সমরেশ-মজুমদারের-গল্প-গুচ্ছ-সমরেশের-সেরা-১০১-গল্প.

শিরোনাম: ইচ্ছে বাড়ি

গল্পকার: Author Avatar সমরেশ মজুমদার

পঞ্চাশে পা দেওয়ার আগে অন্তত পঁচিশবার শান্তিনিকেতনে গিয়েছে অরবিন্দ কিন্তু কখনও দু রাতের বেশি থাকেনি। বন্ধুবান্ধবদের বাড়ি ছড়িয়ে আছে পূর্বপল্লি এবং রতনপল্লিতে। ষাট-সত্তর বছরের বাড়ি সব। বিরাট বাগান, অনেক ঘর। সঞ্চয়িতা এবং গীতবিতান হেঁকে নামকরণ করা হয়েছিল তাদের। সেইসব বাড়ির মালিকদের অনেকেই রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য ছিলেন।

পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথকে অবলম্বন করে বিখ্যাত হয়েছেন এমন কয়েকজন বন্ধুর পিতাকে সে যৌবনে দেখেছে। অরবিন্দ লক্ষ করত ওসব বাড়িতে একটা গম্ভীর-গম্ভীর ভাব ছিল, এমনকী। সন্ধের পর মদ খাওয়ার সময়ও কেউ চপল রসিকতা করত না। এঁরা যে ব্রাহ্ম তা নয়, কিন্তু কেউ বাড়িতে সন্ধ্যা মুখার্জির গান গাইত না। কলকাতার এত কাছে জায়গাটা চুপচাপ পড়েছিল রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি নিয়ে। বর্ষায় বৃষ্টি দেখতে অথবা দোল কিংবা পৌষ উৎসবে মানুষ ছুটে যেত কদিনের জন্যে। হঠাৎ আশির দশকের মাঝামাঝি কলকাতার বাবুদের মনে হল শান্তিনিকেতনে বাড়ি বানালে চমক্কার হয়। যে জমির দাম ছিল এক হাজার, তা হয়ে গেল ছাব্বিশ। খাল পেরিয়ে যে ধু-ধু প্রান্তর সামনে পড়ে থাকত, তাতে গজিয়ে উঠল সুন্দর-সুন্দর বাড়ি। এমনকী প্রান্তিকের মাঠের জমিও বারো হাজার কাঠায় উঠে এল, যেখানে সন্ধের পর প্রদীপ জ্বলত না বারো বছর আগে। বন্ধুরা বলল, অরবিন্দ, চটপট একটা জায়গা কিনে ফ্যালো, বাড়ি না বানাও এর চেয়ে ভালো ইনভেস্টমেন্ট আর হয় না।

অরবিন্দকে সবাই সফল মানুষ বলে। কলকাতা শহরে তার একটি চালু ব্যাবসা আছে। বছর পনেরো আগে মাত্র দেড় লাখ টাকায় যে ফ্ল্যাট কিনেছিল তার দাম এখন ষোলো লাখ। কলকাতার কয়েকটা বড় ক্লাবের মেম্বার সে। নিজে কিছু করে না বটে, কিন্তু সাংস্কৃতিক জগতের বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে আড্ডা মারতে কোনও অসুবিধে হয় না।

ওর একমাত্র ছেলে সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে পাশ করে যাদবপুর থেকে বি. ই. ডিগ্রি নিয়ে এখন। আমেরিকায় পড়ছে। অরবিন্দর স্ত্রী ইতি বড় ভালোমানুষ। খুব হাসেন। দেখলেই বোঝা যায় স্বামী সম্পর্কে কোনও বড় অভিযোগ নেই। ইতি নিজের চেহারাটাকে বুড়িয়ে যেতে দেননি, অত বড় ছেলের মা বলে মনে হয় না। তুলনায় অরবিন্দর মনে একটু দুঃখ থাকা স্বাভাবিক। ইদানীং ঝুপঝুপ করে টাক পড়ছে তার। তা টাক তো সব মানুষকেই মেনে নিতে হয়েছে। ইতি প্রায়ই অনুপম খেরের কথা বলে তাকে সান্ত্বনা দেয়। এমন একজন পঞ্চাশে পা দেওয়া মানুষকে সফল না বলে উপায় কি! ওকে ধার করতে হয় না, গাড়ি আছে, ব্যাবসাটা দু-দিন না দেখলে অচল হয় না।

মাস তিনেক আগে ওরা চার বন্ধু শনিবারের শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে চেপেছিল। বিকেল-রাত সকাল কাটিয়ে দুপুরে ফিরে আসবে। রতনপল্লির ববি গুহর বাড়িতে ওরা উঠেছিল। ববিও ওদের সঙ্গে এসেছে। আসা মাত্র দারোয়ান চাকররা চরকির মতো ছুটছে। সন্ধে হল। চাঁদ উঠল। ববি গুহর বাগানঘেরা বারান্দায় চেয়ার পেতে বসা হয়েছে। কলকাতা থেকে আনা হুইস্কির সঙ্গে মাছভাজা চলছে। ঢাউস চাঁদের দিকে তাকিয়ে অরবিন্দর হঠাৎ মনে হল, পঞ্চাশ বছর পরে সে আর ওই চাঁদটাকে দেখতে পাবে না। পঞ্চাশ বছর পরে তার বয়স একশো হবে। দূর, অতদিন কি, চল্লিশ বা তিরিশ বছর পরেও যে দেখতে পাবে, তার নিশ্চয়তা কী! সে চুপচাপ বন্ধুদের দিকে তাকাল। ওরা কথা বলছে। পঞ্চাশের গায়ে বয়স সবার। তিরিশ বছর পর এদের অনেকেই। থাকবে না। চল্লিশের পর তো নয়-ই। কিন্তু হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে দুশো বছর বাদেও এখানে বসে মাল খাবে। রবীন্দ্রনাথ একাশি বছর বয়সে মারা গিয়েছেন এবং তারপর বাঁচা বাঙালির আশা করাই উচিত নয়। অর্থাৎ তিরিশ বছরটাই তাহলে ম্যাক্সিমাম আয়ু। অরবিন্দর মন খুব খারাপ হয়ে গেল। ঠিক তখনই গেট খুলে সে লোকটাকে ঢুকতে দেখল। জ্যোৎস্না মাখতে-মাখতে একটা সাদা জামা এবং ধুতি এগিয়ে আসছে। ববি গ্লাসে চুমুক দিয়ে চাপাগলায় বলল, হু ইজ

ততক্ষণে লোকটা সামনে এসে গিয়েছে। বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে নমস্কার করে বলল, আমি বোধহয় এসময় এসে আপনাদের বিরক্ত করলাম?

ববি গুহ জিজ্ঞাসা করল, আপনার পরিচয়?

আজ্ঞে, আমি মদ বিক্রি করি।

মাই গড! তা এখানে কী দরকার?

আজ্ঞে, আপনারা আমার ওপর অবিচার করছেন। আপনারা প্রায়ই আসেন, ক-দিন থাকেন কিন্তু কলকাতা থেকে মদ কিনে এনে খান। আমি স্থানীয় মানুষ, যদি আমাকে সুযোগ দেন, তাহলে কলকাতা থেকে বয়ে আনার কাজটা করতে হয় না।

বোলপুরে আপনার মদের দোকান আছে?

আজ্ঞে না। তবে যে-কোনও মদ আমি এনে দিতে পারি। স্কচ খেতে চাইলে চব্বিশঘণ্টার নোটিশ দিতে হবে। আমি একেবারে কলকাতার দামেই দেব।

কোত্থেকে দেবেন?

লোকটি বিনীতগলায় বলল, ব্যাবসার গোপনীয়তা জানতে চাইবেন না স্যার।

আমরা যে মদ খাই, তা আপনি জানলেন কী করে?

চেহারা দেখে।

সৌমেন চুপচাপ শুনছিল। চাপাগলায় বলল, আমার বউ সেদিন বলছিল রোজ মদ খেয়ো না। এরপর লোকে চেহারা দেখে বুঝতে পারবে।

ববি গুহ ধমকাল, রসিকতা করছেন? চেহারা দেখে বুঝতে পেরেছেন?

আজ্ঞে, আপনারা চারজন শিক্ষিত, সম্পন্ন মানুষ ছেলেমেয়েদের না নিয়ে এখানে এসেছেন। আপনারা শান্তিনিকেতনের দ্রষ্টব্য জিনিস দেখতে যান না, প্রান্তিকের মাঠে হাঁটতেও দেখি না। অবশ্য এখন আর মাঠ কোথায়? মেয়েমানুষের দোষও আপনাদের নেই। চারজন ব্যাটাছেলে সন্ধেবেলায় একসঙ্গে থাকলে যদি একটু মদ খায় তাতে তো কোনও ক্ষতি নেই। এই দেখুন, আজ শনিবার, রতনপল্লির পাঁচটা বাড়ি আর পূর্বর ছটা, মোট এগারোটা বাড়িতে পঞ্চাশজন মানুষ অন্তত ষোলো-সতেরোটা বোতল আজ শেষ করবে। পরিমাণটা আপনি ভাবুন!

লোকটি কথা বলছিল খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে। ববি গুহ বন্ধুদের দিকে তাকাল। এবার অরবিন্দ কথা বলল, আমরা তো কালই চলে যাচ্ছি। এ যাত্রায়–।

আবার তো আসবেন। তাহলে কথা হয়ে গেল। লোকটা হাসল, আমি প্রতিদিন শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস অ্যাটেন্ড করি। গেট দিয়ে বের হওয়ার সময় ডানদিকে তাকালেই আমাকে দেখতে পাবেন। তখন অর্ডারটা দিয়ে দিলেই ঠিক পৌঁছে যাবে।

অরবিন্দ জিজ্ঞাসা করল, আপনার নাম?

মধুসূদন দত্ত। লোকটি নমস্কার করে গেটের দিকে চলে গেল।

ববি বলল, অদ্ভুত! মধুসূদন দত্ত শান্তিনিকেতনে মদ বিক্রি করে বেড়াচ্ছে?

অরবিন্দ বলল, লোকটা খুব সরাসরি কথা বলে। একসময় এরকম সেলসম্যানের কথা শান্তিনিকেতনে কেউ চিন্তাও করতে পারত না।

সৌমেন বলল, রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে ওকে দূর করে দিতেন।

ববি গুহ বলল, রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে এইভাবে বারান্দায় বসে আমরা মাল খেতাম কিনা সন্দেহ আছে।

দেবব্রত চুপচাপ মানুষ। তবু বলল, আচ্ছা, সেসময় অত বিখ্যাত মানুষ এখানে আসতেন, থাকতেন, তাঁরা পান করতেন না, এটা বিশ্বাস করতে পারি না।

আলোচনা অন্যদিকে ঘুরে গেলে অরবিন্দর মনে হল ওই মধুসূদন দত্তর সঙ্গে আর একটু কথা বললে ভালো হত। লোকটা এতদিন কি করত, মদ বিক্রি করা ছাড়া আর কিছু করে কি না, পরিবার আছে কি না অথবা কখনও কবিতা লিখত কি না, এ নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারত।

পরদিন ফেরার সময় দেখা গেল হাওড়া থেকে ট্রেন এসে পৌঁছায়নি। রবিবার বলে প্ল্যাটফর্মে ভিড় খুব। অরবিন্দ গেটের কাছে পৌঁছে ডানদিকে তাকাতেই মধুসূদন দত্তকে দেখতে পেল। হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে একাই এগিয়ে গেল, চিনতে পারছেন? কাল রাত্রে–।

বিলোক্ষণ। কলকাতার এক পার্টি আসছে প্রান্তিকে উঠবে। ওদের জন্যে ভদকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আগেরবার অর্ডার করে গিয়েছিল। এখন ট্রেন বেশি লেট করলে দুপুর পেরিয়ে যাবে, সন্ধে নামলে কেউ ভদকা খায় না, চিন্তা হচ্ছে। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মতো মুখ করে বলল মধুসূদন দত্ত।

আপনি এখানে অনেক বছর আছেন?

তা আছি। আপনি এখানে স্থিতু হবেন না?

বন্ধুবান্ধবদের বাড়ি আছে, দিব্যি আসছি, যাচ্ছি–।

দূর! প্রত্যেক মানুষের তো একটাই জীবন। কিছু-না-কিছু রেখে যেতে হয় পরের প্রজন্মের জন্যে। যাঁরা প্রতিভাবান তাঁরা সৃষ্টি রেখে যান, যাঁরা সাধারণ এবং সক্ষম তাঁরা অন্তত একটা বাড়ি রেখে যেতে পারেন।

কে করবে? আমার পক্ষে তো আর দাঁড়িয়ে থেকে করানো সম্ভব নয়।

কোনও দরকার নেই। আমি আছি। ইচ্ছে হলে খবর দেবেন।

ওই যে কথাটা, কিছু রেখে যাওয়া–তা ঢুকে গেল বুকে। লোকে বলবে, এই বাড়িতে অরবিন্দবাবু থাকতেন। বন্ধুরা বলল, লাখ চারেক খরচ করলে মোটামুটি মাথা গোঁজার জায়গা হয়ে যাবে। শুনে ইতি বলল, মাঝেমধ্যে বেড়াতে যেতে পারি কিন্তু পাকাঁপাকি থাকতে পারব না।

এখন কে থাকতে বলছে? বুড়ো বয়সে–। অরবিন্দ বলতে গেল।

সেই বয়স এলে দেখা যাবে।

অরবিন্দ চলে যাওয়া ইতিকে দেখল। সাতচল্লিশ প্লাস। আর ম্যাক্সিমাম এগারো বছর। মানে এগারোটা পুজো, এগারোটা পূজাসংখ্যা। অথচ এমন ভাব, বুড়ো হতে প্রচুর দেরি। একটা মানুষ জন্মাল, বড় হল, ছেলেমেয়ে আনল, বুড়ো হল এবং মরে গেল, তা নিয়ে একবারও ভাবল না।

আর এই ভাবনাটাই অরবিন্দকে ক-দিন বাদে শান্তিনিকেতনে নিয়ে গেল। গেটের ডানদিকেই পাওয়া গেল মধুসূদন দত্তকে। মধুসূদন হাসল, এবার একা? কি দেব?

আমি ট্যুরিস্ট লজে উঠছি। বিকেলে দেখা করবেন। আমার নাম অরবিন্দ মিত্র।

বিকেলে মধুসূদন দত্ত এল। সঙ্গে সেই ব্যাগ। তাকে বলল, আমি এখানে একটা ছোটখাটো বাড়ি করতে চাই। আপনি বলেছিলেন–।

জমি কিনে বাড়ি বানাবেন, না পুরোনো কিনে ঠিকঠাক করে নেবেন?

পুরোনো বাড়ি কেনা ঠিক হবে?নিজের মনের মতো তো হবে না।

তা ঠিক। পূর্বপল্লির শেষ প্রান্তে জমির দাম এখন চব্বিশ। প্রান্তিকে যেতে যেখানে সুনীলবাবু অর্ঘ্যবাবুদের বাড়ি সেখানে পনেরো ছাড়িয়ে যাচ্ছে। প্রান্তিকের কাছে বারোতে পাবেন। তবে আমি সাজেস্ট করব পূর্বপল্লিতেই বাড়ি বানান। একটু কমে পেয়ে যেতে পারি।

খানিকটা আলোচনার পর ঠিক হল কাল সকালে মধুসূদন দত্ত অরবিন্দকে জমি দেখাতে নিয়ে যাবে। কথা শেষ হয়ে গেলে সে ব্যাগে হাত দিল, কী দেব?

মনে পড়ল। মাথা নাড়ল সে, না-না, আমি একা-একা মদ খাই না।

ও! লোকটাকে খুব হতাশ দেখাল। ধীরে-ধীরে চলে গেল।

পূর্বপল্লির জমি দেখা থেকে শুরু করে তার অধিকার আইনসম্মত করে নেওয়ার যে ঝামেলা, মধুসূদন দত্তই সামাল দিল। হ্যাঁ, অরবিন্দকে কয়েকবার আসতে হয়েছে। সঙ্গে কোনও বন্ধু থাকলেও লোকটাকে নিরাশ করেনি। কলকাতার দামেই মদ বিক্রি করে এটা প্রমাণিত। কথাটা পরিচিত মহলে ছড়িয়ে পড়ায় লোকটার চাহিদা বেড়ে গেছে। দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দারা। বোলপুর স্টেশনের গেট পার হওয়ার সময় ডানদিকে তাকিয়ে বলছেন, মধুবাবু, অমুক বাড়িতে উঠছি। আসছেন তো?

মধুসূদন দত্ত হাতজোড় করে জবাব দেন, সেবার সুযোগ দিচ্ছেন, আমি ধন্য।

এক ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু বাড়ির নকশা করে দেওয়ার আগে প্রশ্ন করেছিল, কীরকম খরচ করতে চাও? ছেলে তো আর শান্তিনিকেতনে গিয়ে বাস করবে না।

মাথা নেড়েছিল। আসলে ভেতরে ঢুকে পড়ার পর অরবিন্দর যেন একটা ঘোর লেগে গিয়েছিল। বলেছিল, বাড়ি ইজ বাড়ি। কে থাকছে, কদিন থাকছে, তা ভাবার দরকার নেই।

অতএব যা ভেবেছিল তার চেয়ে অনেক বেশি খরচ হল। ইতি মাঝে একবার দেখতে গিয়েছে। সেটা ভিতপুজোর সময়। দেখে বলেছিল, এখানে বাড়ি হলে যা ইচ্ছে তাই করতে পারো। কেউ দেখতে আসবে না।

ভিত তৈরি হয়ে গেলে মধুসূদন দত্ত বলল, প্রথমে দুটো কাজ করতে হবে। এক, পাঁচিল দেওয়া–দুই, গাছ লাগানো।

গাছ লাগানো মানে? অরবিন্দ বুঝতে পারল না।

বাড়িটাকে ঘিরে এখন গাছ লাগিয়ে দিলে গৃহপ্রবেশের সময় দেখবেন ওগুলো বেশ ডাগর হয়ে গিয়েছে। এখানকার মাটিতে তরিতরিয়ে বাড়ে। তবে কী গাছ লাগাবেন, সেটা ভাবুন। ফুলের গাছ, যেমন, টগর লাগাতে পারেন। আবার শিরীষ, দেবদারু, কদমজাতীয় গাছও লাগানো যায়। শেষের গাছগুলো বহু-বহু বছর বেঁচে থাকবে। আর যদি সরকারি গাছ কিনে এনে লাগান তাহলে কয়েক বছর বাদে প্রচুর টাকা পাবেন বিক্রি করে। ব্যাবসাও হয়ে যাবে। মধুসূদন দত্ত মতলব দিল।

কাগজে বিজ্ঞাপন দেখেছে কিন্তু জমি থেকে গাছ কাটার কথা ভাবতে তার খুব খারাপ লাগল। মধুসূদনবাবুকে বলল, ইউক্যালিপটাস, শিরীষ, দেবদারু গাছ লাগান চারপাশে। দুটো কদমগাছ থাকবে দু-পাশে। কাটাকাটির মধ্যে আমি নেই।

বাড়ি তৈরি হতে লাগল। গাছ পোঁতাও শেষ। প্রতি শনিবার অরবিন্দ চলে আসে শান্তিনিকেতনে। প্রতিটি ইট বসছে আর অরবিন্দর মনে হচ্ছে পাঁজরগুলো তার চেনা হয়ে যাচ্ছে। সিমেন্ট পড়ার আগে বাড়িটার যে আসল খাঁচা, যা বহু বছর খাড়া হয়ে থাকবে তার সঙ্গে পরিচিত হতে যে কী আরাম, তা কাউকে বোঝানো যাবে না। ইটের ওপর সিমেন্ট মেশানো বালি ফেলে আর ইট চাপিয়ে যখন উচ্চতা বাড়ানো হচ্ছে তখন যেন সিমেন্ট মেশানো বালি কীরকম মায়া-মায়া হয়ে। যাচ্ছে। অরবিন্দর মনে হল, সে যখন থাকবে না তখন এই বাড়িটা থাকবে। এত টান সে কখনও অনুভব করেনি।

যেসব বন্ধুরা ইতিমধ্যেই ওখানে বাড়ি বানিয়েছে তারা অরবিন্দকে বোঝাল, লোকটার হাতে সব ছেড়ে বসে থেকো না। নিজে সিমেন্ট ইটের দরাদরি কর। নইলে মেরে ফাঁক করে দেবে। কন্ট্রাক্টর টেন পার্সেন্ট নিয়ে থাকে, তোমার মধুবাবু কত নিচ্ছে কে জানে!

অরবিন্দ অসহায় বোধ করল। মধুসূদন দত্তের কথা এবং কাজে কোনও অসঙ্গতি পায়নি সে। লোকটা তাকে ঠকাচ্ছে কিনা খোঁজ করতে গেলে ওকে অপমান করা হয়। তবে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত লোকটার টিকি দেখা যায় না। অরবিন্দ অনুমান করে, তখন মধুসূদন দত্ত মদের ব্যাবসা। করে বেড়ায়। এ নিয়ে কোনও আপত্তি করার মানে হয় না। কারণ, তার বাড়ি তৈরির কাজে কোনও ব্যাঘাত হচ্ছে না। তবে একটা অস্বস্তি কাটাতে পারছে না, তাকে কী দিতে হবে? সেই জমি কেনা, প্ল্যান স্যাংশান করানো থেকে শুরু করে ইলেকট্রিকের মিটার আনবার দরখাস্ত করা। পর্যন্ত যে লোকটা একটুও গাফিলতি করেনি, তার দক্ষিণা কত এটা জানা দরকার। ট্যুরিস্ট লজের ঘরে বসে একবার প্রশ্নটা করেছিল সে। মধুসূদন দত্ত জিভ বের করে শব্দ করল, থাক না ওসব। আমিও মরে যাচ্ছি না, আপনিও থাকছেন। অন্তত দু-এক বছর তো আছি। পরে হবে ওসব কথা। আগে মনের মতো বাড়িটা হোক, দেখে প্রাণ জুড়োক, তারপর কথা বলা যাবে।

অরবিন্দ বলেছিল, কিন্তু আগে থেকে জানলে আমি বাজেট করতে পারব।

এই দেখুন, বেফাঁস কথাটা বলে ফেললেন। বাজেট! পৃথিবীতে কেউ কখনও তার বাজেট ঠিক রাখতে পেরেছে। অর্থমন্ত্রীরাই পারে না তো সাধারণ মানুষ। তা ছাড়া শখের জিনিস, ভালোবাসার জিনিস অত বাজেট মাথায় রেখে হয় না। শাজাহান কখনওই তাজমহলের জন্য বাজেট করেননি। ঠিক কিনা বলুন। মধুসূদন দত্ত হাসল।

অরবিন্দ শেষপর্যন্ত প্রশ্ন করে ফেলল, আপনার বাড়ির ঠিকানা কিন্তু আমি জানি না।

আপনি স্যার জিজ্ঞাসা করেননি কখনও, তাই বলিনি। আসলে আমার কোনও ঠিকানা নেই। এর কাছে কদিন, ওর কাছে কিছুদিন, এভাবেই চলে যায়। এই যে আপনি বাড়ি বানাচ্ছেন, আপনি তো পাকাঁপাকি থাকবেন না, হয়তো শনি রবিবারে আসবেন প্রথম-প্রথম, তা বাকি পাঁচদিন। তালাবন্ধ থাকবে, থাকবে তো? তখন যদি বলেন আমাকে পাহারা দিতে, তাহলে একটা মাথা। গোঁজার জায়গা জুটে যাবে, এইরকম?

আপনার পরিবার?

ছিল, কিন্তু রাখতে পারিনি। সন্তান হয়নি। তখন দুবরাজপুরে থাকতাম। চাকরি করতাম। সে ভাবল, আমি অপদার্থ তাই পছন্দসই পুরুষ পেয়ে ছেড়ে গেল আমাকে। লোকে বলেছিল থানায় যেতে, আমি যাইনি। অনিচ্ছুক ঘোড়াকে চাবুক মেরে কোনও কাজ হয় না।

আপনার নামটা নিয়ে কখনও ভেবেছেন?

একগাল হাসল লোকটা, কবিতা লিখতাম। বাল্যকালে। চতুর্দশপদী। একেবারে তাঁর নকল করে। বন্ধুবান্ধবরা বলত, ভালো হয়েছে। বড় হয়ে বুঝলাম, কিস্যু হয়নি। লেখার চেষ্টা আর করি না। সবার তো সব হয় না।

আর একটা কথা, অরবিন্দ বলল, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে আপনি ঘুরে-ঘুরে মদ বিক্রি করেন, কখনও কোনও বাধা আসেনি?

আজ্ঞে না! মানুষের প্রয়োজন আমি মিটিয়ে দিচ্ছি। তিন পেগ মদ খাওয়ার পর টেপে এ পরবাসে অথবা সখী আঁধারে শুনতে যাদের ভালো লাগে তাদের বঞ্চিত করি না আমি। আজ থেকে তিরিশ বছর আগে যেভাবে মানুষ রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করত, সেইভাবে চিরকাল কেন করবে? সময়ের সঙ্গে গ্রহণ করার ধরনটা বদলাবে না? তিন পেগ পেটে পড়ার পর সহেনা যাতনা কেউ যদি সত্যিকারের দরদ দিয়ে গায় তাহলে তাকে কি আপনি রবীন্দ্রবিরোধী বলবেন? তা ছাড়া সে তো পাবলিক ফাংশান গাইতে যাচ্ছেনা, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নির্জনে বাস করছে।

মধুসূদন দত্ত চলে গেলে অরবিন্দর মনে হল কথাগুলোর যুক্তি আছে। কলকাতায় তো বটেই, এখানে যে-সমস্ত মানুষ সাপ্তাহিক মাসিক অথবা বাৎসরিক ভ্রমণে নিজের বাড়িতে আসে তাদের বয়স এখন পঞ্চাশের সামান্য ওপরে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা চলে গেছেন। সন্ধেবেলায় তাঁরা মদ্যপান, কিঞ্চিৎ খিস্তিযোগে রসালাপ যেমন করেন, তেমন কোনও গাইয়ে সঙ্গে থাকলে রবীন্দ্রনাথের গানও শোনেন। এই মিশ্রিত মানুষেরা কেউ রবীন্দ্রবিরোধী নয়। তফাত এই, এঁরা কেউ তাকে গুরুদেব গুরুদেব করেন না।

শেষপর্যন্ত বাড়ি তৈরি হল। গাছগুলো বড় হয়ে গেছে। এক বছরে সবকটা ঋতুর স্পর্শ পেয়ে অনেক-অনেক বছরের জন্যে তৈরি হয়ে গিয়েছে। অরবিন্দ কলকাতা থেকে চমৎকার আসবাব আনিয়ে নিল। রান্নাঘরে গ্যাস চলে এল। পাখাগুলো ঘুরতে লাগল বনবন করে। তিনটে শোওয়ার ঘর, তিনটে টয়লেট, ডাইনিংকাম বসার ঘর আর বাগানঘেরা একটা বারান্দা। মধুসূদন দত্তর। অনুরোধে একটা ছোট জেনারেটারের ব্যবস্থা করেছে সে। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বাড়ির দিকে তাকালে মনে হয় স্বপ্নের বাড়ি। কলকাতার ফ্ল্যাট এর কাছে কিছু নয়।

বন্ধুরা বলল, গৃহপ্রবেশ করো অরবিন্দ, দলবেঁধে কলকাতা থেকে যাব সবাই।

ইতি বলল, তোমার বন্ধুদের নিয়ে দলবেঁধে গেলে থাকতে দেবে কোথায়? ওই তো কটা ঘর। সবাইকে বলো বিশ্বভারতীতে গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা ধরে ফিরে আসতে।

এ কথা বলা যায় না। থাকতে দিতেই হবে এমন তো কথা নেই। ববি গুহর বাড়ি আছে, সন্ধি গুহঠাকুরতার বাড়ি আছে, বন্ধুবান্ধবদের বাড়ির তো অভাব নেই। কিন্তু যে দিনটি গৃহপ্রবেশের জন্যে ঠিক করা হল সেদিন দেখা গেল প্রত্যেকের অসুবিধে। কেউ-না-কেউ কলকাতায় কাজেকর্মে জড়িয়ে থাকবে। ইতি বলল, বাড়িটা আমাদের, আমাদের সুবিধেম তো গৃহপ্রবেশ করব, যার সুবিধে যাবে, আমরা দিন পালটাব কেন?

অরবিন্দর সেটা মত ছিল না, তবু মানতে হল। বন্ধুরা জানাল, সপ্তাহের মাঝখানে না গিয়ে সামনের শনিবার হাজির হবে। লেটে গৃহপ্রবেশ সেলিব্রেট করবে সবাই। ইতি বলল, বাঁচা গেল।

দুই অরবিন্দ

বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। ঝকঝকে নতুন সাদা নতুন ডিজাইনের একতলা বাড়ি। পূর্বপল্লিতে এর কোনও জুড়ি নেই। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। গাছগুলো এক বর্ষাতেই তরতরিয়ে উঠেছে। কী সবুজ ছেয়ে গেছে বাড়িটার চারধারে! প্রাসাদ নয় কিন্তু ছোট্ট অথচ মজবুত বাড়িটা দাঁড়িয়ে থাকবে অনেক-অনেক বছর। একটু যত্ন করলে তিন-চারশো বছরও থেকে যেতে পারে। যখন অরবিন্দ থাকবে না, তার ছেলে অথবা বংশধর বলবে বাড়িটা যে বানিয়েছিল তার কথা। এটাকেই কী রেখে যাওয়া বলে?

কেমন দেখছেন স্যার?

মুখ ফিরিয়ে দেখলাম মধুসূদন দত্ত দাঁড়িয়ে আছেন খানিক দূরে।

জবাব দিলাম, ভালোই। শুধু সাদা রংটা যেন বড় চোখে লাগছে।

ধুয়ে যাবে। বর্ষাটা যেতে দিন। শীত পড়লে আর একপ্রস্থ মোলায়েম রং মাখিয়ে দেব। হ্যাঁ, শনিবার অতিথিরা আসছেন, কী-কী ব্যবস্থা করতে হবে বলে দিন।

চারজন এখানে থাকবে বাকিরা বন্ধুদের বাড়িতে। দুপুর আর রাত্রের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আমার স্ত্রী অবশ্য তখন থাকতে পারছেন না।

দেখুন, বাড়ি যদি নিজের হয় তাহলে তার কোণে-কোণে মায়া জড়ানো থাকে। আর এই মায়া স্থায়ী হয় প্রিয় মানুষীর স্পর্শ পেলে। ঘরের সঙ্গে তাই ঘরণির সম্পর্ক এত নিবিড়। তিনি থাকলে বাড়ি কখনওই অশুচি হয় না। যাকগে, কত বোতল দেব? দুপুরে এসেই তো খেতে বসবেন না, ভদকা বা বিয়ারের ব্যবস্থা রাখতে হবে। আবার সন্ধের পর হুইস্কি। পরিমাণটা যদি বলেন।

হঠাৎ আমার খারাপ লাগা শুরু হল। এত জ্ঞানগর্ভ কথা বলার পরই লোকটা চট করে ওর মদ বিক্রির ব্যবসায় চলে এল। আমি দেখতে পেলাম আমার বাড়ির লম্বা বারান্দায় বসার ঘরে বন্ধুরা মদ আর চাট নিয়ে বসে আছে। যদি মধুসূদনকে না বলতে পারতাম, তাহলে এই মুহূর্তে আমার ভালো লাগত। কিন্তু ওসবের ব্যবস্থা না থাকলে আমার শিক্ষিত ভদ্র রুচিবান বন্ধুরা কী পরিমাণ বিরক্ত হবে, তা আমি জানি। হয়তো বিকেলেই ওরা আসর বসাবে ববি গুহ-র বাড়িতে। আমার গোঁড়ামি নিয়ে কটুক্তির বন্যা বইয়ে দেবে। মধুসূদনবাবুকে বললাম, আপনার তো স্টকের। অভাব নেই, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেবেন, আমি দাম দিয়ে দেব। বলেই খেয়াল হল, জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা, এই যে আপনি বাড়ি-বাড়ি মদ বিক্রি করেন এটা তো সম্পূর্ণ বেআইনি, না?

আজ্ঞে, হ্যাঁ-ও বলা যায় আবার না-ও।

না কেন?

আমি দোকান থেকে এনে আপনাদের দিচ্ছি। এক্সাইজ ডিউটি তো দোকানদার দিচ্ছে, আমি বাহকমাত্র। হরিদ্বারে মাছমাংস খাওয়া যেমন বেআইনি, শান্তিনিকেতনে মদ বিক্রি করা তো। তেমন অর্থে বেআইনি নয়। খোদ কবিগুরু তাঁর কবিতায় হুইস্কির কথা লিখে গিয়েছেন। আর এখন লোকে মদ খায় কিন্তু মাতলামি করে না। যে করে তাকে অসভ্য বলা হয়, পরেরবার আর ডাকা হয় না। তার মানে মদ খাওয়াটাও আর বেআইনি নয়। যাক সে কথা, বাড়িটার একটা নাম দেবেন না?

মাথা নাড়লাম। এই নিয়ে ইতির সঙ্গে কদিন কথা হয়েছে। বাড়ির একটা নামকরণ করা দরকার। শ্বেতপাথরের ফলকে সেটা লিখে গেটের মাঝখানে বসিয়ে দিতে চেয়েছে সে। আমি বলেছি গেটে নয়, ঢুকতেই যে দেওয়াল চোখে পড়ে তার মাঝখানে ওটা বসাব। বাড়ি রইল ঠিকঠাক অথচ গেট ভেঙে গেল এমন তো হতেই পারে। ইতি রবীন্দ্রনাথ হাতড়ে ছিল। পূর্বপল্লি রতনপল্লির বেশিরভাগ বাড়ির নামকরণের পেছনে তিনি রয়েছেন। শান্তিনিকেতনে বাড়ি হয়েছে আর রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে নামকরণ হবে এ কী সম্ভব?ইতি গোটা দশেক নাম ঠিক করেছিল আমার পছন্দ হয়নি। রেগেমেগে সে বলেছিল, তাহলে তোমার বাবা-মায়ের নামে নামকরণ করো। মাতৃস্মৃতি-পিতৃস্মৃতি গোছের।

আমি হেসে বলেছিলাম, ভাগ্যিস বলনি বাড়ির নাম দাও, ইতি।

ও গম্ভীর মুখে সরে গিয়েছিল। আর এ নিয়ে কথা বলেনি। ভাবনাটা তখনই মাথায় এল। বাড়িটার নাম যদি দিই অরবিন্দ তাহলে কেমন হয়?যুগ-যুগ ধরে অরবিন্দ বেঁচে থাকল। তারপরেই খেয়াল হল আশি বছর বাদে লোকে দেখে ভাববে ঋষি অরবিন্দের নামে নামকরণ করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তো ভদ্রলোককে নমস্কার-টমস্কার জানিয়েছেন। তখন কেউ আমার কথা ভাববে না। একই নামে বিখ্যাত কেউ থাকলে এই হয় মুশকিল। এক্ষেত্রে নাম এবং পদবি দুই-ই লিখতে হয়। কিন্তু সেটা কল্পনা করতেই অস্বস্তি হল। লোকে ভাববে, আমি আমার ঢাক নিজেই। পেটাচ্ছি। নির্লজ্জ বলতে পারে। বাইরের কেউ মুখের ওপর কিছু না বললেও ইতি ভাবতে পারে সে কথা। কলকাতায় ফ্ল্যাটের দরজার পাশে লেটার-বক্সে ওর নাম ওপরে, আমার নাম নিচে লেখা আছে। এখানে একা আমার নাম দেওয়ালে থাকলে দৃষ্টিকটু হবে। অথচ আমি নিজের টাকায় বাড়িটা বানিয়েছি, প্রতিটি স্তর নিজের চোখে দেখেছি, এই বাড়ির সঙ্গে বহু বছর নিজের নামটাকে জড়িয়ে রাখার দাবি আমারই আগে। শালা, চক্ষুলজ্জা করেই বাঙালি শেষ হয়ে গেল।

হঠাৎ খেয়াল হল। মধুসূদন দত্তকে বললাম, একটা কাজ করতে হবে।

বলুন।

ওই যে বাগানের মাঝখানে খোলা জায়গাটা রয়েছে, ওখানে অন্তত তিরিশ ফুট গভীর একটা ভিত করতে হবে। ছয় বাই চার ফুট। মাটির তলায় গাঁথুনি থাকবে তিরিশ ফুট। মাটির ওপরে ফুট-পাঁচেক। খুব মজবুত। কদিন লাগবে?

ঘর হবে?

না-না। একদম সলিড। ভেতরে কোনও গর্ত থাকবে না।

এরকম একটা থাম্বা করবেন কেন?

দরকার আছে। আজই শুরু করে দিন কাজ।

স্টেশনে যাওয়ার সময় ইতি দাঁড়িয়ে গেল, ওরা গর্ত খুঁড়ছে কেন?

পিলার হবে।

কেন?

এমনি। দেখতে ভালো লাগবে।

এত বাজে খরচ করো! সে গেট পেরিয়ে রিকশায় উঠল। তাকে তুলে দিলাম শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে। ট্রেন ছাড়ার আগে বলল, তোমাকে একটা কথা বলি। পাশের বাড়ির মুকুদি, ডক্টর। মুখার্জির স্ত্রী, মদ খাওয়া একদম পছন্দ করেন না। ওপাশে মিস্টার হাজরা আছেন, রবীন্দ্রনাথের স্নেহ পেয়েছেন, শুদ্ধ মানুষ। বাড়িতে এমন কাণ্ড বন্ধুদের নিয়ে কোরো না যাতে ওঁরা আঘাত। পান। আমাকে এখানে আসতে তাহলে আর বলবে না। মনে রেখো।

ট্রেন চলে যেতেই দেখলাম মধুসূদন দত্ত আজও দুজন খদ্দের পেয়ে গেছেন। তাদের ঠিকানা টুকে নিচ্ছেন। একটুও ভয়ডর নেই লোকটার। অবশ্য না থাকাই স্বাভাবিক। আই. জি. ডি. আই. জি. থেকে আবগারি বিভাগের বড়কর্তারা ট্রেন থেকে নেমে হাত তুলে ওকে বলে যান, দত্ত, আমি এসেছি।

আজ দুপুরের ট্রেনে বন্ধুরা আসবে। মধুসূদন দত্ত ঠাকুর-চাকর আনিয়ে রান্নার তদারকি করছিল। বাগানে দাঁড়িয়ে আমি দেখছিলাম গর্ত খোঁড়ার পর নিচে ইট-সিমেন্ট-বালির গাঁথুনি চলছে। চারপাশে লোহার রডকে বেঁধে তাকে ঘিরে মোটা পিলার ওপরে উঠে আসবে। মধুসূদন দত্ত চেয়েছিল পুরোটাইট না দিয়ে বালি-সিমেন্ট মিশিয়ে ভরাট করতে। আমি রাজি হইনি। খরচ হোক কিন্তু মজবুত করা দরকার। মিস্ত্রিদের তাগাদা দিচ্ছিলাম। ওরা বলল বিকেলের মধ্যেই ভরাট করে ফেলতে পারবে।

দুটো মারুতি ভাড়া করে মধুসূদন দত্ত ওদের নিয়ে এল স্টেশন থেকে। আমি গেটে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমাকে দেখে সবাই হইহই করে উঠল। গেট খুলে ভেতরে ঢুকতেই ওরা বাড়িটার প্রশংসা করতে লাগল, দারুণ, গ্র্যান্ড, সুপার্ব, বিউটিফুল, মিসেস কোথায়?

কলকাতায় কাজ ছিল বলে চলে গেছে শুনে ববি গুহ বলল, বুদ্ধিমতী মহিলা। এতগুলো দামড়াকে স্বাধীনতা দেওয়ার কথা ভেবেছেন। ওখানে কি হচ্ছে?

সবাই গর্তটাকে দেখল। তখনও মিস্ত্রিরা নিচে। ওপর থেকে জোগানদার জোগান দিচ্ছে। পাশ থেকে মধুসূদন দত্ত বলল, বসার জায়গা হচ্ছে।

সঙ্গে-সঙ্গে কারও আর আগ্রহ থাকল না। মোট সাতজন এসেছে। এদের একজন এই প্রথম শান্তিনিকেতনে। বাগানে দাঁড়িয়েই জিগ্যেস করল, কত খরচ হল অরবিন্দ? টোটাল কত হবে?

হিসেব করিনি।

কম হবে না। কিন্তু ভাই যাই বলো ব্যাড ইনভেস্টমেন্ট। এতদূরে এসে তুমি নিশ্চয়ই পারমানেন্টলি থাকবে না।তপন যেন আমার জন্যে আপশোস করল।

সঙ্গে-সঙ্গে সন্ধি প্রতিবাদ করল, তোর শালা কোনওকালে কিছু হবে না। সারাজীবন কিপটের মতো কাটিয়ে দিলি। আরে, টাকা জমিয়ে কি হবে যদি নিজে ভোগ করে না যেতে পারিস! এই বাড়ি, গাছপালা, আকাশ-এসবের মর্ম তুই জীবনে বুঝলি না।

বললাম, তোরা হাতমুখ ধুয়ে নে। খাবার রেডি আছে।

সঙ্গে-সঙ্গে হইহই করে উঠল সবাই, আরে এখন সবে একটা বাজে, এখনই লাঞ্চ! মধুবাবু, ভদকা বিয়ার বের করুন।

যেযার মতো জামাকাপড় পালটে বসে গেল বারান্দায়। মধুসূদন দত্ত সযত্নে মাছভাজার সঙ্গে পানীয় পরিবেশন করছেন। তপন জিজ্ঞাসা করল, আপনি? গ্লাস কোথায়?

মধুসূদন দত্ত মাথা নাড়লেন, আমার নামের এক মহাত্মা যা খেয়ে গেছেন তারপর আর কোন মুখে খাই। আপনাদের সেবা করতেই আমার আনন্দ।

ববি গুহ গেয়ে উঠল, তাই তোমার আনন্দ আমার পর।

সৌমেন ধমক দিল, হেঁড়ে গলায় গাইবি না।

ববি বলল, যা ইচ্ছে তাই করব। আজ আমরা বাঁধনহারা।

তপন বলল, সেই রবীন্দ্রনাথ।

ববি গুহ বলল, যাচ্চলে! বাংলাভাষা কী রবীন্দ্রনাথের পৈতৃক সম্পত্তি?

আমি বললাম, অবশ্যই। ওই ভদ্রলোক না জন্মালে আমরা এখনও বঙ্কিমী ভাষায় কথা বলোতাম।

ববি গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, রবীন্দ্রনাথ বাঁকা ভাষায় লেখেননি?

বাঁকা ভাষায়?

ধরো, দুটি কিশোরীর বিয়ে হল। খুব বন্ধু। ভোরবেলায় স্বামী একজনকে জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছ? তোমার চোখে জল কেন? সে জবাব দিল, কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসারই ঘায়ে নিবিড় বেদনাতে পুলক লাগে গায়ে। ববি গুহ চুমুক দিল।

সবাই হইহই করে উঠল। সন্ধি জিজ্ঞাসা করল, দ্বিতীয়জনের কেসটা কী?

ববি বলল, দ্বিতীয়জনকে সকালবেলায় বান্ধবী জিজ্ঞাসা করল, কিরে, কেমন আছিস? সে বলল, কাল রজনীতে ঝড় বয়ে গেছে রজনীগন্ধা বনে। আর স্বামী চলে গেল তার কাজের জায়গায়। কয়েকমাস বাদে স্ত্রী-র চিঠি গেল প্রবাসে স্বামীর কাছে, এক রজনীর বরিষণে মোর সরোবর। গেছে ভরিয়া।আবার হাসির ফোয়ারা ছুটল। ববি এবার আমাকে জিজ্ঞাসা করল, এগুলো বাঁকা ভাষায় লেখা নয়?

তপন বলল, তোদের মন বিষাক্ত তাই সর্বত্র বিষ খুঁজে বেড়াস।

সন্ধি বলল, মানুষটাকে গুরুদেব বানিয়ে লোকে কী বিপদে ফেলেছিল ওঁকে। একটু যে প্রাণ খুলে তরল রসিকতা করবেন, তারও উপায় ছিল না। ফলে এইরকম আড়াল-আবডাল বেছে নিতে হয়েছে, কী বলেন মধুসূদন দত্ত মশাই!

মধুসূদন দত্ত চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলেন। মাথা নেড়ে বললেন, আপনাদের কোনও দোষ নেই।

তার মানে? ববি গুহ জিজ্ঞাসা করল।

দেখুন, অচিন্ত্যকুমার অথবা প্রেমেন্দ্র মিত্র যদি অশ্লীল শব্দ লেখেন আপনাদের আপত্তি নেই। বুদ্ধদেব বসু বা সমরেশ বসু লিখলে সাহিত্যের সম্মান দিতে কার্পণ্য করেন না। আমি অবশ্য তেমন বুঝি না, বিদেশি ক্লাসিক এবং মহাভারতে তো ওসবের ছড়াছড়ি। এতে কোনও অন্যায় হত না। যত দোষ রবীন্দ্রনাথের বেলায়? তাঁর প্রেমের কবিতা কামহীন হবে? নীরক্ত মানুষ নিয়ে কবিতা লিখবেন এমন ধারণা নিয়ে এখনও বসে আছেন আপনারা? তিনি অশোভন ভাষায়। লিখতে পারেননি কিন্তু চমৎকার প্রতীক ব্যবহার করেছেন। সেটা উপভোগ না করে বক্র কথা বললে কী আনন্দ পাওয়া যায় তা বুঝি না। কথা বলতে-বলতে মানুষটার গলা চড়ছিল। শেষ হওয়ামাত্র যেন বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন ভেবে মাথা নিচু করলেন।

আমার বন্ধুরা এ-ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছিল। সন্ধি বলল, আপনার দেখছি বেশ পড়াশুনা রয়েছে, তাহলে মদ বিক্রি করেন কেন?

মধুসূদন দত্ত জিভ বের করলেন, ছি-ছি! আমি নিতান্তই মূর্খ। অবসর সময়ে ভালো লাগে বলে ওঁর বই-এর পাতা ওলটাই। আর একপ্লেট মাছভাজা দেব?

আমি বুঝতে পারছিলাম, তাল ভঙ্গ হয়ে গেছে। বন্ধুদের মেজাজ চলে গেছে তাই বললাম, আপনি লাঞ্চের ব্যবস্থা করুন। বেলা তো বেশ হয়ে গেছে।

মধুসূদন দত্ত চলে গেলে ববি গুহ বলল, লোকটা তো বহুত খচ্চর। দিল মেজাজের বারোটা বাজিয়ে। একে টাইট দিতে হবে।

বললাম, গরিব মানুষ, ওকে টাইট দিয়ে কি হবে?

অনধিকার চর্চা করল। ওর এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে করল। মানছ?

মানছি। তবে ভুলে যাও এটা।

খাওয়া শেষ হলে সবাই গা এলাল। খাটে না কুলোতে মেঝেতে চাদর পেতে শুয়ে পড়ল কেউ কেউ। আমি বাগানে গিয়ে দাঁড়ালাম। মিস্ত্রিরা এখন ওপরে উঠে এসেছে। দ্রুত কাজ করছে ওরা। এবার সোজা মাথা তুলে দাঁড়াবে পিলার। মধুসূদন দত্ত মাথা নিচু করে কাছে এলেন, আমাকে মাপ করবেন স্যার।

কেন?

ছোট মুখে বড় কথা বলা ঠিক হয়নি।

কখনও-কখনও অপ্রিয় সত্য বলতে হয়। আপনি কোনও অন্যায় করেননি।

কিন্তু ওঁরা অতিথি। একটু প্রমোদ করতে এখানে এসেছেন। আসলে আমি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ব্যঙ্গ সহ্য করতে পারি না। যাকগে। নিশ্বাস ফেললেন মধুসূদন দত্ত, আচ্ছা, এটা ঠিক কি। বানাতে চাইছেন বলুন তো! পাঁচ ফুট লম্বা হবে অথচ সিঁড়ি থাকবে না ওপরে ওঠার। ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না।

শেষ হোক, তারপর বলব। আপনি শুধু একটা কাজ করুন। বোলপুরের খোয়াই স্টোর্সে কাউকে পাঠান। ওরা একটা শ্বেতপাথরের ফলক দেবে, বিকেলে মধ্যে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করুন।

টাকাপয়সা দেওয়া আছে।

শ্বেতপাথরের ফলক! তার মানে স্মৃতিসৌধ?

এখন নয়। কুড়ি-পঁচিশ বছর বাদে হলেও হতে পারে। আমি হাসলাম, দাঁড়াও পথিকবর দেখে তো লোকে এখনও পার্কসার্কাসে দাঁড়িয়ে পড়ে।

মধুসূদন দত্তের মুখ গম্ভীর হল, স্যার, আমি একবার গিয়েছিলাম ওখানে। মন টানছিল বলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু গিয়ে মনে হয়েছিল, না এলেই হত।

কেন?

মনে হল, কবি যেন পথিকের অনুকম্পা ভিক্ষে করছেন। তোমরা যদি বঙ্গদেশে জন্মাও তাহলে দয়া করে একটু দাঁড়াও। বাঙালির মতো স্মৃতিমোছা জাত আর কোথায় আছে, তা তো জানা। নেই। ছেলেপিলে না থাকলে অথবা ব্যাবসা না হলে এদেশে কোনও মহৎ স্রষ্টার শতবার্ষিকী অনুষ্ঠান হয় না। জন্মদিন পালন তো দূরের কথা। মধুসূদন দত্ত সেটা জানতেন না। তাই এখন ওই লেখার দিকে কেউ অবহেলায় তাকায় না। আচ্ছা চলি, আবার সন্ধেবেলার স্টক আনতে হবে।

বিকেলে খোয়াই স্টোর্স থেকে প্যাকেট এল। বন্ধুরা তখন চা পান করছে। আমি মোড়ক খুললাম না। মিস্ত্রিদের কাজ শেষ হয়নি। ওরা কথা দিল কাল সকালের মধ্যেই কাজ শেষ করবে।

আজ খুব হাওয়া দিচ্ছে। গাছেরা বেশ দুলছে, যদিও আকাশে মেঘ নেই। স্নানটান সেরে সবাই গুছিয়ে বসেছে বারান্দায়। সন্ধি বলল, আজ চাঁদ উঠলে ভালো লাগত।

তপন বলল, আমার একসময় ধারণা ছিল, শান্তিনিকেতনে এলে দারুণ-দারুণ রমণীর দেখা পাওয়া যায়। সেইসঙ্গে মহুয়া আর সারারাত নাচ।

ননসেন্স! পঞ্চাশে পৌঁছেও প্রিমিটিভ ভাবনা নিয়ে বসে আছিস। এখন আমাদের হিম্মত বলে কিছু নেই। ইচ্ছে হলেও কেউ একা সোনাগাছিতে যেতে পারব না। এখন এইসব উলটোপালটা কথা বলে লাভ কী! মহাকবি মধুসূদন কোথায়? সন্ধি বলল।

ববি গুহ চ্যাঁচাল, মধুবাবু! মাল নিয়ে আসুন। সন্ধে যে যায়!

কোনও সাড়া দিল না। আমি উঠলাম। হোস্ট হিসেবে এখনই মদ পরিবেশনের দায়িত্ব আমার। কিন্তু মধুসূদন দত্ত তো এখনও ফিরে আসেনি। তবে কী স্টক জোগাড় করতে পারেনি অথবা সেটা করতে বাইরে গেছে। আমরা আরও আধঘণ্টা অপেক্ষা করলাম।

ববি জিজ্ঞাসা করল, তোমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে গেছে?

না। মাথা নাড়ালাম আমি।

লোকটা থাকে কোথায়?

ঠিকানা জানি না। কখনও কামাই করেনি।

এ বাড়ি তৈরির জন্য তোমার কাছে দক্ষিণা নেয়নি?

এখনও না।

মুশকিল হয়ে গেল। এরকম সম্পূর্ণ অজানা লোককে দায়িত্ব দেওয়া কি ঠিক?

ভদ্রলোক আমার কোনও ক্ষতি করেননি আজ পর্যন্ত।

এখন মদ না পেলে–কেউ আমার সঙ্গে চলো, বোলপুর থেকে কিনে আনি।

আমার বাড়িতে এসে ওরা পয়সা দিয়ে মদ কিনে খাবে সেটা হয় না। অতএব আমিই ববি গুহ-র সঙ্গে চললাম। গাড়ি চালাতে-চালাতে ববি যখন মধুসূদনকে গালাগাল দিচ্ছিল তখন তাতে কান দিচ্ছিলাম না। মধুসূদনের ওপর দুপুর থেকেই খেপে আছে সে। কিন্তু লোকটার কি হল? কখনও খেলাপ করেনি আজ পর্যন্ত।

আইনসম্মত মদের দোকানে পৌঁছে দেখলাম সন্ধের পরেও কাউন্টার ফাঁকা। ববি গুহ যে ব্র্যান্ড চাইল পাওয়া গেল না। রুচি নিয়ে নামাতে হল, দামও বেশি। কারণ জিজ্ঞাসা করাতে দোকানদার বলল, আনার খরচ আছে। তা ছাড়া এখানে বিক্রিও কম হয়।

মধুসূদন দত্তকে চেনেন? ববি গুহ আচমকা প্রশ্ন করল।

কোন মধুসূদন?

বাড়ি-বাড়ি ঘুরে মদ বিক্রি করে।

ও হ্যাঁ, শুনেছি। আমাদের বাজার নষ্ট করে দিচ্ছে।

ধরেননি কেন?

কে ঝামেলা করে বলুন।

কোথায় থাকে লোকটা জানেন?

না। তবে ও বোলপুরে বিক্রি করে না। শান্তিনিকেতনেই ঘুরে বেড়ায়।

দোকান থেকে বেরিয়ে রাগতস্বরে ববি বলল, একদম জালি লোক। কার পাল্লায় পড়েছিলে ভেবে দ্যাখ। আবার রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আমাকে জ্ঞান দেয়!

সেদিন জমবে না-জমবে না করে শেষপর্যন্ত জমে গেল। আমার নতুন বাড়ির বারান্দায় প্রায় গোটা তিন বোতল মদ শেষ হয়ে গেল। রাত দশটা নাগাদ প্রত্যেকেরই নেশা জমজমাট। সন্ধি গান। গাইছিল। আমাদের যে-কোনও পার্টিতে ও মেজাজ হলে গায়। ওর ভরাট গলায় আমার সর্বস্ব যেন কেঁপে উঠছিল, আঁধার রাতে একলা পাগল যায় কেঁদে। হয়তো সুরা কাজ করছিল কিন্তু আমি এই বন্ধুদের একপাশে বসে কী একা হয়ে যাচ্ছিলাম! আমার বুকের ভেতরে রক্ত ঝরে যাচ্ছিল অসাড়ে। যখন সন্ধি গাইল, অন্ধকারে অস্তরবির লিপি লেখা হলে আমারে তার অর্থ শেখা তখন হঠাৎই কান্না পেয়ে গেল। যতবারই সে আমার হয়ে বুঝিয়ে দে গাইছিল ততবারই মনে হচ্ছিল এক জীবনে বোঝা যাবে না। আমি কাঁদছিলাম কিন্তু আমার চোখে জল ছিল না। আমার সর্বশরীরের সঙ্গে মিশে থাকা একাকীত্ব কেঁদে মরছিল। সন্ধি গান থামাল। তারপর ববি গুহ-র দিকে মুখ ফিরিয়ে জড়ানো গলায় বলল, কিছু ঢুকল মাথায়?

ঠিক হ্যায়। ববি চোখ বন্ধ করে জবাব দিল।

ঠিক নেই। দুপুরে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাজে বকছিলি না? আজকের এই অন্ধকারে একচল্লিশ সালে অস্ত-যাওয়া রবীন্দ্রনাথের লিপি লেখা আছে, তার অর্থ শেখা তোর কোনওকালে হয়ে উঠবে না।

অ্যাই তুই আমাকে ইনসাল্ট করছিস! উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল ববি গুহ।

সত্যি কথা হজম করার চেষ্টা কর।

নো, নেভার। আমি এখানে অপমানিত হতে আসিনি। আমি চলে যাচ্ছি আমার বাড়িতে। এই, কেউ যাবে আমার সঙ্গে?

আমি ববি গুহকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু ও সুস্থ ছিল না। তপন এবং সৌমেন ওর সঙ্গে চলল। ওরা যখন গেটের কাছে এবং আমি সঙ্গে থেকে বোঝাতে চেষ্টা করছি ঠিক তখন একটা গাড়ি এগিয়ে এল। তার হেডলাইটে চারপাশ উদ্ভাসিত। একজন পুলিশ অফিসার নেমে এলেন। গাড়ি থেকে। ভদ্রলোক আমার নাম জিজ্ঞাসা করতে আমি মাথা নাড়লাম। উনি বললেন, আপনি মধুসূদন দত্তকে চেনেন?

হ্যাঁ।

আপনি কী তাকে কিছু কিনতে পাঠিয়েছিলেন?

আমি ঠিক পাঠাইনি, উনি নিজেই আনতে চেয়েছিলেন। কেন?

কী হয়েছে? আমি একটা খারাপ খবর দিচ্ছি। উনি একটু আগে মারা গিয়েছেন।

মারা গিয়েছেন। আমি চিৎকার করে উঠলাম।

হ্যাঁ। ব্যাগ হাতে রাস্তা পার হতে গিয়ে বাসে ধাক্কা খান। ওঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। শেষপর্যন্ত সেন্স ছিল। মারা যাওয়ার আগে আপনার নাম-ঠিকানা বলেন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময়েও ব্যাগের হাতল ছাড়েননি। ওতে মদের বোতল ছিল কিন্তু ভদ্রলোক নেশা করেননি।

পুলিশ অফিসার একজন সেপাইকে বলতে সে মধুসূদন দত্তের ব্যাগটা মাটিতে নামিয়ে দিল। ভদ্রলোক বললেন, এত রাত্রে আপনাকে বিরক্ত করব না। কাল সকাল দশটা নাগাদ একবার আপনি যাবেন। ওঁর আত্মীয়স্বজনদের খবর দেওয়া দরকার।

যতদূর জানি কেউ ছিল না ওঁর।

তাই নাকি! তাহলে আপনাকে একটু কষ্ট করতে হবে। ওর ডায়েরির নাম মধুসূদন দত্ত কিন্তু সেটা যে সত্যি তা আপনাকে অনুগ্রহ করে বলতে হবে। আচ্ছা, নমস্কার। অফিসার গাড়িতে উঠতেই হেডলাইটের আলো ঘুরে ফিরে গেল। ওই গভীর গহন অন্ধকারে এখন আমরা একা।

বারান্দায় যারা বসেছিল তারাও পুলিশের গাড়ি দেখে বেরিয়ে এসেছিল। আমি পাথরের মতো দাঁড়িয়েছিলাম। মধুসূদন দত্ত নেই। বকরূপী ধর্ম প্রশ্ন করেছিলেন যুধিষ্ঠিরকে। যুধিষ্ঠির ঠিকঠাক উত্তর দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই উত্তর মানুষ কখনও মনে রাখে না।

হঠাৎ ববি গুহ আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল শব্দ করে, শালা, নিজেকে খুব ছোট লাগছে রে এখন। লোকটাকে আমি মিছিমিছি সন্দেহ করেছিলাম।

সন্ধি বলল, অবিশ্বাস্য!

কী অবিশ্বাস্য!

ববি গুহ ফিরে এল।

আমরা আবার বারান্দায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে। মধুসূদন দত্তের ব্যাগটাকে তুলে আনতে হয়েছে। অন্ধকারে ব্যাগের চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। সন্ধি বলল, লোকটা আমাদের জন্যে মদ কিনতে গিয়ে মরে গেল! অবিশ্বাস্য!

অবিশ্বাস্য শব্দটা যেন ওর জিভে আটকে আছে।

তপন বলল, আমি আমার ঠাকুরদা, বাবার মৃত্যু দেখেছি। ওঁদের বয়স হয়েছিল।

দূর! বাবর, আকবর, সিরাজ, রামকৃষ্ণদেব, রবীন্দ্রনাথ একসময় বেঁচেছিলেন, এখন নেই। তার মানে তাঁদেরও মরতে হয়েছে। সবাইকে মরতে হবে। তুই আমি কেউ শালা বাঁচব না। এই মধুসূদন দত্ত সেটা আবার মনে করিয়ে দিয়ে গেল। এই জন্যে আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবি না। যা ইচ্ছে তাই করি। ওর ব্যাগ থেকে একটা বোতল বের কর।ববি গুহ বলল।

সন্ধি বলল, অবিশ্বাস্য।

হোয়াই? ববি খেপে গেল।

লোকটা মদ পাঠিয়ে দিল অথচ দাম নিতে আসবে না। এখন সে শুয়ে আছে লাশকাটা ঘরে। আর তুই তার পাঠানো মদ খাবি? সন্ধি বলল, অবিশ্বাস্য!

লোকটার আত্মা এতে শান্তি পাবে। ববি গুহ বোতল বের করল, বাঃ, এই তো আমাদের ব্র্যান্ড। ওর কাউকে তুমি চেনো যাকে দামটা দিয়ে দিতে পারি?

না, কাউকে চিনি না। অন্ধকারেই মাথা নাড়লাম আমি।

তোমার কাছেও এই বাড়ি বানাবার জন্যে টাকা পেত তো?

পেত।

কী করবে?

জানি না।

*

গতরাত্রে কেউ ডিনার খায়নি। নেশাগ্রস্ত মানুষগুলো দু:খী-দু:খী হয়ে শুয়ে পড়েছিল। আমি অনেকক্ষণ চুপচাপ বসেছিলাম। ক্রমশ খারাপ লাগা অথবা লোকটির জন্যে যে কষ্টবোধ তা অসাড় হয়ে গেল। একসময় কিছুই ভাবছিলাম না আমি। মাথার ওপর অনেক তারা। এরা সব পৃথিবীর শেষদিন পর্যন্ত থাকবে। গতকাল মধুসূদন দত্ত ছিলেন, আজ নেই। নিজের জন্যে যে ভাবনা তার কি কোনও সুস্থ মীমাংসা নেই?

ঘুম ভেঙেছিল সকাল-সকাল। বন্ধুরা সবাই মড়ার মতো ঘুমোচ্ছে। খাটে কুলায়নি কিন্তু কেউ তার তোয়াক্কা করেনি। বাগানে দাঁড়িয়ে দেখলাম মিস্ত্রিরা এসে গেল। কাজে লেগে গেল তারা। মনে হয়, ওদের নিষেধ করি। কোনও দরকার নেই। ওইভাবে মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকার কোনও দরকার নেই। কিন্তু পিলারটিকে অসম্পূর্ণ রাখার তো কোনও মানে হয় না। শেষ করুক ওরা।

বন্ধুরা উঠল। কয়েকজনের ইতিমধ্যে হ্যাঙওভার হয়ে গেছে। কালো কফি খেল তারা। খাওয়াদাওয়া করে দুপুরের ট্রেনে সবাই ফিরে যাবে কলকাতায়। হঠাৎ ববি গুহ বলল, তোমাকে তো আইডেন্টি ফাঁই করতে যেতে হবে!

হ্যাঁ। তোমরা শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে চলে যাও, আমি কাঞ্চনজঙ্ ধরব।

না, চলো সবাই মিলে যাই। বডি যদি পাওয়া যায় লোকটার শেষ কাজ করে যাই আমরা। আফটার অল শেষসময় পর্যন্ত আমাদের সঙ্গেই তো ছিল। ববি গুহ বলল। দেখলাম অন্যরাও একমত।

তখনও সদরে শরীর চালান দেয়নি পুলিশ। ববি গুহর তৎপরতায় সেটা বন্ধ করা হল। আমি মধুসূদন দত্তকে আইডেন্টি ফাঁই করলাম। পোস্টমর্টেম ছাড়াই ববি দুপুর নাগাদ দাহ করার অনুমতি জোগাড় করল।

মধুসূদন দত্তকে শ্মশানে নিয়ে আসতে আমাদের কাঁধ দিতে হয়েছিল। আমরা কলকাতাবাসী। সুখী মধ্যবয়সি সম্পন্ন মানুষ, এতে অনভ্যস্ত হওয়া সত্বেও গম্ভীরভাবে কাজটি সম্পন্ন করলাম। সৎকারের ব্যবস্থা হল। হঠাৎ ববি কোত্থেকে এক বালককে ধরে নিয়ে এল। বলল, এ মুখাগ্নি করবে–

সে কী? সন্ধি অবাক।

আমরা শালা হিন্দু, পোড়াচ্ছি যখন তখন মুখাগ্নি করাতে তো হবেই। এই বাচ্চাটার বয়স আট। আরও সত্তর বছর বাঁচবে ধরে নিতে পারি। ওর বাপ-মা নেই, চায়ের দোকানটায় কাজ করে। ওই করুক মুখাগ্নি। যতদিন বাঁচবে ততদিন মনে রাখবে লোকটাকে। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল, এই যে দশ টাকা। শোন, যাঁর মুখে আগুন ছোঁয়াবি, তাঁর নাম মধুসূদন দত্ত। বলো তো নামটা?

কচি গলায় উচ্চারিত হল, মধুসূদন দত্ত।

আবার বলো।

মধুসূদন দত্ত।

ভুলবি না?

বালক মাথা নেড়ে না বলল।

পাটকাঠির আগুন বালক ছোঁয়াল মধুসূদন দত্তের মুখে। আগুন জ্বলল চারপাশে, ববি চেঁচিয়ে উঠল, দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে, তিষ্ঠ ক্ষণকাল।

সন্ধি ধমকে উঠল, অ্যাই চুপ কর! আমি মন্ত্র পড়ছি। শেষ মন্তর! বলেই সে গান ধরল, তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না, করে শুধু মিছে কোলাহল।

পূর্বপল্লিতে ফিরে এলাম শেষ দুপুরে। সারাদিন কারও খাওয়া হয়নি। স্নান হয়নি। সবাই খুব ক্লান্ত। আমার কেবলই মনে পড়ছিল সেই মহিলার কথা, যিনি ত্যাগ করেছিলেন মধুসূদন দত্তকে, যিনি এখনও জানেন না প্রচলিত অর্থে তিনি বিধবা। একটা মানুষ ছিল, একটা মানুষ নেই, কি সামান্য তফাত।

বাড়ির সামনে পৌঁছে দেখি মিস্ত্রিরা অপেক্ষা করছে। তাদের কাজ শেষ। তিরিশ ফুট মাটির তলায় ডুবে থাকা পিলার পাঁচ ফুট মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মসৃণভাবে। হেডমিস্ত্রি এগিয়ে এল, এখন কী করতে হবে বাবু?

বোলপুর থেকে মধুসূদন দত্ত যে প্যাকেটটা আনিয়ে দিয়েছিলেন সেটা ঘরেই পড়ে আছে। ওই প্যাকেট থেকে ফলকটা বের করে পিলারের ওপর লাগিয়ে দিতে হবে সিমেন্ট কাঁচা থাকতেই। যতদিন পিলারটা থাকবে ততদিন লোকে ফলক দেখে জানতে পারবে অরবিন্দ মিত্র নামে একজন মানুষ এখানে বাস করতেন। ইতি কী ভাবল, বন্ধুরা কী মনে করল তাতে কি এসে যায়। এদেশে লোকে যখন নিজের নামে একটা স্টেডিয়াম তৈরি করতে পারে, তখন আমি একটা বাড়ি বানাতে পারি না?

কিন্তু এখন অস্নাত, অভুক্ত এই আমি একদম সময় পাচ্ছিলাম না ভেতর থেকে ওই ফলক বের করতে। আজকের দিনটা যাক, এর পরেরবার যখন আসব তখন হয়তো মন এবং শরীর অনেক চাঙ্গা থাকবে, সায়ও পেয়ে যেতে পারি।

যাদের হ্যাঙওভার হয়েছে তারা একটু পান করে নাও, ফিট হয়ে যাবে। ববি গুহ বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করল গ্লাস হাতে।

সন্ধি কিন্তু কিন্তু করল, খালি পেটে খাব?

নার্ভ ঠিক হয়ে যাবে। তারপর স্নান সেরে ভাত-ঘুম। সন্ধের ট্রেনে কলকাতা। আরে, এই বাড়িতে এসেছি যা ইচ্ছে তাই করব বলে। নিয়ম মানতে তো কলকাতাই রয়েছে। ববি চিৎকার করল।

সন্ধি যেতে-যেতে ঘুরে দাঁড়াল, অরু, তোর বাড়ির নাম দে ইচ্ছেবাড়ি।

ওরা সব ভেতরে চলে গেল। ইচ্ছেবাড়ি। বুকের মধ্যে খলখলিয়ে উঠল শব্দদুটো। যা ইচ্ছে তাই নয়, আমার ইচ্ছে এইখানে থেকে যাক অনন্ত বছর। আমি মনে-মনে একটা ফলক বসিয়ে দিলাম। ওই কাঁচা পিলারের গায়ে, ইচ্ছেবাড়ি। মধুসূদন দত্ত আমাকে বলেছিলেন, যাঁরা

প্রতিভাবান তাঁরা সৃষ্টি রেখে যান। যাঁরা সাধারণ এবং সক্ষম, তাঁরা অন্তত একটা বাড়ি রেখে। যেতে পারেন। আর সেই বাড়িটার নাম ইচ্ছেবাড়ি ছাড়া আর কি হতে পারে! মিস্ত্রিদের আমি ছুটি দিয়ে দিলাম। সামনের রবিবার সকালে ওদের আবার আসতে হবে নতুন ফলক লাগাবার জন্যে।

আমি বন্ধুদের সঙ্গ পাওয়ার জন্যে পা বাড়ালাম।

এখন পর্যন্ত গল্পটি পড়া হয়েছে ৭৬ বার
যদি গল্পটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
    মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন