর হল।

হাসপাতালে কয়েকদিন কাটিয়ে হরিপদ চাচা সুস্থ হয়ে ফিরলেন। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা তাকে নতুন কিছু শিখিয়েছে। তিনি মধুকে বললেন,

“বাবা শহরের চাকচিক্য ভালো কিন্তু গ্রামের মাটি এই সবার ভালোবাসা কোথাও পাবি না। তুই বড় হয়ে গ্রামটাকে গড়িস তুই যেন এই গ্রামের গর্ব হস।”

মধু বাবার কথাগুলো মন দিয়ে শুনল। তার মনে হল সত্যিই তো, এই গ্রামের মানুষের ভালবাসা, মাটির গন্ধ এই প্রকৃতির ছোঁয়া কোথাও পাওয়া যায় না। সে পড়াশোনা করবে তার গ্রামের উন্নতির জন্যই।

হরিপদ চাচা সুস্থ হওয়ার পর গ্রামের লোকেরা আবার তাদের কাজে মগ্ন হল। তবে মধুর মনে বাবার কথাগুলো গভীর দাগ কেটে গেল। সে প্রতিজ্ঞা করল বড় হয়ে সে তার গ্রামকে এক নতুন রূপ দেবে। গ্রামের শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতির জন্য কাজ করবে।

শালবন গ্রামটি দিনের পর দিন বদলাচ্ছে কিন্তু তার প্রকৃত সৌন্দর্য ও মমতা অটুট থাকছে। মধুর চোখে সেই স্বপ্ন ফুটে উঠছে, যে স্বপ্ন একদিন এই গ্রামকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যাবে।

মধু গ্রামের যুবকদের নিয়ে একটি ছোট দল গঠন করল। এই দলের উদ্দেশ্য হলো গ্রামের সমস্যাগুলি চিহ্নিত করে সেগুলির সমাধান করা। প্রথমত তারা গ্রামের রাস্তাগুলি সংস্কার করার জন্য উদ্যোগ নিল। গ্রামবাসীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে, নিজেরা হাতে হাতে কাজ করে রাস্তা মেরামত শুরু করল। তাদের এই প্রচেষ্টা গ্রামের মানুষদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা জাগিয়ে তুলল।

তারা একটি ছোট লাইব্রেরি গড়ে তুলল, যেখানে গ্রামের ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনার সুযোগ পেল। মধু নিজে তাদের পড়ানোর দায়িত্ব নিল। তিনি তাদের শুধু পাঠ্যবই নয়, গ্রামোন্নয়নের বিষয়েও শিক্ষা দিলেন। তাদের মধ্যে একটি জ্ঞান ও উদ্দীপনা ছড়িয়ে পড়ল, যা গ্রামকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

গ্রামের স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধানে মধু এবং তার দল একটি স্বেচ্ছাসেবী স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে তুলল। তারা শহরের কিছু ডাক্তার ও নার্সদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিনামূল্যে সেবা দেওয়ার জন্য রাজি করাল। প্রতি মাসে তারা গ্রামের মানুষদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা শিবিরের আয়োজন করল।

গ্রামের মহিলাদের স্বনির্ভর করার জন্য তারা একটি সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলল। মহিলারা এখানে এসে সেলাই শিখল এবং নিজেরা বিভিন্ন ধরণের পণ্য তৈরি করে বিক্রি করতে শুরু করল। এতে তারা আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হল এবং তাদের জীবনে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন হল।

একদিন মধু বাবাকে নিয়ে গ্রামের মাঠে বসে ছিল। হরিপদ চাচা গ্রামের পরিবর্তন দেখে আনন্দে বললেন,

“বাবা, তুই যে আমার স্বপ্নকে সত্যি করেছিস তাতে আমি খুব খুশি। তুই শুধু আমার নয়, পুরো গ্রামের গর্ব।”

মধু বাবার কথা শুনে হাসল, “বাবা, এটা শুধু আমার একার কাজ নয়। গ্রামের সবার সহযোগিতা ছাড়া এটা সম্ভব হত না। আমরা সবাই মিলে এই গ্রামকে নতুন করে গড়েছি এবং এই যাত্রা চলতেই থাকবে।”

হরিপদ চাচার চোখে জল এসে গেল। তিনি বুঝলেন সত্যিকারের উন্নতি তখনই সম্ভব যখন মানুষ একসাথে কাজ করে, একে অপরের পাশে দাঁড়ায়।

গ্রামের জীবনের এই খুঁটিনাটি গল্পই যেন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় কোথাও না কোথাও আমাদের শেকড় এই মাটির সাথেই গভীরভাবে যুক্ত। আমরা যেখানেই যাই না কেন, সেই শেকড়ের টান আমাদের বারবার ফিরিয়ে আনে মাটির কাছেই ভালোবাসার আঁচলে।

গ্রামের সেই ছোট ছোট সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-নিরাশার মাঝে লুকিয়ে থাকে এক অপার জীবনবোধ। সেই জীবনবোধই আমাদের জীবনের প্রেরণা, শক্তি আর অটুট বন্ধনের নিদর্শন। মধু আর তার গ্রামের মানুষের এই প্রচেষ্টা আমাদের দেখিয়ে দেয় সত্যিকার উন্নতি কখনও একা আসে না, সেটা আসে মিলেমিশে একসাথে কাজ করার মাধ্যমে।

শালবন গ্রামের এই কাহিনী প্রমাণ করে ইচ্ছাশক্তি ও পরিশ্রমের মাধ্যমে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। গ্রামের মানুষের আন্তরিকতা, ঐক্যবদ্ধতা ও সংগ্রামের গল্প আমাদের প্রতিনিয়ত অনুপ্রাণিত করে শিখিয়ে দেয় প্রকৃত সাফল্যের অর্থ কী?

এখন পর্যন্ত গল্পটি পড়া হয়েছে ৫১ বার
যদি গল্পটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
    মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন