যাহা ক্ষুদ্রে, তাহাই বৃহতে — কোয়ান্টাম যুগে কি বেদান্তের পুনর্জন্ম?
যাহা ক্ষুদ্রে, তাহাই বৃহতে — কোয়ান্টাম যুগে কি বেদান্তের পুনর্জন্ম?
নন্দ দুলাল মন্ডল

আলোচনা - যাহা ক্ষুদ্রে, তাহাই বৃহতে — কোয়ান্টাম যুগে কি বেদান্তের পুনর্জন্ম?

নন্দ দুলাল মন্ডল
শুক্রবার, ১০ অক্টোবর ২০২৫

আমি পদার্থবিদ্যার ছাত্র নই। এই শাখায় আমার জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত বা একেবারেই নেই বললেই চলে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুবাদে খানিকটা আলাপ। তাই যেখানে মনে হবে আমি সঠিক বিশ্লেষণ করে উঠতে পারলাম না সরাসরি আমাকে জানাবেন।
_________________________________
\”একদিন প্রাচীন ভারতের কোনো আশ্রমে ঋষি কণাদ একটি ছোট কণাকে হাতে নিয়ে বলেছিলেন —
\’এই ক্ষুদ্র কণার ভেতরেই সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড ঘুমিয়ে আছে।\’

তিন হাজার বছর পর,
ক্যালিফোর্নিয়ার এক ল্যাবরেটরিতে জন মার্টিনিস একটি সার্কিট হাতে ধরে বললেন
\’এই ছোট সার্কিটেও কোয়ান্টাম জগত জেগে আছে।\’
সময় আলাদা, ভাষা আলাদা, কিন্তু চিন্তার স্রোত একই।\”
এই ২০২৫ সালে “ঋষি কণাদ” ও “জন মার্টিনিস”-কে এক প্রতীকী সেতুতে দাঁড় করিয়ে যেন ইতিহাস নিজেই নিজের পুনর্জন্ম দেখছে ।

২০২৫ সালের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত এই কাজ (Clarke, Devoret, Martinis) পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী মোড় এনেছে। তারা একটি বৈদ্যুতিক সার্কিটে (electrical circuit) কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল টানেলিং (quantum mechanical tunneling) এবং কোয়ান্টাইজড শক্তি স্তর (quantised energy levels) প্রদর্শন করেছেন, এমন একটি সিস্টেমে যা হাতের মুঠোয় ধরার মতো বৃহৎ কিছু বিষয়। অর্থাৎ, তারা প্রমাণ করেছেন এমনকি একটি “বড়” যন্ত্র (যেমন ইলেকট্রিক সার্কিট)-ও কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়মে কাজ করতে পারে!

এবার এতোক্ষণে  আপনার মনে হয়তো যে যে প্রশ্ন গুলো এসছে –

#এক,Quantum Mechanics (কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা) কী?
সাধারণভাবে, কোয়ান্টাম মেকানিক্স হচ্ছে সেই বিজ্ঞান, যা অতি ক্ষুদ্র কণা (electron, proton, photon ইত্যাদি)-র আচরণ ব্যাখ্যা করে।এই স্তরে জিনিসগুলো “নিশ্চিতভাবে” নয়, বরং “সম্ভাবনার” ভিত্তিতে ঘটে।

#দুই,Quantum Tunneling (কোয়ান্টাম টানেলিং) কীভাবে কাজ করে?

ধরুন, একটা বল পাহাড়ের একদিকে আছে।
বলটি সাধারণ নিয়মে পাহাড় পার হতে পারবে না, কারণ পর্যাপ্ত শক্তি নেই এতো বৃহৎ পাহাড়কে অতিক্রমণ করার ( মানে ওই ধরুন আমি আপনি এই পাহাড় সমান কোরাপটেট সিস্টেমের সামনে যেভাবে একটা ক্ষুদ্র বল) ।
কিন্তু কোয়ান্টাম জগতে, একটি কণা “অলৌকিকভাবে” দেয়ালের ভেতর দিয়ে হঠাৎ পার হয়ে যেতে পারে —
এটাই Quantum Tunneling।
Clarke ও Devoret এমন এক সার্কিট বানান যেখানে বৈদ্যুতিক চার্জও এইভাবে “টানেলিং” করে পার হয় — ঠিক যেমন ক্ষুদ্র কণারা করে।
এতে বোঝা গেল, এই নিয়ম শুধু পরমাণুর স্তরে নয়, বড় সিস্টেমেও প্রযোজ্য!

#তিন, Energy Quantization (শক্তির স্তরবিন্যাস) কী?
একটা সাধারণ বাতি চালু করলে ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়।
কিন্তু কোয়ান্টাম জগতে কোনো কণা ধীরে ধীরে শক্তি নেয় না —
বরং “ধাপে ধাপে” শক্তি নেয়।
মানে, নির্দিষ্ট মাত্রায় (1 unit, 2 unit, 3 unit …) শক্তি গ্রহণ করে।
এই তিন বিজ্ঞানী দেখিয়েছেন, তাদের বানানো সার্কিটেও শক্তি স্তরবিন্যাস দেখা যায় —যা আবারও প্রমাণ করে যে বড় কোনো সিস্টেমেও কোয়ান্টাম আচরণ সম্ভব।

#চার,এই আবিষ্কার আমার আপনার কি কাজে লাগতে পারে?
– অতিদ্রুত কম্পিউটার ও ডেটা প্রসেসিং অর্থাৎ বর্তমান কম্পিউটার থেকে কোটি গুণ দ্রুত কাজ করা Quantum Computer আসবে।জটিল গবেষণা, চিকিৎসা, আবহাওয়া, ট্রাফিক বা AI প্রশিক্ষণ মুহূর্তে সম্পন্ন হবে।আমরা “লোডিং” বা “হ্যাং” শব্দটা ভুলে যাব।
Quantum Communication প্রযুক্তিতে কোনো মেসেজে আড়ি পাতলে সঙ্গে সঙ্গে তা ধরা পড়বে।
অনলাইন ব্যাংকিং, পেমেন্ট, ব্যক্তিগত ডেটা সম্পূর্ণ সুরক্ষিত থাকবে।
“হ্যাকিং” বা “ডেটা লিক” হয়তো প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে।
ভবিষ্যতের মোবাইল হবে “Quantum Phone” —
যেখানে ডেটা ট্রান্সফার ও প্রসেসিং বর্তমানের তুলনায় কয়েক হাজার গুণ দ্রুত।
Quantum Sensor-এর মাধ্যমে রোগ নির্ণয় হবে প্রাথমিক পর্যায়েই,
যেমন: ক্যান্সার, হার্ট ব্লক, ব্রেন ডিসঅর্ডার—সবকিছু শুরুতেই ধরা পড়বে।
MRI, CT Scan ইত্যাদির নির্ভুলতা বহু গুণ বাড়বে।
সার্জারি ও রোবটিক চিকিৎসা হবে আরও নিখুঁত ও নিরাপদ। ইত্যাদি ইত্যাদি ।

এটি ইতিহাস তৈরি করেছেন কারণ এটি “Quantum Physics”-এর সীমাকে ভেঙে দিয়েছে বলেই আমার মনে হচ্ছে। এর আগে পর্যন্ত, কোয়ান্টাম মেকানিক্স মনে করা হত অতি ক্ষুদ্র কণা (atoms, electrons, photons ইত্যাদি)-র জগতে সীমাবদ্ধ।
মানুষ ভেবেছিল, যত বড় কোনো বস্তু হবে, ততই তা “ক্লাসিক্যাল” নিয়মে (Newton-এর নিয়ম) কাজ করবে। কিন্তু এই তিন বিজ্ঞানী প্রমাণ করলেন একটি বড় ইলেকট্রিক সার্কিটও কোয়ান্টাম নিয়মে কাজ করতে পারে।এটা এমন এক সেতুবন্ধন সৃষ্টি করেছে যেখানে
“Quantum World” ও “Classical World” এর মাঝের ফাঁকটা ভেঙে গেল।
এই কাজ ভবিষ্যতে কোয়ান্টাম কম্পিউটার, সেন্সর ও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্র পাল্টে দিতে পারে।
অপরদিকে বেদান্ত বলে —
“ব্রহ্ম সত্যম্‌ জগৎ মিথ্যা, জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ।”
অর্থাৎ, যা আমরা “বস্তু” বলে দেখি, তা আসলে চেতনার প্রকাশমাত্র। কোয়ান্টাম মেকানিক্সও হয়তো কোথাও গিয়ে একই কথা বলার চেষ্টা করে, যেখানে বলে
পর্যবেক্ষক (Observer) ছাড়া কোনো কণার অবস্থাই নির্ধারিত নয়। এটাই “Observer Effect”। আর আমাদের বেদান্তে যাকে বলা হয় “দর্শক চেতনা”, বিজ্ঞানে সেটাই “Quantum Observer” —
অর্থাৎ পর্যবেক্ষণ করলেই বাস্তবতা “collapse” হয়ে নির্দিষ্ট আকার নেয়।
গৌতম বুদ্ধ বলেছিলেন —
সবকিছু পরিবর্তনশীল; স্থায়ী কিছু নেই।”
কোয়ান্টাম মেকানিক্সও বলে —কোনো কণার অবস্থান স্থির নয়; কেবল পরিবর্তনের সম্ভাবনা।

শঙ্করাচার্যের তার অদ্বৈত দর্শনে বলা হয়েছে — “জগতে দ্বৈত কিছু নেই; ব্রহ্মই একমাত্র সত্য।”
এই দৃষ্টিভঙ্গি কোয়ান্টাম ঐক্যের মতো —
যেখানে আলাদা কণা নেই,সবই আসলে এক বৃহৎ তরঙ্গের রূপান্তর।

অর্থাৎ আমি এক কথায় এভাবে বলতে পারি যে –
\” universe is one quantum field vibrating in infinite patterns.”
অর্থাৎ এক, দ্বিতীয় কিছু নয়।

এই গোটা বিষয়টাকে রবি ঠাকুরের ভাষায় বললে –
\” বিজ্ঞান ও দর্শন একে অপরের হাত ধরে চলে।”
এই নোবেল পুরস্কার যেন সেই ভাবনারই বাস্তব রূপ,বিশ্ব বাইরের নয়, আমাদের চেতনারই প্রতিফলন।
যেখানে বিজ্ঞান আবার দর্শনের দিকে ফিরে তাকাচ্ছে, বোধহয় কোথাও গিয়ে তাকাতেও হয়।
সর্বশেষে বলবো বেদান্ত যেখানে বলে
‘যাহা ক্ষুদ্রে, তাহাই বৃহতে’।
সেখানে ২০২৫-এর নোবেল বলে: ‘Quantum rule applies to macroscopic reality’।
দুই কথাই আসলে এক।

~ নন্দ দুলাল মন্ডল ।
পশ্চিমবঙ্গ,ভারত।

পরে পড়বো
১২৫
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন