চিত্র-নভঃ-কিরীটিনী সচন্দ্র রজনী,
চিত্রি’ বিকসিত নৈশ কুসুম-মালায়
উদ্যান, সরসী-নীর ; অযুত রতনে
চিত্রি’ সচঞ্চল চির নীল নীরনিধি,
ভাসিছে নিদাঘাকাশে | বিশ্ব চরাচর
নীরবে শান্তির সুধা করিতেছে পান |
চন্দ্রের একটি রশ্মি শিবিরের দ্বারে
রহিয়াছে শতরঞ্চি উপরে পরিয়া,
যেন স্থির উল্কাখণ্ড, স্থিরতর জ্যোতিঃ |
নিরখিয়া সেই রশ্মি বিমল উজ্জ্বল,
উদাস হইল প্রাণ, পর্যঙ্ক ত্যজিয়া
শিবির-বাহিরে নব-শ্যাম দূর্বাদলে
বসিলাম মন-সুখে ; সন্মুখে আমার
অনন্ত অসীম সিন্ধু! চন্দ্রের কিরণে
খেলিছে অনিলসহ সলিল-লহরী,
চুম্বি’ মৃদু কলকলে মম পদতলে
রজত-বালুকাকীর্ণ ধবল সৈকত |
দক্ষিণে আমার — মৃদু সুমধুর কলে
ছুটিয়াছে কল্লোলিনী@ নাচিয়া নাচিয়া,
আলিঙ্গিয়া প্রতিকুল তীরে গিরিচয় ;
ধবল উত্তরী যেন মাধবের গলে!
অপূর্ব প্রকৃতি শোভা! অদূর ভূধর
শোভিছে মেঘবত্ আকাশের গায়ে ;
কেবল কোথায় কোন উচ্চ তরুবর
অরণ্য হইতে তুলি’ উচ্চতর শির,
করিতেছে আকাশের সীমা নিরুপণ |
চিত্রিত আকাশ-চন্দ্র- ভূধর-সাগর,
চিত্তবিমোহিনী শোভা! মরি কি সুন্দর!
‘এমন সময়ে’ আমি ভাবিলাম মনে
নিশাহন্তা ‘মেকবেত’ সাধিল মানস
সুপ্ত ‘ডনকেনের’ রক্তে ; এমন সময়ে
নিভাইল অশ্বত্থামা, ভজিয়া ধূর্জটী,
পাণ্ডব বংশের পঞ্চ প্রদীপ উজ্জ্বল ;
এমন সময়ে লঙ্ঘি উদ্যান প্রাচীর,
ভেটিল ‘রোমিও’ প্রাণ-প্রিয় ‘জুলিয়েটে’,
নিরখিল চন্দ্র-সূর্য একত্র উদয় ;
এমন সময়, হায়! প্রণয় যন্ত্রণা
নিবাইতে সাগরিকা উদ্যান-বল্লরী
লয়োছ্ল করে, দিতে কোমল গ্রীবায়,
উদ্বন্ধনে বিনাশিতে দুঃখের জীবন ;
এমন সময়ে সুপ্ত কনক-লঙ্কায়,
একাকিনী শোকাকুলা পতির বিরহে
কাঁদিলা অশোক বনে সীতা অভাগিনী ;
‘এমন সময়ে’ সেই সমুদ্রের কূলে
ভাবিতে ভাবিতে দেহ হইল অবশ ;
ক্রমে অজানিত সেউ সমুদ্র-বেলায়
শুইলাম, সুকোমল দূর্বাদলময়ী
শ্যামল শয্যায়! স্নিগ্ধ সমুদ্র-নীরজ
অনিল বহিতেছিল অতি ধীরে ধীরে ;
পশিলাম ক্রমে নিদ্রা-স্বপন-মন্দিরে |
রত্ন-সৌধ-কিরীটিনী স্বর্ণলঙ্কা জিনি,
দেখিনু শোভিছে রাজ্য জলধি-হৃদয়ে
শত লঙ্কা পরিসরে ; বাঁধা ছিল বলে
এক চন্দ্র, এক সূর্য রাবণ-দুয়ারে,
এইখানে সুকুমার প্রণয়-শৃঙ্খলে
কত চন্দ্র, কত সূর্য প্রতি ঘরে ঘরে
রহিয়াছে শৃঙ্খলিত | বহিতেছে বেগে
যেই রম্য রখশ্রেণী বাষ্পে, হুতাশনে,
অতি তুচ্ছ তার কাছে পুষ্পকের গতি |
চপলা সন্দেশবহা ; যাহার পরশে
মরে জীব, সে বিদ্যুত্ দেশদেশান্তরে,
কভু ছায়া-পথে, কভু জলধির তলে,
বহিতেছে রাজ-আজ্ঞা | অপূর্ব কৌশল
বিরাজিয়া স্থানে স্থানে গণে অনায়াসে
সময়ের গতি, কিংবা আকাশের তারা |
লঙ্কার অমৃত ফল বানরের করে
হইল নিঃশেষ, কিন্তু এ অপূর্ব পুরে
জাতীয়-গৌরব রূপে যে অমৃত ফল
ফলিতেছে অনিবার, বিনাশিতে তা’রে
পারিবে না নরে কিংবা সমরে অমরে |
এমন অমৃত পানে পুরবাসিগণ,
আনন্দে শান্তির কোলে করিয়া শয়ন,
নিদ্রা যায় মন-সুখে, হায় রে! কেবল
অন্ধকার কারাগারে বসি, একাকিনী
একটি রমণীমূর্তি করিছে রোদন |
কতকাল রমণীর নয়নের জল
ঝরিয়াছে, কে বলিবে? সেই অশ্রজলে
হইয়াছে দুঃখিনীর অঙ্কিত কপোল ;
কবরী অবেণীবদ্ধ, জটায় এখন
হইয়াছে পরিনত ; হায়! করাঘাতে ক্ষত
বিক্ষত ললাট, স্থানে স্থানে কলঙ্কিত |
বহুমূল্য পরিধেয় নীল-বস্ত্রখানি
হইয়াছে জীর্ণ শীর্ণ — নিতান্ত মলিন,
ততোধিক রমণীর মলিন বরণ |
বহুমূল্য রত্নরাজি আছিল যথায়,
চরণে, প্রকোষ্ঠে, অংসে, উরসে, গ্রীবায়,
উদ্বন্ধন-লতিকার চিহ্নের মতন,
শ্বেতরেখামাত্র এবে সর্ব কলেবরে
রহিয়াছে বিদ্যমান, বাম করোপরে
রক্ষিত বদন-চন্দ্র ; — ফাটিল হৃদয়
এই মূর্তিমতী শোক করি দরশন ;
জিজ্ঞাসিনু— ‘বল মাতা! কে তুমি দুঃখিনি?
এমন বিষাদ-মূর্তি কিসের কারণ?’
বলিলা রমণী অশ্রু মুছিয়া অঞ্চলে,—
‘দুঃখিনী ভারত-লক্ষ্মী আমি, বাছাধন!
আমিই অশোক-বনে সীতা বিষাদিনী |’

মন্তব্য করতে ক্লিক করুন