একদিন রাজু প্রাইভেট পড়াচ্ছে।রাজুর সামনে বসে আছে ৫ জন শিক্ষার্থী।এমন সময় একজন মেয়ে ( একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী)এসে ৫ জন শিক্ষার্থীর পেছনে দাঁড়ালো।রাজু মেয়েটিকে খেয়াল করে নি যদিও খেয়াল করাটাই ছিলো অতি স্বাভাবিক।অগত্যা মেয়েটি নিজে থেকেই বললো -বোসবো?
রাজু বললো- কেনো নয়! নিশ্চয়ই।
মেয়েটি বসলো।
ঠিক সেই থেকেই কি শুরু!
এতো বছর পর রাজুর ঠিক মনে নেই।তবে মনে পড়ে- কলেজে আসার সময় সেই জলডাঙা থেকে মেয়েটি রাজুকে এসএমএস করতে করতে আসতো – যাবার বেলায়ও তাই- এসএমএস করতে করতে যেতো।
এতোটা দীর্ঘ পথ তখন ওকে আসতে হতো হেঁটে হেঁটে! প্রায় কতো কিলো হবে? কিলোটিলো মনে নেই তবে পথটা ছিলো দারুণ দীর্ঘ যেনো অফুরন্ত পথ পড়ে আছে বিছিয়ে থাকা রোদ্দুরের মতো।ভেবে কষ্ট হতো যে অতোটা পথ ওকে হেঁটেই আসতে হতো।
এসএমএস -এর আগে যেভাবে শুরু হয়েছিলো: একদিন সন্ধেবেলা রাজু বসে আছে মডেল প্রাইমারি বিদ্যালয়ের মাঠে।রাজুর সামনে বসে ছিলো ‘আজও প্রশ্নবিদ্ধ’ উপন্যাসের লেখক আহমাদ শামীম।এমন সময় টুংটাং করে বেজে উঠলো রাজুর সেলফোন।রাজু কল রিসিভ করে ‘হ্যালো’ বোলতেই ওপাশ থেকে একটি মেয়ে কন্ঠ বললো: কি করছেন….’।রাজুর সামনে যেহেতু শামীম বসে আছে তাই সে স্বাবলীলভাবে কথা বোলতে পারছিলো না।রাজু তখনও মেয়েটির নাম জানতো না।চিনতে চেষ্টা করছিলো যে কে তাকে ফোন করেছে।কাউকে নাম জিজ্ঞেস করার অভ্যাস রাজুর নেই,তাই জিজ্ঞেস করে নি।দুই- এক মিনিট পর কথা ফুরালো।
তারপর একদিন রাতের বেলা প্রথম এসএমএস শুরু হলো।শুরুটা কে করেছিলো – ‘রাজু’ নাকি ‘সে’?মনে নেই রাজুর।এইভাবে রাতের পর রাত চলছিলো এসএমএস খেলা।এসএমএস -এ মেয়েটি ” জরি” আর রাজু ” নীল”।যেমন, রাজু লিখতো: “নীল বললো এই জরি,কি করছো তুমি?” মেয়েটি লিখতো : “জরি বললো- দুই নয়নে দেখছি তোমায়।”রাজু লিখতো: ‘চোখে চোখ রাখি, নয়নে নজরে মাখামাখি’।জরি লিখতো: ‘তোমায় একবার দেখবো বলে চোখ মেলেছি সহস্রবার’।রাজু লিখতো: ‘তোমাকে দেখতে দেখতে একদিন আমি অন্ধ হয়ে যাবো’। জরি বলতো:’বিষন্ন আত্মার আত্মীয় তুমি, আমি সঙ্গী নিঃসঙ্গতার’।রাজু বলতো:’অনন্ত সুখের অস্তিত্ব তুমি, আমি চিহ্ন অস্তিত্বহীনতার’।
মনে পড়ে একদিন সারারাত এসএমএস খেলার পর শেষ রাতের দিকে মেয়েটি ফোন করলো।কিছুক্ষণ কথা বলার পর বললো:একটা কথা বোলবো?
রাজু বললো- বলো।
রাজুর স্পষ্ট মনে আছে মেয়েটি মানে জরি ইংরেজিতে বলেছিলো:I love you.
শুনে রাজু বিচলিত হয়েছিলো? পুলকিত হয়েছিলো? স্বাভাবিক ছিলো? নাকি মরে গিয়েছিলো?তবে I love you বলে যে জরি নীলের মানে রাজুর বন্ধ্যাত্ব দূর করেছিলো- সেই কারণে রাজু মেয়েটির কাছে নিজেকে চিরঋণী মনে করে।
কলেজ ফাইনাল শেষ হয়ে গেলো।জরি এইচএসসি পাশ করে যথারীতি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো।মাঝে মধ্যে কথা হতো।এসএমএস তখনও চলছিলো তবে আগের চেয়ে অনেকটাই কম।
একদিন জরি বললো – আমার মন খুব খারাপ
রাজু জানতে চাইলাম- কেনো?
আমার এক বন্ধু আমার সঙ্গে রাগ করে কথা বলছে না,ফোনও রিসিভ করছে না।
রাজু বললো – অপেক্ষা করো,নিশ্চয়ই ধরবে।
জরির সেই বন্ধুকে রাজু শুধুই বন্ধু ভেবেছিলো।
এক সময় জরি রাজুকে জানালো- সেই বন্ধুর সঙ্গে জরির প্রেম হয়ে গেছে।
রাজু বললো- কীভাবে হলো?
জরি বললো- এটা কি ব্যাখ্যা করা যায়! এটা তো এমনি এমনিই হয়ে যায়।
জরির ব্যাখ্যা রাজুকে মোটেই প্রশ্নবিদ্ধ করে নি।তবে রাজু ঠিক বুঝে গিয়েছিলো- ওটা আসলে
ব্যাখ্যাকে এড়িয়ে যাবার ব্যাখ্যা কিংবা রাজু ধরে নিয়েছিলো – ব্যাখ্যাটা জরির জানা নেই,
তাই ওভাবে বলেছিলো।আর রাজু বেশ বুঝতে পারছিলো – এসএমএস খেলার দিন শেষ হয়ে গেছে।
শেষ হয়ে গেছে জরি শেষ হয়ে গেছে নীল।
তারপর দীর্ঘ বিরতি—
৪ বছর পর আকস্মিকভাবে একদিন জরির প্রেমিক(রাজুর পূর্ব পরিচিত) পুরুষটির সঙ্গে রাজুর দেখা- কলেজ ক্যাম্পাসে।সে রাজুকে সংক্ষিপ্তভাবে জানালো : জরির সঙ্গে ৪ বছর গভীর গভীরতম সম্পর্কের পর এখন সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে!
পরে রাজু জানতে পেরেছিলো – ছিন্ন হবার কারণ হলো – প্রেমিক পুরুষটি জরিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেছিলো।তার ভাষ্য – জরি অন্য ছেলেদের সঙ্গেও কথা বলতো যা সে মেনে নিতে পারে নি।
সেই অন্য ছেলেরা ছিলো আসলে জরির বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু যাদের সঙ্গে জরির ছিলো কেবলি প্রাসংগিক বা সহজভাষায় লেখাপড়া নোটস ক্লাস – এসব বিষয়ে কথা বলার সম্পর্ক।-
এর বাইরে আর কিছুই নয়।এই স্বাভাবিক ঘটনাটিও সে মেনে নিতে পারে নি।খুব সাধরণ একটি বিষয় নিয়েই ওদের নিবিড় নিবিড়তম সম্পর্ক ভেঙে গেলো!
রাজু অবাক হয় নি আনন্দিত বা দুঃখবোধেও হয়নি ম্রিয়মাণ কারণ রাজু জানে এরকম হয়েই আসছে বরাবর- এসব নতুন কিছু নয় – যা খুব স্বাভাবিকভাবেই মনে করিয়ে দেয় শেক্সপিয়ারের “ওথেলো”।বিশ্বাসের ঘরে ঈর্ষা ঢুকে গেলে মানুষ পালিয়ে যায়- ঢুকে পড়ে বাঁদর আর মহামারী।
জরির সঙ্গে রাজুর হয়তো আর দেখাই হতো না। কিন্তু হয়ে গেলো যেদিন জরির প্রেমিক( প্রাক্তন?) পুরুষটির বিয়ের দাওয়াতে জরিও এসেছিলো।আর দাওয়াত পেয়ে রাজুও গিয়েছিলো। বিয়ের পর জরির প্রেমিক রাজুকে জানিয়েছিলো:জরি নাকি বিয়ের দিন তার হাত ধরে অনেক কান্না করেছিলো।- এ কথার সত্যতা রাজু কোনোদিন যাচাই করে দেখে নি কেননা
যাচাই করাটা রাজুর কাছে অপ্রাসঙ্গিক এবং হীনমন্যতা মনে হয়েছিলো।সম্ভবত রাজু অতটা হীনমন্য নয়।
কিছুদিন পর জরি আর জরির প্রেমিক পুরুষের এক কমন বন্ধু বিদেশ চলে যাবে।তাকে জরি আর জরির এক বন্ধু see off জানিয়ে ফিরে আসছিলো নতুন এয়ারপোর্ট থেকে।পথে জরির বন্ধুর মোবাইল থেকে ফোন দিয়ে জরির অই বন্ধুটি রাজুকে ধরিয়ে দিয়েছিলো জরির সঙ্গে কথা বলার উদ্দেশে।রাজু জরির সংগে কথা বললো আধা মিনিট কিংবা তার চেয়ে কম।সেদিনই হয়তো শেষ কথা- ধরে নিয়েছিলো- রাজু।কিন্তু একদিন জরি ফোন করে রাজুকে দেখা করতে বললো।রাজু হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিয়েছিলো।জরি বলেছিলো- যতোটুকু রাজুর মনে পড়ে- এরকম কিছু: MBA করতে জরি সিংগাপুরে চলে যাবে।তবে বিয়ে হয়ে গেলে যাওয়া হবে না আর।
সেই যে কথা হলো, তার এক মাস পর রাজু জরিকে ফোন দিয়েছিলো জরির সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশে।
রাজু : তুমি এখন কোথায়?
জরি : শ্বশুর বাড়ি।
রাজু : তোমার বিয়ে হলো কবে?
জরি : এই তো কিছুদিন আগে।
রাজু কী বলবে বুঝতে পারছিলো না।তবে বুঝতে তো পারছিলোই -দেখা করা আর সম্ভব নয়।তাই জরিকে রাজু আর বলেনি কেনো রাজু সেদিন জরিকে ফোন দিয়েছিলো।জরিকে ফোন করার জন্য জরি রাজুকে ধন্যবাদ জানিয়ে কথা শেষ করে দিয়েছিলো।-
সেই ছিলো জরির সঙ্গে রাজুর সত্যিকারের শেষ বারের মতো কথা বলা।রাজু জরিকে ফোন দেয় নি আর কোনোদিন তারপর।জরিও দেয় নি রাজুকে আর।
জরি কোনোদিন জানবেও না- জরির একটি ফোনের জন্য রাজু আজও অপেক্ষা করে থাকে।অপেক্ষা করে যাবে আজীবন যেমন অপেক্ষা করছে আজ রাতেও যখন চাদ্দিক ছেয়ে আছে আঁধার আর অন্ধকার।
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন