যুবক অনার্য

কবিতা - আমার বন্ধু সুরঞ্জন

লেখক: যুবক অনার্য

শেষবার যখোন দেখা হলো সুরঞ্জন বোলেছিলো: চতুর্দিকে শুধু ভাঙনের শব্দ যে-দিকে তাকাই দেখি মানুষের দাঁতে গেঁথে আছে রক্তাক্ত মানুষ শিশুর হাতে বেলুনের মতো মানুষের আয়ু যুদ্ধ মারী ও মড়ক কেবলি বৈষম্যবাদিতা। এসব দেখেছি বহুকাল আজ বড়ো দুঃসময় আজ বড়ো অন্ধকার। হাতের মধ্যে সময়গুলো চিপসে যাচ্ছে বারবার।

নীলু, ফিরে না এলে তোর বৌদিকে বোলিস: বুকের মধ্যে আগুন নিয়ে জন্ম নেয় যে পুরুষ তার কোনো ঘর নেই সংসার-শিকড় তাকে জড়িয়ে রাখতে পারে না কিছুতেই। জন্মপোড়া তোর এই বন্ধুটাকে ক্ষমা না করে একটা জীবন কাটিয়ে যেতে যেতে সে যেনো সহসা বুঝে ওঠে– কোনো কোনো নদী আজন্ম অচেনা থেকে যায় বাণ না ডাকলেও বয়ে চলে স্রোতের উল্টোদিকে; আমি সেই নদীর মতন চিরদিন দাঁড়িয়ে থেকেছি নিজেরই বিরুদ্ধে নিজে আমি আমার চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু নই। জানি, সেও নয় অন্য কারো মতো তবু আমি চাই পৌরাণিক প্রথা সে অন্তত একবার ভেঙে দিক যেনো সিঁথিতে লেপ্টে থাকে তার আজীবন রক্তাক্ত সিঁদুর। কপোলে আমি না হয় সিঁদুর হয়েই থেকে যাবো দৃশ্যচ্যুত সন্তের মতো।

মান্তু আর বিণিকে বোলিস : বাবা বলেছেন তোমরা যেনো অনেক বড়ো হও দৈর্ঘ্যে প্রস্থে বেড়ে ওঠা নয় বড়ো হওয়া মানে বুঝতে শেখা মানুষজন্মের মানে– মানে এই নষ্ট ভূভাগ ১৮০ডিগ্রী ঘুরিয়ে দেয়া যেনো একেকটি প্রাণ হয় বৃক্ষের মতো সবুজ আর গোলাপের মতো লাল।

আমার এই পুরুষজন্মের শপথ নিয়ে বলি: ফিরে এলে বুঝে নিস সুরঞ্জন আসলে জন্মাতেই পারে নি, না এলে বুঝবি এক জনমে অজস্র জন্ম আমার, মৃত্যুও আমাকে ভয় পায়। দেখিস সূর্যপোড়া এই পৃথিবীটা একদিন ফিরে আসবে আমাদের কাছেই পাতার মর্মরে আর পাখির কুজনে বেজে উঠবে আমাদেরই গান একদিন খুব অভিমানে পালিয়ে যাবে একচক্ষু ঈশ্বরের মিথ্যে অভিধান তাই এখনি সময় রুখে দাঁড়াবার মাথা তুলে উঠে দাঁড়াবার এখনি সময় হ্যাঁ নীলু এখনি এই তারাভরা অন্ধকার আকাশের নীচে সকলে একসঙ্গে এমনকি একা একা একলা হবার পরেও। আমি জানি শেষ পর্যন্ত মানুষকে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিষ্টান কৃষ্ণাঙ্গ শ্বেতাঙ্গের কাছে নয়, ফিরে আসতে হবে মানুষেরই কাছে।

সেই যে দেখা হলো তারপর সুরঞ্জনকে দেখিনি কোথাও। যে গুরুদায়িত্ব সুরঞ্জন আমায় অর্পন করেছিলো তা পালন করতে গিয়ে আমি হাজির হয়েছিলুম রূপশ্রী যেখানে বুকঝিম মধ্যদুপুরের মতন একটি বাড়ি, যে বাড়ির নাম ‘মিছিল’– সুরঞ্জন রেখেছিলো। গিয়ে শুনি বৌদিরা এখন অই বাড়িতে নেই– সুরঞ্জনের দাদা ঘাড় ধরে বের করে দিয়েছে। বৌদি বিণি আর মান্তুর কাছে পৌঁছে দেবার সেই যে কথা– আমার রাখা হলো না আর।

জানি না আজ এই সুদীর্ঘ বছর পর এখনো বৌদির সিঁথিতে সিঁদুর লেপ্টে থাকে কিনা রক্তাক্ত হয়ে। জানি না মান্তু আর বিণি ওরা আজ হয়েছে কতটা বড়ো শুধু জানি মানুষেরা এখনো হয় নি বৃক্ষের মতো সবুজ গোলাপের মতো লাল। চতুর্দিকে শুধু ভাঙনের শব্দ নিঃশব্দ অন্ধকার কারা যেনো ধূপ করে জ্ব’লে উঠতে উঠতে নিভে যায় কেউ অপেক্ষা ক’রে নেই ফিরে গেছে যে যার নিজস্ব দেবতার কাছে যে যার আত্মরমণের কাছে। আমার বন্ধু সুরঞ্জন ফেরে নি। সুরঞ্জন হয়ে জন্ম নিলে কেউ ফেরে না কোনোদিন।

এখন পর্যন্ত লেখাটি পড়া হয়েছে ১৩ বার
যদি লেখাটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন