যুবক অনার্য

গল্প - সুপ্রিয়া ব্যানার্জির ডায়েরি থেকে

লেখক: যুবক অনার্য
প্রকাশ - বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ধরণ: বিরহ, ভালোবাসা

এই ঘনঘোর সন্ধ্যেবেলা আমি লিখছি তোমাকে।-
অনেক দূরের একটি দিন। তোমার সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়েছিলেন রাণুদি।সে এখন বিদেশ-বিভুঁই, বর বাচ্চা নিয়ে বেশ সুখী।এতো বছর পরেও পুরনো দিনগুলি আমার চোখে স্বচ্ছ জলের মতো ভেসে ওঠে।সেই যে তুমি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে ইশকুলের কাছে অশত্থ গাছের ছায়াটুকু ঘিরে। ছুটির পর আমি ছায়ার কাছে আসতেই দুষ্টু হেসে বোলতে তুমি: কিরে,আজও বুঝি পিট্টি খেয়েছিস মাষ্টারবাবুদের!
আমিও হেসে: তোমার তো সেই একই কথা- বোলে চুপ করতেই তুমি আমার একহাত মুঠোয় নিয়ে বোলতে- চল আজ বাড়ি না গিয়ে কোথাও হারিয়ে যাই- দূরে,যাবি?

জানতাম ওসব তুমি বোলতে এমনিতেই। চিরদিন ওটাই তোমার স্টাইল।

আমিও বোলতাম কথার পিঠে কথা: বাড়ি যেতে যে ভালো লাগে না আর।চলো হারিয়ে যাই,হারাই – সুদূর কোনো দূরে।
তুমি বোলতে: তারপর?
আমি ‘ঝালমুড়ি’ বোলতেই দু’জনে একসঙ্গে হো হো হেসে উঠতাম।
এভাবে বছর মাস কেটে গিয়ে মাধ্যমিক শেষ হলো।উচ্চ মাধ্যমিকে তুমিই আমাকে ভর্তি করে দিয়েছিলে ‘বর্ষা বরণ কলেজ’ – এ।কলেজেও একই রকম তুমি দাঁড়িয়ে থাকতে নির্জন বৃক্ষের মতো। নিঃসঙ্গ ওরকম তোমার দাঁড়িয়ে থাকা- দেখে কষ্ট হতো খুব।একটা মানুষ প্রতিদিন রোদ্দুরে ঝোড়ো হাওয়ায় বৃষ্টিতে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে- কাউকে কষ্ট দেবার অধিকার এমন আমায় কে দিয়েছে! তবু মুখ ফুটে না আসবার কথা বোলতেও পারছিলাম না।বোল্লে তুমি কষ্ট পাবে তাই বলিনি – ‘দাদা,তুমি প্রতিদিন এভাবে কষ্ট করে দাঁড়িয়ে থেকো না, আমি তো এখন বড়ো হয়েছি।একা একা দিব্যি শিখে গেছি পথ।তোমাকে প্রতিদিন এভাবে কষ্ট করতে দেখে আমার যে ভীষণ কষ্ট হয়।না হয় মাঝে মাঝে.. প্রতিদিন নাই বা এলে তুমি’ – পারিনি বোলে দিতে।
এদিকে অবিনাশের সঙ্গে আমার বেশ ভাব হয়ে গেলো।অবিনাশ আর আমি বন্ধু- পরস্পর।এক সময় টের পাই আমি অবিনাশকে ভালোবেসে ফেলেছি।এ কথা গোপন রেখেই অবিনাশের সঙ্গে তোমাকে পরিচয় করে দিলাম। দাদা, তুমি যে তোমার মতোই ভীষণ উদার আর অমায়িক। আমার বন্ধু বোলে তুমি অবিনাশকেও ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহের চোখে জড়িয়ে নিলে।।বেশি ভালো লেগেছিলো তুমি বিষয়টি সহজ ভাবে নিতে পেরেছিলে।তবে অবিনাশ যে ততোদিনে হয়ে উঠেছিলো আমার প্রেমিক পুরুষ তা তুমি বুঝতে পারো নি তোমার স্বভাবসুলভ সহজতার গুণেই।

দিন কাটছিলো এভাবেই।।তবে দিন তো নয় একরকম সবসময়, দিন বদলে যায়।তোমার চাকুরী হলো।তুমি চলে গেলে এম বি সি কলেজে।ওখান থেকেই রাখতে আমার খোঁজখবর।দিন কেটে যায়।এর মধ্যে হঠাৎ করে তোমার বিয়েও হয়ে গেলো।আমি যেতে পারিনি -দু’ দিন পরেই কলেজ ফাইনাল।বৌমনিকে নিয়ে তুমি থাকছো ওখানেই।বছর ঘুরে তোমার ঘরে বাবু এলো ফুটফুটে জোছনার মতো।কী যে ভালো লাগছিলো।তুমি বেশ গুছিয়ে উঠেছিলে – আজন্ম তুমি এক অগোছালো দাদা আমার।একদিন টিকলুদা আমাকে নিয়ে তোমাদের ঢাকার বাড়ি গেলেন কী একটা কাজে।আমি বসেছিলাম তোমার পড়ার টেবিলে।জল খেতে গিয়ে আমার হাত লেগে কিছু একটা মেঝেয় পড়ে গেলো। তুলে নিয়ে দেখি ওটা একটা ডায়েরি।যা আমার সঙ্গে যায় না – কেনো যেনো আমি তা-ই করলাম।কারো ব্যক্তিগত কিছু সম্পর্কে আমার কোনো আগ্রহ নেই,প্রাইভেসিতে আমি খুব বিশ্বাসী তবু আনমনে ডায়েরির পাতা উল্টে গেলাম।দু’ তিন পাতা ছেড়ে যেতেই এক জায়গায় আমার চোখ স্থির হয়ে গেলো।তোমার হাতে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা :
সুপ্রিয়া,আমার আত্মাটা আমি
তোকেই দিয়ে দিয়েছি।চাইলে
নদীর জলে ভাসিয়ে দিতে
পারিস কিংবা রাখতে পারিস হৃদমাঝারে তোর।আমি
জীবনে কোনোদিন সুখী হবো না।
কেনো জানিস!কারণ এক
জীবনে তুই কোনোদিন আমার
হবি না।এ কথা তোকে বলা আর
তোকে ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে
ফেলা – আমি জানি -আলাদা
কিছু নয়।তুই আমাকে তোর নিজের টিকলুদা’র মতোই দেখিস।
সেই তোকে কী করে বলি তবে-
সুপ্রিয়া, আমি তোমাকে প্রেমিকার
মতো ভালোবাসি।বোল্লে
তুই স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকবি
আর দুমড়ে মুচড়ে যাবি খুব।
তাই কষ্টগুলো মালা ক’ রে
নিজের
কন্ঠেই ঝুলিয়ে নিলাম।
তুই সুখে থাকিস।অনাবিল
অনবদ্য সুখ তোকে
গোলাপ পাঁপড়ির মতো
জড়িয়ে রাখুক আজীবন।
পড়া শেষ করে আমি কতোটা সময় হতবাক আর অন্যমনস্ক ছিলাম- জানি না।
টিকলুদা এসে আমার পিঠে টোকা দিয়ে বোল্লো – চল।
আমি বাড়ি ফিরে এলাম।মনে মনে সেদিনই সিদ্ধান্ত হলো – তোমার কাছ থেকে আমাকে অনেক দূরে সরে যেতে হবে।হারিয়ে যেতে হবে এতোটাই দূরে যেখানে তুমি পারবে না কোনোদিনই পৌঁছে যেতে।শুধু আমার জন্যেই তুমি আজীবন দুঃখী হয়ে গেলে।নিজেকে খুব দায়ী মনে হলো।কেনো মনে হলো সেই ব্যাখ্যা আমার জানা নেই।
আমি তোমার কাছ থেকে দূরে সরে
যেতে থাকলাম।চেয়েছিলান- অবিনাশকে নিয়েই হারিয়ে যাবো। হলো না। অবিনাশটা অন্য এক ব্যানার্জিকে নিয়ে হারিয়ে গেলো।আমার হারিয়ে যাওয়া হলো না আর।তবে আমি ধীরে ধীরে তোমার কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছিলাম সতর্ক এবং সচেতনভাবে- ছুঁয়ে না দেবার মতো দূরে।সম্পূর্ণ অজানা লোকালয়ে যেখানে দাদা বোলে কেউ নেই কিছু নেই।
আজ আমার কোনো দাদা নেই,নেই কোনো অবিনাশ।বড্ড একা আমি ঘুমন্ত পুরীর মতো একলা হয়ে আছি। আমি সুপ্রিয়া ব্যানার্জি- তোমারই আদরের ছোট বোন।খুব বেশি আদরের,তাইনা নীলুদা?

এখন পর্যন্ত লেখাটি পড়া হয়েছে ৬১ বার
যদি লেখাটি সম্পর্কে কোন অভিযোগ থাকে, রিপোর্ট করুন
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন