শিরোনাম: জঠর

গল্পকার: Author Avatar সমরেশ মজুমদার

কুঁচকে যাওয়া পাটসিলকের ঝোলা পাঞ্জাবি খাটো ধুতি আর প্রায় সাদা হয়ে আসা মোজাহীন জুতো পরা লোকটা নগদ টাকাগুলো ট্যাঁকে খুঁজল। ওর সামনে দাঁড়িয়েছিল বুড়ো সাবির মিঞা। সাবিরের পেছনে সদ্য কেনা ছাগল আর মুরগির পালগুলো সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। সকাল থেকেই মওকা পেলে মাল কিনছে সাবির। মেলা এখন জমজমাট। তিনমাস অন্তর এই ভবানীর থানের মাঠে জন্তু-জানোয়ারের কেনাবেচার মেলা বসে। মাইক বাজে, তেলেভাজা আর জিলিপির দোকানে গন্ধ ফোটে। চার-পাঁচ ঘর ফুর্তির জায়গা তৈরি হয়ে যায় সেই-ফাঁকে। দিশি মদের ভালো জোগান থাকে। পয়সা থাকলে এই সময় আকাশ ছোঁওয়া যায়।

বুড়ো সাবির বলল, অনেকদিন পর দেখা হল। মেলায় আসো না কেন?

সিলকের পাঞ্জাবি লাল দাঁত বের করে হাসল, চার-চারটে মাদি ছাগল, ওরা না বিয়য়ালে এখানে এসে কি ফায়দা। মুরগিগুলো ডাগর হতে নিয়ে এলাম। তবে হ্যাঁ, বিইয়েছে একটা ছাগল, পরের মেলায় আসব।

লোকটি গলায় একটা রঙিন রুমাল বাঁধল, ও হ্যাঁ, মিঞা সায়েবের সন্ধানে কাজের লোক আছে?

কাজের লোক? মিঞা ফোকলা দাঁতে হাসল, সারা দেশের লোক কাজ খুঁজছে। তা কীরকম লোক চাই? জোয়ান না যুবতি?

না-না। মেয়েছেলের আমার ডোরায় ঢোকা নিষেধ। বাচ্চা চাই। খাবে কম খাটবে বেশি।

হঠাৎ লোক চাই কেন?

লোকটা মুখ নামাল, কাউকে বোলো না। শরীরটা বিগড়েছে আমার। হপ্তায় তিনদিন জ্বর আসে। কথা নেই বার্তা নেই কাঁপুনি আর জ্বর। শালা সাড় থাকে না শরীরের। ওই সময় জানোয়ারগুলোর জন্যে একটা বাচ্চা চাই।

ডাক্তার দেখাও। এ জ্বর ভালো না।

দুস শালা। পয়সা খরচ করে সুঁই ফোঁড়াব এমন বান্দা আমি নই। লাল ওষুধ দিচ্ছে কম্পাল্ডারবাবু, তাই গিলি। সন্ধানে আছে তেমন?

সাবির মিঞা হাত তুলল, সকালে দেখলাম পুবের মাঠে জনম জ্বর ভিড় করেছে। গিয়ে দ্যাখো একবার। মওকা পেলে ছাগলের চেয়ে কম দাম।

মাটি থেকে চটের থলেটা তুলে হেলতে-দুলতে মেলা ছুঁড়ে লোকটা চলে এল পুবদিকে। সেখানে গাছের তলায় শীর্ণ মানুষেরা বসে আছে কাজের আশায়। লোকটার চোখ চরকির মতো ঘুরছিল। সব শালা খাঁচা বুকে নিয়ে বসে আছে, গোনা যায় প্রত্যেকটা হাড়। একটা ছোঁড়া চাই ছোঁড়া!

শেষতক একটা গাছের সামনে গিয়ে সে হাঁকল, অ্যাই কাজ করবি? প্রৌঢ় লোকটি উবু হয়ে বসেছিল। তার উদোম ঊর্ধ্বাঙ্গে হাড় কাঁপছে। প্রশ্ন শোনামাত্র লোকটার চোখের চেহারা পালটে গেল। দুটো হাত আকাশের দিকে তুলে বলল, হ বাবু হ। দ্যান বাবু একটা কাম।

দূর শালা! তোকে নিয়ে আমার কী হবে? আমার কাজ শক্ত কাজ। জঙ্গলের মধ্যে আমার খেতি। সেখানে আছে ছাগল মুরগি শুয়োর। সেসব দেখতে হবে। এ জন্মে তোর সেই শক্তি হবে না। এটি কে?

আমার ছাওয়াল। একমাত্র ছাওয়াল।

এ কাজ করবে? কী রে, কাজ করবি? দশটাকা দেব। দু-বেলা ভাত পাবি। যাবি?

প্রৌঢ়ের গা-ঘেঁষে ছেঁড়া হাফপ্যান্ট পরে কুচকুচে কালো একটি বালক দেখছিল লোকটাকে। তার মুখে সাড় এল না। প্রৌঢ় বলল, দুধের ছাওয়াল বাবু, নয় মাইয়া আর এই ছাওয়াল। কথা কইতি পারে না। আমারে নেন বাবু, আমি পারুম। সব কাজ পারুম।

লোকটি মাথা নাড়ল, না। তোমাকে শালা একসের চাল খাওয়াতে হবে আর ও ব্যাটা একপো পারবে না। ও যদি পারে তো আসুক। আমি মিঞার দোকানে আছি। ঠিক দুটোয় জঙ্গলে ফিরব, হাঁ!

পাটসিল্কের পাঞ্জাবি চলে যেতে প্রৌঢ় অতীব মায়ায় পুত্রের মুখ দেখল। সঙ্গে-সঙ্গে বালকের মুখ হাঁ হয়ে গেল। জ্বিহা নেড়ে সে বোঝাতে চাইল, ভাত? প্রৌঢ় মাথা নাড়ল। তারপর প্রবল আক্রোশে চুল খিমচে ধরল। ছেলেটা বাপকে ধরে দু-হাতে টানতে লাগল। তারপর বাপের অর্ধকুঁজো শরীরটার সঙ্গে ফিরে গেল আধ মাইল দক্ষিণের নদীর চরে। সেখানে হোগলার ছাউনিতে তাদের বাস।

কাম পাইলা না? দড়ি হয়ে আসা একটি নারী যাকে প্রৌঢ়া বা বৃদ্ধ বলা যায়, নদীর চরে হোগলার ছাউনির সামনে ছেঁড়া চট বিছিয়ে রোদ্দুরে শুয়ে কাতর গলায় প্রশ্ন করল। তার আশেপাশেনটি বিভিন্ন বয়সের শিশু। বড়টির বয়স বারো কিন্তু শরীর বাড়ে নি। প্রৌঢ়ার শরীরে জীর্ণ শাড়ি অথচ উদর স্ফীত। মুখের চেহারায় বোঝা যায় শরীরে জ্বর রয়েছে বেশ।

প্রৌঢ় দেখল শিশুকন্যারা তাকে দেখামাত্র দৌড়ে এসে জড়ো হয়েছে সামনে। সে চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়তেই নারীর কণ্ঠে আক্ষেপজনক শব্দ বের হল, তিনদিন কামে যাই নাই। লোক আসছিল খুঁজতে। শাসায় গেল অনেক।

এই সময় এক বছরের শিশু এগিয়ে এল হামা দিয়ে। মায়ের কাপড়ের তলায় শুকনো স্তনে মুখ গুঁজল খাদ্যের আশায়। রুগ্ন হাতেও ঝটকা এল, মর-মর সব চুষে-চুষে মেরে ফেলল আমারে। হা কপাল! নদীর চরে সেই চিকারের সঙ্গে ছিটকে পড়া শিশুর কান্না উত্তাল হল। বাকিরা ফ্যাল ফ্যাল করে দেখছে তাদের কনিষ্ঠাকে। তবু তার মধ্যেই একটি কচি গলায় শব্দ ছিটকাল, ক্ষুধা লাগছে বাপ, মুড়ি খামু।

প্রৌঢ় উবু হয়ে বসল। তারপর নিচু গলায় বলল, একটা লোক কাম দিতে চায় খোকারে। পেটভাত আর দশটাকা। ছাগল মুরগি দেখনের কাম। দিবা?

চকিতে উঠে বসল নারী। অপলক চোখে বালকের দিকে তাকাল। তারপর ডুকরে উঠল মুখচাপা দিয়ে, তোমারে দিয়া হইব না?

না। প্রৌঢ় মাথা নাড়ল, আমার প্যাট বড়, শরীরে রোগ। দশটাকা কম না, চাপ দিলে পনের টাকা হইতে পারে?

কুথায় ঘর?

জঙ্গলে। প্রৌঢ় আকাশের দিকে মুখ তুলে বলল, হপ্তায় একদিন ছুটি।

শেষ মিথ্যেটা কানে গেল না নারীর। শক্ত গলায় শুধাল, কবে থিকা?

আজই। দুটায় যাত্রা।

হা কপাল! নারীর নিশ্বাস পড়ল।

ভালো জামা নেই। যেটি ছিল সেটিকে টানটান করে পরিয়ে দিল দিদি-বোনেরা।

মুখ মুছিয়ে চুল আঁচড়ে দিল নারী। বারংবার বলতে লাগল সে যেন দুষ্টুমি না করে, না কাঁদে, হপ্তায় একদিন এসে দেখে যায়। এই পৃথিবীর নয় বোন আর মা বাপ শুধু তাকিয়ে আছে। বড় বোন বলল, মা, ছাগলে দুধ দেয়?

নারী ঘাড় নাড়ল, দামি দুধ। খাইলে তাগদ বাড়ে।

আর একজন বলল, মুরগির ডিম?

নারী মাথা নাড়ল। প্রৌঢ় জোগান দিল, তার সাথে একপো ভাত। ভাবন যায় না।

নয়টি শিশু চকচকে চোখে তাদের ভাইকে দেখতে লাগল। বালক দুধ ডিম-এর ভাতের প্রাসাদে যাচ্ছে। একজন ফিসফিসিয়ে বলল, হপ্তায় যখন আসবি একটু দুধ আনবি। দুধ আমি কখনও খাই নাই। আর একজন বলল, ডিম আনবি দাদা? মুরগির ডিম? ।

বালক অপলক দেখছিল, শুনছিল। তার ঠোঁট দুটো শুধু থরথরিয়ে উঠল। শেষ সঞ্চয়ের মুড়ি বের হল তিনমুঠো আর আধ-ভাঙা বাতাসা। নয় বোন বৃত্তাকারে বসে। নারী খাইয়ে দিচ্ছে বালককে। দুমুঠো খাওয়ার পর বালক মাথা নাড়ল। প্রতিবাদ করল। এই মুড়ির দিকে তাকিয়ে থাকা চোখগুলোর দিকে নজর পড়তেই সোজা উঠে দাঁড়াল। ছোটজন থাবা বাড়াল মুড়িতে। দশটি পাঁজরের নিশ্বাস শরীরে নিয়ে বালক পিতার সঙ্গে যাত্রা করল জীবিকার সন্ধানে। যেমন করে বধূকে শ্বশুরগৃহে যাওয়ার সময় বিদায় জানানো হয় তেমনি করে দশটি শরীর পিছু পিছু এগিয়ে এল অনেকটা, তারপর একটা চাপড়া বেঁধে পড়ে রইল শোক অথচ আশার কাঁপন নিয়ে নদীর চরে।

ধু-ধু মাঠ আর বাঁশঝাড় পেরিয়ে জঙ্গল। জঙ্গলের গায়ে আবাদ। তার পাশে লোকটির ঘর, খেতি আর পোষা জীবদের ডেরা। লোকটি যখন সেখানে পৌঁছল তখন ঘুঘু ডাকছে, চারধার নিঃসাড়। বালক আর হাঁটতে পারছিল না। লোকটি বলল, এই হল আমার জায়গা। সব দেখে নে। ছাগল দেখবি, মুরগি দেখবি। কারও যদি অযত্ন হয় তো পেটে পা ঢুকিয়ে দেব শালা। পনেরো টাকা দিতে হবে, কাজ যদি সেরকম না হয় লাথি মেরে তাড়িয়ে দেব। শরীরটা আবার ঢিসোচ্ছে রে। জ্বর এল বুঝি। আজ রাত্রে খাওয়া বন্ধ। আমি ওই ঘরে শুচ্ছি। তুই এই বারান্দায় শুবি। কাল। সকালে ভাত করব তখন খাবি। এদিকে আয়।

লোটা বালককে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে জীবগুলোকে দেখাল। এক ডজন মুরগি আর ছাগল। তারা মুখ তুলে দেখল, পেছনে বাচ্চাগুলো তিড়িং-তিড়িং করে নাচছিল। সাবধানে এদের দেখবি। ও পাশের খেতে যেন না যায়। সামনের মেলায় ছাগলছানাগুলো গায়েগতরে হলে বেচে দিয়ে আসব। আজ কিছু মুরগি বেচেছি মিঞার কাছে। দর দিল না শালা। নিজের মনে কথা বলতে বলতে কেঁপে উঠল লোকটা। তারপর দুহাত বুকের ওপর চেপে বলল, উঁহু বড্ড শীত লাগে রে, আমি আলো জ্বালি না। মাটিতেলের দাম খুব। তুই কাজে লাগ। আর হ্যাঁ, ছানাগুলোকে মা ছাগলটার কাছ থেকে সরিয়ে রাখবি, বাঁটে দুধ জমুক, কাল সকালে তাই দিয়ে পথ্য করব আমি।

কাঁপতে-কাঁপতে লোকটা ঘরের দরজায় তালা খুলে ভেতরে সেঁধিয়ে গেল।

সমস্ত চরাচর জুড়ে এখন নিশ্বাসের শব্দ। গাছপালার শরীরে বাতাস পাক খাচ্ছে। বালক সেই। নির্জনে দাঁড়িয়ে কেঁদে ফেলল। শব্দহীন কান্নায় বুকের খাঁচা কাঁপতে লাগল তার। এবং সেই সময় মুরগিগুলো একসঙ্গে ডেকে উঠে ডানা ঝাঁপটাতে লাগল। সেই বিকট এবং সম্মিলিত চিৎকার। বালককে শূন্যবোধ থেকে মুক্ত করে ছুটিয়ে নিয়ে এল চালার সামনে। এবং সেখানে আসতেই তার নজর পড়ল সাপটার ওপর। পায়ের পাতা ডোবা ঘাসের মধ্যে শরীর রেখে মুরগিদের দিকে এগোচ্ছিল, বালকের ছুটে আসার শব্দ তাকে থমকে দিয়েছে। আজন্ম নদীর চরে থাকায় বালক সাপ চেনে। সাপ দেখলেই তারা বালির চরে ছুটত সেটাকে মারতে। নারী বলত, সাপকে আক্রমণের সুযোগ দেওয়ার আগেই মেরে ফেলা উচিত। পড়ে থাকা একটা বাঁশ তুলে নিয়ে বালক ছুটে গেল সামনে। বিপদ দেখে সাপটি পালাবার চেষ্টা করেও বিফল হল। তার মৃত। শরীরকে বাঁশের ডগায় ঝুলিয়ে বালক নিয়ে এল লোকটির ঘরের দাওয়ার সামনে। তার প্রথম কাজ সে যেন লোকটাকে দেখাতে চায়।

মুরগিগুলো ডাকছে না। কিন্তু তাদের চোখে অসীম কৃতজ্ঞতার ভাষা পড়তে পারল বালক। সে ছাগলগুলোর দিকে তাকাল। তাদের কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। কিন্তু ছানারা স্থির হয়ে রয়েছে। লোকটা এখন উঠবে না। ঘরের ভেতর থেকে কোঁকানির শব্দ ভেসে আসছে। সাপটাকে সেখানেই ফেলে রাখল সে। আর তখনই মনে পড়ল মায়ের কথাগুলো। শেষরাত্রে ঘুম ভেঙে গেলে মাকে বলতে শুনত, তুমি একটা সাপ, ছোবল মাইর্যা -মাইৰ্যো এই শরীরটারে বিষ কইর্যান দিয়াও শান্তি নাই!

সে তাকাল সাপটার দিকে। তার বাবা কী করে সাপ হল কে জানে। মা-বাবার ভাষা মাঝে-মাঝে সে বুঝতে পারত না। হঠাৎ খুব অবসন্ন বোধ করল বালক। খিদেয় পেটের ভেতরটা গোলাচ্ছে। সে বন্ধ দরজার দিকে তাকাল। লোকটা বলেছে কাল ভাত হবে। কিন্তু দুমুঠো মুড়ি ছাড়া সে। কিছুই খায়নি। তার মা বাড়ি-বাড়ি বাসন মেজে ভাত নিয়ে আসত থালায় বেঁধে। বাপ কাজ পেলে চরে উনুন জ্বলত। তারা দশ ভাই-বোন সেই ভাত পেটে পুরে রাত্রে ঘুমুত। তিনদিন মা কাজে যায়নি, বাবা কাজ পায়নি। তাই ভাতও নেই পেটে।

বালক চারপাশে তাকাল। বাগানময় গাছ, কিন্তু গাছে কোনও ফল নেই। তার মনে পড়ল লোকটা বলেছে ছানাগুলোকে মায়ের কাছ থেকে আলাদা করে রাখতে। এগিয়ে গেল সে। দরজা খুলে দিতেই তিড়িং-তিড়িং ছন্দে তিনটে ছানা বেরিয়ে এল। মা-ছাগলটা বের হওয়ার আগেই দরজা বন্ধ করে দিল সে। খানিকক্ষণ সব বিস্মৃত হয়ে বালক ছাগল ছানাগুলোর সঙ্গে মুক্ত আকাশের নিচে খেলা করতে লাগল।

ওপাশে মুরগি এবং ছাগলগুলো ডাকছে। সারাদিন অভুক্ত থাকায় তারা চিৎকার শুরু করল। এই সময় ঘরের ভেতর থেকে জ্বরো গলায় চেঁচিয়ে উঠল লোকটা, ও-পাশের দাওয়ায় ছাগল আর। মুরগির খাবার চাপা দেওয়া আছে, দিয়ে দে। ওরে বাবারে, কি শীত!

বালক হুকুমটা পালন করামাত্র জন্তুগুলোর খুশির নিশ্বাস শোনা গেল। সে ব্যাকুল চোখে দেখল কি তৎপর হয়ে ওরা খাদ্য গলাধঃকরণ করছে। বালকের চোয়াল নড়তে লাগল। হাত বাড়িয়ে সেই খাদ্যপদার্থ তুলে নিয়ে জিভে দিতেই শরীরটা গুলিয়ে উঠল। না, এটা খাওয়া যাবে না। সে ছানাগুলোকে ওই খাদ্য এনে দিল। তৎপর ছানারা তাতে মুখ দিয়েও ফিরিয়ে নিল। ওই খাদ্য তাদেরও পছন্দ নয়।

সন্ধের ছায়া নেমেছে। আর জঙ্গলের মাথায় উবু হয়ে বসেছে তরমুজের মতো চাঁদ। তারই আলোয় চারটে ছানা নিয়ে বসেছিল বিষণ্ণ বালক। ছানাগুলো সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। বালকের। চোখের সামনে নদীর চর, হোগলার ঘর এবং নয় বোনের মুখ ভেসে উঠতেই সে কেঁদে ফেলল। আর তখনই একটি ছানা চট করে জিভ বের করে তার গরম অশ্রু চেটে নিল। একটা কষ্টের কান্না কীভাবে যে হাসিতে রূপান্তরিত হয় তা বালক বুঝল না, কিন্তু পলকেই দুঃখ ভুলে সে ছাগলটাকে জড়িয়ে ধরল। ও-পাশে মা-ছাগলটা এখন ছানাদের ডাকে সাড়া দিতে শুরু করেছে। ছানা। চারটের পা একটা দড়িতে বেঁধে রাখা সত্বেও তারা ছুটে যেতে চাইছে মায়ের কাছে। একটুও ছেলেমানুষি নেই ওদের আচরণে। লোকটা বলেছে ছানাগুলোকে আলাদা রাখতেই হবে। নইলে মা-ছাগলটার বাঁটে দুধ জমবে না, সেই দুধে লোকটা পথ্য করবে আগামীকাল, অনেক চেষ্টার পর ছানাগুলো নেতিয়ে-নেতিয়ে পড়ল। যেমন করে সে আর তার বোনরা বালির চরে নেতিয়ে থাকত না ফিরবে খাবার নিয়ে এই আশায়। এবার নিশ্চয়ই ছানাগুলো ঘুমিয়ে পড়বে। ঘুমিয়ে পড়লে খিদে থাকে না, এটা সে জানত। কিন্তু তখনই মুরগিগুলো চিৎকার শুরু করল। চমকে উঠল বালক। তারপর বাঁশটা তুলে ছুটে যেতে কিছু একটা পালিয়ে গেল পাশের জঙ্গলে। মুরগিগুলো সরে গিয়েছিল একপাশে। এবং তখনই বালক অবাক হয়ে দেখল জিনিসটাকে। খাঁচার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে সে ডিমটাকে বের করে নিয়ে এল বাইরে। এটা ডিম। খেলে তাগদ বাড়ে। ঘ্রাণ নিল সে। কোনও ঘ্রাণ নেই। শক্ত খোলটা হাতের চাপেও স্থির। বিকেলে এটা ছিল না এখানে। লোকটা নিশ্চয়ই জানে না। ডিম কি কাঁচা খায়? এই সময় মা-ছাগলটা অদ্ভুত গলায় ডেকে উঠল। বালকের মনে পড়ল, শূন্য নদীর চরে নারী যখন চিৎকার করে তাদের ডাকত তখন তার গলাটা অনেকটা এইরকম শোনাতো। সে উঠে গেল মা-ছাগলটার কাছে। পরিষ্কার চাঁদের আলোয় মা-ছাগলটা কাতর চোখে তাকে দেখল।

সম্মোহিতের মতো বালক এগিয়ে গেল। ছাগলটি সন্দিগ্ধ হয়ে সরে দাঁড়াতে গিয়েও দাঁড়াল না। এবং এই প্রথম বালক সচেতন চোখে দুধ দেখতে পেল। বালক নতজানু হয়ে বাঁট স্পর্শ করতেই পুরন্ত শরীর থেকে দুধ ছিটকে এল তার হাতে। বিস্মিত বালক এই প্রথম মাতৃদুধের স্পর্শ পেয়ে। এমন হতবাক হয়ে গেল যে -ছাগলটির খোলা দরজা দিয়ে বের হয়ে যাওয়া আটকাতে পারল না। হাতটা মুখের কাছে তুলে নিয়ে অমৃতের স্বাদ পেল সে। তারপর চেতনা ফিরতেই সে ছুটে বাইরে এসে দেখল দুটি ছানা মায়ের দুই বাঁটে মুখ ডুবিয়ে তৃপ্তিতে স্থির, বাকি দুজন নাচছে। তাদের ঘিরে। তারা চেষ্টা করেও বাঁটের দখল পাচ্ছে না।

বালক ভীত হল। ছানাগুলো যদি সব দুধ খেয়ে নেয় তাহলে কাল লোকটার পথ্য হবে কিসে? জবাবদিহির ভয়ে সে যখন বাঁশটা নেবে ভাবছে ঠিক তখন ঘরের মধ্যে থেকে লোকটা চেঁচিয়ে উঠল, পাহারা দিবি সারা রাত। শেয়াল আসে মুরগি খেতে। কিছু হলে দেব ভাত ঢুকিয়ে।

সঙ্গে-সঙ্গে স্থির হয়ে গেল বালক। তার হাতের মুঠোর ধরা ডিম শক্ত হল। এই মুহূর্তে যদি লোকটা বেরিয়ে আসে, তাহলে সে ডিমটাকে পাথরের মতো আঁকড়ে ধরল। কিন্তু লোকটি বের হল না। বালকের হঠাৎ মনে হল তার বাপ যদি সাপ হয় তাহলে ওই লোকটা শেয়াল। নারী বলত শেয়াল খুব চালাক। নইলে নিজের জ্বর হয়েছে বলে তাকে ভাত দেবে না কেন? সে মাটি খুঁড়ে ডিমটাকে পুঁতে রাখল নিচে। চরে বিচি পুঁতলে সে দেখেছে তরমুজের গাছ বের হয়। নিজেকে একটা গোপন সম্পত্তির মালিক বলে মনে হল তার।

বালক এগিয়ে গেল। তারপর অপেক্ষারত দুটো ছানার সঙ্গে বসে রইল মা ছাগলটার দিকে তাকিয়ে, নদীর চরে উনুন জ্বললে যেমন তারা বসে থাকত। আর মা-ছাগলটা হঠাৎই মমতা এবং ভারমুক্তিতে সস্নেহে বালকের গাল চেটে দিল। এতক্ষণে পরিবেশটা ভীষণ পরিচিত হয়ে গেল।

শূন্য চরাচরে সহজ বালক অপেক্ষা করে যায়। পৃথিবীর সব দৃশ্য মুছে গেছে তার সামনে থেকে শুধু টৈটুম্বুর খাদ্যভাণ্ডার বিশ্ব জুড়ে, যা দখলের জন্যে কুশলী হতে হবে তাকে। সে আর তৃতীয় এবং চতুর্থ ছানা হতে চায় না।

এখন পর্যন্ত গল্পটি পড়া হয়েছে ৭২ বার
যদি গল্পটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
    মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন