— নিলু মামার মহাজাগতিক গল্প —
টিটু ছেলেটা ছোট হলেও তার মনটা অনেক বড়। আকাশের দিকে তাকালে তার চোখ দুটো কেমন জানি গোল হয়ে যায়। যেন আকাশের সব তারা সে একাই পকেটে পুরে ফেলবে।
এই তারাগুলো কত দূরে? কোথা থেকে এসেছে? কেন মিটি মিটি করে জ্বলে? টিটু রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে একা একা ভাবে। প্রশ্নের কোনো শেষ নেই তার।
পাশের ফ্ল্যাটের নিলু মামা। লম্বা, রোগাটে মানুষ। চোখে মোটা কাঁচের চশমা। এই শহরে তার আসল কাজ কী, কেউ জানে না। তবে সবাই জানে, তিনি রাতের বেলা ছাদে যান। টেলিস্কোপ নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
নিলু মামা হয়তো আকাশ নয়, আকাশের ভেতরের রহস্যের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
একদিন টিটু সাহস করে ছাদে উঠে গেল। নিলু মামা তার টেলিস্কোপের মুখ থেকে চোখ সরিয়ে টিটুর দিকে তাকালেন। মৃদু হাসলেন।
“কী টিটু, আজ বুঝি তারা গুনতে এসেছো?”
“মামা, তারাগুলো এত মিটিমিটি করে কেন জ্বলে? আর ওই যে সাদা চাদরের মতো যেটা দেখা যায়, সেটা কী?”
নিলু মামা তার রোগা হাতটা আকাশের দিকে তুললেন। “ওটা তো তোমার ছায়াপথ। আমাদের নিজের বাড়ি। আমরা তার ভেতরে থাকি বলে বাইরে থেকে পুরোটা দেখতে পাই না।”
“আমাদের বাড়ি? এটা কি অনেক বড় বাড়ি, মামা?”
নিলু মামা এবার হাসলেন, যেন তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে মজার কথাটি শুনছেন। “বড়? হা হা! টিটু, তুমি যাকে তারা বলছো, সেরকম প্রায় একশ বিলিয়ন নক্ষত্র মিলে এই গ্যালাক্সি তৈরি হয়েছে। এক বিলিয়ন মানে একশ কোটি।”
টিটু হাঁ করে চেয়ে রইল। একশ কোটি! সে কেবল দশ পর্যন্ত গুনতে পারে।
নিলু মামা বললেন, “শুধু আমরা নই। মহাকাশের গভীরে তাকালে দেখবে, গ্যালাক্সি আর গ্যালাক্সি। প্রতিটি গ্যালাক্সিতে বিলিয়ন বিলিয়ন তারা।”
“মনে হবে গ্যালাক্সির বুঝি কোনো শেষ নেই। অনুমান করা হয়, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে অংশটুকু আমরা দেখতে পাই, সেখানে প্রায় এক ট্রিলিয়ন গ্যালাক্সি রয়েছে। ট্রিলিয়ন মানে জানো তো? হাজার বিলিয়ন।”
টিটুর মাথা ঘুরতে লাগল। এত এত গ্যালাক্সি, এত তারা! সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“মামা, এই গ্যালাক্সিগুলো কোথা থেকে এসেছে? কেন এসেছে?”
নিলু মামা টেলিস্কোপটি একপাশে রাখলেন। “এই হলো কাজের প্রশ্ন। বিজ্ঞানীরাও এই প্রশ্নটা করেছিল। তারা পৃথিবী বা চাঁদের গতিবিধি বোঝার জন্য নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র ব্যবহার করে। কিন্তু এই বিশাল গ্যালাক্সিগুলোর গতিবিধি বোঝার জন্য একটা নতুন সূত্রের দরকার হলো—আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি।”
“বড়ই কঠিন নাম, মামা।”
“হ্যাঁ, কঠিন। তবে তার সমাধানটা ছিল আরও বিস্ময়কর। সেই সূত্র বলেছিল, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড প্রসারিত হচ্ছে।”
আইনস্টাইন প্রথমে এটা মানতে চাইলেন না। তিনি ভাবলেন, এ কেমন কথা! বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিশ্চয়ই নিজে নিজে প্রসারিত হতে পারে না। মহাকর্ষ বলের টানে সব গ্যালাক্সি এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত হয়ে যাবে না তো?
“তিনি নিজের সূত্রেই জোর করে একটা ধ্রুব সংখ্যা ঢুকিয়ে দিলেন। ওটা মহাকর্ষ বলের আকর্ষণকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য।”
টিটু মাথা চুলকাল। “নিজের সূত্রকে নিজেই পাল্টালেন কেন, মামা?”
“সেটাই তো রহস্য! আইনস্টাইন তখনো জানতেন না, তাঁর সূত্রের আসল কথাই ঠিক ছিল। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সত্যিই প্রসারিত হচ্ছে। তাই ওই ধ্রুবক বসানোর কোনো দরকার ছিল না।”
“পরে কী হলো?”
“পরে এলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী হাবল। তিনি দূর-দূরান্তের গ্যালাক্সিগুলোর গতিবেগ মাপতে লাগলেন। তিনি দেখলেন, একটা গ্যালাক্সি যত দূরে, সেটা তত বেশি বেগে ছুটে যাচ্ছে!”
“আসলে গ্যালাক্সিটা সরে যাচ্ছিল না, টিটু। সেটা যে জায়গায় আছে, সেই জায়গাটাই প্রসারিত হচ্ছিল। ভাবো, একটা বেলুনের গায়ে তুমি কিছু ফোঁটা এঁকে দিলে। বেলুন ফোলাতে থাকলে ফোঁটাগুলো কেউ কারো কাছ থেকে সরে না গিয়েও দূরে সরে যাচ্ছে।”
“মানে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডটাই বেলুনের মতো ফুলছে!”
“ঠিক তাই। হাবলের পর্যবেক্ষণ দেখে আইনস্টাইন নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। তিনি নিজের ওই ধ্রুবকটিকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘এটি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল’।”
নিলু মামা হাসলেন। “বড় বিজ্ঞানীরাও ভুল করে, টিটু। তবে ভুল স্বীকার করার সাহসটা আরও বড়।”
“তাহলে কি সব গ্যালাক্সি একসময় এক জায়গায় ছিল?”
“ঠিক তাই! যদি সবাই সবার কাছ থেকে দূরে সরে যায়, তবে নিশ্চয়ই অতীতে কোনো একসময় তারা একটা বিন্দুতে ছিল। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে বের করল, এই প্রসারণ শুরু হয়েছে আজ থেকে প্রায় তেরোশো আশি কোটি বছর আগে। তারা এটার নাম দিল—বিগ ব্যাং!”
টিটু চোখ বন্ধ করে ভাবার চেষ্টা করল। তেরোশো আশি কোটি বছর আগে একটা ছোট্ট বিন্দু থেকে সবকিছুর শুরু!
“বিগ ব্যাং মানে কি খুব জোরে একটা বিস্ফোরণ হয়েছিল, মামা?”
“আসলে এটা বিস্ফোরণ নয়, টিটু। এটা ছিল অভাবনীয় দ্রুতগতিতে প্রসারিত হওয়া। বিগ ব্যাংয়ের পরে পর পর এক অভাবনীয় ব্যাপার ঘটেছিল। যাকে বলে ইনফ্ল্যাশন।”
“সেটা কেমন?”
“মাত্র এক সেকেন্ডের মিলিয়ন মিলিয়ন মিলিয়ন ভাগের এক ভাগ সময়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড হঠাৎ করে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন গুণ বড় হয়ে গিয়েছিল। এমন দ্রুত প্রসারণ যে আলোর গতির থেকেও দ্রুত ছিল।”
টিটু অবাক। “আলোর গতির চেয়েও দ্রুত? কিন্তু কোনো কিছু তো আলোর গতির চেয়ে দ্রুত যেতে পারে না।”
“পারে না। কিন্তু বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রসারণে কোনো বস্তু বা তথ্য আলোর গতির চেয়ে দ্রুত যেতে পারে না—এই নিয়ম ভাঙে না। কারণ এখানে কোনো বস্তু ছুটছে না, শুধু জায়গাটাই বড় হয়ে যাচ্ছে।”
“বিগ ব্যাংয়ের পর প্রথম কয়েক মুহূর্ত এত গরম আর ঘন ছিল যে আমাদের পরিচিত বিজ্ঞান তখনো কাজ করত না। কিন্তু মাত্র বিশ মিনিটের মাথায় বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ঠান্ডা হতে শুরু করল।”
“তখন কী হলো?”
“তখন তৈরি হয়ে গেল প্রোটন আর নিউট্রন। আর ইলেকট্রন। কিন্তু তখনো কোনো পরমাণু তৈরি হতে পারেনি। কারণ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তখনো খুব গরম।”
“গরম হলে কী হবে?”
“গরম মানে সেখানে শক্তিশালী ফোটন কণা বা আলো ছিল। সেই আলো ইলেকট্রন আর প্রোটনদের আঘাত করে খণ্ড খণ্ড করে দিত। ফলে তারা একসাথে জুড়ে গিয়ে পরমাণু তৈরি করতে পারত না।”
“তাহলে?”
“কাজেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে অপেক্ষা করতে হলো। একদিন, দু’দিন নয়। এক বছর, দু’বছরও নয়। অপেক্ষা করতে হলো প্রায় তিন লক্ষ আশি হাজার বছর। ততদিনে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যথেষ্ট ঠান্ডা হয়েছে। আলো দুর্বল হয়ে গেছে।”
“যখন তাপমাত্রা কমে গেল, তখন ইলেকট্রন আর প্রোটনরা একসাথে জুড়ে গিয়ে তৈরি করল প্রথম পরমাণু—হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম।”
“আর সেই মুহূর্তে কী হলো জানো?”
টিটু মাথা নাড়ল।
“যে আলো এতক্ষণ ইলেকট্রনদের সাথে ধাক্কা খাচ্ছিল, তারা হঠাৎ করে মুক্তি পেল! তাদের আটকানোর কেউ রইল না। সেই মুক্তি পাওয়া আলো আজ পর্যন্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিজ্ঞানীরা তার নাম দিয়েছে—কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড বা সিএমবি।”
“এটাই কি বিগ ব্যাংয়ের স্পষ্ট প্রমাণ?”
“হ্যাঁ। এটি যেন বিগ ব্যাংয়ের পর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রথম ছবি। দেখলে মনে হবে, সবদিকেই একটা হালকা গরমের আঁচ আছে। আর এই সিএমবি আরও একটা অদ্ভুত তথ্য দেয়।”
নিলু মামা ফিসফিস করে বললেন, “সেটা হলো অন্ধকার বস্তু।”
“অন্ধকার বস্তু?”
“হ্যাঁ, ডার্ক ম্যাটার। যাকে দেখা যায় না। সে কোনো আলো ছড়ায় না, কোনো বিক্রিয়াও করে না। শুধু তার মহাকর্ষ বল দিয়ে অন্য বস্তুদের টানে। বিজ্ঞানীরা দেখেছে, গ্যালাক্সিগুলো যেভাবে ঘুরপাক খায়, তা ব্যাখ্যা করার জন্য এই ডার্ক ম্যাটারের সাহায্য নিতেই হয়।”
“এটা কি অনেক আছে?”
“তুমি অবাক হবে শুনে, বিগ ব্যাংয়ের তিন লক্ষ আশি হাজার বছর পর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মোট ভরের শতকরা তেষট্টি ভাগ ছিল এই ডার্ক ম্যাটার! আর বাকি সব আমরা যে বস্তু দেখি।”
টিটু একটু ভয় পেল। “এত অন্ধকার জিনিস কেন, মামা?”
“ভয় পেয়ো না। ডার্ক ম্যাটার প্রথমে গ্যালাক্সি তৈরি করতে সাহায্য করেছিল। তারা মাধ্যাকর্ষণ শক্তি দিয়ে গ্যাস আর ধূলিকণাকে টেনে এনে এক জায়গায় জড়ো করল। সেই জমাট বাঁধা গ্যাস আর ধূলিকণা থেকে জন্ম হলো প্রথম তারাগুলোর।”
“প্রথম তারারা ছিল বিশাল, আর প্রচণ্ড গরম। তারা খুব দ্রুত তাদের ভেতরের সব হাইড্রোজেন শেষ করে ফেলে। আর যখনই তাদের জ্বালানি ফুরিয়ে যেত, তখনই ঘটত এক ভয়ঙ্কর ঘটনা।”
“কী ঘটনা?”
“সুপারনোভার বিস্ফোরণ। নক্ষত্রটি ফেটে গিয়ে তার ভেতরের সব উপাদান মহাকাশে ছড়িয়ে দিত।”
“কিন্তু এতে কী লাভ হলো?”
“লাভ হলো, টিটু, অনেক বড় লাভ! আমরা যে হাইড্রোজেন আর হিলিয়ামের কথা বললাম, সে দুটো ছিল খুব হালকা মৌল। কিন্তু আমাদের চারপাশে যে ভারি মৌলগুলো আছে—যেমন কার্বন, অক্সিজেন, লোহা—এগুলো তৈরি হয়েছিল নক্ষত্রের ভেতরে। আর সুপারনোভার বিস্ফোরণের মাধ্যমেই সেগুলো মহাকাশে ছড়িয়ে পড়েছিল।”
নিলু মামা হাসলেন। “তোমার শরীরে যে ভারি মৌলগুলো আছে, সেগুলো কোনো এক তারার ভেতরের অংশ। কাজেই মনে রেখো, তুমি মোটেই তুচ্ছ নও, তুমি আসলে নক্ষত্রের সন্তান!”
টিটু নিজের হাত দেখল। তার ভেতরের লোহা, ক্যালসিয়াম—সব তারার তৈরি। কী এক বিস্ময়কর অনুভূতি!
“এরপর কী হলো, মামা? পৃথিবী কেমন করে তৈরি হলো?”
“আমাদের ছায়াপথ, এই গ্যালাক্সির এক কোণে অনেক গ্যাস, ধূলিকণা আর বরফ জমে একটা নেবুলা তৈরি করেছিল। আজ থেকে প্রায় চারশো ষাট কোটি বছর আগে।”
“সেই নেবুলা তার নিজের ওজনের ভারে চুপসে যেতে শুরু করল। আর ঘূর্ণির সৃষ্টি হলো। সেই ঘূর্ণির মাঝখানে প্রচণ্ড তাপ আর চাপে জন্ম হলো একটি তারার। সেই তারার নাম কী, জানো?”
“সূর্য!”
“ঠিক তাই। সূর্যের চারপাশে যে ধূলিকণাগুলো ঘুরছিল, সেগুলো মহাকর্ষ বলের টানে একে অপরের সাথে ধাক্কা খেয়ে জড়ো হতে লাগল। এভাবেই জন্ম নিল গ্রহগুলো।”
“আর সেই গ্রহগুলোর একটা হলো আমাদের পৃথিবী।”
“আজ থেকে প্রায় চারশো কোটি বছর আগে জন্ম নেওয়া সেই পৃথিবী প্রথম দিকে ছিল একটা উত্তপ্ত গোলক। আর তার কাছাকাছি একটি বিশাল গ্রহাণুর ধাক্কায় জন্ম হলো আমাদের চাঁদের।”
“প্রচণ্ড গরম সেই পৃথিবী ধীরে ধীরে ঠান্ডা হতে শুরু করল। আর তখন হলো এক অবিরাম বৃষ্টি। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বৃষ্টি হলো পৃথিবীতে। সেই বৃষ্টিতে ভরে গেল পৃথিবীর সমুদ্র।”
“বৃষ্টির জল কোথা থেকে এল, মামা?”
“পৃথিবীর ভেতরে যে গ্যাস ছিল, তা ঠান্ডা হয়ে মেঘ হয়েছিল। আর অবিরাম বজ্রপাত হচ্ছিল সেই মেঘে। সেই প্রথম দিকের পৃথিবীতে কোনো অক্সিজেন ছিল না। ছিল মিথেন, অ্যামোনিয়া আর জলীয় বাষ্প।”
“সেই পরিবেশ কি জীবনের জন্য উপযুক্ত ছিল?”
“কেউ জানত না। তাই বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখতে চাইল।”
নিলু মামা আবার গল্পের ভঙ্গিতে ফিরে এলেন। “দুই বিজ্ঞানী—মিলার আর উরে। তারা ল্যাবরেটরিতে পৃথিবীর সেই প্রথম পরিবেশ তৈরি করলেন। একটা কাঁচের গোলকে ভরে দিলেন জল, মিথেন, অ্যামোনিয়া আর হাইড্রোজেন গ্যাস।”
“তারপর? বজ্রপাত!”
“ঠিক! বজ্রপাত তৈরি করার জন্য তারা ইলেকট্রিক ডিসচার্জ দিলেন। কয়েকদিন পর তারা দেখলেন, সেই কাঁচের গোলকের ভেতরে জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিড তৈরি হয়ে গেছে!”
টিটু মুগ্ধ হয়ে শুনল। “তাহলে জীবন তৈরি হতে পারে।”
“হ্যাঁ। সহজভাবে তৈরি হতে পারে। অনুমান করা হয়, প্রায় চার বিলিয়ন বছর আগে সমুদ্রের ভেতরে জীবনের আবির্ভাব হয়েছিল। সেই প্রথম জীবন ছিল খুব সাধারণ, খুব সরল। এক কোষী প্রাণী।”
“কেমন দেখতে ছিল?”
“খুব ছোট। কোনো নিউক্লিয়াস নেই। এই সরল এক কোষী প্রাণী পৃথিবীতে টিকে ছিল কতদিন জানো? দুই বিলিয়ন বছর। দীর্ঘ একটা সময়।”
“এই দুই বিলিয়ন বছর ধরে তারা কী করল?”
“এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া জন্ম নিল, যারা সালোকসংশ্লেষণ করতে পারত। মানে সূর্যের আলো আর কার্বন ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করে নিজেদের খাবার তৈরি করত। আর বর্জ্য হিসেবে ত্যাগ করত—অক্সিজেন।”
“অক্সিজেন! আমাদের বাতাস!”
“হ্যাঁ। আজ থেকে প্রায় আড়াই বিলিয়ন বছর আগে, এই এক কোষী প্রাণীরা পৃথিবীতে ধীরে ধীরে অক্সিজেন জমাতে শুরু করল। এর আগে বাতাসে অক্সিজেন ছিল না বললেই চলে।”
“অক্সিজেন জমা হলে কী হলো?”
“পুরনো অনেক প্রাণী, যারা অক্সিজেন ছাড়া বাঁচতে পারত, তারা বিলুপ্ত হয়ে গেল। আর জন্ম নিল নতুন ধরনের প্রাণী, যারা অক্সিজেন ব্যবহার করে বেশি শক্তি তৈরি করতে পারত।”
“এভাবেই এক কোষী প্রাণী থেকে ধাপে ধাপে বহুকোষী প্রাণী তৈরি হতে শুরু করল। আজ থেকে প্রায় এক বিলিয়ন বছর আগে জন্ম হলো বহুকোষী প্রাণীর।”
“বহুকোষী প্রাণীরা পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে লাগল। নানা ধরনের পরিবর্তন আসতে লাগল তাদের শরীরে। এই পরিবর্তনকে বিজ্ঞানীরা বলেন বিবর্তন।”
“তারা দেখতে কেমন হলো?”
“আজ থেকে প্রায় সাতান্ন কোটি বছর আগে এক ধরনের প্রাণীর জন্ম হলো যাদের শরীরে মেরুদণ্ডের আভাস ছিল। এরপর বিভিন্ন ধরনের মাছ, উভচর প্রাণী, সরীসৃপ প্রাণীর জন্ম হলো।”
“আর ডাইনোসর?”
“ডাইনোসর! আজ থেকে প্রায় বাইশ কোটি বছর আগে ডাইনোসরের রাজত্ব শুরু হয়েছিল। পৃথিবীজুড়ে তাদের দাপট চলল দীর্ঘ সময়।”
টিটু চোখ বড় করে বলল, “ডাইনোসর খুব ভয়ঙ্কর ছিল, না মামা?”
“অনেকেই ছিল। তবে জানো, এখন যে পাখি দেখি, ছোট একটা চড়ুই পাখি, তাদের পূর্বপুরুষ ছিল কিন্তু ডাইনোসর। বিজ্ঞানীরা মনে করে, এক ধরনের ছোট ডাইনোসর থেকেই কালক্রমে পাখির জন্ম হয়েছে।”
“তাহলে, ডাইনোসররা কেন নেই?”
নিলু মামার গলা একটু ভারি শোনাল। “আজ থেকে প্রায় ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে। মহাকাশ থেকে একটি বিশাল গ্রহাণু এসে আঘাত করল পৃথিবীতে।”
“প্রচণ্ড সেই সংঘাতে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ধুলোবালিতে ঢেকে গেল। পুরো পৃথিবী ঠান্ডা হয়ে গেল। সেই ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ে ডাইনোসররা আর টিকে থাকতে পারল না। দেখতে দেখতে তারা পৃথিবী থেকে নিঃশেষ হয়ে গেল।”
টিটু চুপ করে রইল। এত বড় একটা বিপর্যয়!
“ডাইনোসররা বিলুপ্ত হওয়ার পর স্তন্যপায়ী প্রাণীরা সুযোগ পেল। ছোট ছোট ইঁদুরের মতো প্রাণী ছিল তারা, যারা ডাইনোসরের ভয়ে লুকিয়ে থাকত। এখন তারাই রাজত্ব করতে শুরু করল।”
“স্তন্যপায়ী প্রাণীরা বিবর্তনের মাধ্যমে নানা রূপ নিল। এর মধ্যে আজ থেকে প্রায় ৫৫ মিলিয়ন বছর আগে জন্ম নিল এক ধরনের ছোট প্রাণী, নাম রাইয়েট। এরা ছিল আমাদের পূর্বপুরুষ।”
“রাইয়েট দেখতে কেমন ছিল?”
“ছোট, লোমশ। দুটো চোখ সামনের দিকে। এরা গাছে বাস করত। প্রায় ৪০ মিলিয়ন বছর আগে রাইয়েটের বংশধররা দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেল। এক ভাগ হলো বানর, আরেক ভাগ হলো এপ। এপ মানে হলো লেজহীন বানর।”
নিলু মামা হাসলেন। “আমরা নিশ্চয়ই বানর থেকে আসিনি। যদি ঠিক করে বলতে হয়, তবে বলতে হবে আমাদের পূর্বপুরুষ আর বানরের পূর্বপুরুষ ছিল একই।”
“এপদের একটা বংশধর হাঁটার চেষ্টা করত। তারা দু’পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে শুরু করল। এভাবেই ধীরে ধীরে মানুষের জন্ম হলো।”
“মানুষের প্রথম দিকের নাম ছিল হোমো ইরেক্টাস। এরা প্রায় এক লক্ষ বছর আগে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। অনুমান করা হয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা খাদ্যের অভাবে তারা টিকতে পারেনি।”
“তারপর? হোমো স্যাপিয়েনস?”
“হ্যাঁ। আমাদের প্রজাতির নাম হোমো স্যাপিয়েনস। এর মানে ‘জ্ঞানবান মানুষ’। এরা জন্ম নিয়েছিল আজ থেকে প্রায় দুই লক্ষ বছর আগে। আমাদের একটা বিশেষ ক্ষমতা আছে, যা অন্য কারও নেই।”
“কী সেটা, মামা?”
“কল্পনা করার ক্ষমতা। আমরা গল্প বলতে পারি, ছবি আঁকতে পারি, গান গাইতে পারি। এই ক্ষমতা দিয়েই আমরা অন্য প্রজাতির মানুষদের থেকে এগিয়ে গিয়েছি।”
নিলু মামা একটু থামলেন। “হোমো স্যাপিয়েনস ছাড়াও সে সময় আরও এক ধরনের মানুষ ছিল। তাদের নাম নিয়ান্ডারথাল। তারা হোমো স্যাপিয়েনসদের মতোই বুদ্ধিমান ছিল। তবে তারা ঠান্ডা আবহাওয়ার জন্য বেশি উপযুক্ত ছিল।”
“নিয়ান্ডারথালরা খুব শক্তিশালী ছিল। তারা দলবদ্ধভাবে শিকার করত। কিন্তু হোমো স্যাপিয়েনসরা তাদের চেয়েও বেশি বুদ্ধি খাটিয়েছিল।”
“কী বুদ্ধি?”
“তারা একে অপরের সাথে কথা বলে ধারণা বিনিময় করতে পারত। শিকার করার জন্য অস্ত্র তৈরি করতে পারত। নিজেদের জ্ঞান এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে পৌঁছে দিতে পারত। এটা ছিল মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনা।”
“হোমো স্যাপিয়েনস আর নিয়ান্ডারথালরা একই সময় একই জায়গায় বাস করত। কিন্তু দেখা গেল, হোমো স্যাপিয়েনসরা টিকে রইল, আর নিয়ান্ডারথালরা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেল।”
“কেন বিলুপ্ত হলো?”
“ঠিক কারণটা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে অনুমান করা হয়, আমাদের পূর্বপুরুষরাই হয়তো নিয়ান্ডারথালদের শেষ করে দিয়েছিল। সেটা ছিল মানব ইতিহাসের এক ভয়ঙ্কর গণহত্যা।”
টিটু মাথা নামাল। মানুষ তাহলে শুরু থেকেই নিষ্ঠুর ছিল।
“হ্যাঁ, টিটু। তবে আমাদের যে কল্পনা শক্তি, তা শুধু নিষ্ঠুরতা নয়, ভালোবাসা আর করুণাও সৃষ্টি করে।”
“নিয়ান্ডারথালরা বিলুপ্ত হওয়ার পর হোমো স্যাপিয়েনসরা ধীরে ধীরে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল। আফ্রিকা থেকে শুরু করে এশিয়া, তারপর বেরিং প্রণালী দিয়ে উত্তর আমেরিকাতেও প্রবেশ করল।”
“আজ থেকে প্রায় ২০-২৫ হাজার বছর আগেও এই প্রণালীটি বরফে জমে শক্ত ছিল। হেঁটে পার হওয়া যেত।”
নিলু মামা আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “আমরাই সেই মানুষ, যারা টিকে আছি। আমরা মহাবিশ্বের বিলিয়ন বিলিয়ন গ্যালাক্সি, ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন তারা আর নিজেদের এই ছোট্ট পৃথিবী নিয়ে ভাবতে পারি। এটাই আমাদের বড় পরিচয়।”
“এই গল্পের শেষ কোথায়, মামা?”
“মহাবিশ্বের গল্পের কি কোনো শেষ আছে, টিটু? বিজ্ঞানী হাবল যে প্রসারণ দেখেছিলেন, এখন আমরা জানি তা শুধু প্রসারিতই হচ্ছে না, প্রসারণের গতিও বাড়ছে!”
“বাড়ছে? কেন?”
“কেউ জানে না। তবে বিজ্ঞানীরা একটা নাম দিয়েছে এর—ডার্ক এনার্জি। অন্ধকার শক্তি। সেই অন্ধকার শক্তিই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে দ্রুত ঠেলে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।”
“তাহলে ভবিষ্যতে কী হবে?”
“সুদূর ভবিষ্যতে প্রসারণ এতই দ্রুত হয়ে যাবে যে, একটি গ্যালাক্সি থেকে অন্য গ্যালাক্সিকে আর দেখাই যাবে না। সব গ্যালাক্সি একে অপরের থেকে এত দূরে চলে যাবে যে, আকাশ হয়ে যাবে কেবল একটি তারা ভরা অন্ধকার শূন্যতা।”
টিটুর মন খারাপ হলো। “আমরা কি একা হয়ে যাব?”
“হ্যাঁ। কেউ কেউ বলে, ভবিষ্যতের মানুষ তখন ভাববে, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বুঝি কেবল আমরাই আছি। আর কোনো গ্যালাক্সি নেই।”
“কিন্তু এখন তো আমরা জানি!”
“এটাই তো জ্ঞান, টিটু। মানুষের এই সংক্ষিপ্ত জীবনকালে তারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে বড় গোপন কথাটি জানতে পেরেছে।”
নিলু মামা এবার উঠে দাঁড়ালেন। “এখনকার মানুষ আরও বড় ভুল করতে পারে। জিন এডিটিং করে তারা সুপার মানব তৈরি করতে চাইতে পারে।”
“সুপার মানব?”
“হ্যাঁ। নৈতিকতা থাকুক বা না থাকুক, জিনগত ইঞ্জিনিয়ারিং করে একজন সুপার মানব সন্তান জন্ম দেওয়া সম্ভব হতে পারে। তখন এই পৃথিবী কি সাধারণ মানুষ আর সুপার মানবে ভাগ হয়ে যাবে? কে জানে!”
নিলু মামা তার রোগা হাতটা টিটুর মাথায় রাখলেন। “তবে তুমি ভেব না। এখন তুমি কেবল মহাবিশ্বের কথা জানলে। এর চেয়ে বড় কোনো গল্প হতে পারে না।”
টিটু আকাশের দিকে তাকাল। তার চোখ দুটো এখন আর কেবল গোল হয়ে নেই, তার চোখে এখন এক গভীর মায়া।
“মামা, আমরা কি সবাই এক?”
“অবশ্যই এক। তুমি নক্ষত্রের সন্তান। তোমার শরীরে তারার ধূলিকণা। যার শরীরে নক্ষত্রের অংশ রয়েছে, সে কি কখনো ক্ষুদ্রতা, হীনতা বা হিংসা দেখাতে পারে?”
নিলু মামা তার টেলিস্কোপ গোছাতে শুরু করলেন। “এখন যাও, ঘুমিয়ে পড়ো। কাল সকালে তোমার জন্য এক কাপ চা আর আমার হাতের বানানো বিশেষ আলুর চিপস থাকবে।”
টিটু নিচে নেমে এল। কিন্তু তার ঘুম আসছে না। তার মনে হচ্ছে, সে যেন এখনো গ্যালাক্সির এক মাথা থেকে অন্য মাথায় ছুটে বেড়াচ্ছে।
বিগ ব্যাংয়ের সেই বিন্দু। সেই দ্রুত প্রসারিত হওয়া ইনফ্ল্যাশন।
হাজার হাজার বছরের বৃষ্টিতে তৈরি হওয়া প্রথম সমুদ্র। সমুদ্রের গভীরে এক কোষী প্রাণের জন্ম।
ডাইনোসরের রাজত্ব। গ্রহাণুর আঘাতে সব শেষ। আবার নতুন করে শুরু হওয়া জীবন।
নিলু মামা যেন শুধু গল্প শোনাননি। তিনি টিটুকে তার নিজের উৎস দেখিয়েছেন।
টিটু ভাবল, নিলু মামা কি সব জানেন? নাকি সব জানার ভান করেন? তিনি কি হিমুর মতো কোনো অন্য জগৎ থেকে এসেছেন? যার কোনো আসল কাজ নেই, শুধু তারা গুনেন?
নিলু মামার ঘরের দরজা সাধারণত বন্ধ থাকে। টিটু মাঝে মাঝে তার ঘরে চাপা হাসির শব্দ শুনতে পায়। মনে হয় তিনি কোনো অদৃশ্য বন্ধুর সাথে কথা বলছেন।
“নিলু মামার ভেতরের তারার ধূলিকণাগুলো কী বলছে তাকে?” টিটু ভাবে।
পরদিন সকালে টিটু নিলু মামার দরজায় টোকা দিল।
নিলু মামা দরজা খুললেন। তিনি অবাক হলেন না। “এসো, টিটু। জানতাম তুমি আসবে।”
ঘরের ভেতরে কোনো আসবাব নেই। শুধু একটা টেবিল, তাতে কিছু বই আর একটা চায়ের কাপ। নিলু মামা টিটুকে একটা আলুর চিপসের প্যাকেট দিলেন।
“কাল রাতে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলাম, মামা।”
“কী সেটা?”
“ওই যে ডার্ক ম্যাটার। যাকে দেখা যায় না। সে কি আমাদের ভয় পায়, মামা?”
নিলু মামা হাসলেন। এই হাসিটা টিটু ভালোবাসে। রহস্যময়, কিন্তু সরল।
“ডার্ক ম্যাটার আমাদের চেয়ে অনেক পুরোনো, টিটু। সে কেবল মাধ্যাকর্ষণ দিয়ে টানে। সে ভয় পায় না। আমরাই হয়তো তাকে বুঝতে না পেরে ভয় পাই।”
“আচ্ছা, মামা। এই যে জীবন, এত কঠিন পথ পেরিয়ে তৈরি হলো। আমাদের পরে কি আরও কোনো নতুন জীবনের জন্ম হবে?”
“হতে পারে। বিবর্তন তো কখনো থেমে থাকে না, টিটু। যে হোমো স্যাপিয়েনসরা টিকে গেল, তাদের মধ্যেও পরিবর্তন আসবে।”
“কেমন পরিবর্তন?”
“বিজ্ঞানীরা এখন মানুষের গড় আয়ু বাড়াতে শিখেছে। আজ থেকে একশো বছর আগেও মানুষের পক্ষে এত বছর বেঁচে থাকা সম্ভব ছিল না।”
“তাহলে কি আমরা চিরদিন বাঁচব?”
“হয়তো না। তবে আমাদের জীবনকাল আরও দীর্ঘ হবে। হয়তো আরও বুদ্ধিমান হবো। হয়তো নিজেদের শরীরের পরিবর্তন করে পৃথিবীর পরিবেশের সাথে আরও ভালোভাবে খাপ খাইয়ে নেব।”
নিলু মামা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন। “কিন্তু এই পরিবর্তন খুব ধীর গতিতে হবে। হাজার হাজার বছর ধরে।”
টিটু আলুর চিপস খেতে খেতে ভাবল। সেও কি বদলে যাবে? তার চোখের দৃষ্টি কি আরও গভীর হবে? সে কি নিলু মামার মতো আকাশের গোপন চিঠি পড়তে পারবে?
“মামা, আপনি কি মহাকাশে যেতে চান?”
নিলু মামা মাথা নাড়লেন। “না, টিটু। মহাকাশে যাব কেন? আমি তো মহাকাশেরই অংশ। তুমিও তাই। আমরা সবাই নক্ষত্রের সন্তান।”
“তাহলে এত টেলিস্কোপ কেন?”
“ওটা হলো একটা চশমা। দূরের জিনিস কাছে দেখায়। আমি শুধু আমার পুরোনো বাড়িটাকে ভালোভাবে দেখতে চাই। সে কত বড়, কত রহস্যে ভরা।”
“আপনার কাছে কি বিগ ব্যাংয়ের কোনো ছবি আছে, মামা?”
“বিগ ব্যাংয়ের কোনো ছবি নেই। তবে সিএমবি-র ছবিটা হলো তার সবচেয়ে পুরোনো স্মৃতি। তিন লক্ষ আশি হাজার বছর আগের আলোর ছবি।”
নিলু মামা মুচকি হাসলেন। “তোমার চোখের ভেতরেও সেই আলো আছে, টিটু।”
টিটু হাসল। এখন সে বুঝতে পারল, নিলু মামা কেন এত শান্ত। যিনি তেরোশো আশি কোটি বছরের ইতিহাস জানেন, তিনি আর অস্থির হবেন কেন?
“মামা, ডাইনোসররা কি আবার ফিরতে পারে?”
“বিবর্তন এমন এক খেয়ালী জিনিস, টিটু। কে জানে, হয়তো পৃথিবীর পরিবেশ আবার বদলে যাবে। হয়তো এমন কিছু জন্ম নেবে, যা দেখতে ডাইনোসরের মতোই। তবে সে হবে নতুন যুগের ডাইনোসর।”
“মানুষও কি একদিন বিলুপ্ত হবে?”
নিলু মামা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। “সবাইকেই তো একদিন যেতে হয়। হোমো ইরেক্টাস চলে গেছে, নিয়ান্ডারথাল চলে গেছে। আমরাও যাব। কিন্তু আমাদের তৈরি করা জ্ঞান, আমাদের লেখা গল্প, আমাদের গাওয়া গান টিকে থাকবে।”
“যেমন আপনার এই গল্প?”
“আমার গল্প তো কিছুই না, টিটু। এটা হলো মহাবিশ্বের গল্প। আর সেই গল্পই আসল। এটাই সবচেয়ে পুরোনো আর সবচেয়ে সত্যি গল্প।”
“আপনি আর কাকে এই গল্প বলেছেন, মামা?”
“আর কেউ জানতে চায়নি। শহরের লোকেরা এখন আকাশ নয়, মাটির দিকে তাকায়। তাদের সব চিন্তা টাকা, বাড়ি, গাড়ি নিয়ে। আকাশ তাদের কাছে এখন শুধু একটা নীল ছাদ।”
টিটু মনে মনে ঠিক করল, সে আর কোনোদিন মাটির দিকে তাকাবে না। সে শুধু আকাশের দিকে তাকাবে। নিলু মামার মতো সেও হয়ে উঠবে এক নতুন মানুষ, যে মহাজাগতিক রহস্যে ডুবে থাকে।
“মামা, আপনি আমাকে আরও গল্প শোনাবেন?”
“অবশ্যই। আজ তো মাত্র সূচনা। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ভেতর আরও কত গল্প লুকিয়ে আছে! নক্ষত্রের জন্ম, কৃষ্ণগহ্বর, ভিনগ্রহের প্রাণী— কত কী!”
টিটু আলুর চিপসের প্যাকেটটা নিলু মামাকে ফেরত দিল। “মামা, চিপসগুলো খুব মজার।”
“মজারই তো হবে। এগুলোর ভেতরেও তো নক্ষত্রের ধূলিকণা আছে। সবকিছুর ভেতরেই আছে, টিটু। সবকিছুর ভেতরেই।”
টিটু হাসি মুখে নিলু মামার ঘর থেকে বেরিয়ে এল। সে সিড়ি দিয়ে নয়, যেন মহাকাশের শূন্যতা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। তার শরীর হালকা লাগছিল।
মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। “কী রে টিটু, নিলু মামার কাছে কী করছিলি? আজ আবার কী গল্প শোনাল?”
টিটু হাসল। “মা, তুমি কি জানো, আমাদের সবার শরীরে তারার ধূলিকণা আছে? আমরা নক্ষত্রের সন্তান।”
মা হেসে উঠলেন। “নিলু মামার কাছ থেকে এসব শিখেছিস? নক্ষত্রের সন্তান! আচ্ছা বাবা, এখন হাত-মুখ ধো। বেলা হয়ে গেছে।”
টিটু ওয়াশরুমে গেল। সাবান দিয়ে হাত ধুতে ধুতে সে ভাবল, সাবানও কি তারার ধূলিকণা? সাবানের ভেতরেও কি লুকিয়ে আছে বিগ ব্যাংয়ের রহস্য?
আজ থেকে তার কাছে সবকিছুর মানে পাল্টে গেল। ঘর, বাড়ি, মানুষ, প্রকৃতি—সবই এখন তার কাছে এক মহাজাগতিক খেলার অংশ।
স্কুলে টিটু তার বন্ধু রিনাকে গিয়ে বলল, “জানিস রিনা, আমরা সবাই তারার সন্তান।”
রিনা হাসল। “কী বলিস! তোর নিলু মামা তোকে আবার কী সব শিখিয়েছে!”
টিটু হাল ছাড়ল না। “না রে। তুই যখন রাতে আকাশের দিকে তাকাস, তখন কি অবাক হস না?”
“অবশ্যই হই। ভাবি, চাঁদটা এত গোল কেন?”
টিটু হতাশ হলো না। সে ধীরে ধীরে রিনাকে বিগ ব্যাংয়ের গল্প, ইনফ্ল্যাশনের গল্প, আর ডার্ক ম্যাটারের গল্প শোনাল।
রিনা হাঁ করে শুনল। গল্প শেষ হলে রিনা বলল, “তাহলে তো আমাদের পড়াশোনা করা দরকার। সব রহস্য জানার জন্য।”
টিটু খুশি হলো। ঠিক ধরেছে রিনা। জ্ঞানই হলো এই মহাজাগতিক রহস্য জানার একমাত্র পথ। নিলু মামার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।
টিটু আর রিনা দুজনেই তখন স্কুল মাঠের আকাশটার দিকে তাকাল। রিনা আজ আর কেবল নীল ছাদ দেখছে না। সে দেখছে তার নিজের আদি বাড়ি।

মন্তব্য করতে ক্লিক করুন