মহাজাগতিক একাকিত্ব
মহাজাগতিক একাকিত্ব
প্রসূন গোস্বামী

গল্প - মহাজাগতিক একাকিত্ব

প্রসূন গোস্বামী
বৃহস্পতিবার, ০৭ আগস্ট ২০২৫ অন্যান

পর্ব ১: আলোর পথে যাত্রা

সেদিন ছিল পূর্ণিমা। আকাশে চাঁদটা ঝকঝক করছিল, যেন মহাকাশের কোনো এক পুরনো, রহস্যময় ডায়েরির খোলা পাতা। আমি আমার ছোট বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম, এই বিশাল মহাবিশ্বে আমরা কত ছোট। ঠিক এই সময় আমার পাশে এসে বসল রফিক, আমার তরুণ প্রতিবেশী। তার চোখে কৌতূহল, মুখে একটা চিরচেনা হাসি।
“কাকা, আজ আবার কী নিয়ে ভাবছেন?” রফিকের কণ্ঠস্বরে এক ধরনের মায়া আছে, যা আমার ভালো লাগে।
“ভাবছি, আইনস্টাইনের কথা,” আমি বললাম। “কী আশ্চর্য এক মানুষ ছিলেন তিনি। জানিস, আলোর পথে হাঁটা কি কঠিন?”
“সে আবার কেমন কথা?” রফিক অবাক হলো।
আমি বললাম, “যে পথে আলো আছে, সে পথে ছায়া নেই। আর ছায়া না থাকলে তার নিজের অস্তিত্বই তো হারিয়ে যায়। আইনস্টাইন ছোটবেলায় ধর্মকে খুব ভালোবাসতেন। বাইবেলের গল্পগুলো তাকে মন্ত্রমুগ্ধ করত। কিন্তু তারপর তার জীবনে এলো বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের বইগুলো তার সেই বিশ্বাস ভেঙে দিল, যেমন ভেঙে যায় কাচের খেলনা। তিনি দেখলেন, বাইবেলের অনেক কিছুই সত্যি নয়। তার মনে হলো, বড়রা ইচ্ছে করে মিথ্যা বলছে। রাষ্ট্রও মিথ্যা বলছে। এই ভাবনা তার মনে এক গভীর অবিশ্বাস তৈরি করল। সেই অবিশ্বাস তাকে আর ছাড়েনি, যেমন পূর্ণিমার চাঁদকে রাতের আকাশ আর ছাড়ে না।”
রফিকের চোখে বিস্ময়। “তাহলে কি তিনি ধর্ম ত্যাগ করলেন?”
আমি হাসলাম। “না, ঠিক ত্যাগ নয়। তিনি ধর্মকে অন্যভাবে দেখতে শুরু করলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘আমার শৈশবের সেই ধর্মীয় স্বর্গ, যা এভাবে হারিয়ে গেল, তা ছিল কেবল ব্যক্তিগত শৃঙ্খল থেকে নিজেকে মুক্ত করার প্রথম প্রচেষ্টা।’ তিনি আরও বললেন, ‘বাইরে ছিল এই বিশাল জগৎ, যা আমাদের মানবজাতি থেকে স্বাধীনভাবে বিদ্যমান এবং যা আমাদের সামনে এক বিশাল, চিরন্তন ধাঁধার মতো দাঁড়িয়ে আছে।’ এই জগৎ তাকে মুক্তি দিয়েছিল। তিনি সেই পথ বেছে নিয়েছিলেন এবং কখনও আফসোস করেননি। সেই পথের পথিক হওয়া সহজ নয়, রফিক।”
রফিক আকাশের দিকে তাকাল। তার চোখে তখন চাঁদের আলো।

পর্ব ২: ঈশ্বরের ধারণা: এক সরল বিশ্বাস

পরদিন সকালে রফিক আবার এল। তার হাতে একটা কাগজের প্যাকেট, গরম সিঙ্গাড়া। “কাকা, আপনার জন্য। চা আর সিঙ্গাড়া খেতে খেতে বলুন, আইনস্টাইন কেন ঈশ্বরকে সরল ভাবতেন?”
আমি সিঙ্গাড়া খেতে খেতে বললাম, “আইনস্টাইন ব্যক্তিগত ঈশ্বরের ধারণাটিকে ‘সরল’ এবং ‘শিশুসুলভ’ বলেছেন। তিনি ভাবতেন, একজন ঈশ্বর আমাদের কর্মে সরাসরি প্রভাব ফেলবেন, আমাদের বিচার করবেন—এটা মানুষের কল্পনা মাত্র।”
“কিন্তু কেন?”
“১৯৪৫ সালে তিনি গাই র্যানার জুনিয়রকে লেখা এক চিঠিতে বলেছিলেন, ‘ব্যক্তিগত ঈশ্বরের ধারণাটি আমার কাছে একটি নৃতাত্ত্বিক ধারণা, যা আমি গুরুত্ব সহকারে নিতে পারি না।’ তিনি আরও স্পষ্ট করে বলেছিলেন, ‘ঈশ্বর শব্দটি আমার কাছে মানুষের দুর্বলতার প্রকাশ ও ফল ছাড়া আর কিছুই নয়। বাইবেল হলো সম্মানজনক, কিন্তু তবুও আদিম কিংবদন্তির সংগ্রহ, যা বেশ শিশুসুলভ।’ তিনি এমনকি ইহুদি ধর্মকেও ‘সবচেয়ে শিশুসুলভ কুসংস্কারের একটি অবতারণা’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। তার কাছে ঈশ্বর মানে ছিল এক ধরনের ‘মায়া’, যা মানুষের মনকে শান্ত রাখে।”
রফিকের কপালে ভাঁজ পড়ল। “তাহলে তিনি কি ধর্মবিরোধী ছিলেন?”
“না, রফিক,” আমি হাসলাম। “তিনি ধর্মবিরোধী ছিলেন না। তিনি ছিলেন অন্যরকম। তাঁর ধর্মবোধ ছিল অন্যরকম।”

পর্ব ৩: ঈশ্বরের খেলা: পাশা না নিয়ম?

আইনস্টাইনের একটা বিখ্যাত উক্তি আছে। রফিক সেটা জানে। “ঈশ্বর কি পাশা খেলেন?”
আমি বললাম, “আইনস্টাইন বিশ্বাস করতেন, এই মহাবিশ্ব এক সুনির্দিষ্ট নিয়মে চলে। এখানে কোনো দৈব ঘটনা নেই। তিনি কোয়ান্টাম তত্ত্বের অনিশ্চয়তাকে মানতে পারেননি। নিলস বোরকে তিনি বিখ্যাতভাবে বলেছিলেন, ‘ঈশ্বর মহাবিশ্বের সঙ্গে পাশা খেলেন না।’”
“কেন? পাশা খেললে কী সমস্যা?”
“আইনস্টাইন ভাবতেন, সবকিছু কার্যকারণ দ্বারা নির্ধারিত। আজ যা হচ্ছে, তা গতকালের কারণে। আর আগামীকাল যা হবে, তা আজকের কারণে। কোনো ঘটনা হঠাৎ করে ঘটে না। তাই তিনি কোয়ান্টাম তত্ত্বের অনিশ্চয়তাকে মেনে নিতে পারেননি। পাশার দান যেমন অনিশ্চিত, মহাবিশ্বকে তিনি সেভাবে দেখেননি।”
আমি একটু থামলাম। “তার বন্ধু মিশেল বেসোর মৃত্যুর পর তার পরিবারকে তিনি লিখেছিলেন, ‘এখন সে আমার থেকে একটু আগে এই অদ্ভুত জগৎ ছেড়ে চলে গেছে। এর কোনো মানে নেই। আমাদের বিশ্বাসী পদার্থবিদদের কাছে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের পার্থক্য কেবল একটি জেদি স্থায়ী বিভ্রম।’ তার কাছে সব কিছুই কার্যকারণ দ্বারা নির্ধারিত। এই ভাবনা তাকে অদ্ভুত এক সান্ত্বনা দিত।”

পর্ব ৪: ইচ্ছার স্বাধীনতা: এক কঠিন প্রশ্ন

রফিক বলল, “তাহলে কি আমাদের কোনো স্বাধীনতা নেই? আমরা কি পুতুলের মতো?”
আমি বললাম, “আইনস্টাইন স্পিনোজার মতো কঠোর নিয়তিবাদী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের আচরণ কার্যকারণ নিয়ম দ্বারা সম্পূর্ণভাবে নির্ধারিত। তিনি শোপেনহাওয়ারের একটি উক্তিকে খুব ভালোবাসতেন: ‘মানুষ যা চায়, তা করতে পারে, কিন্তু সে যা চায়, তা চাইতে পারে না।’ এই কথাটা তাকে অন্যের কাজ মেনে নিতে সাহায্য করত।”
“কিন্তু তাহলে কি জীবনের কোনো মানে নেই?”
“আইনস্টাইন মনে করতেন, মানুষের জীবন তখনই অর্থপূর্ণ হয়, যখন সে নিজেকে অন্যের সঙ্গে যুক্ত করে। আদিম মানুষ কেবল তার প্রবৃত্তির চাহিদা মেটাতে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু আইনস্টাইন মনে করতেন, মানুষের মনকে এই প্রাথমিক স্বার্থপরতা থেকে মুক্ত করে মহাবিশ্বের সঙ্গে একাত্ম হতে হলে চারটি স্বাধীনতা প্রয়োজন: আত্ম-স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সময় থেকে স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতার স্বাধীনতা।”
“বাহ, কী দারুণ কথা!” রফিক মুগ্ধ হলো।
“হ্যাঁ,” আমি বললাম। “কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, একমাত্র এভাবেই মানুষ সত্যিকারের স্বাধীনতা পেতে পারে। সেই স্বাধীনতার স্বাদটা অন্যরকম।”

পর্ব ৫: ধর্মের প্রয়োজন: নৈতিকতার পথ

“কাকা, ধর্ম কি নৈতিকতার জন্য জরুরি?” রফিক এই প্রশ্নটা করল ঠিক যখন আমি একটা চড়ুই পাখির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। পাখিটা এক মনে একটা শুকনো ডাল ঠোঁটে করে নিয়ে যাচ্ছে।
আমি বললাম, “আইনস্টাইন মনে করতেন, নৈতিক আচরণের জন্য ধর্মের কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি বলেছিলেন, ‘মানুষের নৈতিক আচরণ কার্যকরভাবে সহানুভূতি, শিক্ষা এবং সামাজিক বন্ধন ও প্রয়োজনের উপর ভিত্তি করে হওয়া উচিত; কোনো ধর্মীয় ভিত্তির প্রয়োজন নেই।’ তার মতে, মানুষ যদি কেবল ভয় বা পুরস্কারের আশায় ভালো কাজ করে, তাহলে তা খুবই দুঃখজনক।”
“আমারও তা-ই মনে হয়,” রফিক বলল।
“তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমার পক্ষে এমন একজন ব্যক্তিগত ঈশ্বরের কল্পনা করা অসম্ভব, যিনি ব্যক্তিদের কর্মে সরাসরি প্রভাব ফেলেন, বা নিজের সৃষ্টির প্রাণীদের বিচার করেন।’ তার কাছে নৈতিকতা মানুষের জন্য, ঈশ্বরের জন্য নয়। কারণ মানুষ নিজেই পারে নিজের নৈতিকতা তৈরি করতে।”
চড়ুই পাখিটা উড়ে গেল। তার শূন্য স্থানটা কেমন ফাঁকা লাগছিল।

পর্ব ৬: মহাজাগতিক ধর্ম: বিজ্ঞান ও ভক্তি

আইনস্টাইনের একটা বিশেষ ধরনের ধর্মীয় অনুভূতি ছিল, যাকে তিনি ‘মহাজাগতিক ধর্ম’ বলতেন। আমি রফিককে এই গল্পটা বললাম।
“তিনি বিশ্বাস করতেন, বিজ্ঞান ও ধর্ম একে অপরের পরিপূরক। তিনি বলেছিলেন, ‘বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম পঙ্গু, ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান অন্ধ।’ তার কাছে এই মহাবিশ্বের সুশৃঙ্খলতা এবং সৌন্দর্যই ছিল সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।”
রফিক বলল, “এটা কী রকম ধর্ম?”
আমি বললাম, “এখানে কোনো ব্যক্তিগত ঈশ্বর নেই, কোনো প্রার্থনা নেই। শুধু আছে প্রকৃতির নিয়মের প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধা। তিনি বলেছিলেন, ‘সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি যা আমরা অনুভব করতে পারি তা হলো রহস্যময়তা। এটিই সমস্ত প্রকৃত শিল্প ও বিজ্ঞানের শক্তি।’”
আমি একটু থামলাম। “এই অনুভূতি যার নেই, সে যেন মৃত। এই মহাজাগতিক ধর্ম কোনো ব্যক্তিগত ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল ছিল না, বরং প্রকৃতির নিয়মের প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধা ছিল। এই অনুভূতি থাকলে তোর মনে হবে, এই পুরো মহাবিশ্বের সাথে তোর একটা অদৃশ্য সম্পর্ক আছে। তুই একা হয়েও একা নোস।”
রফিক চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইল। মনে হলো, সেও যেন সেই অনুভূতিটা অনুভব করার চেষ্টা করছে।

পর্ব ৭: ইহুদি পরিচয়: এক কঠিন সত্য

“কাকা, আইনস্টাইন তো ইহুদি ছিলেন, তাই না?”
“হ্যাঁ, কিন্তু তার ধর্মীয় বিশ্বাস প্রচলিত ইহুদি ধর্মের মতো ছিল না। তিনি ইহুদি ধর্মকেও ‘সবচেয়ে শিশুসুলভ কুসংস্কারের একটি অবতারণা’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ইহুদি জনগণ, যাদের আমি সানন্দে অন্তর্ভুক্ত, এবং যাদের মানসিকতার সাথে আমার গভীর সম্পর্ক রয়েছে, তাদের আমার কাছে অন্য সব মানুষের চেয়ে আলাদা কোনো গুণ নেই।’”
“তাহলে তিনি কেন নিজেকে ইহুদি ভাবতেন?”
“তিনি ইহুদিদের প্রতি নাৎসিদের ঘৃণার তীব্র নিন্দা করেছিলেন। তিনি মনে করতেন, ইহুদিরা স্বাধীন চিন্তার মানুষ, তাই তাদের উপর দমন-পীড়ন চালানো হয়েছিল। তিনি মনে করতেন, তাঁর ইহুদি পরিচয় তাঁর সংস্কৃতির অংশ, ধর্মের নয়। এই পার্থক্যটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।”
আমি দেখলাম, রফিক বুঝতে চেষ্টা করছে। মানুষের পরিচয় যে ধর্ম বা জাতির চেয়ে অনেক বড় কিছু, এটা তাকে বোঝানো কঠিন নয়।

পর্ব ৮: যিশুর প্রতি শ্রদ্ধা: এক ভিন্ন দৃষ্টি

আমি বললাম, “আইনস্টাইন যিশুর প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করতেন। তিনি বলেছিলেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই! গসপেল পড়লে কেউ যিশুর প্রকৃত উপস্থিতি অনুভব না করে পারে না। তার ব্যক্তিত্ব প্রতিটি শব্দে স্পন্দিত হয়। এমন জীবন দিয়ে কোনো পৌরাণিক কাহিনী ভরা নেই।’”
“তাহলে কি তিনি যিশুকে বিশ্বাস করতেন?”
“না। তিনি যিশুকে ঈশ্বর মানতেন না। তিনি মনে করতেন, যিশু নিজেই নিজেকে ঈশ্বর বলেননি, কারণ তিনি ইহুদি ছিলেন এবং ‘শোনো হে ইসরায়েল, আমাদের ঈশ্বর এক!’ এই মহান আদেশ তিনি ভাঙতে পারতেন না। তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘কখনও কখনও আমি মনে করি, যিশু যদি কখনও জন্ম না নিতেন, তাহলে ভালো হতো। ক্ষমতার জন্য কোনো নাম এত অপব্যবহার হয়নি!’”
রফিক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “এই কথাটা অনেক সত্যি, কাকা।”
“হ্যাঁ, রফিক। কারণ ক্ষমতার লোভ মানুষকে অন্ধ করে দেয়। আর ধর্মের নামে সেই অন্ধত্বকে আরও বাড়িয়ে তোলা হয়।”

পর্ব ৯: ক্যাথলিক চার্চ: এক বিতর্কিত ভূমিকা

“আইনস্টাইন ক্যাথলিক চার্চের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন,” আমি বললাম। “তিনি মনে করতেন, চার্চ অতীতে অনেক অমানবিক কাজ করেছে।”
“কী রকম কাজ?”
“তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যুবকদের মধ্যে চার্চের ব্যক্তিগত ঈশ্বরের মতবাদ ঢুকিয়ে দিতে চাই না, কারণ সেই চার্চ গত ২০০০ বছরে এত অমানবিক আচরণ করেছে।’ তিনি ক্রুসেড, ইনকুইজিশনের অগ্নিকাণ্ড এবং হিটলারের কর্মকাণ্ডের প্রতি চার্চের নীরবতার নিন্দা করেছিলেন।”
“তাহলে কি তিনি চার্চকে পুরোপুরি বাতিল করে দিয়েছিলেন?”
“তিনি বলেছিলেন, ‘গির্জা সবসময় ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের কাছে নিজেকে বিক্রি করেছে এবং অনাক্রম্যতার বিনিময়ে যেকোনো চুক্তিতে সম্মত হয়েছে।’ তাঁর কাছে চার্চ ছিল ক্ষমতার একটি প্রতিষ্ঠান, ধর্মের নয়। তাঁর ধর্ম ছিল মহাজাগতিক, যা কোনো প্রতিষ্ঠানকে মানত না।”
রফিক চুপ করে শুনছিল। মানুষের ভেতরের ভালো-মন্দ নিয়ে অনেক কথা তার মাথার ভেতর ঘুরছিল।

পর্ব ১০: দর্শনের টান: এক গভীর অন্বেষণ

আমি বললাম, “জানিস, আইনস্টাইন ছোটবেলা থেকেই দর্শনের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তিনি শোপেনহাওয়ার, ডেভিড হিউম, মাখ এবং কান্টের মতো দার্শনিকদের বই পড়তেন। তিনি মনে করতেন, প্রকৃতিকে বুঝতে হলে দর্শন এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞান উভয়ই প্রয়োজন।”
“কিন্তু দর্শন তো বিজ্ঞান নয়।”
“ঠিক। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, ‘জ্ঞানতত্ত্ব বিজ্ঞানের সাথে যোগাযোগ ছাড়া একটি শূন্য পরিকল্পনা হয়ে যায়। জ্ঞানতত্ত্ব ছাড়া বিজ্ঞান—যদি এটি আদৌ চিন্তা করা যায়—আদিম এবং গোলমেলে।’ তার কাছে দর্শন ছিল বিজ্ঞানের ভেতরের কাঠামো, যা না থাকলে বিজ্ঞান শুধু তথ্যের স্তূপ হয়ে যেত।”
রফিকের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো, তাকে আমি অনেক বড় বড় কথা বলে ফেলছি। কিন্তু সে মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। তার আগ্রহ ছিল দেখার মতো।

পর্ব ১১: হিউম ও কান্ট: দুই ভিন্ন পথ

“আইনস্টাইন ডেভিড হিউমের দর্শনের ভক্ত ছিলেন,” আমি বললাম। “তিনি বলেছিলেন, ‘যদি কেউ হিউমের বই পড়ে, তাহলে অবাক হতে হয় যে তারপরে অনেক এবং কখনও কখনও অত্যন্ত সম্মানিত দার্শনিকরা এত অস্পষ্ট জিনিস লিখতে পেরেছেন এবং এর জন্য কৃতজ্ঞ পাঠকও খুঁজে পেয়েছেন।’”
“হিউম কী বলেছিলেন?”
“হিউম তাকে আপেক্ষিকতার তত্ত্ব আবিষ্কারে সাহায্য করেছিলেন। হিউম বলেছিলেন, আমাদের সব জ্ঞান অভিজ্ঞতা থেকে আসে। স্থান-কাল বা কার্যকারণ কোনো মৌলিক ধারণা নয়। আইনস্টাইন হিউমের এই কথা থেকেই আপেক্ষিকতার তত্ত্বের ধারণা পেয়েছিলেন।”
“আর কান্ট?”
“কান্ট সম্পর্কে আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘যদি কান্ট আজ আমাদের কাছে যা জানা আছে তা জানতেন, তাহলে আমি নিশ্চিত যে তিনি তার দার্শনিক সিদ্ধান্তে মৌলিকভাবে পরিবর্তন আনতেন।’ কান্ট নিউটনের বিশ্বদৃষ্টির উপর ভিত্তি করে তার কাঠামো তৈরি করেছিলেন, যা এখন দুর্বল হয়ে গেছে। তিনি কান্টকে সম্মান করলেও, তার দর্শনকে সেকেলে মনে করতেন।”

পর্ব ১২: শোপেনহাওয়ারের প্রভাব: এক সান্ত্বনা

আইনস্টাইনের বার্লিনের স্টাডিতে ফ্যারাডে, ম্যাক্সওয়েল এবং শোপেনহাওয়ারের ছবি ঝুলত। শোপেনহাওয়ারের ছবি দেখে আমি রফিককে এই গল্পটা বললাম।
“শোপেনহাওয়ারের দর্শন আইনস্টাইনকে প্রভাবিত করেছিল। আইনস্টাইন শোপেনহাওয়ারের কথাগুলোকে ‘জীবনের কষ্ট, আমার নিজের এবং অন্যের, এবং সহনশীলতার এক অফুরন্ত উৎস’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। শোপেনহাওয়ারের কাজগুলো হতাশাবাদী হিসেবে পরিচিত হলেও, আইনস্টাইন তাকে ‘প্রতিভাবান’ বলতেন এবং তার বই পড়ে আনন্দ পেতেন।”
“কেন? হতাশাবাদী বই পড়ে আনন্দ কেন?”
“কারণ, শোপেনহাওয়ারের দর্শনে একটা অদ্ভুত সান্ত্বনা ছিল। তিনি মানুষের দুঃখকে মহাবিশ্বের অংশ হিসেবে দেখেছিলেন। যখন আমরা বুঝি আমাদের দুঃখটা শুধু আমাদের একার নয়, তখন তা সহ্য করা সহজ হয়ে যায়। আইনস্টাইনেরও এমনটাই মনে হতো।”

পর্ব ১৩: শেষ কথা: এক অন্তহীন রহস্য

আমি রফিকের দিকে তাকালাম। আজ রাতের আকাশটা অন্যরকম—চাঁদ নেই, শুধু তারাদের ছায়া ছড়িয়ে আছে নিঃশব্দে।
“আইনস্টাইন বিশ্বাস করতেন, এই মহাবিশ্ব এক অন্তহীন রহস্য। আমরা আমাদের সীমিত জ্ঞান দিয়ে তার সামান্য অংশই বুঝতে পারি। তার কাছে ধর্মীয় অনুভূতি ছিল এই রহস্যের প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধা। তিনি কোনো ব্যক্তিগত ঈশ্বরকে বিশ্বাস করতেন না, কিন্তু মহাবিশ্বের সুশৃঙ্খলতা তাকে মুগ্ধ করত।”
আমি একটু থামলাম। “তাঁর জীবন ছিল বিজ্ঞান, দর্শন এবং মানবতাবাদের এক অসাধারণ সমন্বয়। তিনি প্রমাণ করেছেন, ঈশ্বরকে বিশ্বাস না করেও একজন মানুষ মহাবিশ্বের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং নৈতিক জীবনযাপন করতে পারে। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি অনেকের কাছে হতাশাজনক মনে হতে পারে, কিন্তু এটি এক নতুন পথের দিশা দেখায়, যেখানে জ্ঞান এবং যুক্তিই প্রধান। এই পথটা একা, রফিক। কিন্তু একা হয়েও এখানে এক অদ্ভুত শান্তি আছে। এই মহাজাগতিক একাকিত্বটা খুব সুন্দর।”
রফিক কিছু বলল না। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল, যেখানে তারাগুলো যেন একটু একটু করে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে—যেন মহাবিশ্ব নিজেই তার নিঃশব্দ উত্তর দিচ্ছে।

পরে পড়বো
১০৩
মন্তব্য করতে ক্লিক করুন